X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

আলমগীর কবিরের মুক্তিযুদ্ধ

বিধান রিবেরু
২৫ মার্চ ২০১৮, ১৪:৫৬আপডেট : ২৫ মার্চ ২০১৮, ১৪:৫৯

আলমগীর কবিরের মুক্তিযুদ্ধ কেন মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির? এই প্রশ্ন নিয়ে আমাদের মনের গ্রীবা উঁচু না হলেও আলমগীর কবির নিজেই এই প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন নিজের দিনলিপিতে—‘মুক্তিযুদ্ধে কেন গিয়েছিলাম?’ উত্তর দেয়ার জন্যই এই প্রশ্ন করেন তিনি। উত্তরে প্রবেশের আগে বলে রাখা বাড়তি হবে না যে আলমগীর কবির হুট করেই দেশপ্রেমী ও মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠেননি। বায়ান্নর একুশের চেতনা যেমন সর্বদা বুকে ধারণ করেছেন, তেমনি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকের স্বরূপ বহু আগে থেকেই আঁচ করতে পেরে জড়িত হয়েছিলেন একাধিক মুক্তিকামী সংগঠনের সঙ্গে। সোচ্চার করতে চেয়েছেন পূর্ব পাকিস্তানের শোষিত ও বঞ্চিত কণ্ঠস্বরকে।

লন্ডনের ‘দি টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সম্পাদকীয় পড়ে আলমগীর কবির প্রথম বেচইন হয়ে ওঠেন দেশের জন্য কিছু করতে। সেটি গত শতাব্দীর ছয়ের দশকের শুরুর ভাগ। সম্পাদকীয়তে তুলে ধরা হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান দ্বারা পূর্ব বাংলার শোষণের ইতিহাসকে। আলমগীর কবির উল্লিখিত প্রশ্নের জবাবে এই প্রসঙ্গটি আনেন এবং সম্পাদকীয় পড়ার পর প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন ‘একাত্তরের ডায়েরি’তে। সম্পাদকীয়র উপসংহারে বলা হয়, ‘পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত যদি দেশের সমস্ত সম্পদ পূর্ব বাংলার উন্নয়নে ব্যয় করা হয়, তাহলেও দুই অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক সমতা আসবে না।’ (কবির ২০১৮: ০৭)

এই অর্থনৈতিক বঞ্চনাকে রাজনীতি ও কর্মতৎপরতায় অনুবাদ করতে সময় নেননি কবির। ‘পূর্বসূরী’ নামের এক গোপন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান তিনি। এরপর বিলেতের চাকরি ছেড়ে দেন। পূর্ববঙ্গে শুরু হয়ে যায় স্বাধীকার আন্দোলন। অন্যান্যদের সহযোগিতা নিয়ে কবির গঠন করেন ‘পূর্ব বাংলা মুক্তিফ্রন্ট’। প্রকাশ করেন ‘পূর্ব বাংলা’ নামের এক পত্রিকা। সশস্ত্র যুদ্ধ করার মানসিকতা নিয়ে কবির ১৯৬৬ সালে চলে আসেন দেশে। সাংবাদিকতার পাশাপাশি চলে রাজনৈতিক তৎপরতা। ওই বছরই তিনি গ্রেফতার হন। বন্দি জীবন কাটান কেন্দ্রীয় কারাগারে। ঘটনার স্বাক্ষ্য কবিরের জবানে যেমন পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যায় শেখ মুজিবুর রহমানের ‘কারাগারের রোজনামচা’তেও। আবুল খায়ের মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান ও প্রিয়ম প্রীতিম পাল সম্পাদিত ‘আলমগীর কবির : চলচ্চিত্র ও জাতীয় মুক্তি’ বইয়ের ভূমিকাতে সলিমুল্লাহ খান এক চমৎকার ভূমিকায় কারাগারে দুজনের সাক্ষাৎপরিচয়ের ঘটনাটি বিশদ করেছেন। এই বইতেই কবিরের ‘একাত্তরের ডায়েরি’ প্রকাশ পেয়েছে, আরো স্পষ্ট করে বললে, এই প্রথম আলমগীর কবিরের রচনা, সাক্ষাৎকার, বক্তৃতা এতো সুসজ্জিত ও সুসম্পাদিত হয়ে প্রকাশ পেলো।

ফিরে আসি কবিরের প্রশ্নোত্তরে। কবিরের জবানিতে দেখা যায়, এপ্রিল মাসে তিনি নরসিংদিতে পৌঁছান ও যুক্ত হন সম্মুখ সমরে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণে তারা বেশিদিন টিকতে পারেননি। তাই বাধ্য হয়ে কবির চলে যান আগরতলা। সেখানে গিয়ে তিনি সবার আগে যেটা বুঝলেন সেটা হলো, ‘আওয়ামী লীগ এই যুদ্ধের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। সামরিকভাবে তো নয়ই, এমনকি প্রশাসনিকভাবেও নয়। অর্থাৎ যুদ্ধ চালানোর মত কোন অর্গানাইজড মেকানিজম তাদের ছিল না ।’ (কবির ২০১৮: ১৩) আর নেতৃত্ব নিয়ে মতানৈক্য তো ছিলোই।

আগরতলা থেকে কলকাতা গিয়ে কবির শুরু করেন সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। এর মাঝে তিনি, জুন মাস নাগাদ, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের একটি বিশেষ বার্তা নিয়ে গোপনে ঢাকা আসেন। সেসময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়ে আহত হন কবির। কিছুদিন আত্মগোপন করেন আজিমপুর কলোনিতে। পরে আবার ঝুঁকি নিয়ে ব্যাংকক হয়ে কলকাতা পৌঁছান। পৌঁছেই দেখেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তুলকালাম কাণ্ড। আর সেটা হলো পূর্ব বাংলার প্রথম ও একমাত্র ‘গেরিলা চলচ্চিত্র নির্মাতা’ জহির রায়হানকে নিয়ে। বেতারের জন্য একটি প্রবন্ধ লিখতে বলা হলে জহির রায়হান সেটি কয়েকদিন টানা খেটে লিখে দেন। কিন্তু সেটা বাতিল করে ফেলে দেয়া হয় ময়লার ঝুড়িতে। এর কারণ প্রবন্ধটি ছিলো বেশি মাত্রায় সমাজতন্ত্র ঘেঁষা। প্রবন্ধটি ছুড়ে ফেলে দেয়ার বিষয়টি জেনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন জহির রায়হান।

পরে অবশ্য কবিরের মধ্যস্ততায় স্বাধীন বাংলা বেতারের সঙ্গে জহির রায়হানের দূরত্ব কমে। শুধু তাই নয়, কবিরের চেষ্টাতেই সরকারের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা জহির রায়হানকে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়, যাতে যুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করা যায়। যদিও মাত্র ৪০ হাজার টাকাই হাতে পেয়েছিলেন জহির রায়হান। নিজে অর্থকষ্টে দিন কাটালেও সেই ৪০ হাজার টাকা দিয়েই তিনি নির্মাণ করলেন চারটি প্রামাণ্যচিত্র। সেগুলোর মধ্যে ‘স্টপ জেনোসাইড’ একটি।

এই ছবিটি নিয়েও যে সেসময় ‘রাজনীতি’ হয়েছে সেটাও দুঃখের সঙ্গে স্মরণ করেন কবির। তথাকথিত কয়েকজন ‘আওয়ামী লীগার’ ছবিটি নিষিদ্ধ করার জন্য স্বাক্ষর অভিযান শুরু করেন। তাদের বক্তব্য ‘স্টপ জেনোসাইড’ কেন লেনিনের উক্তি দিয়ে শুরু হবে, কেন শেখ মুজিবুর রহমানের কথা দিয়ে শুরু হবে না? জহির রায়হানের বক্তব্য ছিলো স্পষ্ট। তিনি বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের কেস প্লিড করতে হলে লেনিনের মত মহামানবের উক্তিই ব্যবহার করতে হবে। কারণ নিজের বক্তৃতা দিয়ে নিজের কেস প্লিড করা যায় না।’ (কবির ২০১৮: ২৮)

ভাগ্যিস বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ। তাঁর হস্তক্ষেপেই ছবিটি আলোর মুখ দেখে তখন। অথচ পরিহাসের বিষয়, কবির বলছেন, জহির রায়হানের এই ছবিটা নিয়ে যিনি সবচেয়ে বেশি প্রতিবাদ করেছিলেন, যিনি সবচেয়ে বেশি নেতার প্রতি ভক্তি দেখিয়েছিলেন, সেই আবু তাহের মোহাম্মদ ফজলুল হক, মাসিক ‘সিনেমা’ পত্রিকার সম্পাদক, কলকাতায় নতুন করে ঘরবাড়ি করে, সেখানেই নিজের ব্যবসা গুছিয়ে নিয়েছিলেন।

এসব ঘটনার ভেতরেই কবিরকে বাংলাদেশ সরকার তথ্য মন্ত্রণালয়ের চিফ রিপোর্টার নিয়োগ দেয়া হয়। আর একই সাথে তাঁকে দায়িত্ব দেয়া হয় স্বাধীন বাংলা বেতারে ইংরেজি বিভাগের। সেখানে তিনি নিয়মিত কথিকা পাঠ করেন ইংরেজিতে। তবে বেতারেই নিজেকে নিয়োজিত রাখেননি কবির। জহির রায়হানের চারটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে তিনি ছিলেন প্রধান সহযোদ্ধা। এই চারটির মধ্যে কবিরের পরিচালনায় নির্মাণ হয় ‘লিবারেশন ফাইটার্স’। আরো দুটি ছবি ‘এ স্টেট ইজ বর্ন’ ও ‘ইনোসেন্ট মিলিয়নস’ প্রযোজনা করেন জহির রায়হান। এই দুটোর মধ্যে প্রথমটির পরিচালকও ছিলেন জহির রায়হান।

এরই মধ্যে আরেকটি ঘটনা ঘটে। ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রের একটি প্রিন্ট নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায়। তখন এই ছবিটি প্রদর্শনের জন্য এক পরিবেশক, নাম নন্দ ভট্টাচার্য্য, অগ্রিম এক লক্ষ বিশ হাজার টাকা দেন। সেই টাকার পুরোটাই জহির রায়হান বাংলাদেশ সরকারকে দিয়ে দেন। শুধু তাই নয়, পশ্চিমবঙ্গে ছবিটি দেখানো বাবদ সব টাকাই তিনি দান করেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহারের জন্য। সরকার এই ছবির প্রদর্শন থেকে পাঁচ লক্ষাধিক টাকা আয় করেছিলো। শুধু অর্থ দিয়ে নয়, শ্রম ও মেধা দিয়ে জহির রায়হান যেভাবে দেশের কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন তার তুলনা নেই। অথচ অতুলনীয় এই ব্যক্তিকেই কৌশলে হত্যা করা হয় স্বাধীন দেশে।

বিজয় লাভের মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর জহির রায়হানের মতো নির্মাতাকে হারিয়ে শুধু আলমগীর কবির যে একা বোধ করেছেন তা নয়, গোটা দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে বিশ্বাস তাঁর। একারণেই কি যুদ্ধোত্তর পর্বে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্রের এমন দুরাবস্থা? সেই প্রশ্নের উত্তর ভিন্ন পরিসরে দেয়া যাবে। তবে তখনকার ছবিগুলো যে মানসম্পন্ন হয়নি, তা বোঝা যায় কবিরের ভিন্ন আরেক প্রশ্নেই। ‘মুক্তিযুদ্ধ এবং আমাদের চলচ্চিত্র’ নিবন্ধে কবিরের জিজ্ঞেস করছেন, ‘যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার কতখানি বাস্তব প্রতিফলন হয়েছে? এবং যতখানি হয়েছে তার প্রকৃত রূপ কি?’ (কবির ২০১৮: ৩৪)

চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘ওরা ১১ জন’ ছবিতে সততা থাকলেও, চলচ্চিত্রায়ন গতানুগিক, অভিনয় মঞ্চঘেঁষা ও কমিক রিলিফের নামে ভাঁড়ামি ছিলো বলে সমালোচনা করেন কবির। সুভাষ দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ নিয়েও খুব বেশি সন্তুষ্ট হতে পারেননি ‘ধীরে বহে মেঘনা’র পরিচালক। ধর্ষণ ও জারজ সন্তান মূখ্য হয়ে ওঠায় মুক্তি আন্দোলনের মূল বক্তব্য সেখানে হারিয়ে গেছে বলে মনে করেন কবির। ‘রক্তাক্ত বাংলা’, ‘বাঘা বাঙ্গালী’ ইত্যাদি বাকি ছবিগুলোতে মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণকে ব্যবহার করা হয়েছে মুনাফা লাভের জন্য, তাই এসব ছবির তীব্র সমালোচনা করেন কবির। শুধু কি মুক্তিযুদ্ধের ছবি নিয়ে হতাশ তিনি?

স্বাধীনতা লাভের পর অন্য যেসব ছবি নির্মাণ হয়েছে, সেগুলোর নিম্নমান ও অসততা নিয়েও কথা তোলেন কবির। সেখানে যে কালো টাকার ছড়াছড়ি হয়েছে, সেটা বলতেও কসুর করেন না তিনি। ‘সংস্কৃতির সংকট ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র’ প্রবন্ধে কবির বলেন, ‘সাম্প্রতিককালে ঢাকায় প্রায় দুশ ছবি তৈরি হচ্ছে। এইসব ছবির বেশির ভাগই তৈরি হচ্ছে রাতারাতি গজিয়ে ওঠা প্রযোজকদের পয়সায়। রাতারাতি গজান প্রযোজকদের দল তাদের বিভিন্ন অসাধু উপায়ে অর্জিত অর্থ অন্য ব্যবসায় খাটাতে ভরসা পাচ্ছে না। স্বভাবতই চিত্রজগৎকে কেন্দ্র করে মুদ্রাস্ফীতি ও নোংরামো ঘটছে, যা আগে কখনো ঘটেনি।’ (কবির ২০১৮: ৪৪) গোপনে পরিচালকদের ভারত ভ্রমণ ও সেখান থেকে ছবি দেখে এসে নকল ছবি বানানোকে তিরস্কার করেন কবির। পাকিস্তানের উর্দু ছবির নকলও করতেন এই নকলবাজ পরিচালক ও প্রযোজকরা।

এমন ক্রান্তিকালে জহির রায়হানকেই বাতিঘর হিসেবে পেতে চাইছিলেন আলমগীর কবির। তাই বলছেন, ‘আজকের আমাদের দুর্দশা দেখে বারবার মনে হয় জহিরের কাছে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প কতটা পেতে পারত— যদি না স্বাধীন বাংলারই বুকের উপর এমন একজন তেজস্বী দেশপ্রেমিককে হত্যা করতে না দিতে পারতাম। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে বাঙ্গালি চলচ্চিত্রকাররা তাঁদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে অক্ষম হলেন। আমাদের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের এহেন হেনস্তার এই হচ্ছে মূল কারণ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এত বড় একটা ঐতিহাসিক থিমকে আমরা হেলায় হারিয়ে ফেলেছি।’ (কবির ২০১৮:৪০)

মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পরও কি বলবার মতো চলচ্চিত্র হয়েছে? কবির থাকলে হয় তো বলতেন, হবে কিভাবে, সেই রাজনৈতিক বোধ কোথায়? এমন কথাই তিনি বলেছিলেন সাতের দশকে। বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের চলচ্চিত্রকারদের ব্যর্থতার প্রধান কারণ তাঁদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং অভিজ্ঞতার অভাব।’ (কবির ২০১৮: ৩৮) মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি যারা করেছেন তাঁদের অধিকাংশই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না বা মুক্তিযুদ্ধকে কাছ থেকে দেখেননি, কাজেই তাদের নির্মাণও হয়ে পড়েছে বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন। কবিরের কথায়, ‘আমাদের এখানে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছবি তৈরি না হবার কারণ হচ্ছে, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন তাঁরা তা হৃদয়ে অনুভব করেন না, আর যাঁরা অনুভব করেন তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ সেভাবে দেখেননি। এছাড়া রয়েছে নানা ধরনের অক্ষমতা।’ (কবির ২০১৮: ২০৩) কবির দেখিয়েছেন, সমসাময়িক নির্মাতাদের মধ্যে একমাত্র জহির রায়হানেরই ছিলো রাজনৈতিক চর্চা ও শিল্প সৃষ্টির প্রতি সৎ অঙ্গীকার, তাই তাঁর ছবিতেও সেটি প্রতিফলিত হয়েছে, আর একারণেই অন্যদের ছবিতে হারিয়ে গেছে জাতীয় মুক্তির মূল সুর।

জহির রায়হানকে হত্যার পর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে যেমন হতাশ ছিলেন কবির, তেমনি রাজনৈতিক অবস্থা নিয়েও ছিলেন নাখোশ। তিনি মনে করতেন বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিবেশ বিরাজ করছিলো, আর সেই পরিবেশেই গণসংস্কৃতির প্রসার ঘটানো অসম্ভব ছিলো না। কিন্তু এর পরিবর্তে যা হয়েছে তা হাস্যকর। কবির বলছেন, ‘বাংলাদেশের মত দেশে সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিবর্তে ধনতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য চেষ্টা করা হাস্যকর। হাস্যকর এই কারণে যে আমাদের পুঁজিও নেই আর ধনতান্ত্রিক পটভূমিও অতীতে ছিল না।’ (কবির ২০১৮: ৪৪)

মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন যে মানুষ দেখেছিলো তা তো আর মিথ্যা নয়, কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর বাস্তবতা দেখে অনেকের মতোই আহত হন কবির। যে প্রতিবেদন দেখে দেশের মানুষের শোষণ-বঞ্চনার অবসানের লক্ষ্যে যুদ্ধ করেছিলেন তিনি, সেই লক্ষ্য বাস্তবায়িত হয়নি। রাহুর গ্রাস লেগেছিলো চলচ্চিত্রাঙ্গনেও। তারপরও কবির ছিলেন আশাবাদী, তিনি তরুণদেরকেই মনে করতেন নতুন দিনের কাণ্ডারি। বলছেন, ‘শত ষড়যন্ত্র যা আজও নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি তা হল সেই নতুন তরঙ্গের প্রত্যাশা—একটি মুক্তিপ্রাপ্ত স্বাধীন জাতির উপযুক্ত চলচ্চিত্রের প্রত্যাশা। তাই আজ সৎ চলচ্চিত্রের পক্ষে, অপচলচ্চিত্রের বিপক্ষে গণমিছিল হয় ঢাকার রাস্তায়। আমাদের আশাবাদী হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।’ (কবির ২০১৮: ৩২)

 


 

সহায়
আলমগীর কবির, চলচ্চিত্র ও জাতীয় মুক্তি, আবুল খায়ের মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান ও প্রিয়ম প্রীতিম পাল সম্পাদিত, আলমগীর কবির রচনা সংগ্রহ, প্রথম খণ্ড (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী ও মধুপোক, ২০১৮)

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া