X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

নিদাঘ চৈত্রের মর্মর

পাপড়ি রহমান
১৪ এপ্রিল ২০১৮, ০০:৩২আপডেট : ১৪ এপ্রিল ২০১৮, ০৭:৩৪

নিদাঘ চৈত্রের মর্মর

পঞ্জিকার পাতায় চৈত্রমাস ঢুকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বর্ষবরণ শুরু হয়ে যেত। তখনো অনতিদূরে একেবারে আনকোরা এক বৈশাখ অপেক্ষমাণ। খাল-বিল-পুকুরের জল কমতে কমতে একেবারে তলানিতে পৌঁছে গেছে। আর আমাদের কচি-পেলব-ওষ্ঠযুগল শুষ্ক হতে শুরু করেছে। কুয়া থেকে সদ্য তোলা ঠান্ডা-শীতল-জলে গলা ভিজিয়েও নিস্তার তেমন মিলছে না! তীব্র দাবদাহে আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত।

দাদাভাই হাট থেকে কিনে আনছেন ডজনকে-ডজন কাগজি-লেবু, হালি ধরে বেলে-বাংগি আর তরমুজ।কুয়ার জল তুলে, চিনি গুলিয়ে তাতে লেবুর রস ফেলে বানানো হচ্ছে জগকে জগ শরবত। আখের-গুড় মেখে দেয়া হচ্ছে বেলে-বাংগিতে। আর আমরা নিমিষে সেসব সাবাড় করে ফেলছি।

তরমুজের রক্তাক্ত-কোমল-বুকে দাঁত বসিয়ে ভাবছি—বারুনির মেলা আসতে আর কত দিন বাকি? কবে আসবে সেই মেলা? আর আমরা ভারি আয়েশ করে চিনির হাতি,ঘোড়া,পাখি,মসজিদ আর মন্দির খেতে পারব? ঘন দু্ধে ডুবিয়ে খাওয়া যাবে বিন্নি ধানের খই। আখরির সঙ্গে প্রমাণ সাইজের সবরি-কলা। আর দুধশাদা-কদমা, সোনালিরঙা-বাতাসা।

মাটি থেকে উঠতে শুরু করেছে গরম-তাপ-ভাঁপ। মরুর দেশের হাওয়া ঢুকে পড়েছে আমাদের বাড়ির আঙিনায়। আর আমাদের দাদিজান সিলেট থেকে কিনে আনা শীতলপাটি বিছিয়ে দিয়েছেন কামরাঙা গাছের তলায়। সেই পাটির উপর বসে-শুয়ে বাড়ির পুরুষেরা তাকিয়ে রয়েছে ওপরের দিকে। তাকিয়ে দেখছে গাছের কয়টা শাখা-পত্র নড়ে উঠলো? মরুর দেশের হাওয়া কয়টা পাতাকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল?

দুপুরের খর-রোদ্দুর দূর গ্রামের দিকে হাঁটতে শুরু করলেই দাদিজান সেই শীতলপাটি তুলে নিয়ে বিছিয়ে দিচ্ছেন জামগাছের তলায়। বিকেলবেলাটা ওখানে বসেই কাটিয়ে দেয়া যাবে। জামতলার সম্মুখের সামান্য ঢালু জমিতে বিছিয়ে থাকা কাদার-গালিচা চলে গিয়েছে বহুদূর, একেবারে দৃষ্টি-সীমানার বাইরে। জমির কাদা শুকিয়ে খটখট করছে, অথচ মাত্র কয়দিন আগেই এই জমিতে বর্ষার জলের কই-মাগুর-শিংগি আর বাইন মনের সুখে বাসা বেধেছিল। আর তাদের পলো ফেলে, কাদা ঘুটে ধরে ধরে চাচারা-ভাইয়েরা আমাদের রান্নাঘরে চালান করে দিয়েছিল। বোঝা যায়, মীনেদের প্রাণ হরণ করে ফেলাতে মাটি এক্ষণে রোষে ফেটে পড়তে চাইছে!

জামতলায় বসলেই জুড়িয়ে যাচ্ছে দেহ-মন। সারাদিন ধরে বয়ে যাওয়া লু ততক্ষণে ঝিমাতে শুরু করেছে। আর উড়তে শুরু করেছে ঝরে পড়া শুকনো পাতার রাশি।দুদ্দার উড়ে আসছে সেগুনের বড় বড় পাতা, ডুমুর গাছের পত্ররাজি, আর বাঁশঝোঁপের এন্তার বাদামি-খয়েরি পাতার রাশি। তাদের মর্মর শুনে মনে হয়, কারা যেন শর্ শর্ শব্দে হেঁটে চলে যাচ্ছে বহুদূর। যেন কোনোদিন তারা আর এমুখো হবে না। তারা কোনোদিন আর ফিরে আসবে না এমন নিদাঘ সময়ে।

এমন পাতা-ঝরা দিনে দুনিয়া ফেটে চৌচির। পুকুরগুলি জলহীন হতে হতে নিস্প্রাণ-ডোবা।এদিকে আমগাছের মুকুলেরা সবুজ-গুঁটি বেধে খানিকটা পুষ্ট হয়ে ফটফট করে চেয়ে আছে আসমান পানে।যারা সামান্য ডাঁটো, তারা ঝুঁকতে শুরু করেছে মাটির দিকে। দিন কয়েকের মাথায় ডাঁশা-যুবতী হয়ে উঠবে।

এই রকম রুখু দিনকালের মাঝেও আমাদের অপেক্ষা শুরু হয়েছে ১২ তারিখের জন্য। চৈত্রের ১২ তারিখ, একদিনের জন্য জমে-ওঠা-মেলার।আমরা বলি বারুনির-মেলা। আমাদের কাছে নতুন বছর মানে বারুনি। ১লা বৈশাখ মানেই বারুনি ঘুরে আসা। এই মেলা থেকে দাদাজান, চাচারা কিনে আনেন মাটির চাক্কাওয়ালা ঘোড়া, পুতুল, হাড়ুকুড়ি, চিনি দিয়ে বানানো সাজ, বিন্নী, আখরি, কদমা, বাতাসা, মুরালি, গজা, চুলের ফিতা, ক্লিপ, কাচের চুড়ি, চোখের কাজল, পাটের-শিকা, আর খেলনা-বটি, ছুরি, দা। যেসব ছোট বটি,ছুরি,দা দিয়ে আম ভালো মতোই কাটা যায়। কাটা যায় কামরাঙা বা কাঁঠালের মুচি।

চৈত্রের ১২ তারিখে জমে ওঠা বারুনির মেলা ওইদিনই ফুরিয়ে গেলেও মাসব্যাপী সে রেশ রেখে যায়। সেই মেলার তামাম তৈজস, খেলনাপাতি আর মিষ্টান্ন, খই-মুড়কি সারা মাস জুড়ে পাওয়া যায়।ফলে আমাদের কাছে চৈত্র যা, বৈশাখও তা।চৈত্র আর বৈশাখের কোনো ফারাক আমরা বুঝি না। আমাদের কাছে নতুন বছর মানেই বারুনির-দিন।চাক্কাওয়ালা মাটির ঘোড়াদের টগবগিয়ে ছুটে চলা।আর রঙিন কাগজের লাল-বেগুনি-নীল চরকি বাতাসের ভাও বুঝেশুনে উড়িয়ে দেয়া।

আমরা এতদিনে বুঝে গেছি, নতুন বছর আসছে মানে আম্র-বৃক্ষরাজি ফলবতী হয়ে উঠছে! কাঁঠালের কমলা-সবুজ পাতাদের ফাঁকফোকরে গাঢ়-সবুজে মুচিরা মৃদুহাসিতে ঘোমটা খুলে দিচ্ছে।সজনে গাছের লতারা পোক্ত হয়ে দোল খাচ্ছে চৈতালি বাতাসে।করল্লা গাছের পাতায়-পাতায় জীবন হেসে উঠছে খলবল করে।আহ! এসবের মাঝেই আমরা জেনে গেছি বসন্ত ঋতু ‘বিদায়’ জানিয়ে ক্রমশঃ ধূসর হয়ে উঠছে।চারপাশের ফুলের গন্ধ মিলিয়ে দিয়ে ধুলার গন্ধ প্রকট হয়ে উঠছে।কারণ এ প্রকৃতি জানে, পুরাতন বিদায় না-হলে নতুন এসে দাঁড়াবে কীসে?

সত্য সত্যই চৈত্রের রঙিন-চরকির ডানায় ভর করে বৈশাখ এসে দাঁড়ালে বাড়ির কর্তারা নড়চড়ে উঠতো।আমরা একদিন ঘুম ভেঙে দেখতাম, মুটে তার মাথার বিশাল ঝাঁকা নামিয়ে রেখেছে আমাদের প্রশস্ত উঠানে। ঝাঁকার উপর একহালি বড় ইলিশ চকচক করছে সকালের রোদ্দুরে।বড়সড় কয়েকটা মোরগ ক্ব ক্ব করে ডেকে চলেছে জলতেষ্টায়।কিছু সবজি-আনাজ উঁকি মারছে ঝাঁকা থেকে। আদা, রসুন, পেঁয়াজ, পান-সুপারি। সের পাঁচেক কালিজিরা চালের পোটলাটা বেশ ওজনদার মনে হলে দাদিজান হাঁক দিয়ে ডাকছেন সাহায্যকারীকে...
‘ময়নার মা, কই গেছ? হাতের কাম ফালাইয়া আহো তো। চাইলডা নামাইয়া থুইয়া দেও, পয়লা বৈশাখ বাইর কইরো’

তার মানে নববর্ষ সমাসন্ন! আমাদের বাড়ির পহেলা বৈশাখ মানেই দুপুরে ভাতের বদলে ইলিশ-পোলাও। শশা আর লেবুর সালাদ। রাতে মোরগের মাংস। অথবা গরুর মাংস ভুনা। দাদিজান সামান ঘরে তুলতে তুলতে বলেন...

‘হুনছেন, ভালো ঘোষের দই আইনেন কিন্তু’

দাদাজান তখন ঘামে জবজবে হয়ে ভেজা পাঞ্জাবি গা থেকে খুলছেন, খুলতে খুলতেই জবাব দেন...

‘ হ, হারু ঘোষেরে কইয়া আইছি’

নতুন বছরের পয়লা দিন অবশ্যই ভালোমন্দ খেতে হবে। খেতে হয়। তাহলে সারা বছর ভালোমন্দ খাওয়া যাবে। দাদিজানের ‘ভালমন্দ খাওয়া’ মানে পোলাও-কোর্মা। দই-ঘনদুধ। খাসির রেজালা। ইলিশ পোলাও। গরুর মাংস ভুনা। আলুর চপ। টিকিয়া কাবাব। বাইশ সের দুধে ক্ষীর। সেমাই আর মিষ্টি।

নতুন কাপড়চোপড় না-কিনলেও চলে। চলবে। কিন্তু ‘ভালোমন্দ’ না-খেলে নতুন বছর আসার দরকার কি? কিন্তু আমাদের তো সব চাই। আমরা ভালোমন্দ খেতে চাই, আবার বারুনির মেলার সব খেলনাপাতিও চাই। আমাদের চাই রঙিন-চরকি, ডাল-ঘুটনি, খেলনা-বটি, মাটির হাড়ি আর সরা।চাই পাটের শিকা, রেশমি-কাচের-চুড়ি। মুরালি, গজা, বাতাসা।

আর চাই মাটির ঘোড়া, যে ঘোড়ার পায়ের তলায় চার-চাক্কা লাগানো থাকে। যার গলায় রশি বেধে টান দিলেই ঘরঘর শব্দ তুলে দৌড়ায়। এই ঘোড়ার সঙ্গে আমরাও টগবগ করে চলি।

কিন্তু কারো ঘোড়া যদি ল্যাংড়া হয়ে যায়, তখন তার কান্না থামানো দায়। ঘোড়ার ঠ্যাং একটা ভেঙে গেলে পয়লা বৈশাখের সমস্ত আনন্দ মাটি হয়ে যায়। যদি ঘোড়াই খোঁড়া হয়ে যায় তাহলে নতুন বছর আসবার দরকার কি?

ও আমার পাগলা ঘুড়ারে
কারে থুইয়া কারে লইয়া যাস?

যার ঘোড়া ল্যাংড়া হয়ে গিয়েছে, তার কন্ঠে এই করুণ গান শুনেই বুঝতে পারি, বারুনির মেলা শেষ হয়ে এল বলে!কিন্তু এই বছর আমাদের আর কিছু কিনে দেয়া হবেনা। কেউ আর কিচ্ছু কিনে দেবে না আমাদের।কারো ঘোড়ার ধড় থেকে মাথা আলাদা হয়ে গেলেও না। ফলে আমরা খুব দুঃখী চেহারা করে ঘুরে বেড়াই। আমরাও তার সঙ্গে গাইতে থাকি,

ও আমার পাগলা ঘোড়ারে

কিন্তু আমরা জানি, সামনের চৈত্র ছাড়া, বারুনির মেলা ছাড়া, আমাদের এত দুঃখ উপশমের আর কোনো উপায় নাই...

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী: ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রী
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী: ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রী
ইউরোপা লিগ থেকে বিদায়ের ভালো দিক দেখছেন লিভারপুল কোচ
ইউরোপা লিগ থেকে বিদায়ের ভালো দিক দেখছেন লিভারপুল কোচ
রাশিয়ায় বোমারু বিমান বিধ্বস্ত
রাশিয়ায় বোমারু বিমান বিধ্বস্ত
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীদের নিতে জাহাজ আসবে এ সপ্তাহেই
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীদের নিতে জাহাজ আসবে এ সপ্তাহেই
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন