X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

কারাবাসে না গেলে জীবনের পাঠ থাকত অসম্পূর্ণ

বেলাল চৌধুরী
২৪ এপ্রিল ২০১৮, ১৩:৫১আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০১৮, ১৫:১৫

কারাবাসে না গেলে জীবনের পাঠ থাকত অসম্পূর্ণ

পাকিস্তান যে আদপেই ফাঁকিস্থান, সেটি আমরা শুরুতে টের না-পেলেও বুঝে গিয়েছিলাম সেই কৈশোর উত্তীর্ণ বয়সেই। যার জন্য অতি তরুণ অবস্থায় আকৃষ্ট হয়েছিলাম বামপন্থায়। সরাসরি বলতে গেলে সাম্যবাদে। কতটা দীক্ষিত হতে পেরেছিলাম, জানি না। তবে আন্তরিকতার দিক থেকে তাকে কোনো খামতি ছিল না। সুতরাং স্কুল ছাড়ার আগেই ‘বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি’ পড়তেই পড়তেই বাইরের জগতের হাতছানিতে পৃথিবীর পথে পা রেখে বেরিয়ে পড়েছিলাম। জীবনের পাঠ নিয়েছি প্রকৃতির কাছ থেকে, মানুষের কাছ থেকে। অনেক সৌন্দর্যে যেমন অবগাহন করেছি, তেমন অনেক কদর্য ক্লেদমুক্ত কুৎসিত দিকও গোচরে এসেছে। কপাল ভালো বলতে হবে, হাঁসের গায়ের মতো গা-ঝাড়া দিতেই ক্লেদমুক্ত হয়েও গেছি অনায়াসে। অতল গভীর খাদের কিনারায় দাঁড়িয়েও অবধারিত পতনের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে গেছি বরাত জোরে। তাই বলে আমি অদৃষ্টবাদী নই কোনোকালেই।

যেহেতু আমার বাল্যকালটা কেটেছিল কঠিন নিয়মের নিগড় আর নির্দয় শাসন ও ভয়ভীতির মধ্য দিয়ে—যার ফলে প্রথম সুযোগেই বাড়ি ছেড়েছিলাম সম্পূর্ণ স্বাধীন জীবনের স্বাদ চাখতে। পিছুটান বলতে তাড়া করত চারুশীলা আম্মা এবং ভাইবোনদের সস্নেহ, সহৃদয় উষ্ণ সাহচর্য। চার ভাই আর পাঁচ বোনের মধ্যে আমি ছিলাম জ্যেষ্ঠ, অর্থাৎ মা-বাবার প্রথম সন্তান।

আমার অষ্টাদশী আম্মা বলতেন, আমাকে পেয়ে শুধু বুক জুড়েই নয় হাতে সাতরাজ্যের মানিকের মতো আকাশের চাঁদও পেয়েছিলেন। তা সে বন্ধনকে অগ্রাহ্য করতে পেরেছিলাম বয়সোচিত ঔদ্ধত্যে কিংবা নীরব অভিমানের বশবর্তী হয়ে। আর আমার আব্বা ছিলেন নিপাট ভদ্র এবং প্রকৃত পরহেজগার সজ্জন মানুষ। তাঁর স্নেহ মমতা ছিল অন্তঃসলীলা ফল্গুধারার মতো বহু নিচ দিয়ে প্রবাহমান; যে কারণে তাঁর ধারে কাছে ভীড়তে সর্বদাই এক ধরনের ভীতসন্ত্রস্তভাব কাজ করত। তবে একমাত্র মেয়ে-সন্তানদের প্রতি তিনি ছিলেন স্নেহসিক্ত। আম্মা, আব্বার সম্পূর্ণ বিপরীত হলেও, দু’জনের পারস্পরিক ভাব-ভালোবাসা ছিল নিখাদ। আম্মার অগোছালোপনা, আব্বার ভালোমানুষিকে কোনো দিনই বাগ মানাতে পারিননি। তাঁর পেছনে হয়তো ধর্মীয় বোধেরও একটা নীরব ভূমিকা ছিল—হয়তো কেন, জোর দিয়েই বলা যায়। তবে তাকে কোনোরকমের গোঁড়ামি বা ধর্মান্ধতার লেশ ছিল না। এসবের ভিতর দিয়ে বেড়ে উঠতে-উঠতেই আমার ভেতর জমতে থাকে বিদ্রোহের ছাইচাপা আগুন। পরে শুনেছি, স্বভাবের দিক থেকে দস্যিপনা আর যাকে বলা হতো ‘মিচকে শয়তানি’, তাকে নাকি আমার জুড়ি মেলা ছিল ভার। অনেকে আবার এটাকে বলতেন নিমাই। কেন তা জানি না। হেলায়ফেলায় নানা কাণ্ডকীর্তনের শেষে বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকায় এসে শুধু কলের পানি খেয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ, নানারকম ফন্দিফিকির খাটিয়ে ভাসমান জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা, উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরে বেড়ানো আর অন্তহীন আড্ডা আর আড্ডা।

বাধাবন্ধনহীন জীবন যাকে বলে। এর ভেতর এক চাচার খপ্পরে পরে সাময়কভাবে বগ্লাহীন জীবনের রাশ টেনে নিজের বাড়িতে প্রত্যাবর্তন এবং যেদিন যে বিষয়ের পরীক্ষা, সে-বিষয় তড়িঘড়ি চোখ বুলিয়ে পরীক্ষা দিয়ে কায়ক্লেশে রয়ের ডিভিশনে মাতৃকুলনাশিনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর নিজেকে বেশ তালেবর এবং লায়েক বলে ভাবতে শুরু করে দিয়েছি। বুকের ছাটি ফুলিয়ে হাঁটি।

এসব করতে করতে জড়িয়ে পড়ি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। প্রথমে ছোটো, খুবই নগণ্য কাজ-কর্ম। যেমন পোস্টার লেখা এবং রাতভর শহরময় ঘুরে দেয়ালে-দেয়ালে সাঁটা। সে এক চোর পুলিশ খেলা। তাতেও এক ধরনের রোমাঞ্চ।

এমন সময় জনগণের জাগ্রত এবং সচেতন প্রতিরোধ দেখে বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের দিশেহারা শাসকজঙ্গীরা বেসামাল হয়ে অচিরাৎ জলাঞ্জলি দিল যাবতীয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং সাম্য, ন্যায়বিচার আর মানবাধিকারের মতো শুভবোধকে। প্রত্যাশামাফিক নেমে এল সামরিক শাসরের জগদ্দল। মীর জাফরের বংশধর ইস্কান্দর মীর্জা নামের এক অখ্যাত উর্দীপরা তল্পিবাহকের হাত ধরে একে একে বেরিয়ে এল জঙ্গীশাহির নেপথ্য নায়করা। এভাবেই বেরিয়ে পড়ল থলের বিড়াল এবং তাদের প্রকৃতস্বরূপ।

যথারীতি এদের পা-চাটা দোসরদের সাক্ষাৎ মিলতেও দেরি হলো না। শুরু হলো দেশব্যাপী নির্বিচার নিপীড়ন আর নির্যাতন। জেল, জুলুম, অন্যায়, অবিচার, হত্যা—কোনোটাই যেন আর বাদ রইল না। সেই পুরোনো খেল শুরু হয়ে গেল পূর্ণোদ্যমে। কখনো ধর্মের নামে, কখনো পঞ্চমবাহিনী, কখনো সেই নিরীহ মেষশাবকের অযৌক্তির গল্পচ্ছলে। দেশ ডুবে গেল এক অদ্ভুত আঁধারে। ৯২(ক) ধারা নামের কাল্পনিক এক জুজু, দেশদ্রোহিতা ও নাশকতামূলক কার্যকলাপের ভুয়া অভিযোগ তুলে নির্বিচারে জেলে পোরা হলো ছাত্র-শিক্ষক এবং খাঁটি দেশপ্রেমীদের। দেশব্যাপী সে এক বিভীষিকার রাজত্ব যেন। চারদিকে ব্যাপক ধরপাকড়।

কলেজে ভর্তি হয়েছি।

তখনো প্রকৃত শিক্ষক হিসেবে নিবেদিতপ্রাণ প্রজাতিরা বিলুপ্ত হয়নি, যারা ছাত্রদের সন্তানজ্ঞানে সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলায় ব্যাপৃত ছিলেন। এক কথায় মানুষ গড়ার কারিগর। এরকম কযেকজনের সস্নেহ-প্রশ্রয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে চলে গেলাম সটান জেলে।

প্রথমে নিজের এলাকা ফেনী থেকে চালান হয়ে নোয়াখালী সদর জেল—সেখানে নীলমণি কবিরাজ, কুমুদবন্ধু দত্ত, পরশুরামের যামিনী মাস্টার অবিকল কার্ল মার্কসের মতো দেখতে সালাউদ্দিন, ওয়াজিউল্লাহ, চৌমুহনির সদাপ্রফুল্ল ডাক্তার রাসবিহারী দাস, নূরুল হক, ফেনী কলেজের সুদর্শন অধ্যাপক মোহিনীমোহন চক্রবর্তী, পরে কলকাতায় গিয়ে নারকেলডাঙার এক কলেজে চাকরি নিয়েছিলেন, ততদিনে তার মুখে ক্লান্তির ছাপ, দুঃখবেদনায় কেমন যেন রিক্ত।

মাস দুয়েকের মাথায় বদলি করে নিয়ে গেল কুমিল্লা জেলে। সেই প্রথম টের পেলম কোমরে দরিবাঁধা আর রাজনৈতিক জীবনের অলঙ্কার হাতকড়া কাকে বলে? কুমিল্লা শহরের সঙ্গে আমার আবল্য নাড়ির বন্ধন। নিজের হাতের রেখার মতোই চিনতাম শহরের অলিগলি, রাস্তাঘাট, বাড়ি-ঘর এমনকি আলো-আঁধারও।

কেবল একটিমাত্র জায়গাই ছিল আমার অনধিগম্য। আর সেটি হচ্ছে—শহরের কেন্দ্রস্থল সরকারি অফিস আদালতের চৌহদ্দির ভেতর বেশ উঁচু পাঁচিলঘেরা জেলখানা। সামনের সদর রাস্তা দিয়ে আসা যাওয়ার পথে যার গেটটি ছিল নজরে পড়বার মতো। বেশ পরিপাটি এবং সারাদিন-রাত তার সামনে দাঁড়ানো সশস্ত্র সেন্ট্রি গার্ড। বাইরে থেকে কয়েকটি গাছের মাথা আর লম্বা টানাদালানের ঊর্ধ্বংশ দেখা যেত। সেটের ছাদেও সেন্ট্রির প্রহরা ছাড়া যে জিনিসটি আমাকে অবাক করত, তা হলো একটি বিশালাকৃতির ঘণ্টা। এত বড় পিতলের ঘণ্টা কেন—অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোনো সদুত্তর পাইনি। পরে জেনেছি, কেউ জেল পালালে বা পালাবার চেষ্টা করলে বা জেলের অভ্যন্তরে কোনো অঘটন ঘটলে দমকলের ফায়ার এলার্মের মতো এই সতর্ক ঘণ্টা ধ্বনি বেজে ওঠে। যাকে জেলের পরিভাষায় বলা হয় পাগলাঘণ্টি। সৌভাগ্যই বলতে হবে আমার, নাতিদীর্ঘ জেলজীবনে এই ঘণ্টাধ্বনি শুনতে হয়নি।

কারাবাস না হলে রুদ্ধদ্বার এই জগতের চমকপ্রদ সব খবরা-খবর অজানাই থেকে যেত। দেশের অন্যান্য জেলের মতো কুমিল্লা জেলও সদর জেল বলে এবং পরাধীন ব্রিটিশ আমলে নির্মিত হয়েছিল বলে লাল সুরকির রাস্তা সারিবদ্ধ কিছু ঋজুদেহী গাছ আর রঙবেরঙের ফুলের বাগান প্রথমদৃষ্টিতে বেশ আকর্ষণীয়ই মনে হয়। সাফসুতরো পরিবেশ হলেও জেল তো জেলই।

ভেতরে টানা হলঘরগুলোকে জেলের ভাষায় বলা হত ‘খাতা’। এর মধ্যে ছাত্রাবাসের মতো পরপর বিছানার সারি। যাদের মধ্যে রয়েছেন বসুরহাটের নগেন ডাক্তার, কুমিল্লার অশেষ প্রাণশক্তির অধিকারী দুই দহোদর কাঞ্চন দত্ত ও অমূল্যকাঞ্চান দত্ত। হোমনার হরেন রায়, কালিকচ্ছের শৈলেন ভট্টাচার্য—প্রমুখ সব কমিউনিস্ট নেতাকর্মীরা।

সবাই মুহূর্তে হয়ে গেলেন দাদা, অসম বয়সের বন্ধু এবং গুরুজনস্থানীয়। মাস তিন কাটতে না কাটতে আবার কোমরে দড়ি বেঁধে বৃহত্তর পটভূমিতে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারগারে স্থানান্তর। ভেতরে দুই নম্বর খাতায় ঢুকে দেখি, সে এক এলাহি কাণ্ড। নিচতলা-ওপরতলা মিলিয়ে জনাচল্লিশেক রাজবন্দি। দেশকে ভালোবাসার মতো মারাত্মক সব অভিযোগে অভিযু্ক্ত। আরো ছিল বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিরা। দণ্ড অনুযায়ী সরু আর মোটা ডোরাকাটা সাজ পোশাক আর টুপি। এদের মধ্যে বড় বড় চোর ডাকাত যেমন ছিল তেমনি ভাগ্যদোষে বা আকস্মিক রিপুর তাড়নায় কোনো দুষ্কর্মে জড়িত হয়ে তার ফল ভুগছে। বহু নিরীহ লোকও এই অবস্থার শিকার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। যাদের থেকে বাছাই করে রাজবন্দীদের কাজেকর্মে সহায়তা করার জন্য নিয়োগ করা হত।

তারা কারা? সাম্যবাদের ভূমিকা-র লেখক আন্দামান ফেরতা অনিল মুখার্জি, তেভাগা আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ দিনেশ লাহেরি, অল্প বয়স বলে গলার কাছ দিয়ে ফাঁসির দড়ি বেরিয়ে গেছে, বরিশালের আন্দামান- ফেরতা আলাভোলা সাদাসিধে সদানন্দ নলিনী দাশ, ঢাকার কমিউনিস্ট নেতা জ্ঞান চক্রবর্তী, কৌতুকপ্রিয় অমল সেন, ব্যায়ামবীর কেশব, যশোরের স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত চিকিৎসক হাসিখুশি ডা. জ্ঞান কাঞ্জিলাল, জেলে থাকাকালীন যার স্ত্রী এবং একমাত্র সন্তান বিয়োগের ব্যথা-বেদনা যে তাকে কাবু করেছে, অন্তত তাকে দেখে বুঝার উপায় ছিল না। কিশোরকাল থেকে জেলখানা যার স্থায়ী ঘরবাড়ি খুলনার রতন সেন, দেখতে প্রায় একই রকম আকৃতির ছোটখাটো বরিশালের সরদার ফজলুল করিম এবং তার প্রাণের বন্ধু খুব সম্ভবত ঢাকার প্রশান্ত যার পদবি আর এখন কিছুতেই মনে করতে পারছি না। সিলেটের কৃপাসিন্দু দে, হাসিখুশি আর প্রাণবন্ত গাট্টাগোট্টা গণিতবিদ শিবশঙ্কর বাবু, ফরিদপুরের শিক্ষক ফণী ভট্টাচার্য, ময়মনসিংহের জ্যোতিষ রায়, চট্টগ্রামের কিংবদন্তিসম কবিয়াল রমেশ শীল, বেতের মতো শরীরের ফুটবলার কালু সিং, চৌধুরী হারুনুর রশিদ, পটিয়ার কালী সেনগুপ্ত, চাঁদু দত্ত, ভাটিয়ারির সি কে দত্ত, ধীরেন বড়ুয়া, কুষ্টিয়ার রওশন আলী ছিপছিপে গড়নের ছাত্র আমিরুল ইসলাম এখন যিনি স্বনামখ্যাত ব্যারিস্টার, নারায়ণগঞ্জের তরুণ মুস্তাফা সারোয়ার, শফি হোসেন খান, কলকাতার আলী আকসাদ, যার কাছে ‘আমার বাংলা’র লেখক পদাদিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের চিঠি আসত বাইরের সুবাতাস নিয়ে, শ্রমিক নেতা শহর আলী, মুন্সিগঞ্জের আব্দুস সাত্তার, নরসিংদীর সূতাকল শ্রমিক নেতা প্রাণগোবিন্দ গুণ, ঢাকার লালমোহন সাহা, তখন কামাল ভাই হিসেবে পরিচিত হলেও পরবর্তী কালের খ্যাতনামা সাংবাদিক হাসানুজ্জামান খান। ঢাকার সূত্রাপুরের আদি ও অকৃত্রিম সন্তোষগুপ্ত যিনি আইজি প্রিজন অফিসে কর্মরত থাকা অবস্থাতেই বমাল ধরা পড়েন খাতাভর্তি কবিতা নিয়ে, রাজশাহীর খাপরা ওয়ার্ডে গুলিবিদ্ধ বরিশালের আব্দুস শহীদ ও ঢ্যাঙা যতন রশীদ এবং ক্ষীণতনু বিনয় এবং আরো কেউ-কেউ ছিলেন, যাদের ওপর-নিচতলার সারি মিলিয়েও মনে করতে পারছি না বলে, একই সঙ্গে লজ্জিত, দুঃখিত এবং ক্ষমার অযোগ্য এই বিস্মৃতির জন্য মরমে মরমে মরে যাওয়া ঢের ভালো জ্ঞান করি। এ যেন এক মস্ত মিলনমেলা। ছাত্র-শিক্ষক, নেতাকর্মী, পেশাজীবী—কে নেই।

আমার পাশের সিটেই থাকতনে ডাকসাইটে তেভাগা আন্দোলনের নেতা দিনেশ লাহিড়ি। সকালবেলায় ঘুম ভাঙত তার জলদগম্ভীর ডাকে। দেখতাম জোড়াসন হয়ে সটান হয়ে বসে আছেন আর বলছেন, ‘ছোড়ার গা থেকে এখনও ফিউডাল রক্তের গন্ধ যায়নি।’ এই এতসব প্রাতঃস্মরণীয় মহাপ্রাণদের দেখা মিলত যদি না কারাবাসে যাওয়ার সুযোগ ঘটত?

প্রতিমাসে পনেরো দিন করে এক এক দল ভাগ করে বিভিন্ন কাজের ভার দেওয়া হত। বয়োকনিষ্ঠ বলে আমার প্রতি প্রায় সকলেরই ছিল সস্নেহ প্রশ্রয়। সবার কাছেই প্রায় সমান সামদর। ভাবা যায়, হাত ধরে লজিক পড়াচ্ছেন সরদার ফজলুল করিমের মতো কৃতধীপুরুষ। ইংরেজি পড়াচ্ছেন তারই বন্ধু প্রশান্ত কিংবা আর কেউ। দাদা-বন্ধু-ভাই স্নেহশীল অভিভাবক কলতে তো এরাই সব। যেন একান্নবর্তী পরিবার। এদের সঙ্গ সুখসাহচর্য যাই বলা যাক, প্রাণভরে উপভোগ করা গিয়েছিল এক বছরেরও অধিক সময়। কলকাতা থেকে রতনদার খ্যাতনামা আইনজীবী বাবার পাঠানো জামা এবং উলের স্যুয়েটার গায়ে দিয়েছি আমি, যা উষ্ণতা এখনো গায়ে লেগে আছে।

স্বল্পকালীন এই জেলজীবনে আমৃত্যু স্মরণীয় থাকার মতো আর একটি ঘটনা পরবর্তীকালে স্বাধীনতার রূপকার বা স্থপতি যাই বলা যায় না কেন, জাতির জনক বা বঙ্গবন্ধু হননি, তখনো চিরউন্নত শির ঋজু টানটান শেখ মুজিবুর রহমান-এর করস্পর্শে ধন্য হওয়া। শুক্রবারে জুমার নামাজ আদায়ের জন্য জন্মসূত্রে মুসলমান হওয়ার সুযোগে যদিও শাসকদলের ভ্রুকুঞ্চিত ভাষায় কাফের আখ্যায়িত হওয়া সত্ত্বেও অস্থায়ী সাপ্তাহিক প্রার্থনা ঘরে যাওয়ার অনুমতি মিলত। ধর্মকর্মে তেমন মতি না থাকলেও জেলজীবনের কঠিন নিগড় থেকে ক্ষণিক মুক্তির স্বাদ পেতে অনেকটা মুখ বদলের মতো ছুটে যেতাম সবাই মিলে; বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে নিয়ে আসা হতো অন্যান্য রাজবন্দি মুসল্লিদেরও। আমাদেরটা ছিল কমিউনিস্ট ব্লক। অন্যান্য ব্লকে থাকতেন বিভিন্ন দলীয় এবং প্রথমশ্রেণীপ্রাপ্ত রাজবন্দিরা। আসলে দেখতাম, পারস্পরিক মেলা মেশা ও দেখা সাক্ষাতের এই সুযোগটা কেউ হারাতে চাইতেন না। এই প্রায় এক ঘণ্টার মতো প্রাপ্ত সুযোগের সদ্ব্যবহারের জন্য সবাই যেন সারা সাপ্তাহব্যাপী উদগ্রীব এবং উন্মুখ হয়ে থাকতেন। জেলখানার এক মৌলবি সাহেবের ইমামতিতে নামাজের ফাঁকেই চলত পারস্পরিক খবরা-খবরের আদান-প্রদান। দেশের রাজনৈতিক পরস্থিতি থেকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা কোনোটাই বাদ যেত না নামাজের বকলমে রাজনীতির কৌশলের বিনিময়। মোনাজাতের সময়ও অব্যাহত থাকত আলাপ-আলোচনা। অবশ্য জেলকর্মীদের অনেকেও এসব ক্ষেত্রে ছিলেন সহানুভূতিশীল। কমরেডদের মধ্যে আদর্শিক একাত্মবোধ এমনই দৃঢ় ছিল যে সেখানে ধর্মকর্ম নিয়ে কারোরই মাথাব্যথা ছিল না। যার ফলে জাতপাত নিয়ে কখোনোই কেউ মাথা ঘামাবার প্রয়োজন বোধ করেননি।

সে যাই হোক, এখানেই প্রথম দিন দেখলাম দীর্ঘকায়, কিস্তিটুপি পরিহিত শেখ মুজিবুর রহমানকে। কী করে যেন কাতারবন্দি হওয়ার সময় তার পাশেই দাঁড়িয়ে গেছি। এর আগেও তাঁকে অনেকবার দেখেছি। সেই কারকুনবাড়ি লেনে, সাপ্তাহিক ইত্তেফাক অফিসে, আরমানিটোলা ময়দানে, কুমিল্লার দারোগাবাড়িতে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে। সেসব দেখা সবই দূর থেকে। কৌতূহলী কিশোরের চোখে।

কখন যেন তাঁর চোখ পড়ল আমার দিকে। যেন এখানে আমি কী করে বা কেন? আমার মাথার চুল তখন রুখোসুখো এবং ঈষৎ লালচে। তার হাত নেমে এল আমার মাথার অবিন্যস্ত চুলে। পাশ থেকে কে যেন একজন বলে উঠলেন, মুজিব ভাই ও কিন্তু রাজবন্দি। তিনি কী ভেবিছিলেন কে জানে? আমি কিছু বলার আগেই তার সেই স্বভাবসুলভ গোপালগঞ্জি উচ্চারণে স্বগতোক্তির মতোই যেন বলে উঠলেন, “হায়রে এন এম খান, (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানের জবরদস্ত মুখ্য সচিব এবং হর্তাকর্তা বিধাতাদের একজন) তোমাদের এতই ভয়, নাক টিপলে দুধ বেরোয় এই মাসুম বাচ্চাকেও তোমরা ধরে এনেছো!” এরপর আরো বারতিনেক তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। স্থান বলাবাহুল্য উপরিল্লিখিত ওই একই অকুস্থলে। এই মহাপ্রাণের সঙ্গে সেই আমার প্রথম ও শেষ চাক্ষুষ দেখা। উচ্চতায় যাঁকে তখইনই মনে হয়েছিল মহামানবতুল্য। এরপর তো সবটাই ইতিহাস ও মহাকালের অঙ্গীভূত।

এখানে আর একটা কথা না বলনেই না। আজ এতদিনের ব্যবধানে অনেক কমরেডের নাম মনে করতে পারলেও তাঁদের পদবি ভুলে গেছি। এমনিতেই আমার স্মরণ শক্তি এত দুর্বল যে সে কথা আর কহতব্য নয়। তবে কিছু ঘটনা, কিছু মানুষের বাক-বিভূতি, আচার-আচরণ, অভিব্যক্তি যা এমনিতেই হয়তো নিছকই নগণ্য, কিন্তু এক সঙ্গে থাকলে তাও স্থায়ীভাবে মনে দাগ কেটে যায়। তবে সেসব নিয়ে আরো বিশদে লেখাটা এখনো শেষ করে উঠতে পারিনি জীবনযুদ্ধের তাগিদে। কখনো স্মৃতিও বিস্মৃতিরই নামান্তর। এই লেখায় উল্লিখিত অনেকেই কালের অমোঘ নিয়মে আজ আর বেঁচে নেই। না থাকলেই বা কী। এঁদেরই তো সম্মিলিত আত্মদানে বিশ্বের বুকে আমরা গর্বিত এক জাতি।

সূত্র : নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায়, বেলাল চৌধুরী,(আত্মস্মৃতি), ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মিয়ানমারের বিমান হামলায় উদ্বিগ্ন জাতিসংঘ মহাসচিব
মিয়ানমারের বিমান হামলায় উদ্বিগ্ন জাতিসংঘ মহাসচিব
ইনজুরিতে আর্জেন্টিনার প্রীতি ম্যাচে খেলা হচ্ছে না মেসির  
ইনজুরিতে আর্জেন্টিনার প্রীতি ম্যাচে খেলা হচ্ছে না মেসির  
এবার রাজশাহীর আম গাছে প্রচুর মুকুল, স্বপ্ন বুনছেন চাষিরা
এবার রাজশাহীর আম গাছে প্রচুর মুকুল, স্বপ্ন বুনছেন চাষিরা
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ মার্চ, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ মার্চ, ২০২৪)
সর্বাধিক পঠিত
লিটনের বাদ পড়া নিয়ে যা বললেন হাথুরুসিংহে
লিটনের বাদ পড়া নিয়ে যা বললেন হাথুরুসিংহে
শ্রীলঙ্কাকে উড়িয়ে ওয়ানডে সিরিজ জিতলো বাংলাদেশ
তৃতীয় ওয়ানডেশ্রীলঙ্কাকে উড়িয়ে ওয়ানডে সিরিজ জিতলো বাংলাদেশ
পদ্মার গ্রাহকরা এক্সিম ব্যাংক থেকে আমানত তুলতে পারবেন
একীভূত হলো দুই ব্যাংকপদ্মার গ্রাহকরা এক্সিম ব্যাংক থেকে আমানত তুলতে পারবেন
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার