কে একজন ডাকে
চমকে শুনি— কে একজন ডাকে ভুলে যাওয়া ডাকনামে—
সবুজ পাতারা— কোথায় যে পড়ে আছে কে জানে!
আত্মমগ্নতার বিবর্ণ সময়ে— এখনও কেউ কাউকে ডাকে?
কিছু বুঝে ওঠার আগেই আচ্ছন্নতা তার দিকে টানে।
আচ্ছন্ন ছিলাম; সে তো বহুকাল— এখনও যেমন আছি—
নির্বান্ধব বিকেলগুলো আমারই মতো নিরন্তর হাঁটে;
আমি কেবল এর দিকে ওর দিকে হাসিমুখ প্রার্থনা করি—
সবাই নিজসুখেই মগ্ন; আত্মপ্রেম রটিয়ে চলে ঘাটে ঘাটে।
আমি তবে অচেনা— অপ্রস্তুত— বেমানান তোমাদের প্রান্তরে—
সবাই উদ্বিগ্ন ও ব্যস্ত দিনমান— সব মুখই রাগী— দুর্দান্ত;
আমার হাসি পায় অহেতুক; মনও খারাপ হয় যখন তখন—
যুক্তি নাই— ঘুরঘুর করি, না— দেখা স্বপ্ন খুঁজে ফিরি একান্ত।
সমস্ল কোলাহল ছেড়ে নিরবে একপাশে চুপচাপ দাঁড়াই—
কোথাও যাবার নেই, আসবেও না কেউ— নিশ্চিত টের পাই।
দিগন্তরেখা
দিগন্ত রেখাকে একা বলে জানি,
মানুষ যেখানে আর যেতে পারে না—
তাই দিগন্তরেখা— সবশেষ; চিরএকা—
খেয়ালখুশির যাদুতে বারবার বারবার
এলোমেলো ঘুরপাক চেনা-অচেনা পথে!
ভিখারির মতো হাত পাতি; রক্তশুন্য নিঃশ্বাস
জানিয়ে দেয় : এটাই জীবন। এমনই হয়, হবে!
মুহূর্তে অচেনা— হওয়া প্রিয় চোখের দিকে তাকাই—
নিয়তি কি এরকম?
অনিবার্য নিয়তি ভ্রু কচলে স্লেটে লেখা
তারাজ্বলা দিনরাত্রি...ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে কাটে—
নিঃসঙ্গ গ্রহচারীর মতো ঘুরতে থাকি!
দিগন্তরেখার মতোই একা হতে হতে
নিজেকে মিলিয়ে যেতে দেখি গাঢ় শুন্যতায়...
সেখানেও আমার জন্যে অপেক্ষা করে আরও একজন :
— সুদূর, অচেনা, আমারই মতো চিরকৈশোর—
স্বয়ং দিগন্তরেখা!
অপেক্ষার পর
জলঝড়ের রাত্রিশেষে সব অপেক্ষার পর...
ক্লান্ত চোখের পরে অস্ফুট সত্য ভাসে—
কে তুমি? কেন তুমি? কোথায় তুমি?
অপলক নিষ্ঠুর উত্তর দাঁত বের করে হাসে।...
আবার জিজ্ঞেসও করে : জানতে না বুঝি !
জানবো না কেন; জানি। আলো মেশে অন্ধকারে—
তারপরও প্রতীক্ষাতো ফুরায় না। বারবার চোখ
যায় ঘড়িতে, ক্যালেন্ডারের পাতায়! সময়ের চাকতি!
একাই ঘোরে, ঘুরতে ঘুরতে ঘুরতে আবার নিষ্ঠুর
হাসে— ফের জিজ্ঞেস করে : ‘অপেক্ষার কি মানে?’
জেনে যাই, অপেক্ষা-প্রতীক্ষা যমজ দুই সঙ্গী;
দিন-রাত তালগাছের মতো একা দাঁড়িয়ে থাকে।
কখন যে ডানাওলা পাখি ধীরে নেমে আসবে নিকটে!
উড়ে উড়ে যাবে নিষ্ঠুর সত্যকে চিনিয়ে বারবার—
এভাবে চলে যাবে বলেই কি কাছে আসে মানুষ!
অপেক্ষা তারপরও— সুদীর্ঘ দিন, দীর্ঘতর রাত—
আর, বুকের সমস্ত কথা লুকিয়ে হাসিমুখে তোমাকে বলা—
খুব ভালো আছি! দেখা হবে আবার!
একটি মুখ
বিদেশী বাতাস তোমাকে বদলে দেবে, আমি জানি।
চেনা রাস্তা, কাদা, ঝড় জল অসহিষ্ণুতা, মরচে পড়া
সমস্ত পুরনো; ইচ্ছামতো নতুন কথার বসন্তঝালড়—
আবেগ তখন অপ্রয়োজনীয়, হাস্যকর। ছেলেমানুষী!
জানবে— এসবও পুরনো, ছেড়ে যাওয়া; ছুড়ে ফেলা!
কিছুই যে নষ্ট হয় না, ভুলে যাওয়া। তারপরো বদল—
প্রিয় চাদর, জানালার পর্দা, ঝুড়িতে পর্যুদস্ত-বাতিল
প্রিয় সেই গান অশ্রুত; অনন্ত কথাস্রোতও রুদ্ধ, নিশ্চল—
সব একলয়ে চলে; কিছুই নতুন নয় অসংখ্য ব্যবহারে
মানুষ-মানুষীর প্রেমও পুরনো; পুনরাবৃত্তিতে ভরপুর;
নিষ্ঠুর নিয়তি কেবল কখনও কখনও নিজেকে জানায়—
ভয়ে, আনন্দে, সুখে, দুঃখে মানুষকে আদিগন্ত ভাসায়।
তারপর সবই পুরনো হয়— দূরে, আড়ালে নীরবে—
কেবল একটি মুখ হৃদয়ে গেথে থাকে; একা নিঃশব্দে।
গহিন ভিতরে
‘একটা শাবল নিয়ে খুঁড়তে নেমে পড়ি!’
‘কোথায়?’
‘নিজের গহিন ভিতরে...’
‘কি পেলে?’
‘একটার পর একটা সুরঙ্গ; দুঃখে ভরা স-ব নদী!’
‘এরপর? কি করলে? নদীর পাশে বসে থাকলে?’
‘না... খুঁড়তেই থাকলাম। খুঁড়তেই থাকলাম...।’
‘আর কিছু পেলে?’
‘দু’ফোটা টলমল জল দেখি ফিরে ফিরে আসে!’