X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

রূপালি সৈকতে আলমগীর কবির

আনিস পারভেজ
২৬ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৩:২২আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৩:৩১

রূপালি সৈকতে আলমগীর কবির

সৈকত থেকে তিনি জলেই চলে গেলেন ২০ জানুয়ারি ১৯৮৯, যমুনা তখন সূর্যকে গিলে নিচ্ছে। শীতের রাঙামাটি, ১৯৩৮, নিরিবিলি শহরে সমতলের বাঙালি হাতে গোনা, সেখানে ২৬ ডিসেম্বর জন্ম নিয়ে আলমগীর কবির মাত্র একান্ন বছর আমাদের জগতে কাটিয়েছেন একটি যন্ত্র দানবের আচমকা ধাক্কায় তাঁর গাড়ি জলে ডুবে যাওয়া পর্যন্ত। জল থেকে তোলা হল তাঁর দেহ—নিথর; তিনি পৃথিবীর সৈকত থেকে যাত্রা করেছেন অজানা ও শূন্যতার অরূপে। পেছনে রেখে গেছেন কিছু রূপ—তার সৃষ্টি, প্রধানত সিনেমা এবং তার সাথে মুদ্রিত লেখা, যা বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সেন্স নির্মাণে প্রধানতম নির্ণায়ক। আলমগীর কবির বাংলাদেশের শুদ্ধতম সিনেমাকার—বানিয়েছেন সিনেমা, শৈলী ভেঙে নতুন শৈলী তৈরি করেছেন, সিনেমা নিয়ে লিখেছেন, তরুণদের উদ্দীপিত করেছেন সিনেমার স্বপ্নে এবং তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন ধাবমান ইমেজের ভুবন তৈরির এবং তার জন্য সাংগঠনিক ক্ষমতার উত্তরণের।

এদেশে বহুকাল, এখনো কেউ কেউ, সিনেমাকে বই বলে। গল্প বলার ঢং ছিল, এখনো আছে, সাহিত্যের প্রকরণে; বাড়তি ছিল গান ও নাচ, যা গল্পের বইয়ে থাকে না। কলকাতার ধাবমান ইমেজের বই এদেশের সিনেমার প্রারম্ভিক সময়ে রেফারেন্স হিসেবে কর্তৃত্ব করেছে। সিনেমা, অর্থাৎ সেই বই, ছিল একমাত্র গণবিনোদন। সিনেমা দেখা ছিল উৎসব, পরিবার হল্লা করে সিনেমা দেখত। গণ-আলাপের অনেকটা জুড়ে থাকতো সিনেমা—“কি চমৎকার বইটা দেখলাম, গানগুলো এখনো কানে বাজছে”। জহির রায়হান, সাদেক খান ও ব্যতিক্রমি দু’একজন ধাবমান ইমেজের বইরূপ বদলানোর চেষ্টা করেছেন, সে প্রচেষ্টায় সবচে শক্তিশালী ধাক্কা ছিল আলমগীর কবিরের দ্বিতীয় সিনেমা “সূর্যকন্যা”।

প্রথম সিনেমা “ধীরে বহে মেঘনা”-য় আলমগীর কবির মুক্তিযুদ্ধের একটি ভিন্ন বয়ান দিয়েছেন। যুদ্ধের অব্যবহিত পরের বাংলাদেশকে দেখিয়েছেন যুদ্ধে নিহত একজন ভারতীয় সৈনিকের বাগদত্তার বোঝাপড়ার দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তিযুদ্ধকে দেখা। আলমগীর কবিরের ক্যামেরা পথে, নদীতে, গলিতে ও আকাশে ঘুরে বেড়ায় সাংগীতিক ছন্দে, বাংলাদেশ প্রতিবিম্বিত হয় ভালোবাসার আঁকরে যার জন্য জীবন বলি দিয়েছে লক্ষ জনতা। এ সেই দেশ, সুনীলের ভাষায় যেখান থেকে নির্বাসন দিলে আমরা বিষ পান করবো, মরে যাব।

“সূর্যকন্যা”, যা ১৯৭৬-এ নির্মিত, এক লহমায় বইকে সিনেমায় রূপান্তরিত করলো। বাংলাদেশে সিনেমার প্রকৃত সেন্স তৈরি হল সিনেমা তৈরির সিকি শতাব্দি পর। সিনেমা নাটক বা উপন্যাস নয়, নিছক নয় ভিন্ন মাধ্যমে গল্প বলা। কারিগরি অনন্যতা ও প্রকাশের ভিন্নতায় সিনেমার উদ্দিষ্ট অন্য এক ভুবন। মানুষ চোখে যা দেখে তার চেয়ে অনেক বেশি দেখে মনের চোখে—কল্পনায়, ভাবনায় ও অনুভূতিতে। সে দেখায় চেতন ও অবচেতনের মাঝের বাঁধা খুলে যায়, অতলান্তিক যাত্রায় মানুষ অরূপকে অবলোকন করে। শুদ্ধ সিনেমা গল্প ও কথনের সীমাবদ্ধতা পার হয়ে আমাদের অতলান্তিক যাত্রাকে দৃশ্যমান করে, জাগিয়ে তোলে আমাদের আদিম কিন্তু বিশুদ্ধ অনুভূতি, যা সময় ও স্থান নির্ভর নয়। তারকভস্কি Sculpting in Time-এ সিনেমার ভাষার এরকমই ব্যাখ্যা করেছেন, সিনেমাও বানিয়েছেন একই বিশ্বাসে। আলমগীর কবির “সূর্যকন্যা”-য় এক যুবকের অবচেতনকে রূপায়িত করেন, যে একটি সময় ও সমাজে বাস করে যেখানে ঐতিহাসিকভাবেই নারী আঁধারে বন্দিনী। এটিই বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা যেখানে এনিমেশন ব্যবহার করা হয়েছে, মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়নে চরিত্র পাল্টে যায় নেগেটিভ চিত্রে। “সূর্যকন্যা” নিয়ে তক্ষুনি প্রচুর আলোচনা হয়েছে, লেখা বেরিয়েছে দৈনিক ও সাপ্তাহিকের পাতায়। মাসাধিক কাল আলমগীর কবিরের সাথে লিখিত বিতর্ক চলতে থাকে মহসিন শাস্ত্রপাণির।।

তৃতীয় সিনেমা “সীমানা পেরিয়ে” নিয়েও আলোচনা হয়েছে, এটি ব্যবসা সফল সিনেমা। সিংহভাগ সময় জনবিরল দ্বীপে শুধুই দুটি চরিত্র; কিন্তু দর্শক নির্মাণের অভিনবত্বে মনযোগহারা হয় না ক্ষণিকের জন্যও। সমান্তরাল বা তথাকথিত আর্ট-ফিল্মের  ধারায় না গিয়ে, সিনেমার মূল ধারাতেই আলমগীর কবির বাণিজ্যের লক্ষ্মীকে পথ করে দিলেন শুদ্ধ সিনেমায় আসন করে নিতে। এটা ছিল কৌশলী পদক্ষেপ, নিজেকে জনবিচ্ছিন্ন না করে মূল ধারায় সিনেমা নির্মাণ করে ধীরে ধীরে বই-সংস্কৃতি পাল্টে শুদ্ধ সিনেমার পথ করে দেয়া।  

আলমগীর কবিরের চতুর্থ সিনেমা “রূপালি সৈকতে” দৃষ্টির আড়ালে থেকে গেছে, যদিও আলমগীর কবিরকে নিয়ে আমাদের উৎসাহে কার্পণ্য ছিল না। ১৯৭৯ এ মুক্তিপ্রাপ্ত “রূপালি সৈকতে” বিভিন্ন কারণে breakthrough বা আগলভাঙা। এটিই দেশের প্রথম আত্মজৈবনিক (auteur) সিনেমা, Cinéma vérité-র শৈলীতে নির্মিত। ষাট দশকে দেশে, এবং দেশের বাইরে লন্ডনে, শোষিত বাঙালির ক্ষোভ ও প্রতিবাদ রূপ নিচ্ছিল একটি জোরালো কাঠামোতে, অদূর ভবিষ্যতে যার ফলশ্রুতিতে জন্ম নেয় বাংলাদেশ। আলমগীর কবির এ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরে ছিলেন সক্রিয় সদস্য এবং কখনো রূপকার। ষাট দশকে মার্ক্সসিজমের পাশাপাশি সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ এগিয়ে থাকা তরুণদের মননকে নিয়ন্ত্রণ করতো, যার ব্যতিক্রম নন আলমগীর কবির। তাই “রূপালি সৈকতে” হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক পরিসরে মানুষের সমতা ও অধিকারে বিশ্বাসী অস্তিত্বের দোলাচলে নান্দনিকভাবে স্পন্দিত একজন যুবকের সিনেমারূপ।    

আলমগীর কবির ষাট দশকে লন্ডনের প্রবাস জীবনে অনুধাবন করেছিলেন এতদিন যা শিখেছেন তা মিথ্যে, জীবনের নতুন পাঠ নিলেন। বার্গম্যানের “সেভেন্থ সিল” দেখে একটি ঘোরে নিমজ্জিত হলেন, ইতিমদ্ধেই মানুষের মুক্তির চিন্তা তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে; অন্যদিকে আধুনিক মানুষের ব্যক্তিক অস্তিত্বের সংকটে আলমগীর কবির মার্ক্স আর সার্ত্রকে মিলিয়ে পড়ছেন।। মানুষের মুক্তি ও ব্যক্তির অস্তিত্বের ও মননের সার্বভৌম প্রকাশের মাধ্যম খুঁজে পেলেন সিনেমায় বারংবার “সেভেন্থ সিল” দেখে। সিনেমা দেখছেন, সিনেমায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন এবং মানুষের মুক্তি সংগ্রামে যোগ দিতে কিউবা ও আলজেরিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রবাসের আলমগীর কবির। লন্ডনে ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন হাউজে কৌশল তৈরি করছেন প্রয়োজনে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে। সেরকম প্রস্তুতি ও প্রত্যয় নিয়ে ফিরে এলেন ঢাকায়। আড়ালে বিপ্লবের সাংগঠনিক কাজ আর উচ্চকণ্ঠে পত্রিকায় নজর কেড়ে নেয়া সিনেমা সমালোচনা। দশ বছর বাদে “রূপালি সৈকতে” নির্মিত হয়েছে এরকম একটি আত্মজৈবনিক প্রেক্ষাপটে। “রূপালি সৈকতে” ডকুমেন্টেশন ও ফিকশনের কোলাজ, যেখানে জহির রায়হানকে দেখতে পাই ‘জীবন থেকে নেয়া’র শুটিং চলাকালে আলমগীর কবিরের মুভি ক্যামেরায়, দেখতে পাই লেনিনের (রূপালি সৈকতে-এর প্রধান চরিত্র) আদলে সিনেমাকারের নিজেরই জীবন—ডিটেনশনে পাকিস্তানি আর্মির অত্যাচার, গ্রামে গ্রামে সংগঠন গড়ে তোলা, এবং সর্বোপরি অস্তিত্বের দোলাচলে প্রেমে পড়েও সিদ্ধান্তহীনতায় সৈকত থেকে ফিরে আসা। “রূপালি সৈকতে” আমাদের রাজনীতির একটি উপাখ্যানকে দেখায়, দৃশ্যমান করে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট, এবং বাঙময় করে ব্যক্তিক অস্তিত্বের টানাপোড়েন।

“রূপালি সৈকতে” আলমগীর কবির নিজেকে একটি সৈকতে দাঁড় করিয়ে দেন, পেছনে তার জীবন ও প্রস্তুতি, সামনে এগিয়ে যাওয়ার বিশাল দরিয়া। প্রকৃত সিনেমা সেন্সের উন্মেষ হয় বাংলাদেশে আরো পরিণত হওয়ার প্রতিশ্রুতিতে। তরুণরা এসে দাঁড়াচ্ছিল তাঁর পাশে। কিন্তু সৈকত তাঁকে নিয়ে গেলো সীমানা পার করে দিয়ে। অজানা অচেনা আর অরূপে চিরকালের জন্য চলে গেলেন এদেশের শুদ্ধতম সিনেমাকার আলমগীর কবির।

ছবি : ডেইলি স্টার থেকে নেয়া 

 

 

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়