X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঋত্বিকের দ্বন্দ্বমূলক ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’

বিধান রিবেরু
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৪:৩৭আপডেট : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৪:৪৪

ঋত্বিকের দ্বন্দ্বমূলক ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’
“ছবির নাম হচ্ছে ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’, ‘Arguments and a story’। তোমাদের গল্প না হলে ভালো লাগে না, তাই একটা গপ্পো দিচ্ছি, আসলে এটা যুক্তি তর্ক, it is completely a political film.[১] অবশ্য ছবিতে পরিচালক ঋত্বিক ঘটক যতটা না একটি গল্প বলেছেন তারচেয়ে অনেক বেশি দ্বন্দ্ব হাজির করেছেন। দেশভাগের দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক বোঝাপড়ার দ্বন্দ্ব, সাহিত্য তথা শিল্পচর্চার দ্বন্দ্ব, দেশী বনাম বিদেশী ভাষার দ্বন্দ্ব, জোতদার বনাম গ্রামবাসীর দ্বন্দ্ব, শহুরে বনাম গ্রামীণ বিলুপ্ত প্রায় সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব এবং সর্বোপরী দেশমাতৃকা ও তার সন্তানদের দ্বন্দ্ব। এই সূত্রে ছবিটিকে একটি দ্বান্দ্বিক ছবি বললে ভুল বলা হবে না। এই দ্বন্দ্ব উপস্থাপনে ঋত্বিক আশ্রয় নিয়েছেন রূপকের (allegory)। রূপকের মাধ্যমে তিনি বারবার ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন যৌথ অচেতনে ঘাপটি মেরে থাকা আদিরূপকে (archetype)। অবশ্য ‘সচেতনভাবে যদি এই আদিম রূপকল্প চলচ্চিত্রায়িত করার চেষ্টা হয়, তাহলে তা আর ‘আদিম রূপকল্প’ থাকে না, হয়ে পড়ে allegory।”[২]

রূপক ব্যবহারের পরও ঋত্বিকের এই ছবিতে রাজনীতি দিবালোকের মতোই স্পষ্ট, কোন ধোয়াশা নেই, বলা যেতে পারে এই ছবি নিরাভরণভাবে রাজনৈতিক। অন্যদের ছবিতে ভণিতা থাকে, রাজনীতিটাকে লুকানোর চেষ্টা থাকে, কিন্তু ঋত্বিক খোলামেলা ভাবেই সমকালের রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। ১৯৭৭ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটি তিনি ১৯৭৩-১৯৭৪ সালে নির্মাণ করেছেন, যার প্রেক্ষাপট ১৯৭১ সাল। সেসময় নকশালবাড়ি আন্দোলনের উষ্ণ হাওয়ায় কলকাতা শহর উত্তপ্ত। আবার অধুনা বাংলাদেশে তখন চলছে মুক্তিযুদ্ধ, সেখান থেকেও শরণার্থী মানুষের ঢেউ আছড়ে পড়ছে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরায়। দ্বিমুখী এই সঙ্কটের ভেতর তখন পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীদেরও কিছু সঙ্কট প্রকট হয়ে ওঠে। দাহকালের উত্থানপতনে কয়েকজন বুদ্ধিজীবী নিজেদের করণীয় ঠিক করে নিচ্ছিলেন, আবার আরেক দল বুদ্ধিজীবী সেসবের তোয়াক্কা না করে বাজারকাটতি লেখালেখি বা শিল্প করে দিব্বি কাটিয়ে দিচ্ছিলেন। এটারও এক তীক্ষ্ণ সমালোচনা চোখে পড়ে এই ছবিতে।

পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭১ সালের সঙ্কট নিয়ে সত্তরের দশকে কলকাতার তিন বিখ্যাত পরিচালক ছবি করেছেন। মৃণালের ‘কলকাতা ৭১’ তথা কলকাতা ট্রিলোজিকে বলবো বেআব্রু রাজনৈতিক চলচ্চিত্র, অনেকটা ঋত্বিকের এই ছবির মতোই। অন্যদিকে, সত্যজিতের কলকাতা ট্রিলোজি যেন আব্রু পছন্দ করে, ভান করতে চায়, ওগুলো রাজনৈতিক ছবি নয়, তবে রাজনীতিতে যা হচ্ছে সেটা পরিচালকের নজরে আছে। সত্যজিৎ বরাবরের মতোই সমকালীন রাজনীতি থেকে একটু দূরে থাকতে চেয়েছেন। যেন রাজনীতি আর শিল্পী দুটি দুই দুনিয়ার জিনিস। একাধিক সাক্ষাৎকার থেকেও এটা স্পষ্ট রাজনীতি জিনিসটা সত্যজিতের নাপছন্দ। ১৯৭২-৭৩ সালে প্রকাশিত সাইট অ্যান্ড সাউন্ড পত্রিকার সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন, ‘আমি কখনই রাজনৈতিক বিষয়ে অজ্ঞাত ছিলাম না। কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই আমার ছবিতে রাজনৈতিক বিষয় আনিনি।’ [৩] এই যে ছবিতে রাজনীতি না আনা, সেটাও যে রাজনীতি, তা কিন্তু ঠিকই বুঝেছিলেন একসময়ে বামরাজনীতিতে সক্রিয় থাকা ঋত্বিক। তিনি বলছেন, “পলিটিক্স কি জীবনের বাইরে? ১৯২৮ সালে চ্যাপলিন মস্কোয় বলেছিলেন: I am interested in man. Politics is a part man. ফিল্ম apolitical -- কোন শিল্পী এ কথা বলে না। কিন্তু প্রশ্নটাই রাজনীতিভিত্তিক। Schelesinger--এর মতে পলিটিক্স ছাড়া উচিত শিল্পীর- কিন্তু এটাই পলিটিকাল কথা।”[৪]

নিজের রাজনৈতিক ও সামাজিক অভিজ্ঞতার ফলই হলো এই ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’, ঋত্বিক বলছেন, ১৯৭১ ও ১৯৭২ সালে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতারই প্রকাশ ঘটেছে এই ছবিতে। এই ছবিতে সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দর্শন নেই। রাজনীতিকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও ছবিটি নির্মাণ করেননি ঋত্বিক। নকশালপন্থী, ইন্দিরা গান্ধী, সিপিআই(এম), অথবা সিপিআই কাউকে তুষ্ট করতে অথবা নিজের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে স্লোগান আকারে চালিয়ে দেয়ার জন্যও ছবিটি বানাননি তিনি। লোকেদের মনে চিন্তার উদ্রেক করতেই বেশি আগ্রহী তিনি, সমাধান বাতলে দেয়ার চাইতে।[৫] তাই তো ছবির ভেতরেই নীলকণ্ঠরূপী ঋত্বিক লেখক সত্যজিৎ বসুর চরিত্রে থাকা উৎপল দত্তকে বলেন, ‘ভাবো ভাবো, ভাবার প্র্যাকটিস করো। তোমরা ভাবলে কাজ হবে।’

ভাবনার ভাঁজটাই দর্শকের কপালে ফেলতে চান ঋত্বিক। আর নেহাতই লোকে দেখবে না বলে একটা গল্প গুঁজে তর্কটাই উসকে দিতে চেয়েছেন তিনি। তাই এই বাহাসে তিনি আমদানি করেছেন রূপকধর্মী সব চরিত্র। নিজের চরিত্রের নাম দিয়েছেন নীলকণ্ঠ বাগচী, একজন ভাঙা ও ক্ষয়ে যাওয়া বুদ্ধিজীবী। এই চরিত্রের নাম নীলকণ্ঠ কেন? আর কেনই বা এই চরিত্রটি সর্বক্ষণ মদ পান করতে থাকে, তাও দেশী মদ? ঋত্বিক যেন এখানে শিবের প্রতিনিধি। অমৃতের সন্ধানে সমুদ্র মন্থন শুরু করতেই যখন বিষ উঠে আসতে থাকে, তখন সুরাসুর বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। দেবতাদের রক্ষার্থে নিজেই সব বিষ পান করেন শিব, স্ত্রী পার্বতী তখন শিবের গলা চেপে ধরেন, যেন বিষ দেহে প্রবেশ করতে না পারে। তখন শিবের কণ্ঠ নীল রং ধারণ করে।

ঠিক এভাবেই মানুষের কল্যাণ (অমৃত) হবে বলে বলে রাজনীতিবিদরা দেশভাগ করলেন, অথচ পরে দেখা গেল অকল্যাণ তৈরি হলো, বাস্তুহারা মানুষের ঢল নামলো দুই পাশে, দারিদ্র যেন হঠাৎ করেই জেকে বসলো, শুধু ভিটেমাটি ত্যাগই নয়, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ হলো সঙ্গী। এই অকল্যাণের বেদনা যেন সেই পৌরাণিক বিষের মতোই। এই বিষের নহর বইছিলো ১৯৭১ সালে এসেও, ঘটনার পরম্পরা হিসেবে। দেশভাগের অনিবার্য ফল হিসেবেই সে বছর সৃষ্টি হয়েছিলো বাংলাদেশের। অথচ বাংলার বিভক্তি চাননি ঋত্বিক। ‘দুই বাংলার মিলন’ ছিল তাঁর আমৃত্যু লালিত স্বপ্ন। প্রসঙ্গটি বারবারই উঠে এসেছে ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’  ছবিতে।

এই ছবিতে এক সময়ের পরিচিত বন্ধু ও সাহিত্যিকদের বলতে শোনা যায়, নীলকণ্ঠ সারাজীবন দুই বাংলার মিলন চেয়ে চিৎকার করেছে, নাটক করেছে, অথচ এই ১৯৭১ সালে ইতিহাস যখন নতুন করে লেখা হচ্ছে তখন লোকটি গলায় শুধু মদ ঢালছে। ভর্ৎসনা শুনতে হয় নীলকণ্ঠ বাগচীকে। কিন্তু নীলকণ্ঠ ততদিনে জেনে গেছে তাকে দিয়ে আর কিছু হবার নয়, তিনি ভাঙা বুদ্ধিজীবীতে পরিণত হয়েছেন, তাই তিনি তরুণদের প্রতি আশাবাদী। নকশালপন্থী এক যুবককে তাই নীলকণ্ঠ বলছে, ‘ক্রিম অব বেঙ্গল’। সেই ‘ক্রিম অব বেঙ্গল’রাই যখন ভ্রান্ত মতাদর্শের বলি হচ্ছে, তখন মানবসৃষ্ট বিষ নিজের অক্ষমতার মুখে, গলায় ঢালা ছাড়া আর দ্বিতীয় পথ খোলা থাকে না নীলকণ্ঠের। শুরু থেকে শেষ অব্দি তাই সে গলায় ঢেলে চলেছে মদ। আর সঙ্কটটা যেহেতু দেশী তাই মদটাও যেন দেশী, বিদেশী মদ সাধলেও তাতে হাত দেয় না নীলকণ্ঠ। বরং আরো এক ‘বিষফোঁড়া’য় গিয়ে আশ্রয় নেয়, পুরুলিয়ার জঙ্গলে, নকশালপন্থী সশস্ত্র বিপ্লবীদের ঘাঁটিতে।

বিষে বিষে বিষ ক্ষয় হয় কি না সেই সিদ্ধান্ত নেবে দর্শক, তবে ঘন জঙ্গলে নকশালপন্থী সশস্ত্র বিপ্লবীর সঙ্গে বাহাসে লিপ্ত নীলকণ্ঠ বলে, তারা ‘মিসগাইডেড’, ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে তরুণরা। আর বয়োজ্যেষ্ঠরা ‘কনফিউসড’, দ্বিধাগ্রস্ত। নীলকণ্ঠরূপী ঋত্বিক বলছেন, ‘হয় আমরা চোর, নয় বিভ্রান্ত— আর নয়তো কাপুরুষ হয়ে পালিয়ে যাবার মিছিলে। খাঁটি কোন বেটা না। এক শালাও না।’ আক্ষেপটাও আছে নীলকণ্ঠ বাগচীর, এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক অবস্থাকে কেউ বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেনি, সেই আক্ষেপ। সাতচল্লিশেল জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বুকে ছুরি মেরে, দুই বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করে যে স্বাধীনতা অর্জিত হলো, সেটার জন্য আক্ষেপ। নিজের কালে দেখা বুদ্ধিজীবীদের করুণ দশায় তিনি নিজেকেও আবিষ্কার করেন, আক্ষেপ আছে সেখানেও। আর এই জায়গাতেই ঋত্বিক অন্য নির্মাতাদের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন। তিনি নিজের সমালোচনা করতে জানেন। তিনি অকপটে বলতে পারেন, তিনিও দ্বিধান্বিত, ক্ষয়িষ্ণু, ভঙ্গুর।

১৯৭১ সালের মতো উত্তাল সময়ে দ্বিধান্বিত হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তাই ছবিতে হয় তো মঞ্চনাটকের প্রভাব আছে বা গল্পের সেরকম বালাই নেই, তারপরও মূল বক্তব্যে দ্বন্দ্বটা কিন্তু স্পষ্ট হয়েই ফুটেছে। যেমন নীলকণ্ঠ ও স্ত্রী দুর্গার দ্বন্দ্ব। সরল চোখে দেখলে, একজন স্বামী সংসারের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ, এ নিয়ে স্ত্রীর অভিযোগ দীর্ঘদিনের, সমস্যার সমাধান না হওয়ায় পুত্র সত্যকে নিয়ে স্ত্রীর চলে যাওয়া। কিন্তু এই ঘটনাটিকে যদি রূপক আকারে নেয়া হয়, তাহলে দেখা যাবে দুর্গা, যে সত্যের মা, সে আসলে দেশমাতৃকা, দেশের বুদ্ধিজীবীদের ত্যাজ্য করেছে। সঙ্গে আছে সত্যরূপী ইতিহাস, যা ভবিষ্যতে স্বাক্ষ্য দেবে। তাই তো শেষ প্রান্তে নীলকণ্ঠের গুলি খেয়ে মরে যাওয়াটাও প্রত্যক্ষ করে সে। আর ঐজন্যই যেন দুর্গাকে সত্যকে সঙ্গে আনতে বলেছিল নীলকণ্ঠ।

সত্য এসে কি দেখলো জঙ্গলে? দেখলো সম্ভাবনাময় বেপথু একদল যুবক সংঘর্ষে লিপ্ত শাসকগোষ্ঠীর প্রশাসনের সঙ্গে। এই দ্বন্দ্বের মাঝেই নচিকেতা ও বঙ্গবালার সমঝোতা সম্পন্ন হয়। মনে করিয়ে দিই, এই্ দুই চরিত্রই নীলকণ্ঠের যাত্রাপথের সঙ্গী। নচিকেতা নীলকণ্ঠের ছায়াসঙ্গী, আর বঙ্গবালা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসা আশ্রয়প্রার্থী। পুরাণে নচিকেতার পিতা ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে যম দর্শনের কথা বলে, মানে সোজা বাংলায় বলেছে, ‘তুই মর’। পিতার কথা ফলে যায়, নচিকেতা মারা যায়, আর চলে যায় যমালয়ে। সৌভাগ্যই বলতে হয়, তিন দিন গৃহে উপস্থিত ছিলো না যম, যখন সে ফিরে এলো, দেখলো নচিকেতা তিনদিন কিছু না খেয়েই অপেক্ষা করছে তার জন্য। অতিথি না খেয়ে অপেক্ষা করছে, এটা তো লজ্জার ব্যাপার! যম তাই বলল, তোমার পিতার আদেশ মোতাবেক আমার সাথে তোমার দেখা হয়েছে এবার তুমি ফিরে যেতে পারো। যমের ঘর থেকে ফিরে এলো নচিকেতা। অর্থাৎ মৃত্যুকেই জয় করলো সে। এখন এই মৃত্যুঞ্জয়ী নচিকেতার সঙ্গেই তো দেখা হবে বঙ্গবালার। বঙ্গবালা যে বাংলাদেশের মাতৃরূপ, মায়ের সেই আদিরূপকল্প বা আর্কিটাইপ। এজন্যই দুর্গা ও বঙ্গবালার সখ্য জমে ওঠে। একারণেই নীলকণ্ঠ দুজনের কাছেই সন্তানের মতো।

নীলকণ্ঠ সম্পর্কে বঙ্গবালা যখন দুর্গাকে বলে, ‘এক্কেরে পোলাপান’ তখন দুর্গা প্রশ্ন করে, ‘আর তুই, তুই মা? তুই তো জানিস ও কি রকম দায়িত্বজ্ঞানহীন, কাণ্ডজ্ঞানহীন।’  বঙ্গবালা উত্তরে বলে, ‘মুই কাণ্ডজ্ঞান এক্কেরে সিলাইয়া দিমু।’ এই সেলাইয়ের কথাটি বলার আগ পর্যন্ত দুই মার্তৃরূপকে একটি স্তম্ভের দুই পাশে দেখা যায়। একটা বিভেদ। যেন বঙ্গমাতার মাঝখানে সীমান্তরেখা, বিভাজন রয়েছে। যখনই কাণ্ডজ্ঞান সেলাইয়ের কথা বলা হচ্ছে তখনই ক্যামেরা কোন পাল্টে যায়, পিলার বা স্তম্ভ সরে যায় একদিকে। দুই মাকে দেখা যায় একপাশে। সংলাপ ও চলচ্চৈত্রিক ভাষার মাধ্যমে দেশভাগ ও দুই বাংলার মিলনাকাঙ্ক্ষার এতোটা নান্দনিক দৃশ্য আর কে রচনা করতে পারবেন ঋত্বিক ছাড়া? ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে ঋত্বিক বলছেন, ‘দেখুন আমি একটা transcendental ব্যাপার করতে চেষ্টা করেছি। আমার কাছে বাংলা একই বাংলা, আমি মনে মনে সীমানা মানি না। সীমাটা ইতিহাসের পরিহাস। আমার কাছে দুই বাংলা নেই, ভালোবাসার রাজ্যে বাংলা এক মা। একজন মায়ের আবার ভাগ কি?’[৬]

বঙ্গমাতাকে যারা ভাগ করেছেন, তাদের প্রতি যেমন ঋত্বিক প্রশ্নবাণ ছুড়ে দেন, তেমনি শ্রমিকদের নিয়ে যারা রাজনীতি করেন, শ্রমিকনেতা, তাদের ভূমিকাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেন। একটা এন্টি-থিসিস দাঁড় করান। এইসব নেতার বক্তৃতা দিয়ে কি আদতেই শ্রমিকদের মঙ্গল হয়? নাকি সেটা ফাকা বুলিতে পর্যবসিত হয়? শ্রমিকনেতাদের বড় বড় কথার বক্তৃতাকে তাই দেখা যায় ঋত্বিক তুলনা করছেন কুকুরের বকাবকির সঙ্গে। ছবিতে সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব দেখাতেও ভুলে যান না ঋত্বিক। তিনি ইঙ্গিত করেন বাংলা ভাষার উৎস এখানকার মাটিতেই, ‘অংবং’ বলা সংস্কৃত বাংলার উৎস নয়, ওটা বিদেশী ভাষা। এখানে পল্লীর পঞ্চানন শেকড়ের প্রতিভূ আর জগন্নাথ বিদেশী ভাষার প্রতিনিধি। জগন্নাথ কারণে অকারণে সংস্কৃত শ্লোক আওড়ান, ঋত্বিক দেখাতে চাইলেন সংস্কৃত সকল কিছুর ওপরই জোর করে বসতে চায়। কিন্তু মাটিসংলগ্ন যারা, পঞ্চাননের মতো, তারা এই জোরজবরদস্তি পছন্দ করে না। তাদের কাছে জগন্নাথের ‘অংবং’ এলিট ভাষা। পঞ্চানন আরো একটি দিক ইঙ্গিত করেন, সেটি হলো লোকসংস্কৃতির অংশ যে মুখোশ, শহুরে মানুষ এখন সেটিকে শোকেসে নিয়ে সাজিয়ে রাখেন। অর্থাৎ লোকসংস্কৃতি এখন আর চর্চার বিষয় নেই, এটি এখন সাজিয়ে রাখার বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। 

সংস্কৃতি ও ভাষার মতোই দেখা যায় জোতদারদের সঙ্গে গ্রামবাসীদের দ্বন্দ্ব। গ্রামের মাধব জোতদারের গুলিতে জগন্নাথ নিহত হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এরই ফাঁকে ছৌনাচের উসিলায় রাবণবধের কাহিনীও বয়ান করে দেন ঋত্বিক। জোতদার যেন দশানন। আর বিশাল হনুমানবাহিনী হলো গ্রামবাসী। ভূমিসংস্কারের দাবিতে সাঁওতালদের তীরধনুক যে উত্থিত সেটা দেখাতেও ভোলেন না ঋত্বিক। ছবির এক পর্যায়ে বঙ্গবালা ছৌনৃত্যে নাচতে চায়, তখন সাঁওতাল পঞ্চানন বলে, ‘নাচো মা ঠাকুরন নাচো, তোমরা না নাচলে কিছুটি হবার নয়’; শুধু নারী নয় দেশমাতৃকাকেই জেগে ওঠার বার্তা দেন ঋত্বিক এখানে, জোতদারদের বিরুদ্ধে, শোষকের বিরুদ্ধে।

এমনভাবে দেখলে গোটা ছবিতেই দেখা যাবে ঋত্বিক নানামুখী দ্বন্দ্বের কথাই বলেছেন। তাছাড়া ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’  ছবিটাও শুরু হয়েছে যুদ্ধ দামামার সঙ্গীত দিয়ে। কারো সাথে যেন যুদ্ধ ঘোষণা করছেন ঋত্বিক। এরপর দেখা যায় এক বৃদ্ধকে, এই বৃদ্ধ যেন ত্রিকালদর্শী স্বয়ং সময়। সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। কি দেখছে? ভূতের নৃত্য। কালো কাপড়ে মোড়ানো অশরীরিদের নাচন। ঋত্বিক মনে করতেন ভূতের নৃত্যই চলছে পুরো বঙ্গদেশে। এক সাক্ষাৎকারে ঋত্বিক বলছেন, ‘আমি বাপু বলতে চেয়েছি ভূতের নৃত্য চলছে গোটা বাংলা দেশে ।’[৭] ছবির শেষ অঙ্কে এসেও এই ভূতের নাচ দেখা যায়। বাংলায় যেন এই নৃত্য আর শেষই হচ্ছে না। আর ওদিকে বৃদ্ধ সময় বসে বসে সেটা দেখেই যাচ্ছে।

দেশমাতৃকা এজন্য সন্তানদের দোষারোপ করছে, তাদের অযৌক্তিক মৃত্যুবরণ দেখছে, তাদের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা দেখছে, শোষণ দেখছে, দেখছে খুনোখুনি, দ্বন্দ্ব। তারপরও আরেক মাতৃরূপ, বঙ্গবালা যার নাম, তার মধ্য দিয়েই নচিকেতার সঙ্গলাভ তথা মৃত্যকে জয় করে সামনে এগুনোর কথাই বলতে চান ঋত্বিক। অনেক সমালোচক বঙ্গবালার সঙ্গে নচিকেতার এই মিলনের বিষয়টি ধরতেই পারেননি। ঋত্বিক কি অযথা এই দৃশ্য জুড়ে দেয়ার মানুষ? অনেকেই আবার সমালোচনা করেছেন এই ছবিতে কোনো কাঠামো নেই। কাঠামো তো তৈরিই করতে চাননি ঋত্বিক। তিনি চেয়েছেন বঙ্গদেশে যে দ্বন্দ্ব চলছে সেটারই এক কোলাজ হাজির করতে, যে দ্বান্দ্বিক অবস্থার ভেতর দিয়ে এই ভূখণ্ডের মানুষ জীবন অতিবাহিত করছে সেটাকে ছোট ছোট নোক্তা আকারে হাজির করতে।

শেষ করবো একটি দ্বিমত দিয়ে। পশ্চিবঙ্গের সমালোচক দীপেন্দু চক্রবর্তী বলছেন, “‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’তে মার্কসবাদী ঋত্বিক, ইয়ুংবাদী ঋত্বিক, এবং শিল্পী ঋত্বিক পরস্পর মারামারি করে নিহত হয়, শুধু বেঁচে থাকে সেই ঋত্বিক যাঁর মানবদরদ ও অনুভূতি অপরাজেয়।” [৮] এই মন্তব্যটি ঠিক নয়।

মার্ক্সবাদে ইতিহাসকে বোঝার ও সত্যকে জানার জন্য যে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়, হেগেলের ঋণ স্বীকার করে, ঋত্বিক এই ছবিতে সেই পদ্ধতিরই প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। আর্থসামাজিক অবস্থায় নানামুখী দ্বান্দ্বিক অবস্থান থেকে ঋত্বিক সত্যকে জানার চেষ্টা করেছেন, ইতিহাসকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। একারণেই ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ ছবির শুরুতেই দেখা যায় বৃদ্ধরূপী সময়, আর নীলকণ্ঠের পুত্রের নাম রাখা হয় সত্য। মার্ক্সের এই পদ্ধতি অর্থাৎ দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদকে ঋত্বিক ছবিতে উপস্থাপন করেছেন রূপক আকারে, যে রূপকের পেছনে তিনি সচেতনভাবেই রেখেছেন আদিরূপকল্পের ধারণা। যদিও মার্ক্সবাদ ও ইয়ুংবাদ দুটো দুই মেরুর জিনিস। তারপরও ঋত্বিক ছবিতে মার্ক্সবাদের সঙ্গে কার্ল গুস্তাফ ইয়ুংয়ের কৌম অচেতন ও আদি রূপকল্পের মিশেল ঘটিয়েছেন অসাধারণ দক্ষতায়। এই দক্ষতা ঋত্বিকের সমসাময়িক নির্মাতাদের মধ্যে বিরলই বটে। তাই মার্ক্সবাদ, ইয়ুংবাদ বা মানববাদ, যাই বলি না কেন, সবকিছু নিয়েই ঋত্বিক আজো বেঁচে আছেন, কালকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে। 


 

বোধিনী

১. ঋত্বিক ঘটক, ঋত্বিক ঘটক: একটি সাক্ষাৎকার, চলচ্চিত্র মানুষ এবং আরো কিছু, দে’জ পাবলিশিং, ২০০৭, কলকাতা, পৃষ্ঠা-২৯৩। সাক্ষাৎকারটি প্রথম প্রকাশ হয় ‘চিত্রবীক্ষণ’ (সেপ্টেম্বর ১৯৭৩) পত্রিকায়।

২. নিত্যপ্রিয় ঘোষ, ঋত্বিক ঘটক: যুক্তি তক্কো আর গপ্পো, ঋত্বিকচর্চা, চণ্ডী মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত, প্রতিভাস ২০১৭, কলকাতা, পৃষ্ঠা-১১৯

৩. শুভেন্দু দাশগুপ্ত, সত্যজিৎ রায়: নিজের কথায়, সত্যজিৎ রায়: ভিন্ন চোখে, শীতলচন্দ্র ঘোষ ও অরুণকুমার রায় সম্পাদিত, ভারতী বুক স্টল, ২০০২, কলকাতা, পৃষ্ঠা-২৫।

৪. ঋত্বিক ঘটক, সুখ অসুখ ও ঋত্বিক ঘটক, চলচ্চিত্র মানুষ এবং আরো কিছু, দে’জ পাবলিশিং, ২০০৭, কলকাতা, পৃষ্ঠা-২৬৪। সাক্ষাৎকারটি প্রথম প্রকাশ হয় ‘আন্তর্জাতিক আঙ্গিক’(বসন্ত-গ্রীষ্ম ১৩৭৯-১৩৮০ বাং) পত্রিকায়।

৫. ঋত্বিক ঘটক, শেষ সাক্ষাৎকার প্রথম নমস্কারের আগে, সাক্ষাৎকার চতুষ্টয়, মুহম্মদ খসরু, উলুখড়, ২০০৮, ঢাকা, পৃষ্ঠা-৪৬। প্রথম প্রকাশ মুহম্মদ খসরু সম্পাদিত ‘ধ্রুপদী’ (এপ্রিল, ১৯৭৭) পত্রিকায়।

৬. ঋত্বিক ঘটক, ঋত্বিক ঘটক ও দুই বাংলার ছবি, চলচ্চিত্র মানুষ এবং আরো কিছু, দে’জ পাবলিশিং, ২০০৭, কলকাতা, পৃষ্ঠা-২৬৩। সাক্ষাৎকারটি প্রথম প্রকাশ হয় ‘চিত্রপট’ (অক্টোবর ১৯৭২) পত্রিকায়।

৭. দীপেন্দু চক্রবর্তী, ঋত্বিকের যুক্তি, ঋত্বিকের তক্কো, ঋত্বিকের গপ্পো, ঋত্বিক ঘটক, রজত রায় সম্পাদিত, প্রতিভাস, ২০১১, কলকাতা, পৃষ্ঠা-২৯২।

৮. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৯৩

দোহাই

১. Ritwik Ghatak, Cinema & I, A collection of writings and interviews, Dhyanbindu and Ritwik Memorial Trust, 2015, Kolkata.

 

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
খুলনায় এ যাবতকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এ যাবতকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে ভিত্তিহীন তথ্য রয়েছে
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিমার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে ভিত্তিহীন তথ্য রয়েছে
পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে হাজার কোটি টাকার কাজ চলছে: প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল
পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে হাজার কোটি টাকার কাজ চলছে: প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল
‘আশ্রয়ণ’: গ্রামীণ বসতি রূপান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়
‘আশ্রয়ণ’: গ্রামীণ বসতি রূপান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা