X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

জীবনানন্দ দাশ এখনো নতুন : সুমন রহমান

.
২২ অক্টোবর ২০১৭, ১৬:৪৫আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০১৭, ১৬:৫৩

জীবনানন্দ দাশ এখনো নতুন : সুমন রহমান আজ ২২ অক্টোবর বাংলা ভাষার শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশের প্রয়াণবার্ষিকী। এই উপলক্ষে কথা হয় কবি ও গবেষক সুমন রহমানের সঙ্গে। যিনি ইউল্যাবের মিডিয়া স্ট্যাডিজ এন্ড জার্নালিজম বিভাগের শিক্ষক। কথা বলেছেন মোহাম্মদ মারুফ।

বাংলা ট্রিবিউন : জীবনানন্দ দাশকে আপনি কিভাবে মুল্যায়ন করেন?

সুমন রহমান : জীবনানন্দ দাশ সেই ধরনের কবি- যতই দিন যায় ততই তিনি উজ্জ্বল হন। এই ধারার কবিরাই পাঠকদের মধ্যে ক্ল্যাসিকের ধারনা বাঁচিয়ে রাখেন। অর্থাৎ চিরায়ত সাহিত্য বলতে আমরা যা বুঝি- যে সাহিত্য মরে না, অনাদিকাল বেঁচে থাকে- জীবনানন্দ দাশ হলেন সেরকম ক্ল্যাসিকের উদাহরণ। জীবনানন্দ দাশ পৃষ্ঠপোষকতাহীন, মুখপত্রহীন কবি। তিনি কোনো সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন না। কিন্তু পরবর্তীকালে নিজেই আধুনিক সাহিত্যের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেন। অদ্ভূত ব্যাপার! তিনি নিজে রোমান্টিক ছিলেন না, অথচ তার ব্যাপারে তার পাঠকরা অতিমাত্রায় রোমান্টিক।

এলিয়ট রোমান্টিক আর ক্ল্যাসিকের যে দ্বিধা আধুনিক সাহিত্যের আলোচনায় প্রায় অনিবার্য ভেবেছিলেন, জীবনানন্দ ডিসকোর্সে সেরকম দেখি না। যদিও এলিয়টি পরিভাষায় জীবনানন্দ যথার্থ রোমান্টিক কবি। কিন্তু পাঠকের কাছে তার আপীল ক্ল্যাসিকের। আবার, এই আপীল নিয়ে তার পাঠকেরা যথেষ্ঠ রোমান্টিক। ফলে এলিয়ট-কথিত বিভক্তি এখানে কাজ করছে না। এইটাই তাত্ত্বিকভাবে জীবনানন্দ নিয়ে আমার সবচেয়ে আগ্রহের জায়গা।

 

বাংলা ট্রিবিউন : আধুনিকতাবাদের জায়গা থেকে তাকে কিভাবে দেখেন?

সুমন রহমান : যাকে আধুনিকতা বলা হয় কিংবা যেসব ধারণা থেকে আধুনিকতাবাদ আসে তার মধ্যে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ, ব্যক্তি স্বাধীনতা, একাকীত্ব, বিষাদ এগুলো অন্যতম। যত বেশি শিল্পায়ন হচ্ছে মানুষ তত বেশি একা হয়ে যাচ্ছে। প্রাচীন মূল্যবোধ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আধুনিকতার অনুভব আসে ঠিক এই জায়গা থেকে। আমরা জীবনানন্দ দাশের কবিতায় এসব অনুভবের পরিবেশনা ক্রমাগতভাবেই দেখি। ত্রিশের দশকে আধুনিক কবিতা লেখার চল যাদের হাত থেকে শুরু হয় জীবনানন্দ দাশ তাদেরই একজন। আধুনিকতার আরেকটা বিবেচনা হল গভীর যুক্তিবোধ। ইতিহাসবোধ। সেদিক বিচারেও জীবনানন্দ আধুনিক। অবশ্য এই আধুনিক হওয়া না-হওয়া এগুলো আমার কাছে কোনো অর্থ বহন করে না।

 

বাংলা ট্রিবিউন : বাংলা কবিতার বিকাশে জীবনানন্দের ভূমিকা কতটুকু?

সুমন রহমান : এটা বোঝার জন্য জীবনানন্দ দাশের দিকে তাকানোর দরকার নেই। নিজেদের দিকে আয়না ধরলেই হবে। জীবনানন্দ পঠন ছাড়া আধুনিক বাংলা কবিতার পঠন সমাপ্ত হয় না। আর এই পঠনের মারফত আমরা তাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করছি। তার প্রতি মুগ্ধতা বাড়ছে। তার সময়ে তিনি নানা ধরনের সাহিত্যিক বঞ্চনার স্বীকার হয়েছেন। তাকে ‘মেঠোকবি’ বলে তাচ্ছিল্যও করা হতো। ফলে আধুনিক কবিতা আন্দোলনের উজ্জ্বল সৈনিক যারা সে সময়, তারা জীবনানন্দকে কাতারভূক্ত করার কোনো উৎসাহ পাননি। ম্যাড়ম্যাড়ে কবিতা, একেবারেই স্বল্পভাষী নয়, ছন্দের পরীক্ষানিরীক্ষা নাই, শুধুই আবহমান পয়ারে বয়ে যাওয়া! ফলে, সমকালে অনিবার্যভাবেই তিনি পেছনের সারিতে। ঐ জায়গা থেকে আস্তে আস্তে আমাদের জীবনানন্দ বিষয়ক ধারণা প্রতিটি দশকে পাল্টাতে লাগলো। চল্লিশের দশকেই টের পেলাম জীবনানন্দ দাশ অপরিহার্য কবি। এবং যেটা হয় আর কি, যখনই নতুন কবিরা আসছে, তারা পুরনো কবিদের ভুলে যাচ্ছে। বা যেতে চাইছে। যেমন ধরুন, ত্রিশের দশকের কথা উঠলে কবি বলতে আমরা বুঝতাম সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, অমীয় চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সমর সেন। ঐ সময়ের বোঝাপড়ায় জীবনানন্দ তাদেরই পেছনের সারির একজন কবি ছিলেন। কিন্তু যত দিন যেতে থাকলো আমরা তাদেরকে ততই ভুলে যেতে থাকলাম, কিন্তু জীবনানন্দ এখনো নতুন। ফলে বাংলা কবিতার পরবর্তী যে ভ্রমণ সেই ভ্রমণটা জীবনানন্দের নান্দনিকতা এড়িয়ে আর হওয়া সম্ভব হল না। এখনও যদি কোন সমসাময়িক কবিকে প্রশ্ন করেন, সে যদি তার বাংলা কবিতায় ভ্রমণের ইতিহাস বলেন, তো সে জীবনানন্দ থেকেই শুরু করতে চাইবে। জীবনানন্দ একটি মাইলফলক।

 

বাংলা ট্রিবিউন : জীবনানন্দ দাশ কতটা জনপ্রিয় হয়েছেন?

সুমন রহমান : কবিরা অনেক কবিকে মনে রাখেন। কিন্তু পাঠকরা খুব বেশি কবিকে মনে রাখেন না। পাঠকরা জীবনানন্দকে বেশি মনে রাখেন। কবিরা তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। যেমন তার নন্দন থেকে, তেমনই তার ব্যক্তিজীবন থেকে। তিনি ব্যক্তিজীবনে একজন ব্যর্থ মানুষ। তার বৈষয়িক জীবনের ব্যর্থতা এবং কবিতার বিষাদ মিলিয়ে তিনি একটা দারুণ পরিবেশনা আমাদের সামনে হাজির করেন। ব্যক্তি জীবনানন্দ দাশ এবং কবিতার জীবনানন্দ দাশ- দুটো মিলে যে নান্দনিক সংহতি আমাদের সামনে হাজির হয়, সেটা জীবনানন্দকে আরও বেশি জনপ্রিয় করে এবং করবে।

 

বাংলা ট্রিবিউন : তাকে কেমন কবি মনে করেন?

সুমন রহমান : ক্লিশে শোনালেও জীবনানন্দ দাশ গভীর অর্থে একজন দার্শনিক কবি। ইতিহাস সচেতন দার্শনিক কবি। তিনি তার চিন্তাকে কবিতায় প্রকাশ করতে চেয়েছেন। তার কবিতায় দর্শন আর ইতিহাস সর্বক্ষণ এক ধরনের ডুয়েলের মধ্যে থাকে। দর্শনটা গভীর আশাবাদের আর ইতিহাসবোধ অনিবার্য দুঃখের। বা কখনো দার্শনিক হতাশাকে তাড়াতে তিনি ইতিহাসের ‘শতজলঝর্ণার ধ্বনি’ শুনতে বসে যান। এই লড়াই আধুনিকতাবাদের গভীর শেকড় থেকে উঠে এসেছে, এবং বিষাদে তার অনিবার্য পরিণতি। যাকে অনেকেই ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’ হিসেবে শনাক্ত করেছেন।

 

বাংলা ট্রিবিউন : আপনি কখন জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়তে শুরু করেন?

সুমন রহমান : এটা অন্য সবার মতো একই রকম। স্কুলে পড়ার সময়ে দু’একটা পড়েছি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিকে সিরিয়াসলি পড়তে শুরু করি। যখন কবিতা লেখার চর্চা শুরু করি, তখন জীবনানন্দ আরও বেশি প্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে।

 

বাংলা ট্রিবিউন : আপনি তার দ্বারা প্রভাবিত?

সুমন রহমান : তিনি সম্ভবত তার পরবর্তীকালের সব কবিরই অনুপ্রেরণার উৎস। সেটা শুধু কবিতা দিয়েই নয়। কবিতা ও জীবনের একটা ট্র্যাজিক যৌথতা দিয়ে। এটা খুব দারুণ অনুপ্রেরণার একটা ব্যাপার যে, এরকম উৎকৃষ্ট একজন কবি এতটাই অর্থশূন্য, স্বীকৃতিশূন্য, অবহেলিত এবং পারিবারিকভাবে নিগৃহীত একটা জীবন যাপন করে গেছেন। এরকম সংকটের মধ্যে থেকে সাহিত্য চর্চা করে যাওয়াটা অতিমানবের কাজ। ফলে পরবর্তী প্রজন্মের কবি-লেখকেরা যখনই জীবনের টানাপোড়েনের মধ্যে পড়েন, জীবনানন্দ তাদের জন্য বরাভয় হয়ে ওঠেন।

এটা আমি ব্যক্তিগত প্রভাবের কথা বললাম। সাহিত্যিক প্রভাবও নিশ্চয়ই কোথাও কোথাও আছে। যেমন, উপমা। জীবনানন্দ সেই যে বলেছিলেন ‘উপমাই কবিত্ব’-এটা আমি আজো বিশ্বাস করি। আশির দশকে বাংলাদেশের কবিতায় যে বাঁকবদল ঘটল, তার অনেকগুলো আলামতের মধ্যে একটি ছিল, উপমার বদলে উৎপ্রেক্ষা বেশি ব্যবহার করা। আমি ব্যক্তিগতভাবে ওটা করিনি। উপমা এখনো আমার কাছে দারুণ একটি ব্যাপার মনে হয়। আর প্রভাবের বিষয়টা এরকম বিচ্ছিন্নভাবে বোঝা অনেক সময় কঠিন।

যেমন ধরুন, জীবনানন্দের অনেক প্রবণতা আমাদের মধ্যে হয়ত উৎপল, বিনয় কিংবা আল মাহমুদ মারফত আমাদের চর্চায় প্রবেশ করেছে। সেটাকে আলাদা আলাদাভাবে শনাক্ত করতে গেলে তো ফরেনসিক পরীক্ষা করতে হবে। প্রভাব বহুজনেরই থাকবে, কিন্তু দিনশেষে আপনাকে আপনার কবিতাই লিখতে হবে। কবিতার মধ্যে যদি আপনার সামান্য স্বতন্ত্র স্বর হাজির থাকে, আর তার যদি নান্দনিক মূল্য থাকে, সেই প্রভাব আপনার গলার কাঁটা হয়ে উঠবে না। আপনার সেটা লুকাতে হবে না।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা বিলে ভোট আজ
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা বিলে ভোট আজ
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা