X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

আমার পরিচয় : জাতিসত্তার পরিচয়

ইলিয়াস বাবর
২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৮:১৭আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৮:২১

আমার পরিচয় : জাতিসত্তার পরিচয়
‘আমার ঘরে জানালার পাশে গাছ রহিয়াছে/ তাহার উপরে দুটি লাল পাখি বসিয়া আছে’—শুরু এভাবেই। রবীন্দ্রনাথের বরাত দিয়ে ৮০ বছর বয়সটাকে আমরা মাইলফলক হিসেবেই চিহ্নিত করি। কিন্তু বয়সের সংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে ক’জনেইবা পারেন জীবনকে এমন বর্ণিল আর সৃষ্টিমুখর করতে? অনেকের ক্ষেত্রে শেষ বয়েসটা গ্লানি আর অবহেলায় মোড়া হলেও ‘জলেশ্বরীর নায়ক’ সৃষ্টির উন্মাদনা নিয়েই যেন মেনে নেন জগতের নিয়ম! একেবারে জীবনের শেষমুহূর্ত পর্যন্তই এভাবে একটি ভাষার মহত্তম প্রতিনিধি এবং সেবক হয়ে থাকার বিরল সৌভাগ্য নিয়েই যেন বুকের ভেতরের রুমালটি দিয়ে আসতে যান আলোকের পথে! পুষ্পখচিত পথের পরিব্রাজক হয়ে তিনি কি আবারো জাগিয়ে দিতে চান দিবাঘুমে নিমগ্ন জাতিকে; এ-বলে—‘জাগে বাহে কোনঠে সবায়...’ অথচ এ-বদ্বীপেরই, আরো খোলামেলা করে বললে—বাংলা ভাষারই বয়েসি হয়ে তিনি থাকবেন তাঁর বিচিত্র সৃষ্টিসম্ভারে, বহুমাত্রিকতায় মোড়া সব্যসাচী হয়ে।

সৈয়দ শামসুল হক জীবদ্দশায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন—‘আমার নিজের জন্য লিখি। আমার নিজের ভেতরে যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, যা কিছু দেখছি, যা কিছু গুনছি, যা কিছু জানছি, যা কিছু পড়ছি, যা কিছু ভাবছি—সেগুলো আমাকে বলতে হবে। না বলতে পারলে আমার ভেতরটা অসুস্থ হয়ে পড়বে। কাজেই প্রথমত লিখি আমার নিজে চিকিৎসিত হবার জন্য।’ ‘নিজেকে চিকিৎসিত’ করতে গিয়ে সৈয়দ হক তাঁর হৃদকলমে চিকিৎসা দিয়ে যান মূলত একটা শক্তিশালী ভাষার বিপুল পাঠককে। নিজের অভিজ্ঞতা আর জানাশোনার মানবিকবোধকে তিনি তুমুলভাবে নাড়া দিয়ে যান ‘পরানের গহীন ভিতর’-এ ঢেউ তোলেন সফলভাবে। অজস্র লিখেছেন—বিরামহীন, একেবারে পেশাদার হিসেবে। কিন্তু তরল বলে আক্রমণ করার সুযোগ সৈয়দ হক তার পাঠককে দেন না। সমান নিষ্ঠা আর সততা দিয়ে যেন দেখিয়ে যান অমরতার ব্যবসা। আমরা—বাঙালিরা সৈয়দ হকের বিপুল সাহিত্যকর্মের দিকে সম্মান দিয়ে তাকিয়েও শুধুমাত্র ‘আমার পরিচয়’ শিরোনামধারী কবিতাটিতে নিমগ্ন হলে খুঁজে পাবো আত্মপরিচয়ের দিক-দেশনা। আইডেনটিটির সংকট কাটিয়ে উত্তর-প্রজন্মকে নির্দেশনার উপায়ই যেন বাতলে দেন কবিতাজুড়ে। সহজ-সরল, পরিচিত শব্দমালা আর ইতিহাসের মেলাবন্ধনে সৈয়দ হক আমাদের গেয়ে শোনান পরিচয়ের গৌরবদীপ্ত পরানকথা। শুধুমাত্র কবির শারীরিক প্রস্থান হয়েছে বলেই নয়—যুগে যুগে বাঙালির ফিরে যেতে হবে ‘আমার পরিচয়’-এ। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বৃন্দ পরিবেশনা কিংবা আবহসংগীতে বহুল ব্যবহৃত হলেও কবিতাটি নিজগুণে থেকে যায় বরাবরের মতোই নতুন-অর্থবহ এবং সজীব। এদিক দিয়ে বাংলাসাহিত্যের স্বল্প কিছু সার্থক কবিতার তালিকায় অনায়াসেই ডুকে যায় সৈয়দ হকের ‘আমার পরিচয়’।

তেরশত নদীর উপমায় আমরা স্থির হয়েই আছি! প্রকট বিশ্বাসের জোরেই আমরা সহাস্য উচ্চারণ করি—জালের মতো বিস্তারী নদীর সংখ্যা কতো জানো? তেরশত! সৈয়দ হক-ই আমাদের পরিচয়ে যোগ করেন স্থায়ী উত্তর। আহা, মায়াময় অক্ষর—অক্ষরেই তো কবির সাধনা! চর্যাপদ থেকে পাওয়া অক্ষরগুলো দিয়েই আমরা গেয়ে যাই সময়ের গান। এদেশের মানুষ যুগপৎ শান্ত আর দ্রোহী, পারস্পরিক ধর্মীয় মেলাবন্ধনে হয়ে উঠে মানবিক এবং উদার। পলিমাটির মানুষদের বাউলমনও কি বিস্মরণে রাখতে পারি? সেই প্রতাপশালী বারো ভূঁইয়াদের স্বাধীনচেতা মনোভাব সবসময়েই তেল-হাওয়া দেয় সার্বভৌম সত্তা অর্জনে। তিতুমীর-শরীয়ত উল্লাহর আন্দোলন, ক্ষুধিরাম-সূর্যসেনের আত্মাহুতি আমাদের ধাবিত করে দৈশিকতা অর্জনে। মহুয়ার পালা’য় মুগ্ধতা, জয়নুল-অবন ঠাকুরের চিত্রও তো উথালপাতাল করে দেন মনের জমিন! আহা—এতসব সোনায়মোড়া উপকরনের উপর দিয়েই তো আমাদের বাঙালি হওয়া! পরিচয়বলয়কে স্থায়িত্ব দিয়ে দীর্ঘায়নের পথে এগিয়ে যাওয়া...  আর আছে মায়ের ভাষা—কবি একেবারে কবিতার শুরুতেই যেমন বলেন—‘আমি জন্মেছি বাংলায়/ আমি বাংলায় কথা বলি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান—জাতির জনক; তাঁর পরিচয়েই গর্বিত হই, তাঁরই আহ্বানে বজ্রকণ্ঠে বলি জয় বাংলা! এমন সত্যের প্রতিফলনে কবিতাটি হয়ে উঠে মৌলিক চিহ্নায়নের একটি মাইলফলক। হাজার চরণচিহ্ন পেছনে ফেলে প্রেরণার সাগরে একসাথে বেঁচে-বর্তে ছবি আঁকি সাম্যের। শত্রুর সাথে লড়াই করেও—স্বপ্নের মাঝে বাস করি আমরা—অভয়ে এড়িয়ে চলি উদ্যত খড়গ। উর্বর মাটিতে শস্য যেমন ফলাই তেমনি অস্ত্রেও শান দেই প্রয়োজনের তাগিদে। একই সাথে প্রেমি এবং দ্রোহি; সৃষ্টিশীল ও হন্তারক। তবুও কেউ কেউ ভুলে যায় ইতিহাস; তারা কুলাঙ্গারের খাতায় নিক্ষিপ্ত হয় অজান্তেই; অথচ কে না জানে—আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের চেতনার সন্তান।

‘আমার পরিচয়’—শুধুমাত্র সৈয়দ শামসুল হকের শ্রেষ্ট একটি কবিতাই নয়; বাংলাসাহিত্যেরই অন্যতম সফল কবিতা। এদেশের নৃতাত্ত্বিক-লোকাচার-সংস্কৃতি-পূর্বপুরুষ—সর্বোপরি বাঙালির উৎসমুখ নিয়ে কথা বলতে হলে আমাদের অবশ্যই ফিরে যেতে হবে ‘আমার পরিচয়’-এ। এতো সৈয়দ হকের ব্যক্তিগত থাকতে পারে না আর! নিজের কথা হয়েও একটি জাতির পরিচয়ে গভীর এবং স্বার্থকভাবে গেথে হয়ে যায় সামষ্টিক পরিচয়ের বাহন। এমন কপাল, বলাবাহুল্য এমন দুর্লভ সৃষ্টিগুণেই সৈয়দ হক আমাদের আলোচনা কি কথায়, উৎসব কি আনন্দে, প্রতিবাদ কি প্রতিরোধে হয়ে উঠেন কেন্দ্রবিন্দু। এ-কেন্দ্র ঘিরেই আবর্তিত হয় শুভতার চাষ-বাস। মূলত সৈয়দ হক মুগ্ধচৈতন্যে আমাদের ভেতরকার সত্তাটিতে দখল দেন স্বোপার্জিত কাব্যভাষা আর আত্ম-অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে। ‘হাজার বছরের বাংলা কবিতা’-এ যেমন পাই—‘সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায় অবদমনজনিত চেতনা ক্রিয়াশীল বলেই তাঁর কবিতার ভাষায় মগ্নচেতনার স্রোতে প্রাধান্য পেয়েছে।’ মূখ্যত সৈয়দ হক শিল্পযাপনই করতেন। নিজের ইতিহাস সম্পর্কে পরমভাবে যত্নশীল ও সচেতন হওয়ায় কবিতায়া তিনি ফিরে যান উৎসের দিকে। শিল্পের নানা মাধ্যমে সফলভাবে বিচরন করলেও প্রধানত তিনি ছিলেন কবি-ই। হাসান আজিজুল হক এক স্মৃতিকথায় লেখেন—‘সবার আগে তিনি কবি, সেটা তিনি নিজেই বলতেন।’

স্তুতি আদায় করে তবেই সৈয়দ হক ফিরলেন অজানার দেশে—কুড়িগ্রামের পথে। শব্দের বাজিকর হয়ে নিপুন হাতে খেলে গেছেন সাহিত্যসাগরে। দীর্ঘ জীবনের অবিরাম সৃষ্টিতে তিনি মুগ্ধ করে গেছেন বাংলা ভাষাভাষিকে। ব্যক্তিগত জীবনাচারে যেমন ছিলেন স্মার্ট, তেমনি শিল্পের নানা ফর্মে চালিয়ে গেছেন নিরীক্ষা। নিজেই খুঁজে নিয়েছেন নিজের রাস্তা। পথিকৃতের ভূমিকা নিয়ে তারই ভাষা অনুকরনে আজকের তরুণ সাহিত্যকর্মিরা। তার প্রভাব গভীরভাবে প্রোথিত হয় উত্তর-প্রজন্মের সৃজন-মানসে। ‘আমার পরিচয়’এর সৈয়দ হককে আমরা বারবারই পাঠ করি। কারণ তিনিই বলে যান—‘এ বড় বাজিকর, তারে কই বড় বাজিকর/ যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর।’ অনন্তের জীবনে প্রবশের আগে কিংবদন্তি হওয়া সৈয়দ শামসুল হকের ঋণ অপরিমেয় জেনেও আমরা—পরানের গহীন ভিতর থেকে জানাই শ্রদ্ধা।

জেড-এস
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ ডিসি ও এসপিদের
উপজেলা নির্বাচনমন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ ডিসি ও এসপিদের
জিম্মিদের মুক্তির জন্য হামাসকে ১৮ দেশের আহ্বান
জিম্মিদের মুক্তির জন্য হামাসকে ১৮ দেশের আহ্বান
অডিও ফাঁস, নারীর কাছে ডিবি পুলিশ সদস্যের ‘হেরোইন বিক্রি’
অডিও ফাঁস, নারীর কাছে ডিবি পুলিশ সদস্যের ‘হেরোইন বিক্রি’
উপজেলা নির্বাচনে নেই বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল
উপজেলা নির্বাচনে নেই বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা