X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

খেলা ।। সাদাত হোসাইন

.
২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:১৯আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:২৩

খেলা ।। সাদাত হোসাইন
মজিদ মিয়া থক করে একদলা থুথু ফেললো ভেজা মাটিতে। গত কিছুদিনের টানা বৃষ্টিতে কাদা-জল হয়ে আছে বাড়ির উঠান। সে একদৃষ্টিতে সেই উঠোনের দিকে তাকিয়ে আছে।

‘আব্বা, বিষ্টিতো মনে হয় আরও দুই চাইরদিনেও কমতো না। গাঙ্গের পানিও হুমহুম কইরা বাড়তেছে। ধান খ্যাততো মনে হয় তলাইয়াই যাইব!’

মজিদ মিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো, রবিউল দাঁড়িয়ে আছে। রবিউল তার বড় ছেলে। বয়স বার। তবে এই বয়সেই বুক চওড়া হতে শুরু করেছে। বাহুর মাংসপেশি পরিশ্রমী শরীরের আভাস দিচ্ছে। সে বলল, ‘দুইদিন হয় নাই ধানের চারা লাগাইলাম, এহনই যদি গাঙ্গের পানি ছুইট্যা আইয়া জমিন তলাই দেয়, সব চারা পানিতে ভাইস্যা যাইবো আব্বা’।

মজিদ মিয়া বিড়বিড় করে বললো, ‘এতো সহজে বাঁধের রাস্তা তলাইবো না। চিন্তা করিস না’।

‘রাস্তা যদি ভাইঙ্গা যায়?’

মজিদ মিয়া শক্ত গলায় বলল, ‘এই রাস্তা আইজকার না। এর উপর দিয়া কত বন্যা আইলো গেলো, রাস্তা কোনদিন ভাঙ্গে নাই’।

‘এইবার পানির অবস্থা ভালো না আব্বা’।

মজিদ মিয়া কথা বললো না। সে বড় বড় পা ফেলে রাস্তায় উঠে এসে দাঁড়াল। রাস্তার একপাশে নদী, আরেকপাশ সবুজ ধানক্ষেত। মাত্র দুদিন হয়েছে ধানের চারা লাগানো হয়েছে। এখন এমন টানা বৃষ্টিতেই বিপদ। তারওপর বাঁধ ছুটে গেলে আর উপায় থাকবে না। একপেট-আধপেট দূরে থাক, বছর শেষে না খেয়ে উপোষ করেই মরতে হবে। বৃষ্টির তোড় বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে নদীর স্রোত। হুহু করে জল উঠে আসছে। মজিদ মিয়ার মনে হলো, বাঁধের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা রেইন্ট্রি গাছখানা থরথর করে কাঁপছে। সে দু কদম হেঁটে রেইন্ট্রি গাছটার কাছে গিয়ে আলতো হাতে গাছটার ভেজা শরীর ছুঁয়ে দিল। শুধু রেইন্ট্রি গাছটাই না, রাস্তাটাও কাঁপছে। সে ডান হাতের তালুতে গাছের শরীরটা শক্ত করে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকালো। ঘন কালো মেঘে ছেয়ে যাওয়া আকাশ। মজিদ মিয়ার হঠাৎ মনে হল, ওখান থেকে কেউ একজন খুব আগ্রহ নিয়ে তাকে দেখছেন!

এই ধানের চারা, নদীর হুহু করে বেড়ে ওঠা জল, ঘন মেঘ আর এই বৃষ্টি, এর সকলই তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছেন। যেন রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার কোন খেলা আর তিনি তার দর্শক। এই খেলার পরের অংশ দেখার জন্য তিনি প্রবল উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছেন।

শেষ অবধি বাঁধ ভাংলো না। বৃষ্টি থেমে গেলো। ঝলমলে আলো আর ফুরফুরে হাওয়ায় ভরে উঠলো ধানক্ষেত। সোনালী ধানে ন্যুব্জ হয়ে ফসলের আগমনী জানান দিল ধানের শীষ। মজিদ মিয়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিকেলের সোনারোদে স্বপ্নালু চোখ মেলে তাকিয়ে রইল ধানক্ষেত, বাঁ পাশের শান্ত নদী আর স্নিগ্ধ আকাশের দিকে। তার আবারও মনে হল, কেউ একজন তাকে দেখছে। কিন্তু সে তাঁকে দেখতে পাচ্ছেনা। অদ্ভুত রহস্যময় এক খেলা। এই খেলায় কে হারে, কে জেতে, তাতে দর্শকের কিছু যায় আসেনা। দর্শক কেবল উত্তেজনা খোঁজে, আনন্দ খোঁজে, পরিতৃপ্তি খোঁজে।

মজিদ মিয়ার ঘুম ভাংলো মাঝরাতে। সে ধরফর করে উঠে বসল। বাইরে শোশো হাওয়া বইছে। বিকট শব্দে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঘরের টিনের চাল মচমচ শব্দ তুলে উড়ে যেতে চাইছে। মজিদ মিয়া দিশেহারার মতন ঘরের দরজা খুলে দৌড়ে বাইরে এলো। উঠোনের চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো প্রলয় নৃত্য শুরু করেছে! আচমকা সাঁই করে উড়ে গেলো টিনের চাল। একটা আজদাহা গাছের ডাল ভেঙে পড়ল ঘরের উপর। মজিদ মিয়া বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে দেখল, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ভাঙা ডালের নিচ থেকে কাউকে টানছে রবিউল, ‘মা, মা, বনু, ও বনু, আব্বা...’

মজিদ মিয়া ছুটতে গিয়েও পারল না। তার আবারও মনে হল, এই উন্মত্ত ঝড়ো আকাশের অন্ধকার থেকে কেউ একজন তাকিয়ে আছেন। প্রবল উত্তেজনা নিয়ে তিনি দেখছেন রুদ্ধশ্বাস এক খেলা। সেই খেলায় রবিউল কী তার মাকে, বনু কে বাঁচাতে পারবে? মজিদ মিয়ার সোনালী ধানের শীষ কী শেষ অবধি লাল ফুলের মতন ভাত হয়ে পাতে ফুটে উঠতে পারবে? নাকি ঝরে যাবে!

গভীর রাত। মজিদ মিয়া বসে আছে ঘরের দাওয়ায়। বনুর হাত ভেঙেছে। সেই রাতের পর দিনকয় পেরুলেও বনুর ভাঙা হাতের ব্যথা এতটুকু কমেনি। রবিউল আর তার মা ভাঙা হাতের বনুকে নিয়ে কাকভোরে গিয়েছে গঞ্জে। মজিদ মিয়ার দুশ্চিন্তা হচ্ছে খুব। ক্লান্তও লাগছে। ঝড়ে লণ্ডভণ্ড জমিতে ছড়ানো ছেটানো অপুষ্ট ধানগুলোই পাখির ঠোঁটের মতন একটা একটা করে খুঁটেখুঁটে কুড়িয়েছে সে। এখন ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়ছে। খানিক তন্দ্রাও লেগে এসেছে। আচমকা চোখ মেলে তাকালো মজিদ মিয়া।

এখন কত রাত? রবিউলরা এখনো ফেরেনি?

মজিদ মিয়া উঠে দাঁড়াতে যাবে, এই মুহূর্তে তার চোখ আটকে গেলো পাশের দেয়ালে। পাশে কেরোসিনের কুপিটা জ্বলছে। দেয়ালে তেরছাভাবে পড়া আলোর মাঝখানে বসে পাখা নাড়ছে একটা গুবড়ে পোকা। বাদবাকী অংশটা অন্ধকার। মজিদ মিয়া চোখ ফেরাতে গিয়েও পারল না। সেই অন্ধকারের ভেতর থেকে সতর্ক ভঙ্গীতে বেরিয়ে এলো একটা টিকটিকি। সন্তর্পণে পা বাড়ালো। পোকাটা সামান্য নড়ে উঠল। টের পেয়েছে বোধহয়, তার ঠিক পেছনেই ওঁত পেতে আছে ভয়ঙ্কর বিপদ!

টিকটিকিটা আরও দু’কদম এগুলো। তারপর দাঁড়িয়ে রইল। তার গলা ফুলেফুলে উঠছে। বাজপাখির মতন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। যেকোন মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে সে। সে কী পোকাটাকে ধরতে পারবে?

মজিদ মিয়া উঠতে গিয়েও পারলো না। রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা নিয়ে টিকটিকিটার দিকে তাকিয়ে রইল। পোকাটা বুঝি টের পেয়ে গেল! ওই যে নড়ছে, এক্ষুণি উড়ে যাবে? ইশ!

পোকাটা নড়ল না, তার পাখায় কেবল সামান্য কম্পন দেখা গেল। টিকটিকিটা নিঃশব্দে পড়ে রইল। নির্জীব, সতর্ক, প্রস্তুত। এই বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়বে! মজিদ মিয়ার বণুর কথা মনে রইলনা, রবিউল বা তার মায়ের কথাও না। সে স্নায়ু টানটান উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো, টিকটিকিটা কী পোকাটাকে ধরতে পারবে? নাকি পোকাটা উড়ে যাবে?

কী হবে?

এক অদ্ভুত রহস্যময় রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার খেলায় বুঁদ হয়ে রইল সে। কিন্তু সে কী জানে, এই খেলা কারো জীবন মরণের হিসেব, মৃত্যু ও জীবনের ফয়সালা?

জানে সে?

পোকাটা কি জানে, তার ঠিক ঘাড়ের কাছেই ওঁত পেতে আছে মৃত্যু, কিংবা তার পাখার সামান্য ঝাপটায় লেখা আছে জীবন?

জানে সে?

সে কী জানে, কেউ একজন প্রবল উত্তেজনা নিয়ে দর্শক হয়ে তাদের দেখছে?

দেখছে জগতের আদি ও অকৃত্রিম এক খেলা!


 

আরো পড়ুন-

পুরুষ ।। অশোক দেব

জেড.এস.
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা