X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১
উড়িষ্যার লোককথা : পর্ব- ২

বনকন্যা

দিদার মুহাম্মদ
২০ জুলাই ২০১৭, ১০:১০আপডেট : ২০ জুলাই ২০১৭, ১০:১০

 

বনকন্যা

এক গ্রামে বাস করতেন আদিবাসী ভুঞ্জিয়া গোত্রের এক বৃদ্ধ। তিনিই ছিলেন গ্রামের সরদার। গ্রামের ভালো-মন্দ দেখাই ছিল তার আসল কাজ। সংসারে থাকার মধ্যে তার ছিল এক স্ত্রী আর তার ছেলে-ছেলের বৌ। সে বছর গ্রামে দেখা দিল তীব্র পানি সংকট। গ্রামের লোকজন এলো বৃদ্ধ সরদারের কাছে পুকুর কাটার আরজি নিয়ে। গ্রামের লোকজন যে খুব বিপদে পড়েছে পানির সংকটে তা বৃদ্ধ সরদারের বুঝতে কষ্ট হয় না। তাই আর কী করেন। তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এক মাস দিনরাত পরিশ্রম করে পুকুর কাটা শেষ হলো। কিন্তু কী হলো পুকুরে, কোন পানি উঠলো না। বৃদ্ধ সরদার কিছুই ভেবে উঠতে পারলেন না। এতদিনে পুকুর কাটতে খরচা গেছে অনেক। তিনি দারুণ দুঃচিন্তায় পড়লেন। কী হবে গ্রামবাসীর!

বৃদ্ধ সরদার গেলেন তাদের গ্রাম দেবতার কাছে। পানির জন্য আরজি করলেন। দেবতা বললো, যতক্ষণ বৃদ্ধের সন্তান বেঁচে আছে ততক্ষণ পুকুরে কোন পানি উঠবে না। বৃদ্ধ বয়সে কী নিদারুণ পরীক্ষায় পড়লেন তিনি! কেবল সন্তান বলি দিলেই পুকুরে পানিতে টলটল করবে। হায় ভগবান! বিষণ্ন মনে তিনি বাড়ি ফিরলেন। স্ত্রীকে সব খুলে বললেন। বৃদ্ধা স্ত্রী ভাবলেন গ্রামের সমস্ত মানুষ পানির অভাবে মারা পরবে তার এক সন্তানের জন্য! আবার সন্তানের জন্য তার চোখ জলে ভরে উঠলো। কিন্তু মন শক্ত করে তিনি সাই দিলেন গ্রামবাসীর পক্ষে। বলেন, পুকুরের পাশেই তার সন্তানকে যেন বলি দেওয়া হয়। আর এসব কথা বেড়ার ওপাশ থেকে কান পেতে শুনছিলো ছেলের বৌ।

সন্ধ্যায় ছেলে বাড়ি ফিরলো। ছেলের বৌ সোনার থালায় ভাত আর রুপোর বাটিতে তরকারি এনে ধরলো স্বামীর সামনে। সে অবাক হয়ে স্ত্রীকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলো। স্ত্রী বললো, ‘তোমার বাবা কাল তোমাকে পুকুরের ধারে বলি দিবে। আর তাই জীবনের মতো স্বাদ মিটিয়ে খাও।’

রাতে ভাবতে ভাবতে এক সময় ছেলে আর ছেলের বৌ বাড়ি ছেড়ে বনে পালিয়ে গেলো। কোন মতো একটা ঘর বানালো। বাড়ি ছাড়ার সময় তারা যে খাবার সাথে এনেছিল তাই দিয়ে তো চললো কিছুদিন, এখন! ছেলে তার স্ত্রীকে বললো, ‘আগুনের ব্যবস্থা করে কিছু জল গরম করো। আমি যাই, দেখি কোন শিকার ধরে আনি। তারপর রান্না করে এক সাথে খাব।’ ছেলের বৌ লম্বা একটা গাছ বেয়ে উপরে উঠে গেলো, কোন আগুনের নিশানা পাওয়া যায় কিনা! সে দেখল কাছেই কোথাও ধোঁয়া উঠাছে। সে আগুনের খোঁজে সে দিকে গেলো।

খুঁজতে খুঁজতে সে দেখলো যেখানে ধোঁয়া উঠছিল সেখানে এক সুদর্শন-সুপুরুষ বসে আছে। লোকটি ‍কিছু খড়ে আগুন ধরিয়ে কুণ্ডলি তৈরি করেছে আর সেখান থেকেই ধোঁয়া উঠছে। বৌটি তার কাছ থেকে আগুন চেয়ে নিয়ে আসলো। আর ছেলেটি যে শিকার ধরে আনলো তা রান্না করে আয়েশ করে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। পরদিন সকালে আবার ছেলেটি শিকারে গেল আর বৌটি আগুন আনতে একই জায়গায় গেলো। এভাবেই চলছিল দিনগুলো। কিন্তু কী হলো, ছেলের বৌ যে দৈনিক যায় আগুন আনতে, ঐ সুদর্শন পুরুষের সাথে প্রেম হয়ে গেলো। লোকটি তাকে একদিন বললো, তার স্বামীকে খুন করতে যাতে তারা একসাথে থাকতে পারে। এই শুনে ছেলের বৌটি ভাবল কিছুক্ষণ।

এক সন্ধ্যায় ছেলেটি ফিরলো শিকার নিয়ে। বৌটি ঘরের এক কোণায় বসে ছিল। যখনই তার স্বামীকে দেখলো, সে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। কী হয়েছে জিজ্ঞাস করলে সে বললো, ‘আমি কানের ব্যথায় মরছি। একমাত্র গোখরা সাপের দুধ কানে দিলেই এই ব্যথা সারবে। অন্যথা আমি মরেই যাব।’ ছেলেটি বৌকে যার পর নাই ভালোবাসতো। গোখরার দুধ আনতে গেলে যে সে মারা যাবে তা তার মাথায়ই এলো না। সে তখনি তীর-ধনুক নিয়ে বেরিয়ে পড়লো গোখরা সাপের দুধ আনতে।

ছেলেটি এক জায়গায় দেখলো এক বাচ্চা গোখরা। তারই পাশে একটি পাত্রে রয়েছে গোখরার দুধ। আশেপাশে মা গোখরাকে দেখা গেলো না। সে বাচ্চা গোখরাকে মেরে দুধ নিয়ে ঘরে ফিরলো। বৌ স্বামী গোখরা দুধ নিয়ে হাজির দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। সে ভেবেছিল গোখরার দুধ নয়, গোখরার কামড়ে তার স্বামী নিশ্চিত মারা যাবে আর নতুন প্রেমিকের সাথে তার বিয়ে হবে। ছেলেটি দুধের বাটি দিয়ে আর নজর দিল না যে সে কি আসলেই দুধ কানে দিলো কিনা। আসলে সে তো দাঁত কটমট করে অগোচরে দুধের বাটি ধরে ফেলে দিয়েছে।

কয়েকদিন বৌটা চুপচাপ থাকলো। একদিন সে তার প্রেমিকের কাছে গিয়ে সব বলে। লোকটি বলে, ‘তাকে বাঘের দুধ আনতে বলো। এত সে না মরে যাবে কোথায়!’

একদিন ছেলেটি শিকার থেকে ফিরে এসে দেখলো বৌটি আবার চিৎকার করে কাঁদছে। সে তার কান ব্যথার কথা আবার বলে। তার থেকে বাঁচার উপায়ও যথারীতি বলে; কেবল বাঘের দুধই তার এই অসহ্য ব্যথার নিবারক। নই সে কান ব্যথায় মরলো বলে। আর ওমনি ছেলেটি ছুটলো কোথায় আছে বাঘিনী। এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড় করে এক জায়গায় সে দেখলো ছয়টি বাঘের বাচ্চা মল-মূত্রের নালার মধ্যে পড়ে গেছে। বাচ্চাগুলোর প্রতি তার দয়া হলো। সে তাদের উপরে তুলে তাদের ও তার আশেপাশের সমস্ত মল-মূত্র আর আগাছা পরিস্কার করলো। লম্বা এক গাছে উঠে দেখলো বাঘিনীকে দেখা যায় কিনা। কিন্তু দেখা গেলো না। তাই সে বাঘিনীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো।

বাঘিনী গিয়েছিল কোথাও খাবারের সন্ধানে। সে ফিরে এসে দেখলো তার বাচ্চারা আর তার আশেপাশের স্থান ঝকঝকে তকতকে। বাঘিনী বাচ্চাগুলোকে জিজ্ঞেস করলো কে করেছে এই কাজ! বাচ্চাগুলো দেখালো গাছের উপরের ঐ লোকটা। এবার বাঘিনী জিজ্ঞাস করলো সে কেন এখানে এসেছে, কী কারণে এই উপকারটা সে করলো? ছেলেটি সব খুলে বললো। বাঘিনী খুব কৃতজ্ঞাতা প্রকাশ করে তার দুধ তো দিলোই, সাথে তার এক শাবককে দিলো বাঘিনীর দুধের প্রমাণ স্বরূপ। ছেলেটা ফিরে আসলো বাঘিনীর দুধ আর শাবক নিয়ে। বৌকে বাঘিনীর দুধ দিয়ে সে বাড়িতেই বাঘের বাচ্চাটা পালন করতে থাকলো।

দু-এক মাস পার হয়েছে কি হয়নি। বৌটা আবার দেখা করলো তার প্রেমিকের সাথে। তাকে আদ্যোপান্ত খুলে বলে সে থামলো। এবার প্রেমিক লোকটা একটু চিন্তায় পড়ে গেলো। সে ভেবে এবার আরও একটা উপায় বললো। সে বললো, ‘পাহাড়ের অন্যপাশে রয়েছে এক গভীর গর্ত। ঐ গর্তে একবার নামলে কেউ তাকে তুলতে পারবে না। সেখানেই সে মরে পঁচে থাকবে, তাকে সেই গভীর গর্ত থেকে পানি আনতে বলেবে।’ যেই কথা সেই কাজ। বৌটি আবার একই কিত্ত করতে থাকলো আর তার স্বামী এমনই গর্ধব যে, সে তাকে বিশ্বাসই করতে থাকলো। আসলেই সে তার বৌকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসতো। সে গেলো পাহাড়ের ঐ পাড়ে আর দেখলো পুকুরটা খুব গভীর আর পানির স্তরও অনেক নিচে। এও বুঝলো একবার নিচে নামনে তার আর ‍উঠে আসা সম্ভব না, মরা ছাড়া গতিই থাকবে না। সে সেখানেই বসে পড়লো আর কাঁদতে থাকলো।

কাঁদতে কাঁদতে দুইদিন চলে গেলো। তার বৌ ভাবলো তার স্বামী নিশ্চিত মরে গেছে। একবার ঐ পুকুরে নেমে সে তো কোনমতেই আর উঠতেই পারবে না। মরেও না, বেঁচেও না। দুইদিন দুইরাত একটানা কেঁদে পার করার পর তার কান্না শুনে বনের কন্যা তার সামনে হাজির হয়ে কান্নার কারণ জানতে চাইলো। বনকন্যা তার সব কথা শুনে বললো, ‘এক শর্তে সে তাকে পানি তুলে দিতে রাজি।’ বৌকে বাঁচানোর জন্য সে সকল শর্তই মানতে রাজি। কিন্তু বনকন্যা এ কী বলে, তাকে বিয়ে করতে হবে! অন্তত বৌ এর জীবন তো বাঁচুক। বনকন্যা তাকে পানি এনে দিলো। সে পানি নিয়ে বাড়িতে এলো। সে এতটা ক্লান্তিকর নির্ঘুম রাতজাগা কান্নার পর, এতটা কঠিন পাহাড়ী পথ পার হয়ে যখন বাড়িতে এসে বৌ এর হতে পানি তুলে দিলো সে আর চেতন থাকতে পারলো না। সে বেঘোরে ঘুমিয়ে পড়লো।

এবার বৌ বুঝতে পারলো এভাবে আর তার স্বামীর হাত থেকে বাঁচা যাবে না। সে তার ষড়যন্ত্রের শেষ চালটিই চালতে চায়। সে একটা কুড়াল নিলো। আর এক কোপে স্বামীর গর্দান নামিয়ে দিলো।

এদিকে গ্রামের পুকুরের কলকল করে পানি উঠে টলটল করছে। নিশ্চিত সরদারের একমাত্র পুত্র মারা গেছে। নইলে কে বা পুকুর পানিতে ভরে উঠবে! সরদার কেবল সন্তানের শেষকৃত্য সম্পাদন করতে চান। তিনি মৃত সন্তানের লাশ আনতে বেরিয়ে পড়লেন। আর ছেলের বৌটি তো প্রেমিকের সাথে চলে গেছে।

কিন্তু কী হয়! বাঘের যে বাচ্চাটি ছেলেটির বাড়িতে পালিত হচ্ছিল, সে দেখলো তার প্রভূর ছিন্নমস্তক পড়ে আছে। সে প্রভূর শরীর আর ছিন্নমস্তক নিয়ে ফিরলো বনদেবীর কাছে। সাতরাত সাতদিন সে কান্নাকাটি করে প্রভুর প্রাণ ভিক্ষা চাইলো। বনদেবী সন্তুষ্ট হয়ে তার প্রভুর প্রাণ ফিরিয়ে দিলো। শাবক আর বনকন্যা ছেলেটিকে সব খুলে বললো। সব শুনে ছেলেটি বনকন্যার কাছে একটি হাতি চাইলো। আর বনদেবীর কাছে চাইলো একটি তলোয়ার। এরপর সে, বনকন্যা আর শাবকটি হাতির পিঠে চড়ে তার স্ত্রীর কাছে গেলো। ষড়যন্ত্রকারী হন্তারক স্ত্রী ও তার প্রেমিককে হত্যা করে সবাই মিলে তার ঘরের দিকে আসতে লাগলো।

বৃদ্ধ সরদারও এই পথে আসছিলেন মৃত সন্তানের খোঁজে। তিনি জীবিত সন্তানকে ফিরে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। সন্তান বনকন্যা আর বাঘ শাবককে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। ধমধাম করে বনকন্যার সাথে বিবাহের কাজটি সম্পন্ন হলো। পূজার মধ্য দিয়ে জলপূর্ণ পুকুরটি উদ্বোধন করা হলো। সবাই সুখে শান্তিতে বাস করতে লাগলো। (চলবে- প্রতি বৃস্পতিবার)


 

লেখক : দিদার মুহাম্মদ। আইসিসিআর স্কলার, মাস্টার অফ পারফর্মিং আর্টস (এমপিএ), ব্যাঙ্গালুর ইউনিভার্সিটি, কর্ণাটক, ভারত।

 

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
সরকারের সব সংস্থার মধ্যে সহযোগিতা নিশ্চিত করা বড় চ্যালেঞ্জ: সেনাপ্রধান
সরকারের সব সংস্থার মধ্যে সহযোগিতা নিশ্চিত করা বড় চ্যালেঞ্জ: সেনাপ্রধান
মহিলা সমিতি মঞ্চে ‘অভিনেতা’ ও ‘টিনের তলোয়ার’
মহিলা সমিতি মঞ্চে ‘অভিনেতা’ ও ‘টিনের তলোয়ার’
ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জোরদার করলো ইইউ
ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জোরদার করলো ইইউ
সর্বাধিক পঠিত
এএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
রেস্তোরাঁয় ‘মদ না পেয়ে’ হামলার অভিযোগএএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট