X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

সমালোচনা সাহিত্যের কতক কেজো প্রসঙ্গ ।। শেষ পর্ব

মোজাফফর হোসেন
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১২:১৪আপডেট : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১২:২০

সমালোচনা সাহিত্যের কতক কেজো প্রসঙ্গ ।। শেষ পর্ব
খ. সাহিত্য-অলঙ্কার (Literary Device) ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

কাফকা-সদৃশ (Kafkaesque)

কাফকা দেখিয়ে দিয়েছেন যে, একজন ব্যক্তির ফাইল বা নথিপত্র ঐ ব্যক্তির জায়গা জুড়ে নিয়েছে—ফাইলটাই হল আসল, ব্যক্তি তার ছায়াবিশেষ। কাফকার সাহিত্যের অন্য একটা অপরিহার্য দিক হল—অপরাধীর অপরাধ খুঁজে নেওয়া। আপনাকে জেলে বন্দি রেখে অত্যাচার করা হচ্ছে, কাজেই আপনাকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, আপনি অপরাধী। কাফকার সাহিত্য এমনটিই বলছে। সমস্যাটা শুধুমাত্র সামাজিক বা রাজনৈতিক না, মনস্তাত্বিকও বটে। অভিযুক্ত একসময় সত্যি সত্যি মেনে নেয় যে সে অপরাধী। সে নিজেই তার শাস্তির যথার্থতা আবিষ্কার করে। কাফকায় এই সমস্ত পরিস্থিতিটা মনে হবে যেন উপহাস, শুধুমাত্র উপহাসের ঐ চরিত্রগুলোর কাছে মনে হবে এটা একটা দুঃস্বপ্নের মতো। (এই উপহাসকে কুন্দেরা দেখছেন এইভাবে, ‘আমাদেরকে মানুষের মহত্ত্বের সুন্দর ইল্যুশন দেখিয়ে দুঃখবোধ সান্ত্বনা জানায়। কমিক বড়ই নিষ্ঠুর, এটা নির্মমভাবে আমাদের বেঁচে থাকার অর্থহীনতার ওপরই অর্থারোপ করে।’) কাফকা যে জগতটা চিহ্নিত করছেন সেই জগতটা অফিস আদালত ও আমলা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কুন্দেরা বলছেন যে, কাফকা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভেবে লেখেন নি। তাঁর কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল না। প্রকৃতির নিয়মেই যেন কাফকার গল্পগুলো আজ সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে। পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্র—সবখানেই আজ তা তেমনই প্রাসঙ্গিক। অন্যত্র বলছেন, ‘কাফকা আমলাতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে উঠিয়ে এনেছেন তাঁর উপন্যাসের কাব্যে। তিনি যেভাবে খুব সাধারণ একজন মানুষের অতি সাধারণ একটা গল্পকে মিথে, এপিকে রূপান্তরিত করেন, তা পূর্বে দেখা যায়নি।’ [তর্জমা : লেখক]

বর্ণনা-পদ্ধতি (The Art of Narative)

ন্যারেটিভ হলো কোন ঘটনার বিবরণ তৈরি করা। শিল্প-সাহিত্য থেকে শুরু করে প্রতিটা প্রকাশ মাধ্যমে ন্যারেটিভ থাকে। কে বলছে এবং কিভাবে বলা হচ্ছে এটি ন্যারেটিভের মূল বিষয়। পয়েন্ট অব ভিউ বা দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে ন্যারেটিভ তিন ধরনের হয়ে থাকে—ফার্স্ট পারসন ন্যারেটিভ, সেকেন্ড পারসন ন্যারেটিভ ও থার্ড পারসন ন্যারেটিভ। সাধারণত যে কোনো একটি পারসনের দৃষ্টিতে একটি গল্পকে উপস্থাপন করা হয়। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। যেমন, জোসেফ কনরাডের `হার্ট অব ডার্কনেস’ উপন্যাসে সমস্ত গল্পটা তিনজন ব্যক্তির (মূল চরিত্র মার্লো, লেখক নিজে ও নামহীন চরিত্র) ন্যারেশনে সম্পূর্ণ হয়েছে। ন্যারেটিভ যে একটা কাহিনিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তার উদাহরণ হল জাপানি চলচ্চিত্র রাশোমন। এই ছবির প্রতিটা চরিত্র ছবির এক একজন বর্ণনাকারী। একটি খুনের ঘটনাকে একে একে সবগুলো চরিত্রের প্রেক্ষাপট থেকে তুলে ধরা হয়। যে খুন হয়, তার ভূত এসেও ঘটনাটার আত্মবয়ান উপস্থাপন করে। বঙ্কিমের ‘রজনী’ উপন্যাসে আখ্যানভাগের বর্ণনা দিতে উঠে আসে চরিত্ররাই। রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে উপন্যাসটির তিনটি প্রধান চরিত্রের মুখ থেকে। দিলারা হাশেমের ‘আমলকীর মৌ’ উপন্যাসে মূলকথক লেখিকা নিজেই, মাঝে মধ্যে কথকের ভূমিকায় চলে এসেছে কেন্দ্রীয় চরিত্র সারা।  

