X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রতিশ্রুত ভূমি, ইসরায়েল রাষ্ট্র এবং পরিচয়ের রাজনীতি ।। পর্ব-১

আবুল হাসান রুবেল
২৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৪:৩১আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ২৩:২৫

প্রতিশ্রুত ভূমি, ইসরায়েল রাষ্ট্র এবং পরিচয়ের রাজনীতি ।। পর্ব-১
আমাদের জীবদ্দশায় তো বটেই সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসেই সবচেয়ে প্রলম্বিত সংকট প্যালেস্তাইন-ইসরায়েল সংকট। সম্প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী স্বীকৃতি এবং সেখানে দূতাবাস স্থানান্তরের ঘোষণা দুনিয়া জুড়ে যেমন প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে, তেমনি সংকটকেও দিয়েছে নতুন মাত্রা। এর মাধ্যমে প্যালেস্তাইনের জনগণের ওপর নতুন করে নিপীড়ন, জবর-দখলের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে একদিকে, অন্যদিকে শান্তি প্রক্রিয়াকে তা এক অনতিক্রম্য বাধার মুখে ফেলেছে। কিন্তু কেন হঠাৎ ট্রাম্পেরএই ঘোষণা? এর বাস্তব আর প্রতীকী গুরুত্বই বা কতটুকু?

প্রথমেই মনে রাখা দরকার ট্রাম্প ক্ষমতাসীন হয়েছে পরিচয়ের রাজনীতির ওপর ভর করে, ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে। ট্রাম্পের ভোটদাতাদের মধ্যে একটা বড় অংশ ইভানজেলিকাল ক্রিশ্চিয়ান। যাদের সংখ্যা ৫০ মিলিয়নের কম নয়। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে সাদা ইভানজেলিকদের মধ্যে ৮২ ভাগ বিশ্বাস করে ঈশ্বর ইহুদিদের ইসরায়েলি ভূমি দিয়ে গেছেন, যে কথা আমেরিকান ইহুদিদের ভেতর মাত্র ৪০ ভাগ বিশ্বাস করে। তারা আরও বিশ্বাস করে হয় গোটা জেরুজালেম ইহুদিদের হস্তগত হবে, একটা সভ্যতার যুদ্ধ সংঘটিত হবে, হয় তারা সকলেই খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করবে, না-হয় ঈশ্বরের ক্রোধে মারা যাবে। সাধারণভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জেরুজালেমে দূতাবাস স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত খুব জনপ্রিয় হয়নি। এর পক্ষে গড় জনসমর্থন মাত্র ৩১ ভাগ, এমনকি ইহুদিদের ভেতরে বিরাট অংশ এর সমর্থক নয়। কিন্তু ইভানজেলিকাল ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো ট্রাম্পের মঙ্গল কামনায় রীতিমত প্রার্থনা করছে, তাকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ হিসাবে প্রচার করছে। অন্যদিকে যারা এর সমর্থক নয় তারা এই সিদ্ধান্তের জোর বিরোধিতা করছে না। তাদের বেশিরভাগেরই এতে তেমন কিছু আসে যায় না। আর এর ফাঁক গলেই একটা বিশেষ অংশকে তার স্থায়ী সমর্থক ও ভোটার বানিয়ে নিচ্ছে ট্রাম্প শিবির।  পরিচয়ের রাজনীতির মজাটা এখানেই, বেশিরভাগ মানুষের স্বার্থের পক্ষে না হয়েও, এমনকি তার মতের পক্ষে না হয়েও তা জনপ্রিয় হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। শুধু এই ভোটারদের নয় ট্রাম্প এর মাধ্যমে ইসরায়েল লবির পক্ষে তার জোরালো অবস্থানও প্রমাণ করল।  ট্রাম্প এর ইভানজেলিক সমর্থকরা তাকে সত্যের সাধক, নির্ভিক নেতা, ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র হিসাবে নানা ভাবে প্রচার করছে। অনলাইনে প্রেয়ার গ্রামের একটা সাম্প্রতিক পোস্টে বলা হচ্ছে, ইসরায়েলের নানা দোষ, বিশ্বাসহীনতা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যদি আমরা তার পক্ষে থাকি, ঈশ্বর আমাদের সহায় হবেন। যখন সারা দুনিয়া চিৎকার করছে, তখন ডোনাল্ড ট্রাম্প যিনি তার মায়ের কাছে ঈশ্বরের অনুগ্রহ সম্পর্কে জেনেছেন তিনি বিরূপ প্রতিক্রিয়াকে উপেক্ষা করে সরল কিন্তু সঠিক কাজটি করার শৈল্পিক দক্ষতা অর্জন করেছেন। জেরুজালেম প্রেয়ার নামে এটা লক্ষ লক্ষ ছাড়া হয়েছে। আর এসব তাৎক্ষণিক লাভের বাইরেও আছে জেরুজালেমের প্রতীকী গুরুত্ব। আর এই সিদ্ধান্তের ফলে যদি কোনো অস্থিরতা তৈরি হয় তাতে অস্ত্র বিক্রির মুনাফাটা হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোরই। মধ্যপ্রাচ্যে চিরস্থায়ী অগ্নি জ্বালিয়ে রাখার ক্ষেত্রে অস্ত্র ব্যবসা তো চির পুরোনো অথচ চির নতুন ঘটনা।

আসলে গোটা বিষয়টাতেই রাষ্ট্র, রাজনীতি, ধর্ম, ইতিহাস, মিথ, বাণিজ্য ইত্যাদি এমন জড়াজড়ি করে আছে যে কে কাকে পরিপুষ্ট করছে সেটা চেনাই কঠিন। মার্কিন জরিপের ফলাফল আমরা দেখলাম খোদ জেরুজালেমে যদি জরিপ চালানো হত তাহলে ফলাফল আসলে কেমন হত? আদর্শ, বিশ্বাস নির্বিশেষে প্রায় সকল আরব মুসলমানকেই এটা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি করবে, তারা এর শিকার কাজেই তারা সাধারণভাবে এর বিপক্ষে থাকবে সেটা ধরে নেয়া যায়। তারা এখন জেরুজালেমের জনসংখ্যার ৩৭ ভাগ। আরব খ্রিষ্টান ১ ভাগ। বাকি ৬১ ভাগ ইহুদি।  মোট জনসংখ্যার ২৩.৫২ ভাগ নিষ্ঠাবান গোঁড়া ইহুদি, যারা ইজরায়েল রাষ্ট্রের ধারণা ও জেরুজালেম রাজধানীর ধারণা ইহুদিদের জন্য আত্মঘাতী মনে করে। বাকি ৩৭.৫ ভাগের মধ্যে ইহুদিবাদী ও উদারপন্থী প্রায় সমান সমান।  অর্থাৎ এই পদক্ষেপের কড়া সমর্থক খুব কমই পাওয়া যাবে সেখানেও। আসলে প্রকৃত জনসমর্থন নয় এই সিদ্ধান্তের আসল শক্তি নিহিত মিথে। প্রতিশ্রুত ভূমির ‍মিথ।  তাড়া খাওয়া জাতির মিথ। যে মিথকে ঘিরে গোটা ইজরায়েল রাষ্ট্র ও তার ইতিহাসের পাঠ তৈরি হয়েছে। এমনকি প্যালেস্তাইন সমর্থক ইতিহাসকার, বুদ্ধিজীবীরাও অনেকক্ষেত্রে যাকে বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করেছেন।

সাধারণভাবে ইহুদিদের সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে এবং এটা প্রায় বিশ্বাসের স্তরে পৌঁছেছে যে, ইহুদি জাতির ইতিহাস বল প্রয়োগের মাধ্যমে স্থানান্তরের ইতিহাস। তারা পিতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে ক্রমাগত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে চলেছে। ধর্মীয় ব্যাখ্যা অনুযায়ী এটা ঈশ্বরের অবাধ্যতার পাপের ফলাফল। আর ইহজাগতিক ব্যাখ্যা অনুসারে নানা সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় কারণের ফলাফল। আর এই পিতৃভূমি বা আদিভূমি হলো জেরুজালেম তথা ইসরায়েল। ইসরায়েলকে সম্পর্কিত করা হয় ওন্ড টেস্টামেন্টে ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ভূমির ধারণার সঙ্গে। আর ইহুদি ধর্মে এই প্রতিশ্রুত ভূমির ধারণা অনেকটাই কেন্দ্রীয়। গোটা তাওরাতে ৪র্থ সর্বোচ্চ বার উচ্চারিত শব্দ হলো প্রতিশ্রুত ভূমি। জায়নবাদীদের দিক থেকে যেমন, তেমনি তার বাইরেও ইসলায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার একটা চল আছে। কিন্তু আদতে আধুনিক রাষ্ট্র হিসাবে ইসরায়েলের গঠনের সঙ্গে এই প্রতিশ্রুত ভূমি বাস্তবায়নের সম্পর্ক কতটুকু? কীভাবে একটা ধর্মীয় ধারণা একটা আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি হয়ে উঠল? কীভাবেই বা তা গ্রহণযোগ্য হলো? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজলে আমরা অনেকগুলো কৌতুহলোদ্দীপক ধারণা ও বাস্তবতার মখোমুখি হব।
এক্ষেত্রে প্রথমেই জায়নবাদ বিষয়ে কিছু প্রাথমিক আলোচনা করে নেয়া দরকার। জায়নবাদ শব্দটি এসেছে জায়ন (বা জিওন) শব্দ থেকে যা জেরুজালেমকে নির্দেশ করে। নানা ভাবে ইহুদি জাতি, ইহুদি রাষ্ট্রের বিষয়ে, তাদের আধুনিক দুনিয়ায় খাপ খাওয়ানো বিষয়ে উনিশ শতকের প্রথম দিক থেকেই আলোচনা শুরু হলেও তা একটা আকার পেতে সময় লেগেছে। ১৮৪৫ সালে ইয়োহুদা হাই আলকালাই জেরুজালেমে প্রত্যাবর্তনের ধারণাকে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের কর্মসূচিতে পরিণত করার প্রক্রিয়া শুরু করেন এই বলে- পরিত্রাণকারী (মেসিয়াহ) কোনো ব্যক্তি নন বরং একটা প্রক্রিয়া। ইহুদিদের কর্মকাণ্ড দিয়েই এর শুরু হতে পারে। আমাদের সংগঠিত হতে, নেতা নির্বাচন করতে এবং নির্বাসন থেকে ফিরে আসতে হবে। তার মত আরো অনেক ইহুদিই ঘেটো থেকে বেরিয়ে সমাজের মূল ধারায় মিশে যাবার ক্ষেত্রে জোর দেন সে সময়। তবে এইসব ধারণা, নড়াচড়াকে সূত্রবদ্ধ করে একটা ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের নিয়ে যাবার জন্য হার্যেলকেই জায়নবাদের জনক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। জায়নবাদের মূল প্রকল্প হলো ইহুদি জাতি এবং তার জন্য একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।
নিষ্ঠাবান ইহুদিরা প্রথম থেকেই জায়নবাদী প্রকল্পে সন্দিহান ছিল এবং এমনকি তারা একে অ-ইহুদি, ইহুদি বিরোধী প্রকল্প হিসাবে চিহ্নিত করেছে। নিষ্ঠাবান ইহুদিদের মতে প্রতিশ্রুত ভূমির সঙ্গে জাগতিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোনো সম্পর্ক নাই। যে পাপের ফলে ঈশ্বর ইহুদিদের হাত থেকে পবিত্র ভূমি কেড়ে নিয়েছেন তা থেকে মুক্ত হতে অবিরাম আত্মশুদ্ধি, তোরাহ পাঠ, ঈশ্বরের কাছে কৃপা প্রার্থনা ছাড়া কোনো পথ নাই। ঈশ্বরের আদেশেই তারা পবিত্র ভূমি পেয়েছে, তিনিই তা কেড়ে নিয়েছেন এবং তিনিই তা ফিরিয়ে দেবার একমাত্র অধিকারী। তিনি সন্তুষ্ট হয়ে যখন একজন পরিত্রাণকারী (মেসিয়াহ) পাঠাবেন তিনিই সমস্ত ইহুদিদের একত্রিত করবেন এবং জগতব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন। এখানে অন্য জাতির সঙ্গে হানাহানির কোনো প্রশ্ন নেই। ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে তা শুধু অন্য জাতির সঙ্গে হানাহানিই বাড়িয়ে দেবে না, তা ইহুদি জাতির আক্রান্ত হবার সম্ভাবনাও বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু নিষ্ঠাবান ইহুদিদের বিরোধিতা সত্ত্বেও জায়নবাদীরা শুধু টিকেই থাকেনি বরং দিনে দিনে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। নিষ্ঠাবানদের অভিযোগ তারা জোর করে ইহুদিদের জায়নবাদীতে রূপান্তরিত করেছে। এই জায়নবাদীদের নিষ্ঠাবানরা কিন্তু খামোখাই ধর্মবিরোধী বলেনি বরং তাদের অনেকেই খোলাখুলি ধর্ম বিরোধিতার কথা বলেছে। পুরোনো হয়ে যাওয়া ধর্মীয় ধারণাকে পরিত্যাগ করার কথা বলেছে। এমকি ১৮৯৫ সালে দ্বিতীয় ইহুদি সম্মেলনে হার্যেল ইসরায়েল বাদ দিয়ে উগান্ডায় বসতি স্থাপনের কথা বলে প্রায় নেতৃত্ব হারাতে বসেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য তিনি তা সংশোধন করে নেন। আসলে গোটা ইহুদি সম্প্রদায়কে একত্রিত করার ক্ষেত্রে পবিত্র ভূমির ধারণা ছাড়া অন্যকোনো অস্ত্র তাদের হাতে ছিল না।

ইসরায়েল রাষ্ট্র ইহুদিদের কাছে তাদের আত্মার সম্পূর্ণতার প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। জায়নবাদে ইসরায়েলের ভূমির সঙ্গে ইহুদিদের সম্পর্ককে প্রাকৃতিক হিসাবে চিহ্নিত করে নির্বাসনকে চিহ্নিত করা হয়েছে অপ্রাকৃতিক, বিচ্ছিন্ন, ত্রুটিপূর্ণ সত্তা হিসাবে। আর ইসরায়েলকে গড়ে তোলা, কঠোর শ্রম দিয়ে ফসল ফলানো এগুলোকেই চিহ্নিত করা হলো নতুন ধর্মাচার হিসাবে। শাপিরা বা তেইতেলবাম এর মত জায়নবাদ বিরোধীরা এই পুরো ঘটনাকেই বিবেচনা করেছেন ঈশ্বরের আদেশের বিরোধিতা হিসাবে। নির্বাসনের কষ্ট ভোগ না করা এবং জাগতিক উপায়ে তা থেকে মুক্তির চেষ্টা তাদের কাছে ছিল ধর্মদ্রোহিতা। এমনকি হলোকাস্টও তারা বিবেচনা করেছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ ইহুদি জনগণকে ধর্মদ্রোহিতার পথে প্রলুব্ধকারী জায়নবাদী পাপের ফলাফল হিসাবে। অন্যদিকে হেরেদিমের কাছে ইসরায়েল রাষ্ট্রও স্রেফ নির্বাসন, বিচ্ছিন্নতা এবং ঈশ্বরের কাছে থেকে দূরে সরে যাবারই নিদর্শন এবং হলোকাষ্ট এর অর্ন্তনিহিত আবশ্যিক বৈরিতাকেই তুলে ধরেছে। কিন্তু জায়নবাদ বিরোধীদের এসব বিরোধিতার ধর্মীয় এবং প্রাচীনপন্থী ভিত্তি গরিব, নতুন জীবন পাওয়া ইহুদিদের ভেতরে দ্বিধা আনলেও জাগতিক স্বাচ্ছন্দ্যের তোড়ে প্রায় উবে গেছে। বরং জায়নবাদীরা ইসরায়েল রাষ্ট্রকেই ইহুদিদের ঐক্যের একমাত্র প্রতীক আকারে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।

এমনকি হলোকাস্টও ইহুদি রাষ্ট্রের দাবিকেই শক্তিশালী করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই ইহুদি জাতির ধারণাটা আসলে কতটুকু বাস্তব আর কতটুকু তৈরি করা? সত্যিই কি ইহুদি জাতি একসময় একত্রে প্যালেস্তাইনে বসবাস করত? কেন তারা ছাড়িয়ে পড়ল? তেলআভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ড. শ্লোমো স্যান্ড তাঁর ‌দি ইনভেনশন অফ জিউইস পিপল” গ্রন্থে ইহুদি জাতির ধারণাকে একশত বছরের বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বিপুল পরিমাণ ঐতিহাসিক ও প্রত্মতাত্ত্বিক তথ্যাদি দিয়ে প্রমাণ করেছেন তাড়া খেয়ে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া আদি ইহুদি জাতির অস্তিত্ব কখনোই ছিল না। এক শতাব্দির সামান্য বেশি সময় আগেও ইহুদিরা তাদের ইহুদি ভাবত কেবল ধর্ম বিশ্বাসের কারণে। ভাষাগত মিল, নৃ বা গোষ্ঠীগত সমরূপতা, একই পিতৃভূমির সন্তান বা এরকম কোনো কারণের অস্তিত্ব কখনোই ছিল না এখনও নেই । বিংশ শতাব্দীর শুরুতে জায়নবাদীরা কেবল ধর্মীয় অস্তিত্বের ধারণাকে বাতিল করে ধর্মের বাইরেও ইহুদি জাতির অস্তিত্ব দাবি করে একটা জাতীয় ইতিহাস দাঁড় করানো শুরু করে। আসলে আধুনিক জায়নবাদীদের ইহুদি রাষ্ট্রকে বৈধ প্রতিপন্ন করতে এছাড়া কোনো উপায় ছিল না। বর্তমান ইসরায়েলে ইহুদি সমাজতত্ত্ব, বিজ্ঞান, বা অন্য কোনো বিষয় না থাকলেও ইহুদি ইতিহাস বলে আলাদা বিষয় আছে এবং সেখানে কেবল জায়নবাদী ইতিহাসেরই প্রবেশাধিকার আছে। এটাকেই দুনিয়াব্যাপী ছড়ানো হয়েছে। ফলে শুধু ইসরায়েলিরা নয় গোটা দুনিয়াই এখন ইহুদিদের ইতিহাস বলতে তার জায়নবাদী ব্যাখ্যাকেই চিনতে শিখেছে। একইভাবে জায়নবাদীরা প্রতিশ্রুত ভূমির ধারণাও পরিবর্তন করা শুরু করে কেননা ধর্মীয় ধারণা অনুযায়ী তা ছিল প্রার্থিত ভূমি, বসবাসের জায়গা নয়। ইহুদিরা এতকাল সেখানে যায়নি যেতে পারেনি বলে নয়, বরং সেখানে যেতে তাদের নিষেধ করা হয়েছে বলে এবং ধর্মীয় ধারণা অনুযায়ী একজন পরিত্রাণকারীর মাধ্যমেই কেবল নির্বাসনের অবসান হতে পারে। যাহোক নির্বাসনের ধারণা ছাড়া ইহুদিদের কল্পনা করাও কঠিন এটা এমনভাবেই ইহুদি বিশ্বাসের সঙ্গে গেঁথে আছে। কিন্তু ড. স্যান্ড বলছেন, এই নির্বাসন আধ্যাত্মিক কোন শারিরীক নির্বাসন নয়। এই ধরনের নির্বাসনের একটাও ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। তিনি বলছেন, ‘‌অন্যান্য ইসরায়েলিদের মত আমিও বিশ্বাস করতাম ইহুদিরা জুডায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীরা যাদের ৭০ খ্রিষ্টাব্দে রোমানরা তাড়িয়ে দিয়েছে।’ কিন্তু এর পক্ষে কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। ড. স্যান্ড নির্বাসনের ধারণাকে প্রথম যুগের খ্রিষ্টানদের আমদানি বলে মনে করেন যার উদ্দেশ্য ছিল ইহুদিদের খ্রিষ্ট ধর্মে ধর্মান্তর। ড. স্যান্ড দেখিয়েছেন সে সময় প্যালেস্তাইনে বসবাসকারী ইহুদিরা ছিল মূলত কৃষিজীবী এবং তারা সেখানেই বসবাস করছিল। রোমানরা কাউকেই তাড়িয়ে দেয়নি। তাহলে তারা এভাবে ছাড়িয়ে পড়ল কীভাবে? প্রধানত ধর্মান্তরকরণের তাগিদে। সে সময় ইহুহি ধর্ম ধর্মান্তরকরণের ব্যাপারে প্রবলভাবে উৎসাহী ছিল। সে সময়ের রোমান সাহিত্যেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ইহুহিরা সে সময় ধর্মান্তরকরণের জন্য বিভিন্ন দিকে গিয়েছে বিশেষত ইয়েমেন ও উত্তর আফ্রিকায়। কয়েক শতক পর খাজার রাজ্যের (যা এখন দক্ষিণ রাশিয়ায়) একটা বিরাট অংশের লোকের ইহুদি ধর্মে গণধর্মান্তরের ঘটনা পাওয়া যায়। এটাই মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের আসকেনযাই ইহুদিদের জন্মের ইতিহাস। কিছুদিন আগে রাশান প্রত্মতত্ত্ববিদরা এর রাজধানী আবিষ্কার করলেও ইসরায়েলের ইতিহাসের প্রেক্ষিতে এর গুরুত্ব তেমন আলোচিত হয়নি। এমনকি কোরআনে মক্কা ও মদিনায় ইহুদিদের উপস্থিতি এবং সেখানকার অধিবাসীদের ইহুদি ধর্মে দীক্ষা দেবার চেষ্টার কথা উল্লেখ আছে। প্রাচীন গ্রন্থগুলোতে ইহুদিদের যে উপস্থিতির উল্লেখ আছে সেখানে তাদের সমৃদ্ধ, ধনবান, ক্ষমতার কাছাকাছি লোক হিসাবেই পাওয়া যায়, তাড়া খাওয়া উদ্বাস্তু নয়। সেক্ষেত্রে যদি প্রায় সকল ইহুদিই প্যালেস্তাইনে থেকে যায় তাদের কি হল? আসলে এদর একটা বড় অংশই ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়ে গিয়েছিল, যাদের উত্তরসূরিরা আজও সেখানকার অধিবাসী। ‌ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়নের বক্তব্যেও এর স্বীকৃতি আছে।
(চলবে)

 

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা