X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

মেঘে না মেঘনা

মামুন অর রশীদ
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৩:৪৯আপডেট : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৩:৪৯

মেঘে না মেঘনা

গ্রামটি চেনার তেমন কোনো নিশানা নাই।  ভৈরব থেকে নৌকা দুই ঘণ্টা চলার পর যদি দেখেনে ছোটো ছেলে মেয়েরা নদীর তীরে বালুতে গর্ত করছে, আবার জিজ্ঞেস করলে যদি বলে, টিয়া পাখির বাসা বানাই, ডিম পারবে। তখন বুঝবেন গাছতলীতে চলে আসছেন। গাছতলী গ্রামের তিনদিকে নদী, পূর্বে বিল। একটা নদী হিমাইল রাজার দেশ থাইক্যা আসছে। আকাশ দিয়ে উড়ে যে মেঘ, এই মেঘগুলা নদী হয়ে নামে হিমাইল রাজার দেশে। মেঘের নদী কখনো শুকায় না। কে জানি নদীতে বান দিচ্ছে। বান দিলে নদীটা শুকিয়ে যায়। একটার পর একটা বান। কে যেন গলায় ফাঁস দিচ্ছে।  তখন নদীটার বাঁচার জন্য দুই পারের মানুষদের কানতে হয়, খালি কানলে হয় না, নাকে-মুখে পানি আসতে হয়। না পানি আসলে নদী শুকায়ে যায়। এই পানিতে হউমাছ বাঁচে। বাঁচে চাপিলা আর আইড় মাছে ঝাঁক। কান্দন থামালে হউমাছ তো হউমাছ গোটা নদীই মরে যাবে।

মেঘনারে সবাই ভয় পায়। ভয় পাওয়ার কারণ আছে। একবার জালে কলার থোরের মতো একটা ভারী লোহা উঠল জালে। কেউ বলল, নুহনবীর আমলের নৌকার আলামত। কেউ কইল, সোনা-তামাভরা নৌকা ডুবছিল এইখানে। লোহাটা এরই নমুনা। তখন নাকি ব্রিটিশ আমল। সেই লোহার কলার থোর ঘরে আনা হলো । ছেলেরা নিল মাঠে। গুল্লি খেলার সময় রোদে কলার থোর ফেটে মরে গেল গ্রামের দশঘরের বহু  ছেলেমেয়ে। হয়ত কোনো জংলীবিমানের পেট থেকে পড়া এই কলার থোর এতদিন ফুটে নাই। যেদিন ফুটল, গাছতলী গ্রামের কবরস্থানটারে বড় করে দিল। শুনেছি, সেই থেকে পশ্চিমপাশের নদীতে কেউ জাল ফেলে না।

আমাদের নৌকা যখন গ্রামের ঘাটে থাকে, তখন সন্ধ্যা হবে হবে। তখন কোনো ছেলেমেয়ে টিয়াপাখির বাসা বানাচ্ছে না। তবু এটা গাছতলী। পশ্চিম পাশের নদীটাতে একটা বড় লাল সূর্য ডুববে ডুববে করলেও  ডুবছে না। আমাদের দল থেকে কেউ একটা ছবি তুলবে, তারপর টুপ করে ডুবে যাবে। সত্যিই তাই হুট করে সন্ধ্যা নামল গাছতলী গ্রামে। গাছতলী গ্রামে গাছ কম। খেজুর আর ডাবগাছ বেশি। সবকটা গাছে বাবুইয়ের বাসা ঝুলছে । বাবুইয়ের বাসার মতোই সবকটা ঘরে ঝুলছে কুয়েত-সৌদির চিঠি। সবঘরেই বিদেশি আছে মনে হচ্ছে। বিদেশির বউরাও আছে মনে হচ্ছে। এদের টাকার ছাপ পড়তে শুরু করেছে। প্রথমে পড়েছে বাবুইগুলোর ওপর। কমে এসেছে বাবুইয়ের ঘর। বিদেশ থেকে টাকা আসে তো, বাবুইরে বাসা ভাঙে, খেজুর গাছ কাটে, ছনের ঘরের বদলা চৌচালা ঘর উঠে। টাকা আসেতো চারচালার ওপর আটচালা উঠে। ঘর উঠবে, কাটো গাছ। কাটো গাছ, ভাঙো বাসা, বাবুইয়ের। বুঝতে পারলাম গ্রামটা ভরা ছিল খেজুর ডাব গাছের সারিতে। আজ সেকথা মনে নাই কারো। আজ সবার মনে বিল্ডিং, যদিও এখনও একটা উঠে নাই। যাদের হাতে  বুরুজ আল খলিফা উঠছে দুবাইয়ে, এদের বাড়ি এখানে।

আমি ও আমার ক্যামেরাম্যান যে ঘরে আছি সেটা টিনের। মোহাব্বত আলীর বাড়ি এটা। গঞ্জে তার সরিষা তেল ভাঙানোর কল আছে। তবু বাংলাঘরের অবস্থা কেমন। ঘরের  কোথাও ছিদ্র আছে হয়তো। তীব্র শীত আসছে। আসছে হু হু কান্নার মতো বাতাস। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম, বাতাস নয়, কেউ কাঁদছে মনে হয়। আমার ক্যামেরাম্যান সবে চাকুরিতে এসেছে, নাম সুমন। এটাই তার প্রথম ফিল্ড। খুব কম কথা বলে। আমাকে ভয় পায় বোধহয়। ট্রাইপড টেনে ক্লান্ত। রাত হওয়ার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে । শব্দটা কান্নার  না বাতাসের বোঝার উপায় নেই।

সকালে উঠে মনে হল, দারুণ একটা নদীঘেরা দ্বীপে এসেছি। গাছতলী গ্রামটা আসলেই সুন্দর। মিহি কুয়াশার মধ্যে সকাল হওয়ার আলো ঢুকছে। নদীর ওই পারে লাইন ধরে কার্গো স্টিমার যাচ্ছে ধীরে। এর বাইরে আর কোনো শব্দ নেই। কয়েকটা গোশালিক মাঝে মাঝে আমাকে চেনার চেষ্টা করছে। চিনতে পারছে না। তবে আমি যে নতুন, তা বোধহয় বুঝতে পেরেছে এরা। লোকজন তেমন নেই। ঘরে ফিরে দেখি, সুমন নাশতা খেয়ে ফেলেছে। গ্রামটা ঘুরব ভেবে ঘোরা হলো না।

আসলে মেঘনা নদীর মতো কোনো নদী নেই। হালকা একটা বাতাস সবসময় থাকবে। কেমন কালচে সবুজ জলের থেমে থেমে চলা। কত দূর থেকে নদী একটা দারুণ ক্ষুধালাগা গন্ধ বয়ে আনে জানা যায় না।  দুপুরে দাওয়াত আছে শুনলাম, সুমনের কাছে বলে গেলেন মহব্বত আলী। আমরা যে ঘরে আছি সে ঘরটা মোহাব্বল আলীর মা থাকতেন একসময়। এখন ফাঁকা থাকে। এখন এই  ঘরে একটা বিড়াল থাকে। এই পরিবারে বিড়াল পোষার শখ। আমার অতটা পছন্দ না। রাতে বিড়ালের কান্না শুনেছি বোধহয় মানুষের কান্নার মতো।  গতসন্ধ্যায় এসেছি, এখনো মোহাব্বত আলী ছাড়া বাড়ির কারও দেখা পাইনি। কেমন নীরব বাড়িটা। আসলে পুরোগ্রাম কেমন নিশ্চুপ। কেউ কথাও বলে না শব্দ করে। শুরু মিহিবাতাসের শব্দ। এমন বাতাস যে আসলে কোনো রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসা চিতল মাছের ঝোলের ঘ্রাণকে দূর করতে পারছে না, কিন্তু রান্না ঘরের চালে বেড়ে ওঠা লাউডগা হেলে যাচ্ছে। এই মিহিবাতাস নদীর পার থেকে ছেলেদের হইচই তুলে নিয়ে আসছে। জানালা দিয়ে দেখছি, ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে, একটা রানআউট হলো কী হলো না, এ নিয়ে হইচই।

ক্রিকেটঅলারা ছাড়া বাকিরা সবাই ওরসে। ওরস চলছে মনমন শাহের দরগায়। ওখানে গ্রামের সব লোক। আশেপাশের গ্রাম থেকে লোক আসবে। আসবে নদীর ওইপারের লোকজনও। সমস্যা ওখানেই। ওরসে মারামারি হবে। মারামারি ওরস নিয়া না। নদীর মধ্যে বান নিয়া। গতবছরও মারামারি হলো। চারটা লাশ পড়ল। এবারও পড়বে। প্রতিবছর রক্ত লাগে এই নদীর। এই নদী মেঘনা, কালিদহ সায়রের চেয়ে বড়। এই নদীতে হাজারে হাজারে নৌকা ডুবল। লঞ্চ ডুবল শত শত। একটা সুতাও পরে পাওয়া যায় না।  কিন্তু চেয়ারম্যান বান দিবই। তবে মেঘনারে বান দেওয়া অত সহজ না। মোহাব্বাত আলীই বিড়বিড় করে যাচ্ছেন। কখন যে এসেছে, খেয়াল করিনি। আমার খাবারও নিয়ে এসেছে। চাপিলার ঝোল আর হাঁসের ডিম ভুনা। লাল চালের ভাত। এমন কিছুই খেতে চাচ্ছিলাম।

সুমন ওরসে চলে গেছে, ও বোধহয় গাঁজা খাওয়া শিখেছে। ওখানে নাকি শিরনি বিতরণ হবে।  নাড়িকেল আর গুড় দিয়ে করা শিরনি। শিরনি খেতে হয় কলাপাতা দিয়ে। খবর আছে, খাওয়ার সময় মারামারি শুরু হবে। আমি ওরসে যাব না।  নদীতে যেখানে বান দেয়ার চেষ্টা চলছে সেখানে যাব। আজই রিপোর্ট পাঠাতে হবে। নেট এখানে স্লো। কারেন্ট নেই। কারেন্ট থাকে নামমাত্র। মোহাব্বত আলী রাজি না। আমি ওখানে একা যাব, ব্যাপারটা পছন্দ হলো না মোহাব্বত আলীর। আজকে লাশ পড়বই। ক্যামেরা ভেঙে ফেলতে পারে। আপনার যাওয়া যাইব না। ওরসের নাম কইরা চর দখল হইব। রক্তে ভাইসা যাইব গাঙ।

এমন ফুটেজ আমার নিতেই হবে। নদী দখল রেয়ার ব্যাপার। ইন্টারন্যাশনাল ভ্যালু আছে। নদীতে বাঁধ দিলে, মেঘনার মতো গাঙ নাই হয়ে যাবে। এমনিতে বালুচরে নদী দেখা পাওয়া যায় না। দেশে নৌপথ বলতে কিছু নেই। মোহাব্বত আলীর কথার বাইরে যাওয়া যাবে না। আবার বাঁধের জায়গাটিও দেখতে হবে। ক্রিকেট খেলা দেখার কথা বলে বেরিয়ে পড়লাম।

যত কাছে ভেবেছিলাম, জায়গাটা তত কাছে না। গাছতলীর একেবোরে উত্তর মাথায় চিকন ধারা। হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যা হয়ে এল। কাছে পৌঁছুনো সম্ভব না। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। একটা খেয়াঘাটের মতো। ওখানেই বাঁধ হবে। চরের লোকেরা বাঁধ চায়। গাছতলীর লোকেরা চায় না। বাঁধ হয়ে গেলে এই নদীতে মাছ পাওয়া যাবে না। সন্ধ্যা নেমে আসছে। আকাশটা এমন লাল হয়ে উঠেছে। ওটা হাসান-হোসেনের রক্তের রঙ। সবসময় দেখা যায় না। সন্ধ্যা নামছে, শীতও নামছে জাকিয়ে।

ঘরে ফিরে দেখি, ক্যামেরাম্যান ওরসের দারুণ ছবি নিয়ে এসেছে। কোনো মারামারি হয় নাই। মোহাব্বত আলী অযথা ভয় পেয়েছে। না গিয়ে মিস করলাম বোধহয়। ওরসে শিরনিতো ছিলই, আরো ছিল মোষের বিরিআনি। এ আবার মানত করা মোষের বিরিআনি। এর স্বাদ-গন্ধ আলাদা। ভিডিও থেকে গন্ধ বেরুচ্ছে। দোকানও বসেছে নানা রকম। মাষের জিলাপি একেবারে নরম, গাছতলীতে বলে আমিত্তি। আমার জন্য নিয়ে এসেছে তিনটা। আমার কেন জানি খেতে ইচ্ছে করল না। হয়তো অনেক শীত, হয়তো ক্ষুধা নেই। কারেন্টও নেই।

রাতে না খেয়েই শুয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল কান্নার শব্দ। মনে হয় কান্নার শব্দ না, বাতাসের শব্দ। আবার মনে হলে দলবেঁধে অনেকে কাঁদছে। সবাই ঘুমোচ্ছে অঘোরে। শীতের রাত। মেঘনার বাতাসের ঘ্রাণ এখনও পাচ্ছি। সবকিছু ছাপিয়ে যাচ্ছে মিহি কান্নার মতো শব্দ। মিহি কান্নার শব্দ ধীরে ধীরে বিলাপের মতো শোনাচ্ছে। কেউ কি মারা গেল? নাকি  স্বপ্ন-টপ্ন। নাকি অতিপ্রাকৃত বিষয়-টিশয়।  কে যেন দরজায় কড়া নাড়ছে। আমার কল্পনা মনে হয়। মোহাব্বত আলীর গলাইতো। সুমন বেরুল।  রাতে মারামারি হয়েছে। কতজন বেঁচে আছে অনুমান করা যাবে না, তবে গ্রামে একটা পুরুষঅ থাকতে পারবে না। ভোরের আলো ফোটার আগেই পালাতে হবে। এই যে আমরা যারা ডকুমেন্টারি করতে এসেছি, ভদ্রলোক, তারাও। পুলিশ ছেলে-বুড়া সবাইরে ধরে নিয়ে যাবে। গঞ্জের হাসপাতালে জায়গা নাই, গাছতলীর মানুষের লাশে ভরা। আধমরাদের ঢাকায় নিতে হবে। আমাদেরও ঢাকায় যেতে হবে, রাতের অন্ধকারে। ভোরের আলো ফোটার আগে একটা নৌকায় উঠলাম। নৌকাটা ভাঙা ক্যামেরা-ট্রাইপড নিয়ে রিস্ক নিয়ে উঠলাম। মোহাব্বত আলী চলে যাবে বিল পেরিয়ে। আমরা মেঘনার মাঝ-বরাবর ডিঙি নৌকায়। ভোরের আলো ফুটছে। মেঘনা আরো সুন্দর হয়ে উঠেছে।

 

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী