X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

শূন্যসময়

হানযালা হান
০১ আগস্ট ২০১৭, ১৫:৪৭আপডেট : ০১ আগস্ট ২০১৭, ১৫:৫৯

শূন্যসময়
যে দৃশ্য কেউ দেখেনি, সেই দৃশ্য দেখা যায়; যে সুর কোথাও বাজেনি, সেই সুর শোনা যায়; এ এক আশ্চর্য কথা, যা কেউ বলেনি, অথচ সবাই জানে—বেঁচে থাকার একটা যন্ত্রণা আছে;

কী রঙের ফুল ফোটে নন্দন গাছে? কতোটা গন্ধ ছড়ালে পূর্ণিমা রাতে চাতকের বিরহ জাগে? বিষণœবাহারের পাতায় কী কী বিরহ লেখা থাকে? আত্মঘাতী তিমিদের দুঃখ কতোটা শিল্পোত্তীর্ণ? জীবনের প্রতি কতোটা বিতৃষ্ণা থাকলে ব্যর্থতার গ্লানি গ্রাস করে? এই যে দিন, একটা দিন, তা কি চিরকাল এক থাকে? তবে কীসের জন্য মানুষ তার জীবনকে অপচয় করে?

অনন্ত পথের শেষে যদি আরো পথ থাকে, তবে সেখান থেকে চলো শুরু করি; যদি তুমি জানতে চাও পাকা ডাবের কথা তবে তা আর ডাব থাকে না, হয় ঝুনা নারকেল, এই তার ভাগ্য—সে খণ্ডাতে পারে না, তবে তার ভেতরের পানি আরো মিষ্ট হয়; গোলাম সে চিরকাল গোলাম, যেমন তাসের গায়ে আঁকা; অথচ আকাশের সন্ধ্যা তারাটিও স্থান বদল করে, মেঘ চঞ্চল, সূর্য সদা ঘূর্ণয়মান, চন্দ্র চক্রশীল, সমুদ্র বেগবান, যেমন সকাল চিরকাল সকাল থাকে না, দুপুর বিকেল সন্ধ্যা হয়, জোয়ার আসে ভাটা হয়; বদলে যায় ঋতু, মানুষের মন ও শরীর;

এক ঝুমকোলতা ফুলের কাছে প্রেম নিবেদন করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বটবৃক্ষ, ফুল শর্ত দেয়—পারদের ঝরনায় গোসল করে আসতে হবে; বৃক্ষ তো স্থির—চলৎশক্তিহীন, দেবতাদের তুষ্ট করে সে পেয়ে যায় ডানা, বের হয় ঝরনার খোঁজে, দুধের ঝরনার দেখা মেলে যত্রতত্র, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত বস্তু? সে যে অগম্য, অধরা; এই-ই জগতের রীতি—যা তুমি চাইবে, তা পাবে না; কাঁটা গুল্মলতা ফুল পাখি পাহাড় নদী পরী দেও দানো স্বর্গ মর্ত পাতাল নরক তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পারদের নদী পেলো না, সে একটা নদী বানানোর প্রকল্প নিলো, কিন্তু নদীতে উঠে কেবল পানি, পারদ তো উঠে না, শেষে সে পারদের কারাখানা গড়ল, আর সেই ফুল ততো দিনে হয়ে গেছে এক তরুণী—অন্য কারো ছায়া, এই সব বৃথা ব্যর্থতা থেকে যুবক শিখে নিয়েছে জীবনের মন্ত্র, বেঁচে থাকার মন্ত্রণা, তবু তাকে গ্রাস করে এক নীরব যন্ত্রণা—কথা দিয়ে কেন মানুষ কথা রাখে না?

রাতের পর ভোরের সূর্য উঠেনি, ঘন কালো মেঘ ঢেকেছে পুরো আকাশ, কোথাও বৃষ্টি হয়নি, অথচ—আবহাওয়া অফিস ঘোষণা করেছে সাত নম্বর সতর্ক সংকেত, লোকালয় ছাড়েনি কোনো ট্রলার, জাহাজগুলো ফিরেছে মাঝ সমুদ্র থেকে, নাবিকেরা বাড়ি ফিরেছে, বাৎসল্য ও রতিরস বাসা বেঁধেছে, গাছে গাছে পাখিদের চিৎকার, শিশুরা ভ্যাপসা গরমে কাঁদছে, অতলান্তিক নাকি আটলান্টিক মহাসাগরে জমাট বেঁধেছে মেঘ, পুঞ্জিভূত মহাশক্তিশালী, আকাশে পথ হারিয়েছে অসংখ্য খেচর—এই যদি হয় মানুষের সাধ্যের সীমা, আর কতোবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করলে পৃথিবীর পরিণত বয়স হবে?

আম পাকলে রস, জাম পাকলে রসমিঠা রে

মানুষ পাকলে তিতা, সব রসশুকায় রে... রক মেটাল হার্ড র‌্যাপ, নিউক্লিয়ার ডিটেক্টর আর ডিক্টেটর; এই আমাদের নগর নাগরিক, কেবলি আনন্দ, জগৎ আনন্দময়, এই নিরানন্দ দিনে; রাজার ছেলে রাজা, ভাগ্য বলে ভাগ্য, এই পুরনো রাজতন্ত্র নতুন গণতন্ত্রের বোতলে, কেউ কেউ দেখো টাকার পাহাড় বানায়, এভারেস্ট চূড়া ছাড়িয়ে যায় খ্যাতি, আর আমাদের জেলেবউ ঘুটেরানি তাঁতিবউ একবেলা আহার করে আরেক বেলা রোজা রাখে; যমুনা নদীতে আর মাছ পাওয়া যায় না, মাছ পাবে কি? পানি-ই নাই; যারা শপথ নিয়েছিল মানুষের ভাগ্য বদলে দেওয়ার, তারা অ্যাকুরিয়ামে রঙিন মাছের মুখ থেকে বের হওয়া বুদ বুদ গোনে—এই তার ভবিষ্য, সে খণ্ডাতে পারে না;

দিনটা ছিল মায়ান ক্যালেন্ডারের সমাপ্তি, যদি আর ভোর না হয়? যদি থেমে যায় চক্র? সূর্য ও আর আর নক্ষত্র যদি রাগী ষাড়ের মতো মাথা কোটে কৃষ্ণগহ্বরে? তেঁতুলিয়া নদীতে রঙধনু দেখে শুশুক ছানা টুপ করে জলের মধ্যে ডুবে যায়, নদীর মধ্যে দেখ কত কত রঙ বিবর্ণ হয়ে আসে; জারুল জামরুলের মতো এক ফল—তবু সে ফল নয়, কেবলি দেখতে ফলের মতো, মাছেরা খায়—তার মধ্যে এক রূপবতী রাজকন্যা, রাজ্য নেই, তাই তার গল্প আর এগোয় না; ফুলের বাগানে ফোটে সবজি, খামারে মানবপ্রজনন কেন্দ্র, কারখানায় সংবেদনশিলতা উৎপাদন; আর কতোটা চিন্তাহীন হলে মানুষ পশুত্ব স্বীকার করবে?

খুন না করেও খুনের আসামী, ফাঁসির আদেশ হয়েছিল, মাফ হয়নি, সাজাও কমেনি, শেষ ইচ্ছা জানতে চাওয়া হয়েছিল, বলেছিল সে—বাঁচতে চাই; এ বড় হাসির কথা, তবু কেউ হাসে না; এ বড় কান্নার কথা, তবু কেউ কাঁদে না; কঠিন সত্য এ, তবু হায়, কে কবে মরতে চায়? পুরোহিত এসেছিল—সবাইকে মরতে হবে, এ জগতে কেউ চিরদিন বাঁচে না, সবাই মরে, কেউ আগে—কেউ পরে, অদৃশ্য দৃশ্য পাপের জন্য বরং অনুশোচনা করো, খোদার ওপর রাখো বিশ্বাস, তিনি বাঁচান মারেন;

বাইরে বাতাস নেই, গুমোট, অথচ কয়েদখানার ভেতরে ঝিরঝিরে বাতাস; ফাঁসির আসামী দেখ বাঁচতে চায়; এ আর এমন কী? সবাই বাঁচতে চায়, কিন্তু সবার আবেদন ঈশ্বরের কাছে পৌঁছায় না; তবে কেন এ কৌতুক?

ক্রোধ ক্রুদ্ধ, আর এক ইচ্ছা—গোপন, অন্ধকার, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছ, মাবুদ; আর দেখ এই সকাল বেলা—মেঘের তা-বে সূর্য উঠতে পারছে না, তবু মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, হেকমত মুন্সি মারা গেছেন, লোকটা ছিল খাচ্চর; অথচ, কণ্ঠ মোলায়েম করে ঘোষক বলে—বড় ভালো লোক ছিল, কারো কোনো ঋণ থাকলে ছেলেপেলের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন; বয়সকালে সে কতজনের বিকেলের স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে, এ হিসাব আপাতত সবাই ভুলে চোখের পানি ফেলছে, আহা, লোকটা দানশীল ছিল; এমন নিদারুণ দিন;

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয় হয়, কিন্তু সূর্য ওঠে না, এই যদি হয় আকাশের বিচার, তবে তো জ্বলবে না সোলার প্যানেল, জ্বলবে না ঘরের বাতি, অন্ধকারে ঢাকা পড়বে সড়ক নগর; এই আধুনিক পৃথিবীতে সূর্য নাই, এ হতে পারে না, সূর্যের কাছে খবর পাঠালো বিজ্ঞানীরা, এক দল বিদ্রোহী মেঘ জবাব দিল—বিনা অপরাধে ফুল ছেঁড়া বন্ধ করো;

হায় হায় রব উঠে গেল দুনিয়া জুড়ে, নিরক্ষর বয়স্করা ভয়ে জড়সড়, আজ বুঝি দুনিয়া ধ্বংস হবে? তার আগেই ঈশ্বরের সঙ্গে সন্ধি হয়ে গেল, বিদ্রোহী মেঘেরা তা মানবে না, আরো শক্তিশালী বজ্রমেঘ পাঠালেন ঈশ্বর; ঈশ্বরের জলকামান নাকি বিদ্রোহী মেঘ? কে বেশি সামর্থ্য রাখে? মেঘে মেঘে লাগলো সংঘর্ষ, বজ্রপাতে মরল বহু প্রাণ;

শহরজুড়ে রোল ওঠে জেলার সুইসাইড করেছেন, আসামী না মেরে নিজেই মরে গেছেন, আসমানি ফরমান এল— জেলারকে খুন করা হয়েছে; নিরাপরাধ মানুষ ঝোলানো— পাপ থেকে বাঁচতে সহজ পথ বেছে নিলেন, এই সত্য বলতে মানা; এই যখন আইন, তখন আদালত মিথ্যা রক্ষাকারী;

এই বিবমিষা ও বিভৎস্য দিনে, দেখ, ঢোল করতাল বাঁশি নিয়ে কেউ কেউ সুর ভাজে, ধ্রুপদী সঙ্গীত, এই অসুর দিনে সুরের ধ্যান, যেন হৃদযন্ত্র কেটে নিয়ে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে একটা বিশাল পেঁয়াজ, আহা—অর্গ্যানিক;

কেউ বেহুদা তর্ক করে—বুকে লোম নাই, তাই সে বলে লোম থাকা ভাল্লুকের লক্ষণ; কারো গানের গলা ভালো, সে বলে নৃত্য হলো মাছেদের শিল্প; আর কেউ বাতাসের সঙ্গে ঝগড়া বাঁধায়, তার তো কোনো ইস্যু নাই, তাই সে ইস্যু বানায়— বাতাস কেন দক্ষিণ থেকে আসে? গ্রীষ্মকালে বায়ু দেবতা উত্তরে সাইবেরিয়া থেকে আসতে পারে না? আসলে তার ঘরে উত্তরে জানালা, দক্ষিণে জানালা নাই, তাই সে উত্তরপন্থি; এই যদি হয় মানুষের কালচার, লোকাচারে যদি থাকে পাচার চোরাকারবার, তবে শূন্য থেকে শুরু না করে তারা গোণে দশ থেকে, বলে—দশ হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে আদিম সংখ্যা, এর বাইরে কোনো জ্ঞানকাণ্ড নাই, আবার কেউ কেউ দেখ ভীরের মধ্যে ঢুকে গেছে, এই এক সুবিধা একবার ঢুকে যেতে পারলে, লোকজন আপনাকে ঠেলে নিয়ে যাবে গন্তব্যে, অতি সহজে পৌঁছাতে পারবেন; যেখানে সবাই যায়, সে পথ সহজ; আর দুর্গম পথে দেখ হাঁটতে হয় একা, সেখানে ভয় উৎকণ্ঠা জীবনসংশয়—এই পথ তাদের নয়, যারা অযথা তর্কপ্রবণ, চিলের মুখ থেকে মাছ কেড়ে নিয়ে মুখে পোড়ে;

কেউ কেউ ডাঙায় কুমির হয়ে চারপাশে অসংখ্য ডিম সাজিয়ে বসে আছে, এসব ডিম থেকে একেকটা সাপের বাচ্চা বেরোয়, আর কুমির তা খেয়ে ফেলে, আবার কেউ অতিকমরেড, সে এক আজব কথা মাঝেমধ্যে বলে আর চারপাশে তাকিয়ে দেখে কতোটা বিনোদিত বসে থাকা শালিকশ্রোতারা;

আকাশে মেঘ দেখে বাতাসে নৃত্য শুরু করেছে উড়–ক্কু মাছেরা, তাদের কী প্রজননকাল এল? শরীরে কি জাগে এক অচিন ব্যথা? পাখিরা কি শিকার ভুলে গেছে? তাড়া করে না কোনো মাছরাঙা? নাকি এই রোগশোকের দিনে হিংস্রতা ভুলে বাসায় মেতেছে সুনিপুন কর্মে?

তেকুমা ফুলের গাছ কথা বলে, হাঁটে নাচে গায়, যেন সে এক নারী, আবদার করে, সঙ্গ পেতে চায়, আমি এই ফুল নিয়ে পড়েছি এক বিপদে, তাকে লুকিয়ে রাখতে চাই, অথচ সে সর্বত্র আমার সঙ্গে যাতায়াত করে, ঘরের কোন তার ভাল্লাগে না, পৃথিবীর আলো বাতাসে সে বড় হয়েছে, সেখানেই তার স্বাচ্ছন্দ্য চলাফেরা, বৃষ্টিতে ভিজতে তার খুব আনন্দ, অথচ বজ্রপাতের ভয়ে আমি সদা তটস্থ; ভিজলে জ্বর আসবে, জ্বর এলে আমার ভয় লাগে, মরে যাওয়ার ভয়; আমি যেন প্রতিবার জ্বরে মৃত্যুর দরজার সামনে চলে যাই; এদিকে সে বৃষ্টি পেলে ময়ুরের মতো নাচতে থাকে, যেন বৃষ্টিতে তার জন্ম, এ ছাড়া সে বেঁচে থাকতে পারবে না, আমি—এক লজ্জাবতী বানরের মতো সদা মুখ লুকিয়ে থাকি, পাছে কেউ দেখে ফেলে, তাই চোখ বুজে থাকি;

এমন বাগান আছে কুতর্কের ফুল ফোটে, কাঁটায় ভরা সে বাগানে প্রবেশ করা যায় না, দুর্গন্ধে আশপাশে কেউ যেতে পারে না, এই সব ফুলেরা জালের থলেতে ভরে জল, তারা ফু দিয়ে নিভিয়ে দেয় সূর্যের আলো, আর যেন ইচ্ছে করলে বানাতে পারে একশ একটা চাঁদ, অবশ্য সেসব চাঁদে কোনো বুড়ি চরকা কাটবে কিনা তা তারা জানে না, কারণ—তারা কোনো দিন পূর্ণিমা রাতে পূর্ণ চাঁদ দেখে না, তারা বরং সাঁতার কাটে ডাঙায়, তাদের নৌকা তরতর করে এগিয়ে যায় পিচঢালা রাজপথে, এই সব নৌকা নিয়ে তারা বাইচও দেখায়, এই সব দৃশ্য সম্প্রচার হয়, এমন গুমোট দিন, কেবল তর্কপ্রবণ কাকেরা সারাদিন কা কা করে;

কোনো কোনো পণ্ডিত আছে তারা থিওরি দেন, চাল বাছতে হলে প্রথমে কুলা থেকে চাল ফেলে দিন, এর পর পোকা বেছে মেরে মাটিতে পুতে রাখুন, পোকায় খাওয়া চাল বেছে তুলে রাখুন, বাকিগুলো বাছা চাল, কিন্তু আমাদের মায়েরা কুলা ঝেড়ে কতো সহজে বেছে আনতেন বাছা চাল; আহা, এই সব দেখে তারা বাহ বাহ করে আর থিসিস লেখে, পাণ্ডিত্যের মূর্খামির দিন এ বড়, বোমা পড়ে পড়ে পৃথিবীর মাটি হয়ে গেল পোড়া, অথচ তারা পাখির বিষ্ঠা মাটিতে ফেলতে দিবে না, এ নাকি বড় দূষিত, এই দূষিত দিন, বাতাসে ছড়িয়ে পড়া হিংসার দিন;

এমনও দিন আসে, পুরো আসমান মেঘে ঢাকা; সূর্য একবারও দেখা যায় না, ফলত সূর্যের উপর নির্ভরশীল প্রাণ জড়সড়, যারা তীর্থযাত্রায় বের হয়েছে, অর্ধেক পথ পেরোনোর পর যাত্রা বাতিল করতে হয়, এমন বিপদসঙ্কুল দিন, ভাই চেনে না ভাইকে, বাবা চেনে না ছেলেকে, মানুষ চেনে না মানুষকে, কেবল ছুটে চলে সবাই, যেমন ভেড়ার পাল ছুটে চলে সন্ধ্যার মাঠে;

এমনও দিন আসে, ব্যক্তির কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না, প্রবল স্রোতে যেমন কস্তুরি ভাসে, দাঁড়ানোর মতো ক্ষমতা তার থাকে না; যেন তাকে অন্য কেউ দাবার ঘুটি বানিয়ে খেলে; ফলত তীব্র মনোবেদনায় ভরে যায় মুহূর্তগুলো;

এমনও হাত আছে, স্নেহ প্রেম নিয়ে অপেক্ষা করে; কিন্তু তার আরেক হাতে থাকে ছুরি, সেই লুকানো হাত কখনও কখনও আঘাত হানে; প্রিয়জন, যে সর্বদা থাকে মাথার কাছে, সেই আঘাত হানে মাথায়; কখনও কখনও অতি ছোটো ছোটো ভুল বড় হয়ে দেখা দেয়, সেইসব সামান্য ভুলে বাকি জীবন হাঁটতে হয় পায়ে কাঁটা নিয়ে; কেউ কেউ কত সহজে উড়াল মারে পরিযায়ী পাখির মতো, আর আমাদের এই দিন, নিরন্ন দিন, অভুক্ত দিন, পাকা ফল পোকায় খাওয়ার মতো দিন, পচা ফলের মতো গন্ধ ছড়ানো দিন; তবুও এই সব ফলের মধ্যে থাকে বীজ, আর সেই বীজ রোদে শুকিয়ে মরে যাওয়ার মতো দিন;

হিংস্র হায়েনারা সমাজে সভ্যতার পোশাক পড়ে দিব্যি ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু তাদের স্বভাব কামড়ানো, তারা সর্বদা আশপাশের মানুষকে খুঁচিয়ে মারে, লাল আঙুরের মতো কামরাঙার মতো কতো কতো ফল তাদের মুখে, কিন্তু তারা মাংস খুঁজে বেড়ায়, হরিণ ভেড়া নয়, মানুষের শরীরের সাপেরা তাদের সঙ্গে ফোস ফোস করে, কিন্তু তারা কিছু বলেনা, এইসব হিংস্র দিনে, যখন নরমাংসাশীরা ঈশ্বরের প্রতিনিধি হয়, এই সব দিনে সূর্য ওঠে না, গাছের পাতারা স্থির দাঁড়িয়ে থাকে, ফুলেরা সৌন্দর্য লুকিয়ে রাখে, লাল ঝুঁটি হলুদ বর্ণ পাখিরা লোকালয়ে আসে না, মানুষের মন সন্ন্যাসব্রত ছেড়ে সংসারে হাল ধরে;

এই সব দিনে মানুষ যা চায় তা পায় না, রাস্তায় বেরোলে জুতা ছিঁড়ে যায়, বিমান জরুরি অবতরণ করে, গাড়ির চাকা পাংচার হয়, নৌকা ডুবে যায় অতল জলে, কাছের কেউ ঝগড়া করে, মাথা ব্যথায় পড়ে থাকে নায়িকারা, কেবল দুঃখের সংবাদ শোনা যায়, মানুষ প্রতিবাদ ভুলে যায়, খেলায় হেরে যায় যে পাকা খেলোয়াড়, উদ্ধত আচরণ করে সবচেয়ে বিনয়ীরা, দুধ উথলে উঠে চুলায়, ফানুসগুলো অহেতুক ফুটা হয়ে যায়, বিষ দিয়ে মারা হয় কত শত পাখি, কেউ কেউ জীবনের আলো না পেয়ে আত্মহত্যা করে; এই সব দিন—সূর্যহীনতার দিন, আমাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে, মানুষ ভুলে যায় দিনের কথা, মনে হয়—এক অনন্ত রাত গ্রাস করেছে, এই অন্ধকার যেন শেষ হওয়ার নয়, কেউ কেউ নীরবে কাঁদে একা একা, আবার কেউ কাঁদে খুব জোড়ে; বিশ্বাস প্রেম স্বজন হারালে মানুষ আর বেঁচে থাকে না—যেমন শিকড় কেটে দিলে মরে যায় গাছ;

একটা সাহসী সিংহ ভীতুর ডিমের মতো আশ্রয় খোঁজে, রাজকর্ম ভুলে সে করে হিরালি, গাঁজায় কাটিয়েছে বারোটা বছর, এখন সে এক পা ফেলতে দেখো কাঁপে, যেন পা ফেলার আগে তলার মাটি সরে পুকুর হয়ে যাবে, মধুর পুকুরে ডুবে সে মারা যাবে, ডাঙাকে ভাবে সে পুকুর এবং সেখানে পড়ে হাত পা ছোড়ে, সাঁতার জানে না বলে ঘিয়ের নদীতে হাবুডুবু খায়, পরদিন তাঁর লাশ উদ্ধারের জন্য ডুবুরিরা আসে না, যখন সে নিজেকে দেখে সড়কের ওপর, ফের সে চলে যায় কল্কির খোঁজে, পৃথিবীর মহামানবেরা এই সব ধোঁয়ায় শান্তি খুঁজতেন বলে সেও দুটান দেয়, এবং তাদের কাতারে সে নিজেকে সামীল করে, আর খোঁজে দুধের চাঁদ, এই পৃথিবীর সব কিছু অনাদরে অবহেলায় সে অস্বীকার করে, মহাকালের পথে সে হাঁটে, অবিরত, যেন গ্রহান্তরের পরিব্রাজক;

মানুষ দেখো পিছন দিকে দিব্যি হাঁটে যেন তার পেছনেও দুটো চোখ আছে, এই উল্টো চলার সময়ে সারাদিন পাপ করে সন্ধ্যায় মুখে ধর্ম কথা, পকেটে সাপ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, সুযোগ পেলেই সাপটাকে ছড়িয়ে দেয় লোকালয়ে; আহা, এই ছোবল সময়ে, এই বিষ ছড়ানো দিনে, কতো দিন আগে ঘাসে জমা শিশিরে প্রথম যেদিন মুখ ধুয়েছিলে, পাশে ছিল এক বালিকা, সেই মেয়ে আজ কোথা থেকে এলো, এই এতো এতো দিন পর, পঞ্চালিকা?

ঘুমের দেশে প্রজার চোখে নিদ্রা নাই, রাজা বাগানে দুলতে দুলতে ঘুমিয়ে পড়েন, রাজপ্রাসাদে শান্তি আর শান্তি, রাজা ঘুমায় প্রজা জাগে, প্রজা ঘুমায় রাজা জাগে, এই ঘুম-জাগা পরস্পর বিপরীত ক্রিয়া; এই নির্ঘুমের দেশে পাকা জামের লোভে একটা চড়–ই দিনভর কিচিরমিচির করে, এই সব আচার অনাচার জমা হয়, ঋতু বদলের মতো মানুষ বদলায়, অস্থায়ী এই সব দিনে বর্ষা শীত মিলন ও বিরহ;

সারা রাত না ঘুমিয়ে দিব্যি হেঁটে বেড়ান মহাপুরুষ, ক্ষুধা নাই, ক্লান্তি নাই, যেন তাঁর ইশারায় ফলবতী গাছেরা ডাল অবনত করে, পথে পথে মেঘেরা ছায়া দেয়, উৎকৃষ্ট এক সংস্কৃতিতে তিনি প্রচার করেন ধর্ম, দিনের বেলায় তার চোখে রাজ্যের লোভ, সব মানুষের লোভ তিনি বহন করেন, দিনটাকে তিনি সাধারণ মানুষের জন্য উৎসর্গ করেন, মানুষ আসলে রাত-দিন লোভের প্রাণি, দিনে ঘুমিয়ে অন্যদের তা থেকে রেহাই দিচ্ছেন—জনপদের লোকজন এ কথা সহজে বিশ্বাস করে, কারণ, এই মহাপুরুষ তাদের চোখের সামনে অলৌকিক এক পায়রা শূন্য হাতের মুঠো থেকে ছেড়ে দেন, অবিশ্বাসের ফলে তাদের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে, দূর দেখতে কাছটা বাধা, ভবিষ্যতের বাধা বর্তমান;

এক সিদ্ধ পুরুষ ডোবায় ডুব দিয়ে ওঠে নেউল হয়ে, নদী বহুদূর, দেখেনি সমুদ্র, উত্তর গোলার্ধ থেকে একটা পুরুষ তিমি দক্ষিণে থাকা নারী তিমিকে গান শোনায়, আমরা সেই গান শুনি না, কানে ভেসে আসে মায়াবী ডোডো পাখির গান, তানসেন নাকি বেথোভেন এই সব কেবল মায়া মনে হয়, ফুল ছিঁড়ে ফেললে নদী জোড়া লাগে না; কার্যত এক অগ্নিকুণ্ডে বাস করে মানুষের মন খোঁজে শীতল আশ্রয়, বারবার বজ্রপাতে বধির হয়ে সে চড়–ই পাখিদের মনে করে ডাইনোসর, শরতের আকাশে অকারণে সাদা কাশফুল কেন ফোটে? এ দেখে এক তান্ত্রিক বাঁশিওয়ালা নাককে বাঁশি বানিয়ে মোহময় সুরের আবেশ তৈরি করে, সেই সুরে নগরবাসী ঘুমিয়ে পড়ে, দিবানিদ্রায় তারা অনিদ্রায় ভোগে, এই ফাঁকে তাদের স্বপ্ন চুরি হয়, স্বপ্ন না থাকলে মানুষ বাঁচে না, ফলত নগরবাসী বেঁচেও যেন জীবন্ত মানুষের মতো বাঁচে না, তারা ছোটে কেবল ছোটে, স্বপ্নের খোঁজে, সত্যিকার অর্থে তারা আর ঘুমাতে পারে না—পারে না ঘুমাতে; জলাশয়ে মাছ শিকার করে সবুজ গাছের ডালে বসে মাছরাঙা দুই পায়ের থাবায় বের করা মাছটি যখন ঠুকরে ঠুকরে খায়, সেই দৃশ্য দেখ আর্ট গ্যালারিতে স্থান পায়, হারানো দিনের স্মৃতি মনে করে দর্শকদের মোক্ষণ হয়, তারা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে—দেখার আগে দেখে—জানার আগে জানে—করার আগে করে—খাওয়ার আগে খায়—গাওয়ার আগে গায়—যাওয়ার আগে যায়—হওয়ার আগে হয়—বলার আগে বলে—মরার আগে মরে—মানুষের এই শ্রেণি সদা সর্বদা ক্ষতিকর; সমাজে এরা নাকউঁচু, এই সব মানুষের ভেতরে আছে অমানুষ, মানুষ-অমানুষ দ্বন্দ্বে হারে মানুষ, মানুষের মন মরে গেলে অমানুষ বাঁচে;

মাথার উপরে টুপি, টুপির ভিতর রক্তচোষা কেউ দেখে না, চল্লিশ বছর পর যখন ধ্যান পূর্ণ করবেন সাধু, সেই ভোরে টুপি খুলতে গিয়ে দেখেন তা খোলে না, টুপির ওপর গজিয়েছে এক গাছ, গন্ধরাজ ফুলের গাছ, মৌসুমে মৌসুমে সে গন্ধ ছড়ায়, সাদা রঙের ফুল মনে শুভ্রতা আনে, কিস্তু শিকড়ে বাস করে এক রক্তচোষা, ফলত এই সাধু আর লোকালয়ে ফিরতে পারে না, পাহাড় যেখানে মেশে মাইনী নদীর তীরে, সেই তটে সে বাস করে একা, খায় না, ঘুমায় না, বাঁচে না, মরে না, এক সময় সে কিংবদন্তী হয়ে যায়, লোকজন দেখে পাহাড়ের ঢালে একটা রজনীগন্ধা গাছ গন্ধ ছড়ায়;

ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগ যোগীর, ভোরে মোরগ ডাকার শব্দে ঘুম থেকে উঠে গেছেন ঝরনায়, পানিতে নেমে দেখেন সূর্য দেবতা উঠলেন, প্রণাম করে ডুব দিলেন, পানির ভিতর থেকে মাথা তোলার পর দেখেন পূর্বের সূর্য পশ্চিমে হেলে গেছে, অস্তগামী সূর্য দেবতাকে বিদায়ী প্রণাম করলেন, সত্তুর বছরের জীবনে এমন ঘটনা এর আগে ঘটেনি, বাপ দাদা বা তারও আগে কোনো পূর্বপুরুষের ক্ষেত্রে এমনটা শোনা যায়নি, কোনো ধর্মগ্রন্থেও এমন কথা লেখা নাই; ধান্দায় বিভাহীন ধ্যানী—কী এর মাহাত্ম্য? কী বা লুকিয়ে আছে এ রহস্যে? এই সব প্রশ্ন যতোটা না প্রকট, তার চেয়ে বড় কথা—এতো ছোটো দিনে সে কিছু করতে পারেনি, না পূজা না আহার, শিষ্যরা সান্ধ্য আহ্নিকের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তাদের মধ্যে ভাবান্তর নাই, তবে কি যোগী বিভ্রমের মধ্যে আছেন?

সাতাশ বছর পর সূর্য উঠেছে, গ্রহবাসীর মনে অন্যরকম আনন্দ, প্রাচীন ধর্মের অনুসারীরা দেবের পূজাঅর্চনা করছে, সকাল থেকে পাখিরা কিচিরমিচিরে ভরিয়ে রেখেছে লোকালয় বন, পুরনো পাখির দল ফিরে এসেছে, যেন তারা এতোদিন হারিয়ে গিয়েছিল, সৌর চালিত অসংখ্য কারখানা বন্ধ হয়েছিল, সেই সব কারাখানার দরজা খুলেছে বহু বহু দিন পর, শ্রমিকেরা মারা গেছে অনেকে, যারা বেঁচে বুড়ো থা হয়ে গেছে, তাদের সন্তানেরা এসেছে বাবার চাকরিটা যেন তাকে দেওয়া হয়, হাড্ডিসার, খেতে পায় না, গায়ের রঙ ভ্যাপসা, রোদে দাঁড়িয়ে তারা ফ্যাসফ্যাস করে কথা বলে, কারো কারো ত্বকে ঘা বাসা বানিয়েছে, তারা রোদে খালি গায়ে বসে আছে, আরামে তাদের চোখে ঘুম, কে যেন আদরের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে শরীরে, আবার জমিতে ফসল হবে—ঘরে থাকবে খাবার—অভাব থাকবে না মোটে— ছেলেরা সকালে পাঠশালায় যাবে—নামতা মুখস্ত করবে; এমন আনন্দের দিন, আনন্দ কেবল, এর অন্যথা কেউ আর ভাবে না, সাতাশ বছর পর সূর্যটা আবার চলে যাবে ছুটিতে, সেই কথা কেউ আর ভাবে না;

কথা বললে মনে হয় মুখ থেকে বুদবুদ বের হচ্ছে, জ্বলজ্বলে টলমলে রঙিন, পুরো জগতের প্রতিচ্ছবি, আকৃষ্ট হয়ে কেউ ধরতে যায়, হাত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা হয়ে যায় আগুনের গোলা; হাতে আগুন নিয়ে কে খেলা করে? কোনো কোনো কথা এমন জাদু যা মানুষ ধারণ করতে পারেনা, কথাকে কেউ কেউ রশি বানিয়ে আত্মহত্যা করে, আবার কেউ কথাকে বানায় প্রেমের মন্ত্র, কেউ কেউ একেকটা কথা ছেড়ে দিয়ে দিব্বি ঘুমিয়ে পড়ে, কথাগুলো শিকারী কুকুরের মতো পাহারা দেয়, শান্তির পায়রার মতো কথাও আমি দেখেছি, আর কারো কারো কথা প্রবাদের মতো, মানুষের মনে দাগ কেটে বয়ে চলে দীর্ঘকাল, এমন কথাই নদী হয়, সাগরে মেশে;

কথা কেবল কথা না, কথা হল ক্ষমতা—কথা কেবল কথা না, কথা হল মমতা; কথার মতো কথা হতে পারে প্রেম— কথার মতো কথা হতে পারে যম; কথা কেবল কথা না, কথা হল মূল—কথা কেবল কথা না, কথা হল ফুল; কথার মতো কথা হতে পারে হুল—কথার মতো কথা হতে পারে ভুল; কথা কেবল কথা না, কথা হল ফাগুন—কথা কেবল কথা না, কথা হল আগুন;

মাঘের শীত, তীব্র কুয়াশা, হিম, হিমেল বাতাস, দুই দিন তিন দিন সাত দিন বৃষ্টি, টানা বৃষ্টি, এমন বৃষ্টি জীবনে দেখেনি, হাহুতাশ করে বয়সীরা, আবার দেখ গ্রীষ্মকাল অথচ গরম নাই, এমন কথা কেউ শুনেছে? অথচ এবার তাই হলো, বর্ষাকালে বৃষ্টি না হলে ব্যাঙের বিয়ে, এর পরও বৃষ্টি না হলে আবহাওয়া অফিস প্রকৃতির বিরূপ ইতিহাস ঘাটে, শ্রাবণে বৃষ্টি হয়নি এমন তো হয় না, ফলত সব রেকর্ড ভেঙে শ্রাবণ গেঁথে থাকে স্মৃতিতে; শরতে ভীষণ গরম, এমন তো হওয়ার কথা না, হেমন্ত যায় যায় শীতের দেখা নেই, উল্টো মনে হয় গ্রীষ্মের গরম; পরের বছর হয়তো হেমন্তে মাঘের শীত কাবু করে বাচ্চাদের, বসন্ত অথচ কোকিল ডাকে না, ডাকবে কি করে কোকিল যে হারিয়ে গেছে, অথবা খুব গরম যে কোকিল তেষ্টায় ডাকতে পারে না, অথবা কাকের বাসা নাই, তাই ডিম পাড়ার জায়গা না পেয়ে বেচারারা ডাক ভুলে গেছে; এই সব ঋতু আমাদের মন ও শরীরে বৈচিত্র্য আনে, আর আনে বিরহ ও হিংসা;

একটা মৃত প্রজাপতি কারো কারো মনে অসংখ্য আবেগ নিয়ে বেঁচে থাকে, আর মানুষ? মানুষ তো দেবতা, দেবতাদের মৃত্যু হয় না, তবে তেমন মানুষ পৃথিবী খুব বেশি পায় না; এই সব রঙের খেলা কতো শতো রাত রঙহীন করে তোলে, জীবনের কোনো কোনো আবেগ খুব বেশি দাম আদায় করে নেয়, ফাঁক ফোকড় দিয়ে সুযোগসন্ধানী চড়–ই বাসা বাঁধে;

হে রাত, তারায় ভরা রাত, মনে রেখো, বেদনার আরেক নাম গিটার, সবার আঙুল সেই তার ছুঁতে পারে না, যে ঘ্রাণ প্রথম প্রেমের নাম এনেছে, আমি সেই বাতাসের পিছু পিছু ছুটি; মানুষ নেশা করলে চন্দনের গন্ধ ছড়ায়, অমানুষ নেশা করলে মরা ইঁদুরের গন্ধ, এই গন্ধের দ্বিধা নিয়ে একটা হলুদ পাখির খোঁজে ছুটে বেড়াই জনপদ; লোকালয়ে সূর্যের আলোর নিচে খোঁজে কেউ কেউ চাঁদের কোমলতা, ফলত তাদের শরীর পুরে যায়, অতিবেগুনি রশ্মি নাকি ঘৃণা, দেখতে দেখতে গাছের পাতা ঝড়ে যায়, দেখতে দেখতে দিন পার হয়ে যায়, দেখতে দেখতে ধনি গরীব হয়ে যায়, দেখতে দেখতে মানুষ বুড়ো হয়ে যায়, দেখতে দেখতে এমন হয়, যা হওয়ার না, এর পরও মানুষ বেঁচে থাকে, এক কণা কর্পুরের মতো বাঁচে;

মাঝে মাঝে এমন রাত আসে কিছুতে ঘুমানো যায় না, কাছের কেউ মারা গেলে এমন হয়, অথবা কেউ মরেনি, তারপরও মনটা স্বজনের মৃত্যুর মতো হু হু করে, যেন একটা আদিগন্ত আকাশ উধাও হয়ে গেছে অথবা ছিদ্র হয়ে গেছে ভূপৃষ্ঠের কোথাও, আর সেই ছিদ্র দিয়ে অনবরত উদগিরণ হচ্ছে তরল জ্বালানী, সূর্যের তাপ পেলে আগুন লেগে যাবে; বৃষ্টি নেই, শীত নেই, গরম নেই; মাঝে মধ্যে এমন রাত আসে, চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে যায়, কোথাও আলোর উৎস থাকেনা; রঙিন যে স্বপ্ন তা সাদাকালো হয়ে যায়, বিভীষিকা তাড়া করে, কাছের দৃশ্য অচেনা দূর মনে হয়, অন্ধকারে এক অচেনা আততায়ী ঘুরে বেড়ায়, পৃথিবী জুড়ে প্রার্থনা—ইয়া রাহমান, সারা দিন মান কেন ঢাকা থাকে আসমান?

সকালে যা ঘৃণার ছিল, দুপুরে দেখ কেমনে তা আগলে রাখে মানুষ, উপরে উঠতে কতোটা নিচে নামতে পারে, নীচ, এ এক আশ্চর্য কথা—সাধু সুযোগ খোঁজে অসাধু হওয়ার, অসাধুরা প্রার্থনা করে সাধুতার;

কাকেরা সারা দিন কাকা করে আর মল ছড়ায়, বৃষ্টি নাই— নাই বৃষ্টি, রোদ নাই—নাই রোদ, তবুও ভয়ে ছাতা ফুটিয়ে ঘোরে লোকেরা, ভ্যাপসা গরমের দিন, মা সন্তানকে কোলে রাখতে পারে না, ঘামে ভিজে যায় শিশুর কোমল মুখ, ঘামাচির কামড়ে সারাদিন কাঁদে শিশুরা, বুড়োরা লাঠি নিয়ে নিজের শরীর নিজেরা খোঁচায়, এই সব দিন, এই নষ্ট হওয়ার দিন, মানুষের ভেতরটা কাঁদে নিরবে—নিরবে কাঁদে, আর কেউ কেউ ছুরিতে শাণ দেয় নিরবে, যদিও তার শব্দ শোনা যায় খসা খস—খস খসা;

খোঁড়া পা, পা খোঁড়া, হাঁটে; অন্ধ চোখ, চোখ অন্ধ, দ্যাখে; বোবা মুখ, মুখ বোবা, বলে; বধির কান, কান বধির, শোনে; মহা মুর্খ, মুর্খ মহা, পণ্ডিত; খারাপ লোক, লোক খারাপ, চলে; নদীর ঢেউ, ঢেউ নদীর, ভাঙে; তুফান ঝড়, ঝড় তুফান, আসে; প্রলয় মহা, মহাপ্রলয়, ডাকে; এমন দিন, দিন এমন, কাটে;

এমন দিন, আহা, এমন দিন, যেন সে বাঘের মুখে পড়া হরিণ;

গাছের অর্ধেক দাঁড়িয়ে আছে, বাকি অর্ধেক কেটে নিয়েছে শরিকরা, পাখিরা কর্কশ স্বরে সতর্ক করে, নেউল ঝগড়া করে কুকুরের সাথে, অজগরের গলায় সুতা বেঁধে শিশুরা ঘুরে বেড়ায় দিব্যি, হীরার দোকানে দেখ কাঁচ বিক্রি হয়, দোজখের নমুনা হায়, এমন দিন, ম্যাদা মারা দিন, বাজে পড়া গরুর মতো স্থির দাঁড়িয়ে থাকা দিন;

কেউ কেউ দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ে; ঘুমায় আর স্বপ্ন খোঁজে, সুখ খোঁজে, স্বস্তি খোঁজে; একেকটা দিন, যেন ঘুমে লীন;

সবজান্তা শমসের, সবকিছু জানে, অথচ জানে না কিছুই, এমনকি জানে না—আলো দেখা যায় কিনা, অথচ আমরা তাকে গুরু মানি, কবিতায় তিনি দিগন্তপ্রসারী, ছন্দ তার পায়ে, অলঙ্কারের অলঙ্কার, খ্যাতির চূড়ায় তার পদচারণা, অভিনয়ে হিমালয়, গানের গলা বাঁশির মতো, এতো এতো ভক্ত তাঁর, নক্ষত্রদের মধ্যে বেশ নামডাক, কিন্তু তিনি জানেন না কী করে বাক্যকে পরিযায়ী পাখির মতো এক শতাব্দী থেকে আরেক শতাব্দীতে ওড়াতে হয়, মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে তার অন্তর পড়তে হয়;

সুরের বদলে বেসুরে গান গাওয়ার দিন, কারো কারো চোখ বড় চতুর, সুযোগ খোঁজে—খোঁজে সুযোগ, শিল্পের নামে দেখ জমায় সুবিধার আসর, বাগানে শোভা পায় প্লাস্টিক ফুল, কথার বদলে ওরা বিষ ছড়ায় বাতাসে, আবার আগুনের মধ্যে বসে কেউ জলের প্রার্থনা করে, নিরন্তর চর্চা যার, সেই তো সফল—ব্যর্থতার সর্বগ্রাসী রঙ তাকে ম্লান করে দিতে চায়, বার বার ভাঙে, কিন্তু বার বার জোড়া লাগে; এ হল আগুন—নিজে পোড়ে না, অথচ অন্যকে পোড়ায়; আবার কেউ বাকচতুর, মুহূর্তে বদলে দেয় কথার ধরন, ভূমিকম্পে যেমন জনপদে বয়ে যায় নদী, সুশ্রী মুখে কেউ কেউ অভব্য বুলি ছাড়ে, বমনের মতো, দুর্গন্ধ; আর কেউ আছে এমন, মিষ্টি হেসে, খুড়ের মতো চট করে পোচ মারে, কেউ বোঝে না কী হলো—হলো কী? পরে কেবল দেখে রক্ত ঝরে, কথা কেবল কথা না, কথা হলো ধার; কথা কেবল কথা না, কথা হলো মার;

মাঝেমধ্যে এমনও দিন আসে, নিজেকে একা মনে হয়, কথা বলার মতো কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না, আত্মীয় স্বজন বন্ধু প্রেয়সী কাউকে সঙ্গী মনে হয় না, আকাশের মতো এক নিঃসঙ্গতা গ্রাস করে; নিজেকে মনে হয় ক্রেওকাডাং পাহাড়ের মতো এক নীল তিমি, যে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে গান গায়, কিন্তু তাঁর গান শুনে কেউ সাড়া দেয় না, কত শত বছর সে বেঁচে থাকবে, বাকিটা জীবন তাকে একাকি কাটাতে হবে, কারণ, তাঁর কোনো সঙ্গী কেউ কোনো দিন হবে না; নিজেকে মনে হয় নিশাচর সেই পাখির মতো, রাতের শেষ প্রহরে ডাকে, গত এক যুগ ধরে তার এই ডাক আমি শুনি, সে ডাকে একা একা কিছুক্ষণ থেমে থেমে, সে অপেক্ষায় থাকে, কোনো এক পাখি তার ডাকে সারা দেবে, কিন্তু, না, তাকেও বাকিটা জীবন একা একা কাটাতে হবে; আবার মনে হয়—আমি বোধ হয় সেই পাহাড়ি ঝরনা, যে চায় সমুদ্রে মিশতে, কিন্তু পারে না, সে সমতলে এলে হয়ে যায় নদী; ফলত ঝরনাকে জীবনভর কাটাতে হয় একা একা; এমন নিঃসঙ্গ দিনে বেঁচে থাকার আনন্দ আর থাকে না, কেবল মরে যেতে ইচ্ছে করে; নিজেকে মনে হয় মৃত কাকড়ার মতো, যে সমুদ্রের ঢেউয়ে তীরে এসে ঠেকেছে, রোদে শুকিয়ে কেবল তার খোল পড়ে আছে, আহা, এমন দিন, আত্মঘাতি পেঙ্গুইনের মতো দূরে সরে যাওয়া দিন;

দৃঢ়চিত্তের কিছু ঘোড়া আছে, মনে করে সেই সঠিক, যেন জিবরাইল প্রতিদিন ওহি জানিয়ে দেয়, এই অতিঅহং তাকে অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করিয়ে দেয়, এভাবে আরো কতো কতোভাবে বিপথগামী হয়, এরা সবার আগে হাঁটে, সবচেয়ে উঁচু গলা, যেন সবার মুখপাত্র, বস্তুত প্রতিটি মানুষের আলাদা আলাদা বেদনা, পাখিদের তো নেতার প্রয়োজন পড়েনা, ঘাস ফড়িং সেও ওড়াউড়ি করে ইচ্ছা মতো; মন, কেন তুমি শ্রেষ্ঠ হতে চাও?

অভিমান বঞ্ছনায় ভরা দিন, রাগে ক্ষোভে যেন সে আত্মহত্যা করেছে, স্বজনেরা তাকে কাঁধে করে নিয়ে গেছে, মেয়েরা উলুধ্বনি দিচ্ছে, মুখাগ্নি করেছে ছেলে, অর্ধেক পোড়ার পর উঠেছে ঝড়, শ্বশান ছেড়ে পালিয়েছে সবাই— এমন দিন, হায়রে, অর্ধেক চিতা নিভে যাওয়ার মতো দিন;

পাখিরা ভুলে গেছে ডাক, ভয়ে তারা সেধেছে বাসায়, মহল্লার কুকুরগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে, না জানি কোন দুর্যোগ নেমে এলো আসমানে, সূর্য ঢেকে দিয়েছে এক রাশ ধোয়া, দুপুরে নেমে আসে রাতের আঁধার, পরমাণু বোমা ফাটল কি হিরোশিমায়? দুধের শিশুর মুখ থেকে মা স্তন বের করে নেন, পুরুষেরা আদর করা ভুলে যায় নববধূকে, প্রেয়সীর হাত ছেড়ে দেয় প্রেমিক, কিন্তু সে সব ছাপিয়ে উঠে কান্না, মানুষ মানুষকে শত্রু ভাবে, দেশে দেশে শুরু হয় যুদ্ধ; এই এক দিন, উলঙ্গ উন্মাদের মতো রাস্তায় ঘোরাঘুরি করা দিন;

খেয়া পারের নৌকা ডুবে যায়, শিকারীর জালে ধরা পড়ে পথভোলা পাখি, মাছ ধরা নৌকা হারিয়ে যায় গভীর সমুদ্রে, দোকানীরা বসে থাকে ক্রেতা নাই, শিক্ষক ভুলে যায় পাঠ, ছাত্ররা মারামারি করে, জবাই করা পশুর পেটে বেড়ে উঠে মৃত শাবক, নববধূ বাসর ঘরে আত্মহত্যা করে, গরীবেরা আরো গরীব হয়, যারা সহজে মানুষ ঠকাতে পারে—তাদের ঘরে অর্থসমাগম, ধূর্ত শিল্পীরা রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যায়, এমন দিন, মায়ের কোলে কান্নারত শিশুর মতো দিন;

শিমের বিচি যদি অঙ্কুরোদ্গম না ঘটে, তবে তার জন্য কি পোকা না খেয়ে বসে থাকবে? মাটিতে থাকলে ধরতে পারে পচন, তাই তাকে জন্মের আগে জন্মানোর জন্য লড়াই করতে হয়, অথচ শিল্পী কতোটা সহজে দেখ আসর মাতায়, জন্মের আগে পেতে চায় সম্পদ; নাম বৈরাগী, বাস্তবে ভীষণ কামুক, পুরোপুরি লোভী, যেন ধূর্ত গোখরা, মিটিমিট চোখে চারপাশ দেখে, আর ভাবে ছোবলটা মারবে কোথায়? নাম মোহন, অথচ মুখে খিস্তি ছোটে, যেন এক বন্দুক, ভেতরে গালিভরা গুলি, সুযোগ পেলেই সে যুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেলে;

অভিজাত ভোজসভা, সাধারণের প্রবেশ নিষেধ, মাথা বাসায় রেখে আসতে হবে, রাজকীয় সব খাবার বিশেষ কায়দায় খাওয়ানো হবে, যারা ভুলে মাথা নিয়ে গেছেন, তাদের মাথা কেটে রাখা হয়েছে, এই সব ভোজসভায় মাথা হারোনো আমাদের শিল্পীরা, অন্যের মাথা আছে কিনা তা তারা বুঝতে পারেন না, লেজকাটা শিয়ালের মতো দিন, এমন দিন, হায়রে, এমন দিন;

প্রজননকাল হলে পাখিরা ডাকে আর সঙ্গী খোঁজে, প্রাণিরা প্রজনন ছাড়া সঙ্গীকে জড়ায় না, এই হচ্ছে প্রকৃতির স্বাভাবিক সম্পর্ক, আর মানুষ? সে হায় আজব প্রাণি, দিন নাই, ক্ষণ নাই, ঋতু নাই, মাস নাই, প্রজনন দিন, হায়রে, প্রজনন কাল—রাতে ভীষণ শীত, দিনে অতিষ্ঠ গরম, এমন দিন, হায়রে, এমন কাল;

নীল, গাঢ় নীল, গ্রীষ্মের আকাশ, এতো বেদনা জমল কেন? এমন নীলের মতো মন নিয়ে কেউ কেউ সঙ্গীতের আসর বসায়, শ্রোতারা বোতলে ভরা কান্না বিসর্জন করে, অশ্রু পান করেন যাদুকর, দুঃখের বংশিবাদক, স্বর্গের বাগানে যারা ফুল ফোটাতো—পৃথিবীতে তারা আজ কবিতা লেখে; রোগ জ্বরা মৃত্যু আর হৃদয়ের অদম্য হাহাকার, এই সব ছুটে চলে মানুষের পিছু পিছু, তবু তাদের দিন কাটে মায়ার হাতছানিতে, একটা ছাপানো কাগজকে ভাবে জীবনের মূলমন্ত্র; কলুর মতো, মাথায় তেল নিয়ে হাটে যাচ্ছে, আর ভাবছে, তেল বিক্রি করে প্রচুর লাভ হবে, বিয়ে করবে, বাচ্চাকাচ্চা হবে, তাদের বিয়ে দিবে, নাতিনাতনি হবে, কিন্তু কোনো দিন স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করবে না, এদিকে স্ত্রী ঠিকই একদিন তার সঙ্গে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয়, অন্যমনস্ক কলু রাস্তায় হোচট খায়, সব তেল মাটিতে পড়ে যায়, এই দিন, কলুর তেল নষ্ট হওয়ার দিন;

রঙ বদলায়, মন বদলায়, মানুষ বদলায়, মুহূর্তে পাল্টে যায় জীবনের লক্ষ্য, পুরনো পথে হাঁটে না পথিক, কত সহজে ছুরি চালায় অন্যের পেটে, নিজের পেটে চালিয়ে যদি পরীক্ষা করতো? গাছের চেয়ে প্রাকৃতিক মানুষ পাবে না, একটা দিনে আরো কতো কি ঘটে, অন্ত নাই, দিনের শেষে সন্ধ্যা আসে— তবু তো দিন থাকে, আঁধার আসে, আঁধার নামে বৃষ্টির মতো, অন্ধকারের মেঘ দেখ আজ আকাশ জুড়ে, এমন দিনে প্রেম নিবেদন নিষেধ, পুরনো প্রেমের কথা রঙিন মাছের মতো ঘাই মারে মনের পুকুরে, এমন দিন, হায়রে, মন খারাপের দিন;

কলমের মতো দেখতে এক গোপন সাপ তাড়া করে, তার মুখে বিষের থলি, কিন্তু এক মন্ত্র সাপটাকে বারবার সরিয়ে দেয়, সারা জীবন কষ্টেসৃষ্টে টাকা জমিয়ে সিন্দুক ভরে কৃপণ, রাতের আঁধারে সেই সিন্দুক ডাকাত নিয়ে যায়; চিরকাল ভালোবাসার কথা বলে সঙ্গী হয়েছিল যে নারী, আশ্বিনের মেঘ দেখে সে কেটে পড়ে; আহুত যে ছিল সে মুহূর্তে হয়ে যায় অনাহুত; পরম আকাঙ্ক্ষায় যাকে পাওয়া যায়, সেই হয়ে যায় বিরক্তিকর; মনের গোপন ভাষায় গান গায় একটা চড়ুই, ছোট্ট, চঞ্চল, প্লবগ, অস্থির;

ডালিম গাছের তলা দিয়ে যায় অসংখ্য পথিক, পাকা ডালিম কুড়িয়ে পায় একজন, সে ভাবে, এটা পাওয়ার জন্য সেই যোগ্য, অন্যরা ভাবে—এই লোকটা কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল? কেনার সময় কম দাম দিবে কিন্তু বেচার সময় বেশি চায়, আর কেনার সময় ওজন বেশি চায় কিন্তু বেচার সময় কম দেয়; এই সব মানুষেরা শিল্পের আঙিনায় ব্যবসা খুলে বসে, তারা দেখেনা শোনে না বোঝে না জানে না; অথচ তাদের হাতের মুঠোয় দেখ পৃথিবী গোপন চাবি, এদের বাইরে মসৃণ ভিতরে দগদগে ঘা, দালির ছবি এদের চোখে অর্থহীন রঙমাত্র, ঝড় আসার আগে এরা আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যায়, অথচ যারা অসহায়কে বাঁচাতে ঝড়ের খবর প্রচার করে? সেই সব সতর্ককারী মানুষেরা জলোচ্ছ্বাসে ডুবে মরে, এমন দিন, হায়রে, ঝড়ের দিন—ডুবে মরা মানুষের লাশ হারানোর দিন, এমন দিন—স্বজনের কান্নার দিন;

সকালে যে বাড়ি ছিল ঐশ্বর্যে ভরপুর, বিকালে তা নদীতে বিলীন, কোথায় প্রাচুর্য? সকালে যে ছিল ধনী, বিকালে নিঃস্ব, দেখতে দেখতে মানুষ পাল্টে যায়, বর্ণচোরার মতো মুহূর্তে বদলে যায় মন, নদি, সেও পাল্টায় গতি পথ, দাবানলে পোড়ে বন, অনল ছাড়াই পোড়ে বিরহী মন;

নীরব সেও সরব হয়, সুন্দর সেও কদর্য হয়, কঠোর সেও কোমল হয়, আপন সেও পর হয়, কাছের সেও থাকে দূর, বন্ধু সেও শত্রু হয়, জীবন, তারও মৃত্যু হয়;

দিন শেষে পথিক ভাবে, সারাদিন ভুল পথে হেঁটেছে, এ যেন একটা মানুষ, শেষ জীবনের আত্মোপলব্ধি, বিগত জীবনটা সে পাপ কাজে ব্যয় করেছে, এখন তবে উপায়? সময় তো শেষ, অথচ তারা জানেনা পাপ আর পূণ্য বলে আলাদা কিছু নেই, যা পাপ—তাই পূণ্য; এক বাগানের মালির কথা বলি— শীতকাল এলে সে দেখে প্রজাপতিগুলো মরে যায়, মালি জড়সড় হয়, তার ভুলেই নিশ্চয় এটা ঘটে, এ কারণে সে অপরাধবোধে ভোগে, শ শ প্রজাপতির মৃত্যু দেখে সে আত্মহত্যা করে, অথচ প্রজাপতিরা শীতকালে মরে যায়, তাদের আয়ু শেষ বলে, মালির ক্ষমতা নাই প্রজাপতিকে বাঁচিয়ে রাখে—আর বাঁচায় নিজেকে; সন্তান অসুস্থ হলে মা কেবল সেবা করতে পারেন, সুস্থতা দিতে পারেন না, ঝড়ে ডাল ভাঙলে গাছের ক্ষমতা নাই তা রক্ষা করে, এ হলো এক জটিল ধাঁধা, হায়রে দিন—এমন ধাঁধার দিন;

এই দিন, অন্য দিনের মতো, তার পরও তা অন্যরকম, কারো মা মরে যায়, কারো সন্তান মরে, কেউ কেউ মরে যায়—যায় মরে, কেউ প্রেমিক হারায়, কোনো কালে ছিল না যা—তা খুঁজে খুঁজে হয়রান, কেউ আনন্দ খোঁজে নিরানন্দে, শান্তি খোঁজে হিংস্রতায়, ঠকঠকামির মুখে শোভে ধর্মকথা, ভিন দেশ থেকে গুপ্তচর আসে, যাদুর নামে বগল বাজায়;

একেকটা দিন যেন স্যমন্তক, আটটি যামে আট ঘরা স্বর্ণ প্রসব করে, কিন্তু সে ধন কেউ ধরে রাখতে পারে না, গভীর সমুদ্রে জলপরীদের মতো কেবল নাবিক দলকে হাতছানি দেয়, আহা, একেকটা যাম যেন ঢেউয়ে ভাঙা জাহাজের পাটাতনের একেকটা কাষ্ঠখণ্ড; আহা এমন দিন, হায়রে এমন দিন, সমুদ্রে ডুবে যাওয়া জাহাজের ঋণ;

কেউ খোঁজে পথ, নতুন না পুরাতন? জানেনা, কেউ পকেটে বিষোদ্গারের বান্ডিল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, হাতে স্বপ্ন লুকিয়ে রেখে কেউ আকাশে ঘুড়ি ওড়ায়, না খেয়ে কেউ তৃপ্তির ঢেকুর তোলে, গন্তব্যের সন্ধান পেয়েও কেউ যেতে পারে না, দিব্যি হেঁটে চলে কেউ নিজের তৈরি পথে, শুকনো পাতার ঘ্রাণ শুঁকে কেউ দিব্যি স্বর্গে চলে যায়, এইসব মানুষেরা ঘুরে বেড়ায় চারপাশে, আমি তাদের দেখি নাকি তারা আমাকে দেখে, এ নিয়ে আমি ধাঁধায় পড়ে যাই, এমন দিন, হায়রে, দ্বিধার দিন;

একটা মোমকে মনে হয় আলোকশিখা—আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ; ফলত চাঁদের আলো সূর্যের চেয়ে প্রখর মনে হয়, এমন দ্বিধায় জড়ানো দিন, দখিনা বাতাস কাঁটা বিধিয়ে দেয় ত্বকে, অদৃশ্য হায়েনারা তাড়া করে আদিম কৌমের দলছুট মানুষ ভেবে, নিজেকে গুটিয়ে রাখি নরম সবুজ পোকার মতো, সূর্যের আলোয় আমার শরীরে ফোসকা পড়ে, এমন খরার দিন, নিরন্ন দিন, ভুল পথে হেঁটে গন্তব্য খোঁজার দিন;

নদীর মতো দীর্ঘ মানুষের জীবন, আবার কেউ ভাবে খুব ছোটো, কেউ কেউ জীবনের বিশালতা বোঝার পর মুহূর্তে এর ক্ষুদ্রত্ব নিয়ে আফসোস করে; আকাশের সবচেয়ে উঁচুতে যে ঘুড়ি, সেই ঘুড়ির কথা বলি, অন্য সবার চেয়ে তার সুতা দীর্ঘ, কিন্তু মুহূর্তে তা কেটে যাওয়ার পর সুতা যেমন ছোটো হয়ে যায়, তেমনি ঘুড়িও হারিয়ে যায়;

কেওক্রাডাং পর্বত, শত বছর ধরে ছুটে চলা কাছিম, একটা দলছুট খরগোশ—এ যেন সেই গল্প, দুই বন্ধু, একজন হাঁটে আর আরেকজন দৌঁড়ায়, কেউ কাউকে পেছনে ফেলতে পারে না, দুজনের গতি লক্ষ্য অর্জন সমান, অথচ একজন অস্থির—আরেকজন পাশে দাঁড়িয়ে থাকে অচেনা অশ্বত্থ বট পাকুড়ের মতো—তবু স্থির নয়, বয়ে চলা নদীর পাশে স্নান শেষে ভেজা চুলে দাঁড়িয়ে থাকা নবীনা কিশোরী, এই গ্যালাক্সির অবিকল গতি তারও;

জেলে জাল টানে, কৃষক লাঙল বায়, রাখাল ভেড়ার পাল নিয়ে ঘাসের সন্ধ্যান করে, শহুরে চাকুরেরা ভোরে ছুটে চলে, যেমন খাবারের সন্ধানে উড়াল দেয় পাখিরা, হাঙর তাড়া করে সার্টিনদলকে, নতুন অভিযানে বের হয় নাবিকদল;

এই এক দিন, লাখ লাখ বছর ধরে বয়ে চলা দিন, এই দিন অন্য দিনের মতোই, তবু সে অন্য নয়;

 

২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬—২২ জুলাই, ২০১৭


ইলাস্ট্রেশন : নরোত্তমা



সম্পর্কিত
দোআঁশে স্বভাব জানি
প্রিয় দশ
প্রিয় দশ
সর্বশেষ খবর
নীলফামারীতে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারিসহ ৩ জন গ্রেফতার
নীলফামারীতে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারিসহ ৩ জন গ্রেফতার
পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি জাতিসংঘে তুলে ধরলো বাংলাদেশ
পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি জাতিসংঘে তুলে ধরলো বাংলাদেশ
বার্সার বিদায়ে কান্সেলোর অনাগত সন্তানেরও মৃত্যু কামনা করেছেন সমর্থকরা!
বার্সার বিদায়ে কান্সেলোর অনাগত সন্তানেরও মৃত্যু কামনা করেছেন সমর্থকরা!
পাগলা মসজিদের দানবাক্সে এবার মিললো ২৭ বস্তা টাকা
পাগলা মসজিদের দানবাক্সে এবার মিললো ২৭ বস্তা টাকা
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি