রাত আটটার দিকে বারান্দার বাল্বটা ফিউজ হয়ে গেল। এনার্জি সেভিং বাল্ব। ফটাস করে শব্দ হলো। ঝুরঝুর করে টুকরো টাকরা ছড়িয়ে পড়ল। বারান্দা অন্ধকার। এই নিয়ে তিনবার ঘটল এই ঘটনা। এক সপ্তাহের মধ্যে। আমরা এই ফ্ল্যাটে এসেছি দিন দশেক হলো। আসার তিনদিন পর বারান্দার বাল্ব প্রথম ফিউজ হলো। নতুন বাল্ব এনে লাগিয়ে দিল কেয়ারটেকার। দুদিন পর একই অবস্থা। রাত আটটার দিকে দ্বিতীয় বাল্বটাও গেল। লাইনে গণ্ডগোল আছে কিনা দেখার জন্য ইলেকট্রিসিয়ান আনা হলো। না কোথাও ঝামেলা নেই লাইনে। নতুন বাল্ব লাগিয়ে দিয়ে গেল। তিনদিন পর আজ সেই বাল্বটাও গেল।ঠিক আটটার দিকেই কাণ্ডটা ঘটে। শব্দ শুনে মনে হয় কেউ যেন লাঠি দিয়ে বাড়ি দিয়ে বাল্ব চুরমার করে দিয়ে গেল। ময়না ছিল রান্নাঘরে। বাল্ব ফাটার শব্দে ছুটে এলো।
আপা, ওই দেখেন, আজও বাল্বটা গেল।
তাই তো দেখছি।
ব্যাপারটা কী বলেন তো? দশদিনের মধ্যে তিনটা বাল্ব গেল। তাও শুধু বারান্দার ওই বাল্ব।
আমিও কিছুই বুঝতে পারছি না।
এই ফ্ল্যাটে আপা গণ্ডগোল আছে।
বেডরুমে আধশোয়া হয়ে আমি টিভি দেখছি। স্টার জলসায় খুবই পপুলার একটা সিরিয়াল চলছে। এই সিরিয়ালটা আমি মিস করি না। গল্পের বেশ একটা টার্নি পয়েন্টের মধ্যে আছে সিরিয়াল। প্রায় দম বন্ধ করে দেখছি। তার পরও ময়নার কথায় মুখ ফিরিয়ে তাকালাম। গণ্ডগোল মানে? কিসের গণ্ডগোল?
বোঝেন নাই?
না।
ফ্ল্যাটটা ভালো না।
ভালো না মানে কী? কী হয়েছে ফ্ল্যাটের?
এই ফ্ল্যাটে থাকতে আমার আপা অসুবিধা হইতাছে।
দাঁড়া, সিরিয়াল দেখা শেষ করে কথা বলছি। এই ফাঁকে তুই রান্না শেষ কর। সাহেবের আসার সময় হয়ে গেছে।
আইচ্ছা।
মিনিট পনেরো পর আমি কিচেনের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ময়না রান্না শেষ করে এনেছে। আমার সিরিয়াল দেখাও শেষ।
ময়না।
জ্বি আপা।
এবার বল।
বলছিলাম এই ফ্ল্যাটটা ভালো না। এখানে থাকতে আমার কী রকম জানি লাগে।
আমি হাসলাম। কী রকম লাগে?
ওইটারে কী জানি বলে? অস্বস্তি। অস্বস্তি লাগে আপা, অস্বস্তি।
বাহ্, ভালো শব্দ বলছিস দেখি। অস্বস্তি। তা অস্বস্তিটা কী রকম?
মনে হয় এই ফ্ল্যাটে আমরা তিনজন ছাড়াও আরও কেউ থাকে।
বলিস কী?
জ্বি আপা। এইটা এই ফ্ল্যাটে আসার দুই তিনদিন পর থিকাই আমার মনে হয়।
কেন এরকম মনে হয়?
সেইটা পরিষ্কার কইরা বলা মুশকিল।
ময়নার সঙ্গে মজা করে কথা বলি মাঝে মাঝে। বহুদিন ধরে আমাদের সঙ্গে আছে। অনাথ মেয়ে। আগে আমাদের বাড়িতে ছিল। অর্থাৎ আমার বাবার বাড়িতে। সেই আট দশ বছর বয়স থেকে। আমি যখন ক্লাস টেনে পড়ি, তখন থেকে। আমাকে খুবই পছন্দ করে। আমাদের বাড়িতে এসেই আমাকে সবচে’ বেশি পছন্দ করল। আমারও ভালো লাগল মেয়েটিকে। আমার টুকটাক কাজ করে। আমি ওকে বাড়িতেই লেখাপড়া শিখাতাম। সুন্দর করে কথা বলা শিখাতাম। যদিও দুয়েকটা গ্রাম্য শব্দ সে বলে ফেলে। তবু বেশিরভাগ কথাই সুন্দর করে বলে। ধীরে ধীরে সংসারের সব কাজ শিখল। আমার বিয়ে হলো। বিয়ের পর চলে এলো আমার সঙ্গে। আমাকে ছাড়া সে থাকবে না।
ময়না বড় হয়েছে। এখন কুড়ি একুশ হবে বয়স। দু চার বছরের মধ্যে বিয়ে দিতে হবে। ময়নার প্ল্যান বিয়ের পরও সে আমার সঙ্গেই থাকবে। যার সঙ্গে বিয়ে হবে তাকে যেন আমরা ড্রাইভার বা ফ্ল্যাটের দেখভালের জন্য রাখি। ততোদিনে নিশ্চয় আমাদের নিজস্ব ফ্ল্যাট হবে। লোক আমাদের তখন লাগবেই। অর্থাৎ ওরা স্বামী স্ত্রী আমাদের সঙ্গেই থাকবে। শুনে বলেছি, আচ্ছা ঠিক আছে। তোর প্ল্যান মতোই তোর বরকে আমাদের সঙ্গে রেখে দেব।
এখন ময়না যখন বলল, পরিষ্কার করে বলা মুশকিল, শুনে হেসে বললাম, তাহলে অপরিষ্কার করেই বল।
আমার কথা শুনে ময়নাও হাসল। না আপা, ফাইজলামি না। আমি সত্যি বলছি। এই ফ্ল্যাটে আমার অস্বস্তি লাগে। আপনাদের বাড়িতে এতদিন ছিলাম, আপনার বিয়ের পর দেড় বছর থাকলাম মোহাম্মদপুরের ফ্ল্যাটে। কোথাও এরকম লাগেনি। উত্তরার এই ফ্ল্যাটে এসে আপা, আমার ভালো লাগছে না।
ভালো লাগবে না কেন? ফ্ল্যাটটা খুব সুন্দর। লেকের সামনে ফ্ল্যাট। বারান্দায় দাঁড়ালে লেক দেখা যায়। লেকের ধারে কত গাছপালা, ফুল পাতাবাহারের ঝোপ। সবুজ ঘাস আছে ঝোপঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে। কী সুন্দর হাওয়া বয়, কত পাখি ডাকে। এরকম পরিবেশে তিনতলার এই ফ্ল্যাট তোর ভালো লাগছে না শুনে আমি অবাক হচ্ছি। কিসের অস্বস্তি তাও বুঝতে পারছি না।
ওই যে বললাম, মনে হয় এই ফ্ল্যাটে আমরা তিনজন ছাড়াও আর কেউ যেন থাকে।
কী যে বলিস?
খাবার দাবার গুছিয়ে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে রাখতে রাখতে ময়না বলল, আমার ওই রকম মনে হলে আমি কী করবো বলেন? আমার খালি মনে হয় এই ফ্ল্যাটে আমরা ছাড়াও আরও কেউ থাকে। সত্যি আপা। আমি মিথ্যা বলছি না।
আমি খিলখিল করে হেসে উঠলাম। কী থাকে? ভূত?
আপনি হাসেন আর যাই করেন আপা, আমার কথাটা সত্য। আমি মাঝে মাঝে টের পাই।
ভূত প্রেতের ভয় আমার নেই। তার পরও ময়নার কথা শুনে আমি একটু সিরায়াস হলাম। কখন টের পাস? দিনে না রাতে?
দিনে কম পাই। বেশি অস্বস্তি লাগে রাতে।
দিনে কবার পেয়েছিস?
দিনে পেয়েছি আপা একবার। একদিন দুপুরের পর। ওই সময় ফ্লাটে আমি থাকি একা। আপনি আপনার ব্যাংকে, দুলাভাই তাঁর অফিসে। আমি সব কাজ শেষ করে আমার রুমে শুয়ে টেলিভিশন দেখি, ঘুমাই। ওরকম একদিন টের পেলাম।
ফ্ল্যাটে আসার কদিন পর?
তিনদিন পর। সেদিন রাতেই বারান্দার বাল্ব প্রথম ওরকম ফটাস করে ফিউজ হলো। আর ওই ফিউজের সঙ্গে সঙ্গে...
আগে দিনের ঘটনা বল।
আমি শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছি, বোধহয় একটু ঝিমুনিও এসেছিল। হঠাৎ মনে হলো দরজার সামনে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে।
যাহ্!
সত্যি আপা। মনে হলো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কে যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
এটা আসলে তোর মনের ভুল। চোখের ভুল। টিভি দেখছিলি। তন্দ্রা মতন এসেছিল। ওরকম অবস্থায় এমন মনে হতে পারে।
না আপা। আমার এমন কোনোদিন হয় নাই। মোহাম্মদপুরের ফ্ল্যাটেও তো আমি একাই থাকতাম। আপনি আর দুলাভাই যার যার অফিসে। ওই ফ্ল্যাটে কোনোদিন এমন হয় নাই।
এবার রাতেরটা বল। বাল্ব ফিউজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কী মনে হলো?
মনে হলো ওদিককার খোলা জানালার পর্দা কয়েক সেকেন্ডের জন্য সরে গেল। জানালা দিয়ে কে যেন ঢুকলো ফ্ল্যাটে।
আমি আবার হাসলাম। ধুৎ। কী বলছিস এসব?
আমার যা মনে হয়েছে তাই বলছি আপা।
জানালা খোলা ছিল, তবে পর্দা টানা ছিল। নিশ্চয় ওসময় লেকের দিক থেকে হাওয়া এসেছে, পর্দা একটু সরেছে আর তোর অমন মনে হয়েছে।
ময়না কথা বলল না। সে আনমনা।
আর কী রকম অস্বস্তি বল।
রাতেরবেলা আপনারা শুয়ে পড়ার ঘণ্টাখানেক পর শুতে যাই আমি। হাতের কাজটাজ সব গুছিয়ে। কিচেনে যাই, ডাইনিং স্পেসে যাই, আমার রুমে যাই। ওই রকম সময় মনে হয় কে যেন আমার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটে আপা।
কী?
হ্যাঁ আপা ছায়ার মতন।
তুই দেখেছিস সেই ছায়া?
না আপা, দেখি নাই। আমার খালি মনে হয়। আর শুধু অস্বস্তি লাগে। মনে হয় কেউ আমার পিছনে আছে।
রাতে তোর রুমেও কি এমন লাগে?
লাগে আপা। দরজা বন্ধ করে শুই। কিন্তু অস্বস্তি লাগে।
কী রকম অস্বস্তি?
মনে হয় আমার রুমে যেন আরও কেউ আছে। আর আজ নিয়ে তিনদিন আপা, আপনি খেয়াল করেছেন কিনা, বাল্বগুলি কিন্তু একই টাইমে ভাঙে। ঠিক আটটার দিকে। মনে হয় কে যেন বাড়ি দিয়ে ভাঙছে। তার পরই মনে হয় জানালা দিয়ে অন্ধকারে কেউ আমাদের ফ্ল্যাটে ঢুকছে।
আমি এই আলোচনাটা অন্যদিকে ঘোরালাম।
ময়না।
জ্বি আপা।
আমাদের বাড়িতে আসার আগে তুই গ্রামে ছিলি না?
হ্যাঁ গ্রামেই তো ছিলাম। আর কোথায় থাকবো?
তোদের গ্রামটা কী রকম?
আমি থাকতাম মামাদের কাছে। মা মারা যাওয়ার পর... আরেকটু আগে থেকে বলি আপা। আমার বাবার বাড়িটা ছিল অনেক মানুষের বাড়ি। দশ পনেরোটা ঘর বাড়িতে। অনেক মানুষ। মা মারা গেল আমার তখন পাঁচ ছয় বছর বয়স। মারা গেল আরেকটা বাচ্চা হতে গিয়ে। বাচ্চাটাও মরা হলো, মাও মারা গেল। ছয় সাতমাস পর বাবা আবার বিয়া করল। সেই মা আইসা...
এসব জানি। সৎমা তোকে খেতে দিতো না, মারধোর করতো। এজন্য তোর মামারা তোকে নিয়ে গিয়েছিল।
হ্যাঁ আপা। আমার তিনমামা। নিয়ে গিয়েছিল মেজোমামা। সেই মামা আমাকে খুব আদর করতো। গরিব মানুষ। সংসারে চারটা ছেলেমেয়ে। নিজের সংসারই চলে না। আমাকে পালবে কেমন করে? তাও কয়েক বছর পাললো। তারপর কাজে দিল আপনাদের বাড়িতে।
তোর মামাদের বাড়িটা কেমন ছিল?
সেই বাড়িটা আপা গরিব মানুষের বাড়ি।
আরে তা তো বুঝলাম। আমি বলতে চাইছি ঝোপজঙ্গল বা ভয় পাওয়ার মতো বাঁশঝাড় তেঁতুলগাছ এসব ছিল কিনা?
ময়না হাসলো। তা ছিল। বাঁশঝাড় ছিল, আমগাছ কলাগাছ নিমগাছ তেঁতুলগাছ এসব ছিল। আপনি যেটা বলতে চাইলেন সেইসব ছিল না আপা। ভূত পেতনি ছিল না। ওইসব আমরা দেখি নাই। বাড়িটা গাছপালা ঘেরা বাড়িই ছিল তবে ভূত পেতনি ছিল না। আর আমার বাপের বাড়ি তো ছিল পঞ্চাশ ষাটজন মানুষের বাড়ি। গাছপালাও কম ছিল। ওরকম বাড়িতে ভূত পেতনি থাকার প্রশ্নই ওঠে না। এত মানুষের বাড়িতে ভূত থাকে না।
তার মানে আমার প্রশ্নটা তুই বুঝেছিস?
বুঝবো না কেন? আপনি জানতে চাইছেন ভূতের ভয় আমার আছে কিনা? ঠিক না?
ঠিক।
ভূতের ভয় কম বেশি সবারই থাকে আপা। আমারও আছে। তবে খুবই কম। আপনার নাই?
আমার অবস্থাও তোর মতোই। আছে একটু একটু। ভূতের বই পড়ে, সিনেমা দেখে একটু একটু ভয় পাই আবার মজাও পাই।
আমিও ভূতের সিনামা দেখি আপা। আমারও খুব মজা লাগে।
এর মধ্যে কোনো সিনেমা দেখেছিস?
না আপা, এই ফ্ল্যাটে আইসা দেখি নাই।
এসময় ডোরবেল বাজলো। আমি গিয়ে দরজা খুললাম। রূপম এলো। বারান্দা অন্ধকার কেন? আজও বাল্ব ফিউজ হয়েছে? আশ্চর্য ব্যাপার! বারান্দার বাল্বই শুধু ফিউজ হচ্ছে!
আমি হেসে বললাম, ভুতুড়ে কারবার। দশদিনে তিনটা বাল্ব গেল। ইলেকট্রিসিয়ান এসে দেখে গেল। বলল কোনো সমস্যা নেই তার পরও একই কাণ্ড।
রূপম গম্ভীর। এটা কেমন কথা? সব ঠিক আছে তার পরও বাল্ব শুধু ফিউজই হচ্ছে। ইলেকট্রিসিয়ান কি সমস্যাটাই ধরতে পারছে না, নাকি?
ময়না বলছে, এই ফ্ল্যাটে ভূত আছে। ভূতটা আসে রাত আটটার দিকে। আলোতে তো আর আসতে পারে না, এজন্য বাল্বটা গুড়িয়ে দিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে ফ্ল্যাটে ঢোকে।
রূপম হাসলো। ময়না দেখি ভালোই গল্প ফেঁদেছে।
রূপম ময়নার দিকে তাকালো। কী রে ময়না, ভূতটা দেখতে কেমন?
ময়না কথা বলল না। আমি বললাম, ফ্রেশ হয়ে আসো। খাওয়া দাওয়ার পর আমি তোমাকে বলবো ময়না কী বলেছে? তার অনুভূতি কী?
রূপম বেডরুমের দিকে চলে গেল।
সে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে বড় জব করে। উত্তরাতেই অফিস। আমি যে ব্যাংকে আছি, আমার ব্রাঞ্চটাও উত্তরায়। মোহাম্মদপুর থেকে আসতে যেতে অনেকটা সময় চলে যায়। ঢাকার যানজটের অবস্থা সবাই জানে। পনেরো মিনিটের পথ যেতে লাগে দুঘণ্টা। এজন্য আমরা উত্তরায় চলে এলাম। এই ফ্ল্যাট থেকে অফিসে যেতে পনেরো বিশ মিনিট লাগে। সকালবেলা আমাকে আমার ব্যাংকে ড্রপ করে রূপম চলে যায় তার অফিসে। নিজেই ড্রাইভ করে। আমাদের নীল রংয়ের একটা টয়োটা এলিয়েন আছে।
খাওয়া দাওয়ার পর ময়নার কথাগুলো রূপমকে বললাম। শুনে সে হাসলো। নতুন জায়গায়, নতুন ফ্ল্যাটে এসে এরকম অনুভূতি কারও কারও হতে পারে। আমাদের ফ্ল্যাটটা গলির একেবারে শেষ মাথায়। ডেড এন্ড। একটু বেশিই নির্জন। সামনে লেক, গাছপালা। সারাদিন মেয়েটা একা একা থাকে। এজন্য ওর এরকম অনুভূতি হচ্ছে। কয়েকদিন থাকলে ঠিক হয়ে যাবে।
বিছানায় গা এলিয়ে রূপম বলল, এখানে এসে আমি খুব ভালো আছি, বুঝলে?
ভালো যে আছো তাতো দেখতেই পাচ্ছি। অফিস থেকে বেরিয়ে জিমে যাচ্ছো, সুইমিং করছো, তোমার তো এসবেই আনন্দ।
সত্যি, এসবেই আমার আনন্দ। আমি সেই পুরনো থিউরিটা মনে প্রাণে মেনে চলি। স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। শরীর ঠিক না থাকলে কোনো কিছুই ঠিক থাকবে না। ময়নার শরীর ঠিক আছে তো?
মানে?
নতুন জায়গায় এসে ঠিকঠাক মতো ঘুম হচ্ছে কিনা, খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করছে কিনা?
হঠাৎ ময়নার শরীরের কথা জিজ্ঞেস করছো কেন?
শরীর ঠিক না থাকলে অনেক সময় এরকম আবোল তাবোল চিন্তা হয় মানুষের।
না, ময়না ঠিক আছে। ওর কথা শুনে আমিও একটু চিন্তিত।
রূপম চট করে আমার দিকে তাকালো। মানে?
অন্য বিষয়গুলো বাদ দিলাম, বাল্ব ফেটে যাওয়ার ব্যাপারটা কী?
আরে ওটা কিছুই না। ভালো ইলেকট্রিসিয়ান এনে লাইনটা ভালো মতো দেখাতে হবে। লাইনে গণ্ডগোল আছে। যে ইলেকট্রিসিয়ান দেখে গেছে ওই ব্যাটা ব্যাপারটাই ধরতে পারেনি।
একটু থেমে বলল, জয়া, তুমিও কি ভূতে বিশ্বাস করতে শুরু করলে? ভয় পেতে শুরু করলে?
আমি কথা বললাম না।
ঠিক তিনদিন পর ঘটলো আরেক ঘটনা।
দুই
আজ শনিবার। শনিবার দিনটা আমরা সাধারণত দুটো জায়গায় কাটাই। হয় রূপমদের বাড়িতে, নয় আমাদের বাড়িতে। উত্তরায় এসেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি প্রথম শনিবারটা কাটাবো রুপমের মা বাবা ভাইবোনের সঙ্গে, পরের শনিবারটা আমার মা বাবা ভাইবোনের সঙ্গে। রূপমদের বাড়ি মোহাম্মদপুরে, আমাদের মগবাজারে। আজ গিয়েছিলাম মগবাজারে।
শুক্রবার দিনের বেলায় আমরা সাধারণত কোথাও যাই না। সারা সপ্তাহ কাজ করে খুবই ক্লান্ত হই। শুক্রবার সাড়ে এগারোটা বারোটা পর্যন্ত ঘুমাই। একেবারেই অলসভাবে বিকাল পর্যন্ত কাটাই। সন্ধ্যাবেলা কোথাও কোথাও বেরোই। আর শুক্রবার কোনো কোনো অনুষ্ঠানও থাকে। বিয়ে বৌভাত জন্মদিন ম্যারেজ এনেভারসরি। ওসবে যেতে হয়। রূপমের বন্ধুরা কেউ কেউ পার্টি দেয়, আমার বন্ধুরা দেয়। ওসবে যাই।
নিজেদের বাড়িতে যাই শনিবার। বিয়ের কয়েক মাস পরই আমরা আলাদা ফ্ল্যাটে উঠে গিয়েছিলাম। আমার শ্বশুর শাশুড়ি দুজনই খুব আধুনিক মানুষ। বললেন, বিয়ের পর নিজের মতো করে থাকা ভালো।মোহাম্মদপুরেই আমাদের একটা ফ্ল্যাট নিয়ে দিলেন। সেখানে দেড় বছর কাটালাম আমরা। ময়না তো সঙ্গে আছেই।
আজ মগবাজার থেকে ডিনার করে ফিরেছি। সাড়ে দশটা বাজে। তিনতলার ফ্ল্যাট বলে আমরা সাধারণত লিফট ইউজ করি না। হেঁটেই ওঠানামা করি। লিফট আর সিঁড়ি বিল্ডিংয়ের মাঝামাঝি জায়গায়। আমাদের ফ্ল্যাটটা উত্তর দিকে। তিনতলায় উঠেই দেখি বারান্দা অন্ধকার। তার মানে আজও বাল্ব গেছে।
ফ্ল্যাটের দিকে আসতে আসতে রূপম বলল, এ তো দেখি ভালো যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। বারান্দার বাল্ব থাকছেই না। তিন চারদিন পর পরই চুরমার হচ্ছে। এ কী কাণ্ড?
আমার মনে হচ্ছে ময়নার কথাই ঠিক।
মানে?
কী যেন একটা আছে এখানে।
ধুৎ। আমি কালই কেয়ারটেকারের সঙ্গে কথা বলবো। না না ওটাকে দিয়ে হবে না। সরাসরি বাড়িঅলার সঙ্গেই কথা বলবো। এর একটা বিহিত কালই আমি করছি।
ফ্ল্যাটে ঢুকে আমি আর রূপম হতভম্ব। দুজনেই নাকে হাত দিলাম। কী রে ময়না, গন্ধ কিসের?
এটা আপা আমিও বুঝতে পারছি না।
পঁচা শুঁটকির গন্ধ। আমরা কেউ শুঁটকি খাই না। এই ফ্ল্যাটে শুঁটকির গন্ধ আসবে কোত্থেকে?
ময়না বলল, ওই আটটার দিক থেকে গন্ধে ফ্ল্যাট ভরে গেছে। বারান্দার বাল্ব ফটাস করে ভেঙে পড়ল আর আমাদের ফ্ল্যাট ভরে গেল গন্ধে। গন্ধটা যাচ্ছেই না।
রূপম বলল, আশপাশের কোনো ফ্ল্যাটে শুঁটকি রান্না হয়েছে? সেখান থেকে আসছে গন্ধ?
আমি বললাম, ওরকম হলে বারান্দা বা সিঁড়ির দিকেও গন্ধ পাওয়া যেত। তা পাইনি।
ঠিক। বাইরে গন্ধ পেলাম না।
গন্ধ আর কথার তালে ছিলাম বলে ময়নার মুখের দিকে তাকানো হয়নি। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি তার মুখে ভয়ার্ত ভাব। একটু যেন দিশেহারাও।
কী রে ময়না, তোর কী হয়েছে?
ময়না ভয় পাওয়া গলায় বলল, আমার খুব ভয় করছে আপা। সেদিন আপনাকে বলেছি, আমার কেমন যেন লাগে। বারান্দার বাল্ব ফিউজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় কে যেন ফ্ল্যাটে এসে ওই জানালা দিয়ে ঢোকে। আমার পিছন পিছন ছায়ার মতন ঘোরে। আমার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে, তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। আজ এজন্য বিকালবেলাই ফ্ল্যাটের সব জানালা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আটটার একটু আগ থেকে আমার কেমন ভয় করতে লাগল। আপনারা তো রাতে খেয়েই আসবেন। আমি ভাবলাম আজ রাতে রান্নাই করবো না। দুপুরের খাবার যা আছে ওসবই খেয়ে নেবো। এজন্য বসে বসে টিভি দেখছি। টিভির সাউন্ড বাড়িয়ে রেখেছিলাম। মোহাম্মদপুরের বাসার ঝরনার সঙ্গে আমার খুবই বন্ধুত্ব হয়েছিল। মোবাইলে ওর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললাম। তার পরও দেখি সময় কাটতে চায় না। আটটার আগ থেকে কী রকম ভয় ভয় করতে লাগল। গা ছমছম করছে। হঠাৎ হঠাৎ গা কাঁটা দিতেছে। মনে হইতাছে বাল্বটা এখনই চুরমার হইব...
রূপম বলল, তুই যে খুবই ভয় পেয়েছিস ময়না তার প্রমাণ হলো তোর ভাষা এলোমেলো হয়ে গেছে। এত ভয়ের কিছু নেই। গুছিয়ে সব বল।
ময়না একটু লজ্জা পেল। সরি দুলাভাই, আমি সত্যি খুব ভয় পেয়েছি।
তারপর কী হলো বল।
বাল্বটা ফিউজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফ্ল্যাট ভরে গেল শুঁটকি মাছের গন্ধে। কোনদিক দিয়ে কেমন করে গন্ধটা ফ্ল্যাটে ঢুকলো বুঝতেই পারলাম না। দরজা জানালা সবই বন্ধ। তারপর থেকে আরেকটা অনুভূতি হতে লাগল। মনে হলো ফ্ল্যাটে আরেকজন কে যেন আছে। ছায়ার মতো চলাফেরা করছে। আমি আমার রুমে বসে টিভি দেখছি, মনে হচ্ছে, ওই যে আপা সেদিন আপনাকে বললাম না, ঠিক ওই রকম, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কেউ যেন আমার দিকে আপা তাকিয়ে আছে। টিভির দিকে মনোযোগ আমি দিতেই পারছি না। চোখ বারবার চলে যাচ্ছে দরজার দিকে। কাউকে দেখতে পাই না কিন্তু মনে হচ্ছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। পঁচা শুঁটকির গন্ধটা যাচ্ছেই না। আর...
কথা শেষ না করে ডাইনিং টেবিল থেকে গ্লাসে পানি ঢালল ময়না। আদব কায়দা ময়না খুবই ভালো জানে। আমার বা রূপমের সামনে দাঁড়িয়ে কোনো কিছু কখনও সে খাবে না। সেকথা ভুলে নিঃশব্দে পুরো এক গ্লাস পানি খেল। ওড়নায় মুখ মুছে বলল, গলাটা শুকাইয়া গেছে আপা।
রূপমের দিকে তাকিয়ে বলল, সরি দুলাভাই।
না না ঠিক আছে। বল তারপর কী হলো?
আমার মনে হচ্ছিল কি দুলাভাই, গন্ধটা মাঝে মাঝে সরে যায়, মাঝে মাঝে কাছাকাছি আসে। এক সময় গন্ধ দেখি আপনাদের বেডরুমের দিকে, একসময় ডাইনিংস্পেসে, একসময় কিচেনে। একসময় মনে হয় ড্রয়িংয়ের সোফার দিক থেকে আসছে। অর্থাৎ কে যেন ছায়ার মতো চলাফেরা করছে। সে যেদিকে যায় গন্ধটা সেদিক থেকে আসে।
ময়না থামলো। তীক্ষ্নভাবে কিছু একটা অনুভব করার চেষ্টা করল। আপা, দুলাভাই এখন কিন্তু গন্ধটা নাই। খেয়াল করেন, গন্ধটা নাই।
সত্যি তাই। গন্ধটা একদমই নেই। পুরো ফ্ল্যাট ফ্রেশ। মুহূর্তে যেন উধাও হয়ে গেছে পঁচা শুঁটকির গন্ধ। সত্যি আশ্চর্য ব্যাপার।
রূপম আমি দুজনেই চিন্তিত। ময়না যে রকম ভয় পেয়েছে, মেয়েটার কোনো মানসিক সমস্যা হয়ে যায় কিনা!
রূপম বলল, এক কাজ কর ময়না। তুই আজ আমাদের রুমে থাক। আমি ড্রয়িংরুমের সোফায় ঘুমাবো। তুই আমাদের রুমের ফ্লোরে বিছানা করে ফেল।
ময়না মানা করলো না। অর্থাৎ সে খুবই ভয় পেয়েছে। একা রুমে থাকতে চাচ্ছে না। বিছানা করতে চলে গেল।
আমি আর রূপম ড্রয়িংয়ের সোফায় গিয়ে বসলাম।
রূপম।
বলো।
ভয় আমারও লাগছে।
ভূতের ভয়?
না না আমি ফান করছি না। আই য়্যাম সিরিয়াস।
শোনো, নতুন জায়গায় এসে একা একটা ফ্ল্যাটে সারাটা দিন এবং রাতের অনেকটা সময় কাটছে ময়নার। আর ওই বাল্ব ফিউজ হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি মিলিয়ে ওর এরকম ভয় লাগছে।
আমাকে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করছো, বুঝলাম। তাহলে গন্ধটা এলো কোত্থেকে? গন্ধটা হঠাৎ করে আবার চলেই বা গেল কেন? এই ফ্ল্যাটে আমি থাকবো না। অন্য ফ্ল্যাট দেখো। এখানে অবশ্যই কোনো গণ্ডগোল আছে।
তুমি না থাকতে চাইলে ফ্ল্যাট আমি অবশ্যই বদলাবো। কিন্তু কালই তো আর সেটা পারছি না। বাড়িঅলার সঙ্গে কনটাক্ট হয়েছে আমি যদি ফ্ল্যাট ছাড়ি দুমাস আগে নোটিশ দিতে হবে, তিনি যদি আমাকে ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে বলেন তাও দুমাস আগে বলবেন।
দরকার হলে দুমাসের টাকা সে কেটে রাখুক আমাদের এ্যাডভান্স থেকে। আমরা তিনমাসের এ্যাডভান্স দিয়েছি...
এখনই ডিসিসানের কিছু নেই। আরেকটু দেখি না। শোনো, আপাতত একটা কাজ করি। আমরা দুজনেই কাল থেকে সন্ধ্যার আগে আগে বাসায় চলে আসবো। কয়েকটা দিন আমি জিমে যাবো না। দিনেরবেলা ময়না ভয় পাবে না। আর সন্ধ্যায় যদি আমরা চলে আসি তাহলে ওর ভয়ের কোনো কারণই নেই।
ঠিক আছে। চলো কাল থেকে তাহলে তাই করি। কিন্তু ওভাবে কতদিন?
কয়েকদিন পর দেখবে সবই স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
রূপমের ধারণা ঠিক হলো না। দিন দশেক পর ঘটল আরেক ঘটনা।
তিন
ছুটির আগে রূপমকে ফোন করলাম। এই, আমার আজ বাইরে খেতে ইচ্ছা করছে। ময়নাকে ফোন করে বলে দিয়েছি রাতে রান্না করতে হবে না। আমরা বাইরে খেয়ে আসবো। তোর খাবারও নিয়ে আসবো। আমরা দুজন তারপর পিৎজা হাটে গিয়েছি। আটটার দিকে খাওয়া শেষ করে, ময়নার জন্য পিৎজা নিয়ে ফিরেছি। এসে দেখি বারান্দা অন্ধকার। দুজনেই অবাক। আবার সেই অবস্থা! গত দশদিনে বাল্ব ফিউজ হয়নি। আমরাও সন্ধ্যার আগে আগে বাসায় ফিরেছি। এর মধ্যে বাড়িঅলা নিজে এসে একদিন দেখে গেলেন। অন্য ইলেকট্রিসিয়ান এনে বারান্দার লাইন চেক করালেন। কোথাও কোনো সমস্যা পাওয়া গেল না। দশদিনে আর কোনো সমস্যা হলো না দেখে আমরাও নিশ্চিন্ত। যাক ঝামেলা গেছে। ময়নাও স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। আগের সেই অনুভূতি তার আর হচ্ছিল না।
আজ আমরা বাইরে আর আজই হলো সেই কাণ্ড? আমি আর রূপম দুজনেই অবাক। অবাকের মাত্রা বেড়ে গেল ডোরবেল বাজাবার পর। ডোরবেল বাজছে। ময়না দরজা খুলছে না। আমরা বাজিয়েই যাচ্ছি, না, দরজা খুলছে না। ঘটনা কী? ময়না কি ফ্ল্যাটে নেই? এমন হওয়ার কথা না। ময়না কোথাও গেলে নিশ্চয় আমাকে ফোনে জানিয়ে যাবে। আমাকে না জানিয়ে ময়না কখনও কোথাও যায় না। থাই এলুমিনিয়ামের জানালা বন্ধ। পর্দা টানা আছে। তার পরও মৃদু আলোর আভাস আসছে ভেতর থেকে। সেই আলোয় রূপম আমার দিকে তাকালো আমি তাকালাম রূপমের দিকে।
রূপম বলল, ব্যাপার কী? ময়না দরজা খুলছে না কেন? কিছুই বুঝতে পারছি না। ফ্ল্যাটে নেই নাকি?
না থাকার কথা না। কোথাও গেলে নিশ্চয় আমাকে ফোন করে যেতো। আর উত্তরায় ওর যাওয়ার মতো কোনো জায়গাও নেই।
তাহলে?
দাঁড়াও ফোন দেই ময়নাকে।
ফোন দিলাম। রিং হচ্ছে, ময়না ফোন ধরছে না। দুতিনবার ফোন দিলাম। কাজ হলো না। শেষ পর্যন্ত ব্যাগ থেকে চাবি বের করে লক খুললাম। খুলে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। ময়না দাঁড়িয়ে আছে কিচেনের সামনে। আমাদের দিকে পিছন ফেরা। মুখটা কিচেনের দরজার দিকে।
আমি খুবই বিরক্ত। কী রে ময়না, এতক্ষণ ধরে বেল বাজাচ্ছি, শুনতে পাচ্ছিস না? এখানে দাঁড়িয়ে আছিস, দরজা খুলছিস না?
ময়না কথা বলল না। নড়লোও না। আমাদের দিকে মুখও ফেরাল না। যেমন দাঁড়িয়ে ছিল তেমনি দাঁড়িয়ে রইল।
কথা বলছিস না কেন? এই ময়না!
ময়নার আগের মতোই অবস্থা। নড়ছে না, মুখ ফেরাচ্ছে না। পাথর হয়ে আছে।
রূপম বলল, হয়েছে কি মেয়েটার? এই ময়না...
আমরা এগিয়ে গেলাম। ময়না, এই ময়না।
একই অবস্থা। নড়ে না, মুখ ফেরায় না।
আমি ময়নাকে একটু ধাক্কা দিলাম। কী রে ময়না, শুনতে পাচ্ছিস না?
ময়না ফ্যাল ফ্যাল করে আমাদের দিকে তাকালো। মুখটা ফ্যাকাশে। যেন আমাদের সে চিনতেই পারছে না। অচেনা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখে পলক পড়ে না।
কী রে ময়না, কী হলো তোর? কথা বলছিস না কেন?
ময়না আগের মতোই তাকিয়ে আছে।
রূপম আর আমি মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। এই অবস্থা হয়েছে কেন মেয়েটার? সমস্যা কী?
আমি বেশ জোরে ময়নার হাত ধরে নাড়া দিলাম। এবার ময়না নড়েচড়ে উঠল। চোখে পলক পড়ল। যেন গভীর ঘুম থেকে বা অজ্ঞান অবস্থা থেকে সচেতন হলো।
কী হয়েছে তোর? এমন পাথর হয়ে আছিস কেন?
ময়না প্রায় ছুটে গিয়ে সেদিনকার মতো এক গ্লাস পানি খেল। তারপর ভয়ার্ত গলায় বলল, আপা, আজ ঘটেছে বিরাট ঘটনা। দুলাভাই, আপনি মনে হয় বিশ্বাস করবেন না। ওই ঠিক আটটার দিকে বারান্দার বাল্ব ফিউজ হলো। আমি কিচেনের দিকে যাচ্ছিলাম। বাল্ব ফিউজ হওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কিচেনের দরজার সামনে পিছন থেকে কে যেন আমাকে বেশ জোরে একটা ধাক্কা দিল। পড়তে পড়তেও মেঝেতে পড়লাম না আমি। দাঁড়িয়েই থাকলাম। তারপর আমার আর কিছু মনে নাই।
আমি আর রূপম মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। দুজনের মুখেই গভীর উৎকণ্ঠা।
রূপম বলল, সত্যি কেউ ধাক্কা দিল নাকি তুই হোঁচট খেলি?
সত্যি ধাক্কা দিল দুলাভাই। মানুষ মানুষকে পিছন থেকে জোরে যেমন করে ধাক্কা দেয় ঠিক তেমন ধাক্কা। ধাক্কার সঙ্গে সেই পঁচা শুঁটকির গন্ধটাও পেলাম। তারপর আমার আর কিছু মনে নাই। দাঁড়িয়ে আছি না বসে আছি না শুয়ে আছি কিছুই আমি জানি না। ধাক্কার সঙ্গে সঙ্গে আমি যেন পাথর হয়ে গেলাম। আমার যেন দম বন্ধ হয়ে গেল।
তার পরই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল ময়না। আপা, আমি এই বাসায় আর থাকবো না। এই বাসায় থাকলে ওই জিনিস আমাকে মেরে ফেলবে। আপনাদেরও ক্ষতি হবে। চলেন আজ রাতেই এখান থেকে চলে যাই। এই ফ্ল্যাটে থাকা একদমই ঠিক হবে না।
আমি রূপমের দিকে তাকিয়ে বললাম, রূপম, চলো।
রূপম অবাক। কোথায়?
হয় তোমাদের বাড়িতে নয় আমাদের বাড়িতে। এই ফ্ল্যাটে এক মুহূর্তও আমি আর থাকবো না। ময়না বহু বছর ধরে আমাদের সঙ্গে। ও মিথ্যা বলে না। আর যেসব কাণ্ড এখানে ঘটছে, আমিও ভয় পাচ্ছি। কাল আমরা দুজনেই ছুটি নেবো। এই ফ্ল্যাটে আর ফিরবোই না। দুমাসের ভাড়া বাড়িঅলা কেটে রাখলে রাখবে। অন্য ফ্ল্যাট দেখে আমরা সেখানে শিফট করে যাবো। যতদিন নতুন ফ্ল্যাট না পাচ্ছি হয় তোমাদের বাড়ি নয় আমাদের বাড়িতে থাকবো। চলো, এক্ষুণি চলো। ময়না, জামাকাপড় ব্যাগ সুটকেসে ভর। আমরা আজ রাতেই চলে যাবো। এক্ষুণি চলে যাবো।
রূপম বলল, চলো তাই করি।
অলঙ্ককরণ : আল নোমান