X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইউটোপিয়া ।। নাইদেশের সাকিন কোথায়?

জাহেদ সরওয়ার
২০ এপ্রিল ২০১৮, ০৯:৫১আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০১৮, ০৯:৫১

ইউটোপিয়া ।। নাইদেশের সাকিন কোথায়?

গ্রিক শব্দ ইউটোপিয়া মানে নোহয়ার বা কোথাও না বা নাইদেশ। শব্দটি স্যার টমাস মোরের কল্যাণে, বহুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে সাহিত্যে এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। ধারণা করি প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব ইউটোপিয়া আছে। যা হয়তো বাস্তবে কোথাও নাই। সে কেমন দেশ চায়। বর্তমান নিয়ে কোনো মানুষকে খুশি হতে দেখা যায় না। হয়তো দুনিয়ার ধারাবাহিক বিকাশের ভেতর লুকিয়ে আছে সেই অসুখ। তা না হলে টমাস মোরের সময়ের ইংল্যান্ডের সঙ্গে—বর্তমানে আমাদের দেশসহ নানা দেশের মিল রয়েছে। ইউটোপিয়া ধারার অনেক লেখা ইতিমধ্যে লেখা হয়েছে। ইউটোপিয়া লেখা হওয়ার আগেও ইউটোপিয়া ছিল। প্লেটোর রিপাবলিককে উৎকৃষ্ট মানের ইউটোপিয়ান সাহিত্য বা দর্শন বলা যায়। যাকে বলা হয় সক্রেটিসের আদর্শ রাষ্ট্র বা প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র। এরিস্টটলের পলিটিক্সকেও আমরা ইউটোপিয়ান কাজ হিসাবে ধরতে পারি। অন্যান্য আত্মসন্ধানী সাধকদের মতো মোরও তার বর্তমান নিয়ে সুখী ছিলেন না।

তাই তাকে নিজের গহিনে ডুব দিতে হয়েছিল। কল্পনার সমুদ্র থেকে অভিজ্ঞতার মিশেল দিয়ে তুলে আনতে হয়েছিল একটি নাইদেশ বা ইউটোপিয়া। নাইদেশ বললেই সেটা নাই হয়ে যায় না। সেটা সবসময় সম্ভাবনাময়। এখানে নাই মানে বাসনা, ডিজায়ার। নাইদেশ মানে বাসনার দেশ। বলা যায় অভাবের ভাব। সে ক্ষেত্রে নাইদেশ বলতে কিছু আছে। তবে তার সাকিন কোথায়? বলতে হয় প্রত্যেক রাষ্ট্রসাধক—কবি, সাহিত্যিক, চিন্তকের ভেতরে সেই নাইদেশ বাস করে। আরো বলতে হয় নাইদেশ আছে অন্তর্বাস্তব হয়ে। স্যার টমাস মোরের এই বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৫৫১ সালে। বইটি লেখা হয় তারও বহু বছর আগে ১৫১৫-১৬ সালে। তার মানে বইটির বয়স প্রায় ৪৭০ বছর। ইউটোপিয়া বইটি আকারে ছোট হলেও বইটিতে দুইটি খণ্ড আছে।

বইটির আঙ্গিকে প্লেটোর রিপাবলিকের নাটকীয় আঙ্গিকের ছায়া আছে। অবশ্য মোর বইটিতে বারবার প্লেটোর প্রসঙ্গ এনেছেন। বইটির প্রথম খণ্ড ইংল্যান্ডের সে সময়কার দুরবস্থা, রাজদরবারের উপদেষ্ঠা হিসাবে নিজের অসারতা, চোরের শাস্তি বিষয়ে কূটকথা, ইউটোপিয়া দ্বীপের অর্থনীতি ও রাজনীতি সম্পর্কে আলোচনা করেন।

আর দ্বিতীয় খণ্ডের মূল ইউটোপিয়া বা স্বপ্নরাজ্যের ভৌগোলিক বিবরণ—আমোউরোতাম মানে রাজধানী ও অন্যান্য নগর ব্যবস্থা, শাসকদের সম্পর্কে, শিল্প, বিজ্ঞান ও পেশা সম্পর্কে, ইউটোপিয়ানদের জীবন ও পারস্পরিক সম্পর্ক, দেশ ভ্রমণ ও অন্যান্য বিষয়, দাসশ্রেণি, পীড়িতের সেবা, বিয়ে ইত্যাদি, যুদ্ধবিগ্রহ সম্পর্কে, ইউটোপিয়ার ধর্ম ও সাম্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা।

ইউটোপিয়া লেখাকালীন সময়ে মোর রাজদরবারের উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি তখন দেখেছেন মাথামোটা শাসকশ্রেণি আগাগোড়া লাম্পট্য ও ভোগে ডুবে ছিল। আর এই লাম্পট্য আর ভোগ জারি রাখতে, দেশ ও তার নাগরিকদের জীবন, তারা রসাতলে ঠেলে দিয়েছিল। চুরির অপরাধে শিরোচ্ছেদ করা, ট্যাক্স আদায়, ক্ষতিকর যুদ্ধের পরিকল্পনা আর পরদেশ জয়ের জন্য মনোনিবেশ। রাজার সম্পদ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মুদ্রায় ভেজাল ধাতুর ব্যবহার, যুদ্ধের মিথ্যে অজুহাতে কর বসিয়ে অর্থ আদায়, পুরোনো ও নতুন নতুন আইন করে তা ভাঙার অপরাধে শাস্তি স্বরূপ জরিমানা আদায়, জনগণের মধ্যে চরম বিশৃঙ্খলা, যেকোনো উপায়ে তাড়াতাড়ি ধনী হবার খায়েশ ইত্যাদি অনাচার মোরকে উদ্বেগাকুল করেছিল। মোর চুরির অপরাধে শিরোচ্ছেদের বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেছেন চুরি যাতে না হয় সে ব্যবস্থা করতে। একদিকে চোর তৈরি। চুরির সুযোগ বৃদ্ধি ইত্যাদি উচ্ছেদ না করে, কেবল শাস্তি দিয়ে চুরি কমানো যাবে না। মোর রাজপরিবারের উপদেষ্টা হওয়া সত্ত্বেও লম্পট রাজার লাম্পট্যকে সমর্থন না করার কারণে, সেই লম্পট রাজার হাতেই মোরকে জীবন দিতে হয়েছিল।

দ্বিতীয় পর্ব ইউটোপিয়ার মূল পর্ব। ইউটোপিয়ার সব নগরগুলোই সুপরিকল্পিত এবং সবগুলোর নকশাই একরকম। গ্রামাঞ্চলে ক্ষেতের সঙ্গে আছে খামারবাড়ি। সববাড়িই যেখানে সবার বাড়ি। শহর থেকে প্রায়শই লোকজন গ্রামে যায়। কাজ করতে ও শিখতে গ্রাম থেকেও তাই। সেখানে সবাইকে তারা একই বাড়ির লোকই মনে করে। সকলে সব কাজ পারে সেখানে। কোনো কাজকে কেউ কখনো অন্যচোখে দেখে না। ইউটোপিয়ার প্রধান কাজ কৃষি। নিজেদের পোষাক তারা নিজেরাই বানায়। সবাই প্রায় একরকম পোষাক পরে। একটা নির্ধারিত সময়ের পরে তারা কাজ করে না। অন্যসময় তারা মানসিক উন্নতি করার জন্য কাটায়। যেহেতু সেখানে সবাই কাজ করে সেহেতু প্রচুর উৎপাদন। অতিরিক্ত চাহিদা না থাকায় কোনো অভাবও নাই। এরপর শাসকদের প্রসঙ্গ আসে। পুরা শাসনব্যবস্থাই নির্বাচিত। প্রধান আধিকারিক ও শাসকরা বুদ্ধিজীবীদের ভেতর থেকে নির্বাচিত হয়। প্রতিটি শাসন ব্যবস্থা একটার সঙ্গে আরেকটা যুক্ত। সর্বোচ্চ ক্ষমতা হলো সিনেটের।

সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে—যেখানটায় সমাজতন্ত্রের সঙ্গে ইউটোপিয়া মিলে যায়। ইউটোপিয়াতে কারো কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নাই। সবকিছু যৌথভাবে সবার। সবার যৌথ জীবন। পণ্যের বিশাল ভান্ডার থেকে যার যা দরকার সংগ্রহ করতে পারে। বিভিন্ন গণভবনে সবাই একসঙ্গে আহার বিহার করে। যে কেউ আবার চাইলে নিজের ঘরেও রান্না করে খেতে পারে। বিশাল হাসপাতালে অসুস্থদের চমৎকার সর্বজনীন ব্যবস্থা আছে। গোটা দেশে কোথায় কি উৎপন্ন হবে? সেটা সিনেট ঠিক করে দেয়। ইউটোপিয়ায় ভ্রমণ নিয়ন্ত্রিত এই জন্য যে, যাতে কেউ ভ্রমণের নামে আলস্যে দিনযাপন না করে। নিজের গ্রাম বা শহর ছেড়ে যেতে হলে প্রকৃত কারণ দেখিয়ে অনুমতি নিতে হয়। তবে যেখানে সে যায় সেখানেও তাকে কাজ করতে হয়। সে এলাকার নিয়ম অনুসারেই। গোটা দেশটাই যেন একটা পরিবার। তাদের কাছে অর্থ সোনাদানা এগুলোর কোনো মূল্য নাই। সোনা দিয়ে তারা মলত্যাগের লোটা, কাজের রান্নার বিভিন্ন ধরনের পাত্র তৈরি করে। সোনা দিয়ে তারা ক্রীতদাসকে বেঁধে রাখার শিখল বানায়। কলঙ্কের চিহ্ন হিসাবে তারা অপরাধীদের কানে গলায় হাতে স্বর্ণের অলংকার পরিয়ে রাখে।

একবার জরুরি কাজে কয়েকজন রাষ্ট্রদূত আসে ইউটোপিয়ার রাজধানীতে। এরা নতুন, ইউটোপিয়া সম্পর্কে তারা তেমন কিছু জানত না। আগে যারা ছিল মানে যারা আগে এসেছিল তারা জানতো ইউটোপিয়ায় জমকালো পোষাকের কোনো দাম নাই। রেশমি কাপড় আর সোনার গহনাকে এরা অপমান আর অবজ্ঞাজনক পোষাক বলে মনে করে। রাষ্ট্রদূত তিনজন রঙের বাহারওয়ালা রেশমি পোশাক পরা একশো ভৃত্য নিয়ে এলেন। নিজেরা সম্ভ্রান্ত বলে গলায় ও হাতে তাদের মোটা মোটা স্বর্ণের চেইন। কানে,আঙ্গুলে,টুপিতে স্বর্ণ ও মণিমুক্তার কাজ করা। তারা ইউটোপিয়ায় এসে দেখল, সবাই খুব সাদামাটা খুব গর্ব হচ্ছিল  তখন। তাদেরকে দেখে লোকে যা ভাববে বলে তারা মনে করেছিল—লোকজন ভেবেছিল ঠিক উল্টো। ইউটোপিয়া লোকজন তাদের অলংকারহীন চাকর-বাকরদের বড় কর্তা মনে করে সম্ভাষণ জানিয়েছিল। পরে রাষ্ট্রদূতরা তা বুঝতে পেরে সব অলংকার খুলে ফেলেছিল।

তবে ইউটোপিয়ানদের কাছে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। মেধাবীদেরকে তারা সবকিছু থেকে অব্যাহতি দেয় জ্ঞানচর্চার জন্য। তবে জ্ঞানে উন্নতি করতে না পারলে, তাকে আবার কায়িক শ্রমে নিয়োজিত করে।সেই নীতিই তাদের কাছে শ্রেয়—যা মানুষকে সর্বাধিক সুখ ও আনন্দ দিতে পারে। সুখ মানে নিছক ভোগ, অর্থহীন ফুর্তি বা রুচিহীনতা নয়। শিকার জাতীয় খেলাকে তারা নিন্দনীয় বলে মনে করে। বিয়ের বিষয়ে একটা অদ্ভুত ধারণা আছে এদের। বিয়ের আগে বর-কনে উভয়ে উভয়কে উলঙ্গ করে দেখবে। এগুলো মোটাদাগে উল্লেখিত আরো অনেক বিষয়ে ছোট ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন মোর। আইনকানুন শিক্ষার ব্যাপারে তিনি বলেন, এখানকার লোকজন আইনকানুন শিখে—কারণ তারা যেন ঠিকমতো আইন মেনে চলতে পারে। সেই আইনের মারপ্যাচে ফেলে মানুষকে হেনস্থা করার জন্য নয়। যুদ্ধকে ইউটোপিয়ানরা ঘৃণা করে। সেখানে কোনো স্থায়ী সেনাবাহিনী নেই। স্বেচ্ছাসেবকদের থেকেই তারা সৈন্য নির্বাচন করে। তবে প্রত্যেক নাগরিককে সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয় আত্মরক্ষার জন্য। ইউটোপিয়ায় সরকারি ধর্ম বলতে কিছু নাই। সবাই যার যার মতো ধর্ম পালন করতে পারে। মোটকথা যা কিছু কল্যাণকর ইউটোপিয়া তাই।


লেখক : কবি ও ভাবুক                                                                                                                                                                                                                        অলঙ্করণ : আল নোমান

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা