গত সপ্তাহে জব্বার আল নাঈমের কবিতার বই ‘এসেছি মিথ্যা বলতে’ প্রকাশিত হয়েছে। প্রচ্ছদ করেছেন, সারাজাত সৌম। প্রকাশক : চৈতন্য। মূল্য : ১৩০ টাকা। শ্লেষ বইয়ের পাণ্ডুলিপি থেকে পাঁচটি কবিতা প্রকাশ করা হলো।
কুকুর
একজন শিল্পপতির সঙ্গে কথা হয়
তার শখ একটি দেশি কুকুর পালবে
বিদেশি কুকুর পালতে খরচ খুব বেশি
বাড়ি পাহারা দেবে
শত্রু তাড়াবে
এবং লেজ নাড়াতে নাড়াতে তাকে সম্মান জানাবে।
কারো সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই বললাম
আমিই সেই কুকুর—
খুব অল্প বেতনে নিয়োগ দিন আমাকে।
কফিনে মোড়ানো বাংলাদেশ
শহিদ মিনারে আনা হবে
কবি শহীদ কাদরীর লাশবাহী কফিন
সাদা মার্কিন কাপড়ে চকোলেটের মতো মোড়ানো
কফিন খুলে দেখলাম মরে আছে বাংলাদেশ...
অঘোরে ঘুমাচ্ছে
কফিনে সংসারের দায়িত্বশীল বাবা
পাঞ্জাবি ও পায়জামা পরিহিত
শুভ্র সুন্দর দস্তানায় ইসরাফিলের বাঁশি হাতে
তাড়া দিচ্ছেন আমাকে—বেঘোরে ঘুমাতে
স্মরণিকার সামনে দাঁড়িয়ে মৃত সব কবি আত্মা
ছিপি খুলে আতরের সুগন্ধ ডান হাতের কবজি ও নাকে
মুগ্ধতায় মিছিলের অগ্রভাগে মৌনমিছিল—
’৪৭ ও ’৫২ সাল
আমার দিকে আজরাইল ’৭১ এর মতো এগিয়ে আসছে
সামান্য নিচে নিসর্গের মতো ছায়া বিলিয়ে যাচ্ছি
শোকের কাতারে; সহকর্মী ও কবিবন্ধুদের জিজ্ঞাসু চোখ
লাশ আনা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জামে মসজিদে
এমন সুযোগে—
কবি কাজী নজরুল ইসলাম আর জয়নুল আবেদিন
ফুলের মালায় প্রথম অভিবাদন জানায়;
আলসেমি রেখে পটুয়া কামরুল জানাজার ইমামতিতে দাঁড়ায়
লাল সবুজের টুপি মাথায়। হায়! এখানেও সাইফুদ্দিন নেই
পটুয়ার টুপি বর্গা হয়ে গেছে, খুঁজে হয়রান
কোথায় পাবো দ্বিজেন্দ্রলাল?
শেষতক টুপি না-পেয়ে
আমরা কফিনবন্দি বাংলাদেশ মাথায় নিয়ে হাঁটতে থাকলাম
মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানের দিকে
রক্তমাখা ইটের গল্প
একবার আমেরিকা গ্লাসভরা ক্রোধের পানি
আফগানিস্তানের দিকে ছুড়ে মারে
ব্যথা পাওয়ার পরিবর্তে হেসে ওঠে তারা—
আবার মুঠোভরা মাটি মারলো ইরাকের গায়ে
গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায় খোমেনি
বিভ্রান্ত মজলিশ পানি আর মাটি একত্র করে
কাদার পিরামিড বানিয়ে
আগুনে নিক্ষিপ্ত করল আমাকে
এর পর বেরিয়ে এলো রক্তমাখা ইটের শরীর
ইটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত বিশ্বের হৃৎপিণ্ড
কেউ জানে না—
সে যে রক্তমাখা ইটের আরেকটি নাম!
আদিনিবাস
গতরাতে মারা যাওয়া লাশগুলোর সঙ্গে ইশারা বিনিময় হয়
তারা কথা বলতে এগিয়ে আসে—
আমি ভয় পেয়ে জীবিত আমাকে খুঁজতে থাকি...
দূরে কুয়াশার মতো কেউ একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে
এদিক-সেদিক তাকালে
লিঙ্গের বীভৎস চেহারা দেখে
আরও বেশি কান্না পায়
ক্রমেই নিজের ভেতর থেকে কঙ্কাল বের করে
দৌড়ে দৌড়ে পালাতে চাই—পারি না
পেছন থেকে কেউ একজন জাপটে ধরে
এখানে প্রতিবাদ—প্রতিরোধ নেই
পৃথিবীর মানুষ বারবার লাশের সামনে নিক্ষেপ করে—
সেই থেকে আমিও লাশ। লাশের সঙ্গে সংসার!
বেকারনামা ও পরবর্তী পদক্ষেপ
সেদিন ইফতারের আগে কবি আশরাফ জুয়েলের বাসার দিকে ট্রাফিক জ্যাম এড়িয়ে হাঁটছি। জুতাবিহীন ট্রাফিক-বৃষ্টিতে ভিজে গেছে সমস্ত শরীর; শহর। অঝোরে ঝরছে। মাথার উপর ছাতা নেই—ভিজছে বাংলাদেশ; ব্যাঙের সর্দিকাশি। ডাক্তার বললেন চিকিৎসা নিতে হবে আমেরিকার রয়েল হাসপাতালে! দরিদ্র ভূমির সন্তান; ঔষধিগাছই শেষ ভরসা আমার।
সন্ধ্যা পারাপারে হুইসেল বাজায় পুলিশ স্টেশন। দৌড়ে পিছিয়ে পড়ছে অফিস ফেরত মানুষ; রিকশাওয়ালা। তামাশা দেখছে শতশত বাসা ফেরৎ বাস যাত্রী।
দৌড়াতে দৌড়াতে পেছন ফেলছি যানবাহন—রোদ-বৃষ্টি; পথচারি। এরপরও সামনে এসে দেখি আরো সামনে নীল ছায়ারা দৌড়াচ্ছে। কেউ কেউ ছিটকে পড়ছে বস্তিপাড়ায়। ছায়া ধরার বাহানা নিয়ে ছুটছি মহাকালের রাস্তায়। ব্যর্থতার ষোল কলা পূর্ণ হচ্ছে। ধরতে গেলে বারবার পিছলে যায় সময়।
আসলে ধ্বংসের রাস্তায় কেউ কারো কথা শোনে না। এরা বিবর্ণ। শরীরে পোশাক নেই। পকেট নেই। পকেট বানাতে না পারার অভিমান; আত্মহত্যার মঞ্চে লাফাচ্ছে সদ্য ভার্সিটি পাশ বর্তমান।