বিন্যাস (Plot)

একটা গল্পে যে ঘটনাগুলো থাকে তার পর্যায়ক্রমিক উপস্থাপনকে প্লট বলে। অর্থাৎ প্লট মানে কাহিনি নয়, কাহিনির বিন্যাস। কার্য-কারণের প্রেক্ষিতে ন্যারেটিভ এগিয়ে যাওয়া। কথাসাহিত্যিক ইএম ফস্টার বিন্যাস এবং কাহিনির মধ্যে পার্থক্য বোঝাতে বলেছেন, রাজা মারা গেল এবং তারপর রানী মারা গেল। এটা গল্প। আর রাজা মারা গেল, সেই শোকে মারা গেল রানীও। এটা হলো প্লট। গ্রিক দার্শনিক ও তাত্ত্বিক এরিস্টটল নাট্য-সাহিত্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন প্লটকে। তিনি বলেছেন, চরিত্রের চেয়ে প্লট অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর মতে, একটি প্লটে অবশ্যই সূচনা, মধ্যবর্তী অবস্থান ও সমাপ্তি থাকবে। এবং প্রতিটি ধাপের সঙ্গে প্রতিটি ধাপ সম্পর্কযুক্ত হতে হবে। ক্লাইম্যাক্স বা চূড়ান্ত পরিণতি প্লটের একটি অংশ। উত্তরাধুনিক সাহিত্যে অবশ্য এই ঐতিহ্যগত নির্মাণ-ছক ভেঙে গেছে।

পটভূমি (Setting)

শিল্প বা সাহিত্যে বিষয়বস্তুর সময়কাল ও স্থানকে পটভূমি বা সেটিং বলে। কিংবা গল্পের সামাজিক প্রেক্ষাপটকে পটভূমি বা সেটিং বলা যেতে পারে। অর্থাৎ কখন, কোথায় এবং কোন প্রেক্ষাপটে ঘটনাটি ঘটল সেটিই এখানে বিবেচ্য বিষয়। পটভূমি একটা আখ্যানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

চিত্রকল্প (Imagery)

সাহিত্যে চিত্রকল্প হলো কোনোকিছুর প্রতীকী উপস্থাপন। চিত্রকল্পের মাধ্যমে কোনো বায়বীয় বিষয়কে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করে তোলা হয়। অর্থাৎ শব্দ দিয়ে ছবি নির্মাণ করার মতো। সাহিত্যে চিত্রকল্পের ব্যবহার থাকা অনিবার্য। প্রকৃতপক্ষে, চিত্রকল্প হলো ভাষার অবিচ্ছেদ্য অংশ। কখনও কখনও একটি কবিতায় কতগুলো চিত্রকল্প মিলে একযোগে একটি একক চিত্রকল্প হিসেবে কাজ করে।

প্রতীক (Symbol)

প্রতীক হলো কোনকিছুর আপাত অর্থের ভেতরে অন্য অর্থ নিহিত থাকা। একটা শব্দ, শব্দগুচ্ছ বা বাক্যের কয়েক স্তরে অর্থ থাকা হলো সিম্বল। কোনো বাক্যে ব্যবহৃত শব্দ যখন তার সাধারণ অর্থ ছাড়িয়ে অন্য অর্থ বহন করে তখন তা প্রতীকী শব্দ হিসেবে গণ্য হয়। যেমন, সিংহের সঙ্গে অহংকার, পায়রার সঙ্গে শান্তি, খরগোশের সঙ্গে নিরীহ, গাধার সঙ্গে বোকামি প্রভৃতি বোধ জড়িয়ে আছে।  

সিমিলি ও মেটাফর

সিমিলি হলো আপাত সাদৃশ্যহীন দুটি বিষয়ের মাঝে তুলনা করা। তবে সরাসরি নয়। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে দুটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের মাঝে তুলনা করতে অব্যয়সূচক শব্দ কনজাংশন (যেমন- মতো, যেন, যেমন ইত্যাদি) ব্যবহার করা হয়। উদাহরণ, সে বাঘের মতো গর্জে উঠল।

অন্যদিকে, মেটাফর হলো দুটি আলাদা বিষয়ের মধ্যে সরাসরি সাদৃশ্য স্থাপন করা। এক্ষেত্রে অব্যয়সূচক শব্দের ব্যবহার করা হয় না। মেটাফর এক ধরনের উপমা বা এনালজি। উদাহরণ : সে বাঘ হয়ে তেড়ে আসল।

কৃষ্ণাঙ্গদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা মার্টিন লুথার কিংয়ের বিখ্যাত ভাষণ ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’-এ সিমিলি ও মেটাফরের প্রয়োগ ভীষণভাবে লক্ষ্য করা যায়। ভাষার অলঙ্কার-বিষয়ক পাঠের জন্য এই প্রবন্ধটি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের স্নাতক কোর্সে পঠিত বলে জানি।

আখ্যানরূপক (Allegory)

অ্যালিগরি হলো মেটাফরেরই বিস্তারিত রূপ। একটা ন্যারেটিভ বা আখ্যান সামগ্রিকভাবে যখন অন্য একটা বিষয়কে উপস্থাপন করে তখন তাকে আখ্যানরূপক বা অ্যালিগরি বলে। অ্যালিগরি কয়েক প্রকারের। যেমন, সামাজিক আখ্যানরূপক বা সোশ্যাল অ্যালিগরি, রাজনৈতিক আখ্যানরূপক বা পলিটিকাল অ্যালিগরি, নীতিগত আখ্যানরূপক বা মোরাল অ্যালিগরি প্রভৃতি। এখানে উদাহরণ হিসেবে অস্কার ওয়াইল্ডের ‘হ্যাপি প্রিন্স’ গল্পের কথা টানা যেতে পারে। গল্পের আপাত-অর্থের ভেতর বেশ কটি অন্তর্নিহিত অর্থ লুকিয়ে আছে। বাংলাসাহিত্যে একটি তুলসী গাছের আত্মকাহিনী (সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ), মহাপতঙ্গ (আবু ইসহাক) প্রভৃতি গল্প আখ্যানরূপক গল্পের উপযুক্ত উদাহরণ। তবে বলে রাখা প্রয়োজন, অ্যালিগরির আলাদা উদাহরণ নিষ্প্রয়োজন, কেননা প্রতিটা সাহিত্যকর্মেরই একটা অ্যালিগরিক্যাল অর্থ থাকে।

পরোক্ষ উল্লেখ (Allusion)

অ্যালিউশন হলো, একটি সাহিত্যকর্মে ইতিহাস-মিথ-ধর্ম কিংবা অন্য সাহিত্যকর্ম থেকে উদাহরণ টানা। যেমন, বিশ্বসাহিত্যে নানাভাবে গ্রীক-পুরাণের কথা এসেছে। এসেছে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা। বাংলাদেশের সাহিত্যে এদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা অ্যালিউশন হিসেবে ঘুরেফিরে এসেছে। 

কথারূপক (Fable) ও উপরূপক (Parable)

ফেবল ও প্যারাবল লোকজসংস্কৃতি বা ওরাল ট্র্যাডিশন থেকে এসেছে। ফেবল হলো সংক্ষিপ্ত ও সরলগদ্যে কোনো গল্প উপস্থাপন করা, যার অবশ্যই একটা নৈতিক-শিক্ষা থাকবে। এবং ফেবলের চরিত্র হবে পশুপাখি, জীবজন্তু, গাছপালা বা প্রাণহীন কোনো বস্তু। তাদের বিভিন্নভাবে মানবিক গুণসম্পন্ন (পারসনিফাইড) করে উপস্থাপন করা হবে। ঈশপের গল্পগুলো ফেবলের উপযুক্ত উদাহরণ। অন্যদিকে প্যারাবল হল, অনুরূপ সংক্ষিপ্ত সরল ফিকশন; যেখানে নৈতিক-শিক্ষা থাকবে। এখানে মোটাদাগে ফেবলের সঙ্গে প্যারাবলের পার্থক্য হল, ফেবলে সরাসরি মানবচরিত্র (হিউম্যান) থাকে না, কিন্তু এখানে থাকে। প্যারাবলের উদাহরণ হল, জর্জ অরওয়েলের উপন্যাসিকা ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’। এখানে জীবজন্তুর পাশাপাশি মানুষও গল্পের চরিত্র হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। কাফকা ও বোর্হেসও বেশ কিছু প্যারাবল লিখেছেন। মহাভারত ও বাইবেল হলো প্যারাবলের আদি-উৎস। আমার ভীষণ প্রিয় একটা ফেবল হলো জেমস থার্বারের ‘খরগোশ, যারা সকল সমস্যার কারণ ছিল’।

আয়রনি

আয়রনি হল যেটা প্রত্যাশা করা হচ্ছে বা বলা হচ্ছে এবং যা ঘটছে তার মধ্যে বিরোধাত্মক সম্পর্ক। আয়রনি কয়েকধরণের : ভার্বাল বা উচ্চারিত আয়রনি, সিসুয়েশন্যাল বা অবস্থানগত আয়রনি, স্ট্রাকচারাল বা কাঠামোগত আয়রনি ও ড্রামাটিক আয়রনি। ভার্বাল আয়রনি হল, যা বলা হচ্ছে তার উল্টো করা। সিসুয়েশনাল আয়রনি হল আপাত পরিস্থিতির উল্টো পরিস্থিতি তৈরি হওয়া। যেমন, ‘দ্য গিফট অব মাজাই’ গল্পে জিম যখন হাত ঘড়ির বিক্রি করে ডেলার জন্যে চিরনি কিনছে তখন ডেলা তার মাথার চুল বিক্রি করে জিমের হাতঘড়ির জন্যে ঘড়ির চেইন কিনছে। স্ট্রাকচারাল আয়রনি হল একধরনের গঠনশৈলী এবং আখ্যানের ভেতর অন্য অর্থ তুলে আনা। জোনাথন সুইফটের ‘অ্যা মডেস্ট প্রপোজাল’ হল স্ট্রাকচারাল আয়রনির উদাহরণ। সুইফট আয়ারল্যান্ডের জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পথশিশু হত্যা করে খাওয়ার প্রস্তাবনা পেশ করছেন। স্বরটা সম্পূর্ণ বিনীত রেখে। কিন্তু তিনি যা বলছেন তা মিন করছেন না। আর ড্রামাটিক আয়রনি হল, কোনো আখ্যানে যখন চরিত্রের থেকে পাঠক বেশি জেনে যায় তখন তাকে ড্রামাটিক আয়রনি বলে। যেমন, গ্রিক ড্রামা ‘অয়দিপাউস’-এ রাজা অয়দিপাউস সাবেক রাজার হন্তাকারীকে হন্যি হয়ে খুঁজে বেড়ায়। সে জানে না, সে নিজেই ঐ রাজার হন্তাকারক। কিন্তু পাঠক শুরু থেকেই জানে।  

অপ্রত্যাশিত সমাপ্তি (Twist Ending)

অপ্রত্যাশিত সমাপ্তি ছোটগল্পের খুব জনপ্রিয় একটি চেহারা। সাধারণত পাঠক তাদের পড়া শেষ করে চমক পেতে পছন্দ করেন। অপ্রত্যাশিত সমাপ্তি বলতে বোঝায়, গল্পের প্লটের শেষের দিকে এসে হঠাৎ মোচড় নেওয়া বা বাক-বদলানোর বিষয়টি। পাঠক এক ধরনের সমাপ্তির সম্ভাবনার কথা ভেবে এগুতে থাকে আর শেষ হয় অন্যভাবে। মার্কিন ছোটগল্পের জনক এডগার অ্যালান পোর অনেক গল্পে অপ্রত্যাশিত সমাপ্তি ঘটেছে। তবে এ ধারার সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক ও’ হেনরি। হেনরির ‘গিফট অব মাজাই’ বহুল পঠিত একটি গল্প। মপাসাঁর ‘নেকলেস’ও তেমনই একগল্প। বাংলাসাহিত্যে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘টোপ’ গল্পটি পড়ে আমরা যেমন চমকিত হয় তেমনি বিষণ্ণও বোধ করি। অ্যামব্রোস বিয়েরসির ‘এ হোর্সম্যান ইন দ্য স্কাই’ ও ‘এন অকারেন্স এট অউল ক্রিক ব্রিজ’ গল্পদুটির কথা আলাদা করে স্মরণ করতে হয়। রোয়ল্ড ডালও টুইস্ট এন্ডিংয়ের জন্য বিখ্যাত। তাঁর ‘দ্য মান ফ্রম সাউথ’ গল্পটি এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।   

আত্মপোলব্ধি (Epiphany)

সাহিত্যে এপিফ্যানি হল চরিত্রের হঠাৎ কোনো উপলব্ধি বা বোধোদয়ের ঘটনা। ফিকশনের কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে যখন কোনো চরিত্র নতুন আলোয় আলোকিত হয় বা প্রজ্ঞা লাভ করে তখন সেই মুহূর্তকে এপিফেনি বলে। আইরিশ কবি ও কথাসাহিত্যিক জেমস জয়েস তাঁর সাহিত্যে ‘সাডেন-আই’ হিসেবে এপিফেনির টার্ম ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, কখনও কখনও জীবনের অতি সামান্য বিষয়ও আমাদের জীবনে এতটা প্রভাব বিস্তার করে যে আমরা তখন নতুন জীবনের স্বাদ পায়। জয়েসের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘অ্যা পোর্টেট অব এ আর্টিস্ট অ্যাজ এ ইয়াং ম্যান’-এ প্রধান চরিত্র ডেডালুস তার ষোলবছর বয়সে প্রথম এপিফেনির সাক্ষাৎ পায়। পাপবোধে ভারাক্রান্ত ডেডালুস একদিন চার্চে পাদ্রির কাছে গিয়ে কনফেশন করে। পাদরির সুব্যবহারে সে মুগ্ধ হয়ে নিজেই পাদ্রি বনে যায়। 

চেতনাপ্রবাহ (Stream of Consciousness)

এটি হল ন্যারেটিভ বা বর্ণনা-পদ্ধতির বিশেষ ধরন যেখানে সাহিত্যের কোনো চরিত্রের অন্তর্জগতের চেতনা বা ভাবনা তার মুখ থেকেই বের হয়ে আসে। লেখক সাইকোলজির এই পদ্ধতি ব্যবহার করে চরিত্রের নিজ মুখ দিয়েই তার চেতন এবং অর্ধচেতন মনে যেসব স্পষ্ট ও অস্পষ্ট ভাবনা আপাত-বিচ্ছিন্ন অনুষঙ্গ হয়ে ভেসে ওঠে তা পাঠকদের কাছে উন্মোচন করেন। এখানে ঘটনা ও কালের যৌক্তিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয় না। স্ট্রিম অব কনশাসনেসের সঙ্গে ড্রামাটিক মনোলগ বা সলিলোক্যুইয়ের পার্থক্য হল, ড্রামাটিক মনোলগে একজন উপস্থিত স্রোতা বা পাঠককে উদ্দেশ্য করে কোনো চরিত্র তার অন্তর্বয়ান তুলে ধরে। কিন্তু চেতনাপ্রবাহে চরিত্র নিজেকে উদ্দেশ্য করেই এসব আওড়াতে থাকে। জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ অথবা ভার্জিনিয়া উলফে্র ‘মিসেস ড্যালোওয়ে’ উপন্যাসে স্ট্রিম অব কনশাসনেস ন্যারেটিভ টেকনিক অবলম্বন করা হয়েছে। বাংলাসাহিত্যে জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের কিছু গল্পেও এটির সার্থক-প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। ওপার বাংলার দেবেশ রায়ের ‘পায়ে পায়ে’ গল্পটিও এই টেকনিক অবলম্বন করে লেখা।

ড্রামাটিক মনোলগ

ড্রামাটিক মনোলগ হল চরিত্রের মনের কথা পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করা। অন্যভাবে বলা যায়, চরিত্রের অন্তর্গত চিন্তা বা থট-প্রসেস পাঠকের কাছে উন্মোচিত হওয়া। চরিত্র সচেতনভাবেই কাজটি করে থাকে। ড্রামা বা নাটকের ক্ষেত্রে একে বলা হয় সলিলোক্যুই। রবার্ট ব্রাউনিংয়ের ‘মাই লাস্ট ডাসেস’, টিএস এলিয়টের ‘দি লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফক’ কিংবা শামসুর রাহমানের ‘একটি ফটোগ্রাফ’ কবিতায় ড্রামাটিক মনোলগের চমৎকার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

ডিউক্স এক্স ম্যাশিনা

ডিউক্স এক্স ম্যাশিনা হলো একধরনের প্লট-ডিভাইস যার মাধ্যমে আপাত সমাধানহীন বিষয় বা ঘটনার সমাধান তৈরি করা হয়। এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক অথবা নতুন চরিত্র, ঘটনার অবতারণা বা দৈব হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সমাধান টানা হয়। এক্ষেত্রে লেখক তাড়াহুড়ো থেকে কিংবা কিভাবে শেষ করতে হবে বুঝে উঠতে না পেরে অপ্রত্যাশিত কিছু করে বসেন। যেমন, গ্রিকনাটক ‘মিডিয়া’তে শেষের দিকের এসে মিডিয়া তার সন্তানদের খুন করার পর পালাবার কোনো উপায় না থাকলে লেখক একটি দৈব ঘটনার আশ্রয় নেন। কথাসাহিত্যে চার্লস ডিকেন্সের ‘অলিভার টুইস্ট’ উপন্যাসে এই ন্যারেটিভ টেকনিক অবলম্বন করা হয়েছে। 

তুলনামূলক সাহিত্য (Comperative Literature)

তুলনামূলক সাহিত্যে একটি সাহিত্যকর্মকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট থেকে বিশ্লেষণ করা হয়। কখনো একটি সাহিত্যকর্মের সঙ্গে অপর ভাষাভাষী এবং সংস্কৃতির সাহিত্যকর্মের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য নিয়ে একাডেমিকভাবে পাঠ করা হয়। আবার একই ভাষা এবং সংস্কৃতির দুটি সাহিত্যকর্মের মাঝেও মিল-অমিল নিয়ে পাঠ করা হয় তুলনামূলক সাহিত্য পাঠ-পদ্ধতিতে। কোনো সাহিত্যকর্মের সঙ্গে অন্যান্য শিল্পকর্মের তুলনা করাও এই পাঠের আওতাভুক্ত। তুলনামূলক সাহিত্যপাঠ থেকে আমরা বলে থাকি, বাংলা সাহিত্যের শহীদুল জহির মার্কেস-প্রভাবিত। কিংবা জাপানি কথাসাহিত্যিক হারুকি মুরাকামি ফরাসি কথাসাহিত্যিক কাফকা-প্রভাবিত। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের আলাদা কোর্স আছে। বাংলাদেশেও বিষয়টি নিয়ে ভাবা হচ্ছে। 


আগের পর্ব পড়ুন-

সমালোচনা সাহিত্যের কতক কেজো প্রসঙ্গ

 

জেড.এস.
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
লাগাতার তাপদাহে যশোরে জনজীবন দুর্ভোগে
লাগাতার তাপদাহে যশোরে জনজীবন দুর্ভোগে
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