X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

লাল মলাটের টালি ও পূন্যাহ

রতন ভৌমিক প্রণয়
১৪ এপ্রিল ২০১৮, ০০:০৪আপডেট : ১৪ এপ্রিল ২০১৮, ০৭:৩৯

লাল মলাটের টালি ও পূন্যাহ

আবহমান কাল থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ, বাংলা অঞ্চলে সামন্তবাদী নিপীড়নের শিকার প্রজাসাধারণ—তাদের ভূমির খাজনা পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে, জমিদারদের দ্বারা লাঞ্ছিত হতো। তাদের জন্য একটি সুপ্রশস্ত সময় নির্ধারণ জরুরি হয়ে পড়ে। সম্রাট আকবর ‘তারিখ-ই-ইলাহি’ প্রচলনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন একটি বিশেষ কারণে। তার নবরত্ন সভার জ্যোতির্বিদগণ প্রকৃত মহাবিষুব সংক্রান্তির ক্ষণের ও বর্ষ আরম্ভের দিনের মধ্যে যে তারতম্য ঘটে—মহামতি আকবরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, একটি কারণেই আর তা হলো রাজস্ব আদায়।

‘শুধু একাডেমিক উদ্দেশ্য নিয়ে মহামতি আকবর এই অব্দ ভিত্তিক ‘তারিখ-ই-ইলাহি’ প্রচলনের উদ্যোগ নেননি। আকবর ছিলেন বাস্তববাদী। একুশে মার্চকে নববর্ষ ধরার বড় সুবিধা হলো ওই দিনটিতে দিন ও রাত্রি সমান। তবে আরও বড় কারণ হলো এ সময়টিতে ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চলে প্রধান ফসলাদি চাষীদের ঘরে আসে। এ সময় রাজস্ব আদায় সহজ হতো—এতে সন্দেহ নেই। হিজরি সন ব্যবহারে এ সুবিধা পাওয়া যেত না। কারণ চান্দ্র বৎসরের তারিখ সৌরবৎসরের গণনায় প্রতি বছরে ১১দিন পিছিয়ে পড়ে। রাজস্ব নির্ভর শাসন কার্যে এটি একটি বড় অসুবিধা। ‘ইলাহি’র আর একটি নাম ছিল রাজস্ব বর্ষ বা ফসলি সন।’

বিষয়টা এই দাঁড়াল বাংলা সন প্রচলনের মূল উদ্দেশ্যে ছিল রাজস্ব আদায় আর সেই থেকে শাসক শ্রেণির সঙ্গে প্রজাসাধারণের একটা আর্থিক সম্পর্ক জড়িয়ে যায়। পরে তা বাংলা, উড়িষ্যা, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও অপরাপর ভৌগোলিক সমীরেখায় একটি নির্দিষ্ট মাসকে বছরের প্রথম মাস হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে দেয়া। ধারণা করা হয় সুবে বাংলার রাজস্ব বিষয়ক পণ্ডিত রাজা টোডরমল ‘ইলাহি’ সনের প্রচলন ঘটান।

সাধারণত বৈশাখ মাসের ১ তারিখে প্রজাসাধারণ জমিদারের কাছারিতে খাজনা দিতে যেতেন এবং জমিদারদের পক্ষ থেকেও প্রজাসাধারণকে আপ্যায়নের জন্য মিষ্টিমুখ করানোর পাশাপাশি পান-তামাকের আয়োজন করা হতো। একই দিনে শত শত প্রজার নিকট থেকে খাজনা আদায় উপলক্ষে যে বিশাল আয়োজন, একে ঘিরেই আমাদের অধিকাংশ মেলার সৃষ্টি। সারাবছর ধরে আয়োজিত মেলার সংখ্যা বিচার করলেই বোঝা যাবে মেলাগুলোর উৎপত্তি হয়েছিল সাধারণ মানুষের ইচ্ছায় এবং স্বতস্ফূর্তভাবে এগুলো কেউ উদ্যোগ নিয়ে চালু করেনি। এসব মেলা বাংলার জনজীবনে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আর এখন তো বৈশাখী মেলা জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।

পহেলা বৈশাখে প্রচলিত আনুষ্ঠানিকতার একটি অন্যতম আয়োজন ‘পূন্যাহ। আভিধানিক অর্থ ‘কোন পূণ্য কাজ অনুষ্ঠানের পক্ষে জ্যোতিষশাস্ত্র আনুমোদিত প্রশস্ত দিন।’ পূন্যাহ সাধারণত জমিদার বা মহাজনের বাড়িতে প্রজা বা খাতকের সম্মিলনে পালিত হতো। “এতে জমিদার বা মহাজনকে তাদের খাজনা বা পাওনা গণ্ডা আংশিক বা ‘তামামশোধ’হিসাবে দিতে পারতেন। জমিদারের বা মহাজনের বাড়িতে নতুন খাতা (রোকড়) খোলা উপলক্ষে অর্থ প্রাপ্তির আনন্দ, অন্যদিকে প্রজার বা খাতকের অর্থ পরিশোধ করতে পারার আনন্দ। এই উপলক্ষে প্রায়ই মিষ্টিমুখ করার রীতি এবং রাত্রে গানের আসরও বসানো হত।”

এখন সামন্তবাদী শাসন নেই, পূন্যাহ নেই। পূন্যাহের আনুষ্ঠানিকতা এখনো হিন্দু মহাজনদের মধ্যে প্রচলিত আছে। নতুন বছরে নতুন খাতা খোলার উৎসব হালখাতা। এর আগে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধোয়ামোছা করা, নতুন বছরে নতুন আমেজে ব্যবসা চালু করার ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা সব ব্যবসায়ীদের মধ্যেই কমবেশি লক্ষ্য করা যায়। এটা বাঙালির দীর্ঘদিনের একটা সংস্কার। হিন্দু, মুসলমান নির্বিশেষে সবাই তাদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান ধোয়ামোছা করে নতুন খাতা দিয়েই নতুন বছরটি চালু করেন। সারা দেশের অনেক স্থানে খোঁজ নিয়ে দেখেছি প্রতিটি স্থানেই বছরের প্রথম দিনে শুরুর আগে নতুন খাতা কেনার হিড়িক পড়ে যায়। সব ব্যবসায়ীরাই নতুন বছরে নতুন খাতায় তাদের হিসাব শুরু করেন। নতুন বছর শুরুর এক সপ্তাহ আগে লাল মলাটের টালি খাতা কেনার ধুম পড়ে যায়। এ রেওয়াজটি সারা দেশেই চালু আছে। সব ব্যবসায়ী হয়তো আনুষ্ঠানিকভাবে পাওনাদারদের মিষ্টি খাইয়ে মাইক বাজিয়ে হালখাতা উৎসব পালন করেন না। কিন্তু রেওয়াজটি পূর্বে ছিল।

বৈশাখ মাস জুড়েই গ্রামবাংলার জনপদে রঙিন কাগজে দোকান সাজিয়ে মাইক বাজিয়ে হালখাতা উৎসব পালন করার প্রথা এখনো চালু আছে। এখন আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে কিন্তু হালখাতা করে নতুন বছরে খাতকদের নিমন্ত্রণপত্র দিয়ে বকেয়া আদায়ের যে রেওয়াজ এক সময় চালু হয়েছিল এরই ধারাবাহিকতার অংশ হিসাবেই ‘হালখাতার নিমন্ত্রণপত্র’এখনো বাণিজ্যিকভাবে ছাপা হয়। দেখা যায় এসব নিমন্ত্রণপত্রের জন্য আলাদা খামও পাওয়া যায়। শুধু নিমন্ত্রণপত্রের কিছু অংশ, যেমন তারিখ, বার ও সময়ের স্থানগুলো শূন্য থাকে। যারা হালখাতার অয়োজন করেন তারা তাদের সুবিধামত অই শূন্যস্থানগুলো পূরণ করে দেনাদারদের নিমন্ত্রণ করে থাকেন। এতে সারাবছরে যেসব দেনাদার নির্দিষ্ট দোকানের বাকি পরিশোধ করেননি। তারা নিমন্ত্রণ পেয়ে মুখ লজ্জার খাতিরে হলেও হালখাতা উৎসবে যোগ দিয়ে নতুন খাতায় নাম উঠান। উৎসবের দিন দোকান মালিক ও মহাজনেরা পুরাতন বছরের বকেয়া নতুন খাতায় ‘পূর্বইজা’ হিসাবে তুলে জমার টাকাটা বিয়োগ করে একটা নতুন ধারণা লাভ করেন। এতে কেউ বিরক্ত হন, কেউবা আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন। তবে মোটের ওপর খুশি হবার ঘটনাটাই বেশি ঘটে। এমনও দেখা যায়, হালখাতাকে ঘিরে একটি প্রায় বন্ধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও নতুন আঙ্গিকে তাদের ব্যবসায়িক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। হালখাতা ব্যবসায়ীদের লাভ লোকসানের বিষয় হিসেবে গণ্য ফ্যাশন নয়।

আজকাল বড় বড় কর্পোরেট হাউসগুলোও নববর্ষে নতুন নতুন অফার নিয়ে গ্রাহকদের সামনে উপস্থিত হয় এবং হালখাতা ঘরানার অনুষ্ঠান করে এজেন্টদের নিকট থেকে মোটা অঙ্কের বকেয়া যেমন আদায় করে নেয়, তেমনি কমিশন দিয়ে নতুন করে ব্যবসা খোলার বা চালানোর সুযোগও তৈরি করে দেয়।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক