X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

পিঙ্গল আকাশে গেণ্ডুয়া খেলা

মিলন আশরাফ
২৯ জানুয়ারি ২০১৮, ১১:২৮আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০১৮, ১১:৩৫

শওকত আলী পাঁচের দশকের মধ্য সময়ে ‘পিঙ্গল আকাশ’ নিয়ে বাংলা কথাসাহিত্যে প্রবেশ করেন শওকত আলী। তাঁর বেশিরভাগ লেখায় আমরা দেখতে পাই নাগরিক মধ্যবিত্ত সমাজের লোভ লালসা আত্মচিৎকার। ব্যক্তিকে কেন্দ্রে এনে কাহিনি আঁকার সফল কারিগর তিনি। অবশ্য আধুনিক উপন্যাসের বিশিষ্ট লক্ষণও বলা যায় এই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা। আলোচ্য উপন্যাস ‘এক ডাইনীর গেণ্ডুয়া খেলা’ মোটা দাগে বলা যায় এটি একটি পারিবারিক উপন্যাস। প্রথমেই যদি আমরা এর নামকরণের দিকে দৃষ্টি দিই তাহলে এটা সহজে অনুমেয় হয় যে, কোনো এক রমণীর ভেতরের খল চরিত্রের বিন্যাস। যা কিনা আমাদেরকে নিয়ে যেতে পারে শেক্সপিয়ারের অপ্রতিদ্বন্দ্বি খলচরিত্র লেডি ম্যাকবেথের কাছে। তবে শুধু খলচরিত্র ছাড়া বিষয়গত আর কোনো কিছুতেই মিল খুঁজে পাবো না চরিত্র দুটির মধ্যে।

বেশ পুরানো ধাঁচের পারিবারিক গল্প ‘এক ডাইনীর গেণ্ডুয়া খেলা।’ এক কথায় বলা যায়, বিমাতা আগমনের মধ্য দিয়ে একটি সংসারের উত্থান-পতনের গল্প। সেই গল্পের বীজ বপনে লেখক সিদ্ধহস্ত। নগর জীবনের ইট-বালি-সিমেট নিয়ে তিনি বিল্ডিং নির্মাণের বদলে সংসার ভাঙনের গল্প শোনান। আমরা কান খাড়া করে শুনতে পাই মহল্লার ছেলেরা ক্রিকেট খেলা নিয়ে হইচই করছে। উপন্যাসের শুরুতেই খেলা! এরপর মামুলি এক মহল্লার ছেলেদের ক্রিকেট খেলা থেকে কীভাবে জীবনের খেলায় মোড় নেবে সেটা দেখার অপেক্ষা করতে বলেন কথাকার শওকত আলী। তিনি যেন ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত হতে বলেন আমাদেরকে। শিরোনামের কথা চিন্তা করে আমরা ভাবতে থাকি, কে সেই ডাইনী? ক্রিকেট খেলা সাঙ্গ করে চলুন এবার পাতা উল্টিয়ে ঢুকে পড়ি উপন্যাসের গহ্বরে।

উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র মাসুম। তাকে দিয়েই ঔপন্যাসিক পুরো উপন্যাসের কড়া বাঁধনটা বেঁধেছেন একেবারে এটেসেটে। খেলা শেষে মাসুম একপা দু’পা করে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। লেখক আমাদেরকে সেদিকে কড়া দৃষ্টি দিতে গোয়েন্দার কাজ করতে উসকে দেন। মাসুমের মাধ্যমে ডাইনীর প্রথম খবরটা জানান তিনি। ঘরে তার সৎমা। তবে কি সে-ই ডাইনী? নড়েচড়ে বসতে হয় আমাদের এবার। মাসুম স্বগোক্তি করে, ‘স্ত্রী মারা গেলে পুরুষ মানুষ ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে কেন বাকি জীবন কাটাতে পারে না।’ দার্শনিক জিজ্ঞাসার মাধ্যমে এক পারিবারিক জীবনের ভেতর বাড়ির উঠোনে ঢুকে পড়ি আমরা। ঢুকেই দেখতে পাই। লেখকের বরাত দিয়ে, ‘তিন ভাইবোনের জন্য একখানা ঘর। ঘরের ভেতরে তিনজনের কাপড় জামা বইপত্র থাকে কিন্তু শোয় শুধু বোনটি। তারা দু’ভাই বারান্দার চৌকিতে পাতা বিছানায় শোয়।’ নামের অনুসন্ধানে আমাদের হাতে এসে পড়ে উপন্যাসের খলচরিত্র অর্থাৎ সৎমা আকলিমা বেগম। প্রথম স্ত্রী ছিল রোমেনা বেগম। স্বামী পোস্টাল ইন্সপেক্টর মাহফুজ হোসেন। আগের ঘরের তিন ছেলেমেয়ে। বড় ছেলে মাসুম। বয়স ১৭/১৮। মেয়ে বুলবুল ১৪/১৫। সবার ছোট মাসুদ ১১/১২। উপন্যাসের ভূগোল পুরানো ঢাকার ওয়ারি, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ি, মেথরপট্রি, দয়াগঞ্জ। কাহিনির প্রায় সব চরিত্রের মুখের ভাষা প্রমিত গদ্যে এমনকি স্বয়ং লেখকেরও। তবে অন্যতম প্রধান চরিত্র সৎমায়ের মুখে বসিয়ে দিয়েছেন মুন্সিগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষা।

মাহফুজ সাহেবের আগের স্ত্রীর বাড়ি ছিল কলকাতায়। তাকে উদ্দেশ্য করে আকলিমা বেগম বলে, ‘শুদ্ধ ভাষায় কইলেই বুঝি ধনী লোক হইয়া যায়? কইলকাতার মানুষ তো এই দেশে ফকি—তো হ্যাগো মা’রে ফকিরণী কমু না, তো কী কমু?’ সংসারে নতুন মা আসাতে সবকিছু তছনছ হতে শুরু করে ঘরের। ছেলেমেয়েদের জীবনযাত্রায় আসে বিরাট পরিবর্তন। আগের ঘরের সন্তানদের দেখে আকলিমা বেগম নতুন বায়না ধরে। ‘ছেলের মা হবে সে।’ ছোট বাক্যের মধ্যে লেখক পুরে দিলেন ঘর ভাঙার গল্প। সন্তানদের দেখভাল করার জন্য নতুন বউকে বাড়িতে আনেন মাহফুজ হোসেন। বাড়িতে আসা বউ বায়না ধরে, মা হতে চায় সে। কিন্তু বিধিবাম! বাচ্চা হয় না তার। দিনের পর দিন ওষুধের পর ওষুধ খায় সে। গলায়, বাজুতে তাবিজ বাঁধে। কাজ হয় না। আকলিমা বেগমের ধারণা মাহফুজের কারণেই তার বাচ্চা হচ্ছে না। প্রমাণ হিসেবে সে দাঁড় করায়, আগের ঘরে বিয়ের এক বছরের মাথায় বাচ্চা হয়েছিল তার। অবশ্য সে বাচ্চা বাঁচেনি। এই নিয়ে নতুন সংসারে কোলাহল বাড়তে থাকে। তবে কি মাহফুজ সাহেব যৌন চাহিদা পূরণের জন্য দ্বিতীয় বিবাহ করেছেন? প্রশ্নটা একেবারে অমূলক নয়। আমরা জানতে পারি, অফিস থেকে ফিরে ঘরে ঢুকে দেড় থেকে দু’ঘণ্টা দরজা বন্ধ করে থাকে তারা। ছোট ছেলে মাসুদ ঘুমের ভেতর জানায়, ‘বউটা আব্বার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে দোল খায়’। যৌনতার আরো এক প্রতীকি ব্যবহার লেখকের বর্ণনায় দেখি। তিনি বলেন, ‘রতিবর্ধক সালসার শিশি আর কৌটা যে কত জমেছে খাটের তলায় তার হিসেব নেই।’ সচেতন কথাশিল্পী নিপুন হাতে সেইসব কঠিন সত্য প্রকাশে পিছপা হন না। নিষ্ঠুর সৎমার চরিত্র ক্যানভাসে আঁকতে তিনি শক্ত ব্রাশই ব্যবহার করেছেন। কোমলতার কোনো জায়গা নেই সেখানে।

সংসারে এসেই ভোগদখলে ব্যতিব্যস্ত আকলিমা বেগম। সবার আগে স্বামীকে করেছে আঁচল বাঁধা। অভিযোগে অভিযোগে পরিবারের বাতাস এখন বিষাক্ত। শুরু করে মেয়ে বুলবুলকে দিয়েই, ‘দেইখ্যেন, এই মাইয়া আপনেরে ডুবাইয়া দিবো, মানসম্মান বইলা কিছু থুইবো না- কুনদিন দ্যাখবেন মেয়ে প্যাট বাঁধাইয়া বইছে।’ সন্তানদের সবসময় ফকিরনীর মাইয়া আর ফকিরনীর পুত বলে গালাগাল করে আকলিমা বেগম। স্ত্রীর কুপ্ররোচনায় পড়ে সন্তানদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে মাহফুজ হোসেনও। সৎমা মাসুমের বন্ধু ফেরদৌসকে জড়িয়ে বাজে কথা রটায়। এতেও নিশ্চুপ থাকে মাহফুজ। আসলে লেখক ইচ্ছে করেই মাহফুজ চরিত্রটাকে নিষ্প্রুভ নির্জীব চেতনাহীন করে অঙ্কন করেছেন। প্রমাণস্বরুপ লেখকের বয়ানে, ‘খুব উঁচু গলায় চিৎকার করে ধমক দিতে চায় মাহফুজ। কিন্তু অবাক কাণ্ড! গলায় তার জোর আসে না—তার স্বর খড়গই নুয়ে পড়া আর নিচু শোনায়।’ পাশাপাশি মাসুম চরিত্রটা এঁকেছেন প্রতিবাদি করে। ব্যক্তিজীবনে লেখক মার্কসবাদ চর্চা করার ফলপ্রসু মাসুম চরিত্র। বাবার চোখে চোখে তাকিয়ে তাকে বলতে শুনি, ‘কে বলেছে আপনাকে এসব বাজে কথা?’ এতোকিছুর পরেও তীব্র কাজ না হওয়ার নিজের ভাই মন্টুকে দিয়ে বুলবুলের সম্ভ্রমহানি করায় আকলিমা বেগম। এখানেও মাহফুজ সাহেবের ভূমিকা শীতল। অন্যদিকে মাসুমকে আবারও প্রতিবাদি হতে দেখি। মাসুম বলে, ‘আপনার মেয়েকে অমন অপমান করেছে তবু আপনি কিছু বলছেন না—কিন্তু আমি বলব, শুধু বলব না, করবও, কারণ ও আমার বোন।’ সৎমা এসে যে আগুন জ্বালিয়েছে সেই আগুনে তাকেও পোড়াতে চায় উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মাসুম। যদিও উপন্যাসটি নায়ক প্রধান নয়, তবুও মাসুমের নামের আগে নায়কের তকমা লাগালেও তেমন অত্যুক্তি হয় না। এই তকমাটা আরো জোরালো হয়ে আমাদের সামনে আসে যখন দেখি লেখক মুন্নি নামের এক কিশোরী মেয়েকে মাসুমের অন্দর মহলে প্রবেশ ঘটান। মেয়েটির ছেলেমানুষীতে মুগ্ধ হয় মাসুম। দু’জনের ভালোলাগার রসায়ন অল্প কথাবার্তার মধ্যে ঠেসে পুরে লেখক যেন একটা মিষ্টি আভাস পাঠকের কানকে মোলায়েম হতে পরামর্শ দেন। মাসুমের বন্ধু ফেরদৌসের খালাতো বোন মুন্নি। ফেরদৌসের বাড়িতে মুন্নি তার সঙ্গে খুনসুটিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নাম বদলের খেলায় মাতে সে। আমরা উঁকি দিয়ে দেখি, তারা দুজন একপা দুইপা করে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে। মুন্নি গেটের কাছে দাঁড়িয়ে মাসুমকে বলে, ‘আবার কবে আসবেন? কাল? নাকি পরশু?’ প্রতিউত্তরে মাসুম, ‘কেন? আমার আসা দরকার?’ মুন্নিও কম যায় না, কাউন্টার অ্যাটাক্ট করে মাসুমকে। ‘আপনি না এলে নতুন নামটা কাকে দেব? ঐ নামে আর কাকে ডাকব?’ লেখক এক কিশোর-কিশোরীর প্রেমের ফাঁদে আমাদেরকে আটকে ফেলেন। মাসুমের সঙ্গে আমাদেরও মজা লাগে। লেখক জানান, ‘কী যেন অন্য ধরনের একটা ভাব জাগে মনের ভেতরে।’ মাসুম বলে ওঠে কিংবা আমরা, ‘কালও আসব, পরশুও আসব।’ এই ছিল তাদের প্রেমের প্রথম পাঠ। তাদের কথাবার্তা শুনে এই ধারণা আমরা পোষণ করি, অল্পকথায় কাজ হলে বেশি কথার কী প্রয়োজন?

তাদের এই খুনসুটির স্থায়ীত্ব খুবই কম। কারণ লেখক মূলত এক ডাইনী সৎমায়ের চরিত্র উন্মোচিত করার লক্ষ্যে কলম ধরেছেন। আমরা আবারও ডাইনীর ঘরে ঢুকে পড়ি। তার ভাই মন্টুকে মাসুমের বন্ধুরা মিলে নাক ফাটিয়ে দিয়েছে, এরই জের ধরে স্বামীর কাছে বিচার দেয় সে। যখন দেখে তেমন কোনো সুরাহা হচ্ছে না, চিৎকার চেচামেচি করে ঘর মাথায় তোলে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘ওরে আমার কপাল—আল্লাহ আমারে তুমি এমুন জালিমের হাতে ক্যান দিলা। ওরে আমার কী হইবোরে। কেহ নাই আমার—ভাইটার নাক ফাটাইয়া দিছে, ফির আমারেই বকা দেয়-বিচার নাই গো-এগো দিলে বিচার নাই।’ সহ্যের বাধ ভেঙে যায় মাহফুজ হোসেনের। তিনি ঘর থেকে বাইরে বের হয়ে পড়েন। অতিষ্ঠ হয়ে যাওয়া মাহফুজ ক্যারেক্টারটা নিয়ে লেখক এবার অতিবাস্তবতা কিংবা পরাবাস্তবতার খেলা খেলেন। গবেষক শাফিক আফতাব এর নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে (১৬.০৮.২০১১) লেখক জানান, ‘বাস্তবতায় যা পাওয়া যায় না মানুষ তাই খোঁজে অতিবাস্তবতায়।’ এক ডাইনীর গেণ্ডুয়া খেলা উপন্যাসে তিনি সেই টেকনিকটা ব্যবহার করেছেন।

ঘর থেকে বের হয়ে মেথরপট্টির কাছের এক শুড়িখানায় ঢোকে মাহফুজ হোসেন। সেখান থেকে মদ খেয়ে নেশায় টইটুম্বুর হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন তিনি। দ্বিতীয় বিয়ের বাসর রাতের কথা তার স্মরণে আসে। আবেগে ওই রাতে স্ত্রীকে আকলিমা নামের বদলে আকি নাম দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, কপালে তার অনেক ভালো বউ জুটেছে। কিন্তু শিগগিরই তার এই ভ্রম কেটে যায়। আকির কথা বাদ দিয়ে তিনি তার প্রথম বউয়ের কথা ভাবতে থাকেন। মনে ভাবেন, প্রথম বউ বেঁচে থাকলে তাকে এভাবে রাস্তায় বের হতে হত না। কণ্ঠে আবেগ মিশিয়ে তিনি বলেন, ‘ওহ হো, রোমেনা কেন তুমি চলে গেলে—তুমি বেঁচে থাকলে আমি কি দ্বিতীয়বার বিয়ে করি? হায়রে কপাল আমার?’ টলতে টলতে একটি শিশুপার্কে এসে পৌঁছান তিনি। গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে বাস্তব পৃথিবী ছেড়ে ঢুকে পড়েন অতিবাস্তবতায়। সেখানে ঢুকেই দেখেন, আকলিমা বেগম তাকে কেন তাকে ডাকা হয়েছে? এই নিয়ে জেরা করছে। মাহফুজ হোসেনও মিনমিনে কণ্ঠে উত্তর দেন, ‘কী করবো। তোমার কথা মনে পড়ছে তাই।’ উপন্যাসের এই পর্যায়ে এসে আমরা দ্বিতীয়বার নিশ্চিত হয়ে যায় যে, মাহফুজ হোসেনের দ্বিতীয় বিয়ের অন্যতম প্রধান কারণ হল যৌনতা। লেখকের বর্ণনা আকলিমার বয়ানে, ‘আমার কথা তো তোমার একটা দরকারের সময়েই মনে পড়ে, তাই না? রাতের বেলা বাসায় ফেরো তো ঐ দরকারের জন্য, না হলে তো বোধহয় বাসায় ফিরতে না—ঠিক না?’ কল্পনার মধ্যে হাসতে হাসতে কাপড় খুলে উলঙ্গ হয় আকলিমা বেগম। মাহফুজ হোসেনের বিভ্রম লাগে, তিনি ভাবেন এ বোধহয় অন্য মেয়ে। তার ভেতরে ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়, গায়ে হাত দিয়ে দেখে সেটা নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। কেমনজানি সরে সরে যায় সব। ছটফট করতে থাকেন তিনি। তার এই কল্পনার রাজ্যে কান পেতে কিছু কথা শুনে চমকে যেতে হয় আমাদের। কারণ আকলিমা বেগম তখন ডাইনী রূপে আমাদের সামনে হাজির। গেণ্ডুয়া খেলা খেলতে এখন সে পুরো প্রস্তুত। হাতে তার গোলাকার দুটি বস্তু। মাহফুজ হোসেন নেশায় ঘোরে জিজ্ঞেস করে, ‘ও দুটো কী?’ জবাবে আকলিমা, ‘বল, আমার খেলার জিনিস, দেখো ভালো করে, তুমি খেলবে?’ ঝুঁকতে ঝুঁকতে তিনি দেখেন, ‘আরে! এতো মানুষের মাথা।’ আকলিমা বলে, ‘হ্যাঁ, গেণ্ডুয়া খেলতো পারো? এসো আমরা গেণ্ডুয়া খেলি।’ কিন্তু মাহফুজ ভেবে পান না, মাথা দুটি আসলে কার? আরেকটু ঝুঁকে ভালো করে দেখেন, মাথা দুটো আসলে মাসুম ও মাসুদের। এবার আমরা দেখতে পাই লেখক অনেক কুশলতার সঙ্গে তাকে লোভী ডাইনীর রূপে আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন। লেখকের বর্ণনায়, ‘কথা বলার সময় তার লাল জিভ বেরিয়ে পড়ে কয়েকবার। আর সেই জিভ থেকে তরল জিনিস টপটপ করে পড়ে।’ ভড়কে গিয়ে মাহফুজ জিজ্ঞেস করে,

—তোমার মুখে কী?

—কেন, রক্ত চেনো না? রক্ত দেখোনি?

—কিন্তু কেন?

—বাহ্ আমার খেতে ইচ্ছে করে যে!

—তাহলে তুমি কে? তুমি কি ডাইনী?

চরিত্রের মাধ্যমে এই প্রথম আকলিমাকে ডাইনী সাব্যস্ত করলেন লেখক। আকলিমার স্বীকারোক্তির মাধ্যমে লেখক পুরো বিষয়টা পাকাপোক্ত করে ফেলেন। ‘এই তো চিনছো দেখি, খিল খিল করে হেসে একেবারে গড়িয়ে পড়তে চায় আকলিমা। তারপর দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, এসো এবার তোমাকে আমি খাই।’

মাহফুজের মতো আমাদেরও শ্বাসরোধ হয়ে আসে। ‘ও বাবারে, আমাকে খেয়ে ফেললো রে!’ মাহফুজের সঙ্গে আমরাও যেন চিৎকার করে বাঁচাও বাঁচাও করতে থাকি। বাস্তবে না পারলেও অতিবাস্তবের মাধ্যমে একটা যেন প্রতিশোধ নিলেন লেখক। তাকে ডাইনী বানিয়ে ছাড়লেন।

পাশাপাশি আরো একজন সৎমায়ের উপস্থিতি দেখতে পাই আলোচ্য উপন্যাসে। তবে এই চরিত্রটা আগের চরিত্রের বিপরীত রূপ। দুটি চরিত্রকে পাশাপাশি রেখে তিনি আমাদেরকে বোধহয় খারাপ-ভালোর পার্থক্য নির্ণয়ের সূক্ষ্ম একটা সূত্র ধরিয়ে দেন চোখের সামনে। উপন্যাস থেকে ধার করে, ‘মা! মাসুম এবার ভালো করে তাকিয়ে দেখে। ফয়সালের যে সৎমা আছে সে খবরটা সে জানে—কিন্তু ইনি ওর সৎমা? একি বিশ্বাস করা যায়? সৎ ছেলের জন্য অমন অস্থির, অমন চিন্তা, আর অমন আদর! তার কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না, নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছে, তবু।’

শওকত আলী শেষবারের মতো আবারও আমাদেরকে সেই কৈশোর প্রেমের আকুতি শোনান। ফয়সালদের বাড়ি থেকে দ্বিতীয়বার বের হয়ে রাস্তায় দাঁড়ায় মাসুম। তার পিছু পিছু মুন্নিও এসে পাশে দাঁড়ায়। এখানে লেখক সিনেমাটিক কৌশল অবলম্বন করেন। চলুন দেখি, ‘মাসুম কোন কথা না বলে সামনের দিকে পা বাড়ায়। মুন্নিও পাশাপাশি হাঁটে। গলিতে সন্ধ্যার ভিড়। ওরই মধ্যে আচমকা একটা রিকশা প্রায় ঘাড়ের ওপর এসে পড়লে ও মাগো! বলে মুন্নি লাফিয়ে সরে আসে আর মাসুমের ঘাড় দু’হাতে আঁকড়ে ধরে। ঐ সময় কী যে হয়—মাসুম নিজেও মুন্নিকে ডান হাত দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে।’

এরপর তাদের দু’জনার আর দেখা হবে না এমন একটা হাহাকারের সংবাদ দেন লেখক। বিচ্ছেদের করুণ সূর। আমাদের হৃদয়কে ভিজিয়ে দেয়। বন্ধু ফয়সালের বাবা খুব রাগি লোক। তার ধারণা মাসুমের কারণেই ছেলেটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় মাসুমের সে বাড়িতে না যাওয়াই উত্তম কাজ। সুতরাং ওখানে না যাওয়া মানে মুন্নির সঙ্গে দেখাও হবে না। কিন্তু মুন্নি নাছোড়বান্দা। সে ঠিকই জানায়, ‘আমি কিন্তু কোচিং এ যাই, ওয়ারিতে।’ তবুও মাসুমকে হতাশই দেখি আমরা। সে আশা ছেড়ে দেয়। তাদের ভাবনায় ছেদ পড়ে, গেটের কাছে দু’জন মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। ওরা লীনা আর স্বাতী। মুন্নির বান্ধবী। দেখা করার তীব্র বাসনায় মুন্নির ভেতরটা বোধহয় দুমড়ে মুচড়ে যায়। তাই সে পা সামনের দিকে বাড়িয়েও মুখ ফিরিয়ে বলে,‘কাল বিকেল তিনটায় কোচিং-এ যাবো, র‌্যাঙ্কিনের স্ট্রীটের মোড়ে, বিয়াল্লিশ নম্বর বাড়ি।’ কুশলি কথাসাহিত্যিক শওকত আলী এক অনন্ত অপেক্ষার নোটবুক ধরিয়ে দিলেন ঠিকানা সমেত। মাসুম কিংবা মুন্নির মতো পাঠকেরও অপেক্ষায় অপেক্ষায় দিন চলে যায়। দেখা মেলে না। কারণ আলোচ্য উপন্যাসে মুন্নিকে আর কোথাও খুঁজে পাই না আমরা।

উপন্যাসের পর্দা নামে পারিবারিক ঝগড়া দিয়ে। মাহফুজ হোসেন ছেলে মাসুমকে ত্যাজ্য করার হুঙ্কার দেন বারবার। ছেলে প্রতিবাদি হয়ে বাবার মুখেমুখে তর্ক জুড়ে দেয়। ছেলের এই আচরণ মেনে নিতে পারেন না তিনি। বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাইলে মাসুম জানায়, এ বাড়ি তার বাবার নয়, দাদার। এমনকি তার ফুফুও। সুতরাং বাড়ি ছেড়ে সে কিছুতেই যাবে না। বাবা গুণ্ডা লাগিয়ে তাকে তাড়ানোর হুমকি দিলে সেও উল্টো বাবাকে শাসায়, ‘আপনি যার কথায় আমাদের গুণ্ডা লাগিয়ে তাড়াতে চান, আমিও লোক লাগিয়ে তাকে তাড়াবো, দেখবেন আজই।’ এই কথা শুনে পেছন থেকে আকলিমা মানে ডাইনী মা ছুটে এসে স্বামী মাহফুজ হোসেনকে টানতে টানতে ঘরের ভেতর নিয়ে যায়। শওকত আলী এখানেই তাঁর শাণিত মোক্ষম অস্ত্রটি বের করে সেটির কারিশমা দেখিয়ে উপন্যাসের সফল সমাপ্তি টানেন।

‘ওদিকে তখন দরজা বন্ধ ঘরে মাহফুজ হোসেন তখনো এলোচুলের উলঙ্গ ডাইনীকে দেখে, কখনো দেখে রাক্ষুসীকে কখনো আবার পেত্মীকে। তারা গেণ্ডুয়া খেলতে চায়, কিন্তু নরমুণ্ডু কোথাও খুঁজে পায় না—আর তাই হায় হায় করতে থাকে।’

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, যারা শওকত আলীর দক্ষিণায়নের দিন, প্রদোষে প্রাকৃতজন, ওয়ারিশ, উত্তরের খেপ, দলিল ইত্যাদি বাঘা-বাঘা উপন্যাস পড়ে মগজ পাঁকিয়েছেন, তাদের কাছে ‘এক ডাইনীর গেণ্ডুয়া খেলা’ একটু পানসে লাগবে বটে। তবে এ উপন্যাসটি আরেকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হল, শওকত আলী গবেষক শাফিক আফতাব জানান, শওকত আলী’র ব্যক্তি জীবনে মা সালেহা খাতুন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করার পর বাবা ডা. খোরশেদ আলী স্থানীয় লোকদের কুপরামর্শে আবার বিয়ে করেন। নতুন বউ সংসারে আসলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাদের। সুতরাং একথা নিঃসঙ্কোচে বলা যেতেই পারে যে, ‘এক ডাইনীর গেণ্ডুয়া খেলা’ উপন্যাসের রসদ এখান থেকেই যোগান দিয়েছেন তিনি।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
জেফারকে সিনেমায় নিয়েছে ফারুকীকন্যা ইলহাম!
জেফারকে সিনেমায় নিয়েছে ফারুকীকন্যা ইলহাম!
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়