তৃতীয় অশ্বারোহী রাসেল রায়হানের প্রেমের কবিতার বই। এটি আলাদা আলাদা শিরোনামে একটি দীর্ঘ কবিতা। উপন্যাসে যেমন দেখা যায়, আলাদা আলাদা শিরোনামে অনেকগুলো গল্প বলেন লেখক, আসলে পুরোটা মিলে একটিই গল্প, তৃতীয় অশ্বারোহীও তেমনই।
লেখকের অন্যান্য প্রকাশনা—সুখী ধনুর্বিদ; প্রকাশক : প্লাটফর্ম প্রকাশনী; জুলাই ২০১৬। বিব্রত ময়ূর; প্রকাশক : প্রথমা প্রকাশনী; অক্টোবর ২০১৬।
রাসেল রায়হানের জন্ম ৬ ডিসেম্বর, ১৯৮৮, বাগেরহাটে। মা মাসুমা আক্তার, বাবা আলী আকবর। ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। ‘বিব্রত ময়ূর’ কাব্যগ্রন্থের জন্য মার্কিন গবেষক অধ্যাপক ক্লিন্টন বি সিলি ও প্রথমা প্রকাশনের যৌথ উদ্যোগে প্রবর্তিত ‘জীবনানন্দ দাশ পাণ্ডুলিপি পুরস্কার ১৪২২’ পেয়েছেন।
কখনো শিরিন আক্তার
আমি সেতারও বাজাতে পারি। আগে শুধু একটিবার নত হয়ে দেখো
হারুত মারুত নামের দুই ফেরেশতাকে স্মরণ করি, যারা মানুষের রূপ পেয়েছিল একবার। জোহরা বিবি নামের এক রমণীর প্ররোচনায় তারা হত্যা করেছিল তার ঘুমন্ত মদ্যপ স্বামীকে। স্বাভাবিকভাবেই তারা ভুলে গিয়েছিল স্তোত্র, আর তাদের শেখানো স্তোত্র পাঠ করে জোহরা বিবি এখন ঝুলে আছে আকাশে, পরিত্যক্ত শার্টের মতন—নক্ষত্র হয়ে।
আর অনন্ত কৌতূহলে মর্ত্যে আসা হারুত মারুত ঝুলে থাকবে উলটো হয়ে, উষ্ট্রের কুঁজের মতন গোপন এক পাহাড়ের অভ্যন্তরে—অন্ধকারে—অন্তিমকাল পর্যন্ত। তারা চিৎকার করে বলতেই থাকবে, ‘মানুষকে নক্ষত্র বানায় অন্য একজন মানুষ...’ তাদের চিরপ্রতিধ্বনিত চিৎকার অপার্থিব এক সুর হয়ে প্রবেশ করতে থাকবে তাদের কর্ণকুহরে।
...আর শিরিন, হঠাৎ তুমি বুঝতে পারবে,
আমার সেতারে
কোন সুর
বেজেছিল
পাঁজর
...আর সেতার বেজে ওঠে।
বিস্মিত হই, কতটা ভঙ্গুর এ পাঁজর। একেকবার হাসো আর ভেঙে ভেঙে যায়। অথচ তোমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে আমার বাম পাঁজরের হাড় থেকে।
—এটা জেনেও কিভাবে গ্রীবা বাঁকিয়ে নাসারন্ধ্র ফুলিয়ে ওভাবে তাকাতে পারো
শুনেছি সবুজ কবুতরের পাঁজর খুব সুস্বাদু। আজ পর্যন্ত আর কোনো সবুজ কবুতর দেখিনি আমি, শিরিন। মনে পড়ে যায়, সাত বছর আগে স্কুল ছেড়েছ তুমি। তখন সবুজ রঙের ইউনিফর্ম পরতে;—এক কোনায় এখনো আইসক্রিমের চকলেটরঙা দাগ লেগে আছে।
তোমাদের কলেজে নতুন ইউনিফর্ম ছিল পীত রঙের।
আর কোনো পীতরঙা কবুতরও এই জীবনে দেখেছি বলে মনে পড়ে না
ছাদে এক যুবক কবুতর ওড়াত। আমি তাকে ঈর্ষা করতাম। মনে আছে, এক চৈত্রের দুপুরে তার ঘরে আগুন লেগেছিল?
...মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, সে আগুন কি আমিই লাগিয়েছিলাম
সাইরেন
একটি ফায়ার ব্রিগেডের লাল গাড়ি ছুটে যাচ্ছে, দিগ্বিদিক হারিয়ে—পরিচিত সাইরেনসমেত। সম্ভবত সে সাইরেন পীতবর্ণা। সবাই দ্রুত সরে যাচ্ছে—কাছেই কোনো শপিঙমল পুড়ে যাচ্ছে ভেবে।
...যেকোনো ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি দেখলেই এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়, আবার তুমি কারও দিকে তাকিয়েছ।
আর
ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছে তার
আয়াতুল কুরসি পাঠ করে বুকে ফুঁ দিয়ে ‘সাবধানে এসো’—যাত্রা শুরুর আগে একবার এই ভালোবাসাটুকুর জন্য ঔৎসুক্য ছিল।
...অথচ তুমি বার বার এভাবে বলো, পরে এসো, পরে এসো—
কত পরে?
দেখছই তো, মানুষ কত দ্রুত মরে যায়
পুনরায় মনোপলি
মধ্যরাতের শপিঙমলগুলোর চেয়ে বেশি নিঃসঙ্গ আর কেউ নেই।
অথচ এই নিঃসঙ্গ শপিঙমলগুলোর সামনেও ভিখিরি দেখা যায়
যে বৃদ্ধা ভিখিরি দাঁড়িয়ে আছে এই রাজকীয় শপিঙমলের সামনে, একদা কি তারই দুধ পান করেছিলাম আমি? তাকেই কবরে শোয়াতে গিয়ে টের পেয়েছিলাম, প্রিয় কারো মৃত্যুও একটি পিঁপড়ের কামড়কে অগ্রাহ্য করার মতো শক্তি দেয় না?
তবে আজমির শরিফে হিজাব পরিহিত অবস্থায় দেখা সেই নারী কে ছিলেন, যার মুখের ভাঁজে আদি সমতল পৃথিবীর মানচিত্র আঁকা ছিল—যে পৃথিবী দাঁড়িয়ে থাকে জোড়াকচ্ছপের পিঠে
আর তুরস্কের গির্জা ধুয়ে দিত যে মহিলা রোজ, তার মুখের সাথেও এই নারীর এত মিল কেন? কেন এই নারী হুবহু চব্বিশ বছর বয়সে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো সোফিয়া লোরেনের মতন দৃঢ়? আটত্রিশ বছরের হুমা কোরেশি, সতেরো বছরের শিরিন, আর সাতান্ন বছরের কাজলরেখার মুখই বা কীভাবে ধারণ করেন তিনি
... প্রসূতিসদনে আজ আমার স্ত্রী বুঝি পুনর্বার তাকে জন্ম দিলো
আয়না
আর এসব জন্মের ঘটনায় সবসময় আমি তোমায় দেখি। যেমন সমস্ত মৃত্যুর ঘটনায় আমার সামনে একটি আয়না রেখে দেয় কেউ। সে আয়নায় বিভ্রান্ত আকাশমণ্ডলীর তীরন্দাজ কালপুরুষের স্থলে আমার মুখ দেখি আমি। যেহেতু মা বলতেন, মানুষ মরে গেলে আকাশের তারা হয়ে যায়, তাই আয়নায় কিংবা আকাশে নিজের মুখ দেখে মনে পড়ে যায়, আমি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম কৈশোরকালীন শেষ দিনটিতে।
মসজিদের এক খতিব বলেছিলেন, আত্মহত্যা মহাপাপ। তাই আত্মহত্যা করা হয়নি আর