X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১
দ্য সেকেন্ড সেক্স

কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, নারী হয়ে ওঠে

জাহেদ সরওয়ার
২৫ মে ২০১৮, ০৭:৪১আপডেট : ২৫ মে ২০১৮, ০৭:৪১

 

কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, নারী হয়ে ওঠে

মহাত্মা সিমোন দ্য বোভোয়ারের এই বইটি এমন একটি বই, যা কোনো পুরুষ পড়লে নারীর প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। আবার কোনো নারী পড়লেও পুরুষের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যেতে পারে। নারী-পুরষ পরস্পরকে দেখার এক তাত্ত্বিক আয়না যেন। নারী-পুরুষের সমস্যা ও সম্পর্ক এখনো অসমাপ্ত, অসামঞ্জস্য। সেটা নীতি নৈতিকতা বা ধর্ম দিয়ে আজও দ্বিভাজিত। কিন্তু কখন থেকে কীভাবে দুজন মানুষ একজন আরেকজনের ওপর কর্তৃত্ব করা শুরু করল এবং কেন ধীরে ধীরে নারী হয়ে ওঠল পুরুষের অধস্থন দাসী। নারীর প্রতি যুগ যুগ ধরে পুরুষের এমন দৃষ্টিভঙ্গি তাকে করে তুলেছে ক্রীতদাসের সমান। এটা কোনো স্বাভাবিক সম্পর্ক নয়। পুরুষ যে কাজ করে তা করতে পারা সত্ত্বেও নারীকে তার সমমর্যাদা কখনো দেয়া হয়নি। আজও পৃথিবীতে পুরুষের হাতে নারী যেভাবে লাঞ্চিত হয়, শোষিত হয় বঞ্চিত হয় তা আর কোনো ভাবেই হয় না। সে সবের শুলুকসন্ধান করেছেন তিনি এই বইটিতে। দুইটি খণ্ডে অনেকগুলো অধ্যায়ে সন্নিবেশিত করেছেন বইটিকে। প্রথমে তিনি জীববিজ্ঞানের উপাত্ত পরিবেশন করেন এরপর মনোবিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিকোণ থেকেও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টাকে বিচার করেন।

ছেলে বা মেয়ে জন্মানোর দায় সম্পূর্ণ পুরুষের। নারীর থাকে এক্স ক্রোমোজোম সেখানে পুরুষের শুক্রাণু থেকে ওয়াই নিঃসরিত হলে ছেলের জন্ম হয় আর এক্স নিঃসরিত হলে মেয়ের জন্ম হয় কিন্তু মেয়ে জন্ম দেয়ার দায় দেয়া হয় নারীকে। এটা কূপমণ্ডকতা ছাড়া আর কিছু নয়। নারী ও পুরুষ একই প্রজাতির ধারক। তাদের উভয়ের দায়িত্ব মানুষ প্রজাতিটাকে টিকিয়ে রাখা। মানুষ প্রজাতিটাকে টিকিয়ে রাখতে সবচেয়ে বেশি নিজেকে উৎসর্গ করে নারী, বিসর্জন দেয় নারী। অথচ তবুও সেই নারীকেই সব লাঞ্ছনা সইতে হয় পুরুষের হাতে। মানুষের প্রজাতি টিকিয়ে রাখার বেশি ভূমিকা রাখা নারীকে মানুষ হিসাবেও মর্যাদা দেওয়া হয় না।

সিমোন বলেন, মাছ বা পাখি যারা ভ্রূণে বিকশিত হওয়ার আগেই ডিমকে শরীর থেকে বের করে দেয়, তারা তাদের শাবকদের সঙ্গে স্তন্যপায়ীদের থেকে কম দাসত্বে আবদ্ধ থাকে। সেই সময় তারা মুক্ত থাকে মাতৃত্বের দাসত্ব থেকে। তখন স্ত্রীলিঙ্গটি মাঝে মাঝেই সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারে পুংলিঙ্গ জীবটির। অশ্বী অশ্বের মতোই দ্রুতগামী। শিকারি কুকুরির ঘ্রাণ পুরুষ কুকুরের মতোই তীব্র, বানরীও বুদ্ধিমত্তায় বানরের চেয়ে কম নয়। কিন্তু নারী এই স্বাতন্ত্র নিজের বলে দাবী করে না। প্রজাতির কল্যাণের জন্য সে ত্যাগ করে এই দাবী।

তবে কি পুরুষ স্বভাবেই আধিপত্যকামী ও স্বার্থপর? তিনি বলেন, পুরুষের আধিপত্য প্রকাশিত হয় সঙ্গমের ভঙ্গিতেও। প্রায় সব প্রাণির মধ্যেই পুরুষটি থাকে নারীর ওপর এবং পুরুষটি ব্যবহার করে যে অঙ্গটি, সেটি একটি জড়বস্তু কিন্ত এটি পরিণত হয় উদ্দীপ্ত দণ্ডে। সঙ্গম একটি দ্রুত ক্রিয়া এতে পুরুষের শক্তি ক্ষয় হয় খুব সামান্য। অধিকাংশ সময় সে সঙ্গমের পরই ত্যাগ করে স্ত্রী লিঙ্গটিকে।

ব্যক্তিগত মালিকানা গড়ে ওঠার সময়ই মূলত নারীও পুরুষের কাছে সঞ্চিত অন্যান্য সম্পদের মত ব্যক্তিগত সম্পদ হয়ে ওঠে। কারণ তখন সে গৃহস্থালী কাজকর্মে সময় দিত। এটা একটা ঐতিহাসিক ভুলবুঝাবুঝি। এরপর সে হয়ে পড়ে সংখ্যা তার ব্যক্তিত্ব ও মানুষ হিসাবে তার সন্মান বিলুপ্ত হয়। এরপর কালকাটে দ্রুত। তাই দেখা যায় একেকজন পুরুষ সম্রাটের হারেমে হাজার হাজার নারী। সবাই তার একজনের ভোগ্য। এভাবে নারী সভ্যতার মালিকানা চক্রে ধরা পড়ে যায়। তাকে বাইরের কোনো কাজে তখন অংশ নিতে দেয়া হয়নি। ধীরে ধীরে তাকে বলা হয়েছে তুমি অবলা তুমি কঠিন কাজ পারবে না। তুমি ভোগ্য ঘরে বসে সাজগোজ কর আর বাচ্চা সামলাও আর দিগ্বিজয়ী পুরুষের জন্য রান্না কর। দেখ পুরুষ কি খেতে পছন্দ করে তুমি রেসিপি শেখো। এভাবে ঘরের অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে তাকে একীভূত করা হয়। তাই সিমোন বলেন, নারীর পক্ষে যা দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছিল তা হচ্ছে; শ্রমিকের সহকর্মী হতে না পারার জন্য সে বাদ পড়ে যায় মানবিক সহচারিতা থেকেও। নারীর মুক্তি ঘটতে পারে তখনই যখন বৃহৎ সামাজিক মাত্রায় উৎপাদনে অংশ নিতে পারবে। গৃহস্থালির কাজে অংশ নেবে নগণ্য মাত্রায়।

নারীকে আসলেই অনেকগুলো স্তর পেরিয়ে আসতে হয়েছে। একে তো মানুষ হিসাবে তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। মধ্যযুগে তাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল যে, তার স্বামী বা মালিকের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাকেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো। ভারতে বিধবাদের সতীদাহের নামে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। মিশরে রাজাদের সঙ্গে তাদের স্ত্রী ও রক্ষিতাদেরও জীবন্ত কবর দেয়া হতো। কোনো কোনো অঞ্চলে নাকি এরকমও ছিল যে, একপরিবারের সব পুরুষই ছিল একনারীর স্বামী। একজন মারা গেলে তখন তার মালিক হতো ধারাবাহিকভাবে অন্যজন। এমনকি প্রাচীন মানুষ নাকি আতিথেয়তামূলক গণিকাবৃত্তি পালন করত। অচেনা অতিথিদেরও আপ্যায়ন করা হতো নারী দিয়ে। এরপর রোমান নেপোলিয়ন ও হিটলারের সময়ে নারীর অবস্থা, এঙ্গেলস ও মার্কসের দৃষ্টিতে নারী এসব বিস্তারিতভাবে সমালোচনা করেছেন সিমোন এই মহাগ্রন্থে। একমাত্র লেলিনের ক্ষেত্রে তিনি বলেন, মার্কসবাদী ধারার প্রতি বিশ্বস্ত লেনিন শ্রমিকের মুক্তির সঙ্গে যুক্ত করেন নারীর মুক্তিকে। তিনি তাদের দেন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাম্য।

সম্পূর্ণ অধিকার বঞ্চিত থেকে নারী ধীরে ধীরে আবার তার অধিকারের জন্য দেশে দেশে লড়াই শুরু করে। সেটা খুবই অনুগ্র স্বরে। যেমন ফরাসি বিপ্লবের পর সেখানে নারী ভোটাধিকার পায়। পৃথিবীর প্রায় দেশে এখন নারীর ভোটাধিকার আছে। কারখানায়, অফিসে সর্বত্র এখন নারীরাও কাজ করছে যদিও নারীসুলভ শোষণে এখনো তারা আক্রান্ত ও শোষিত।

পারিবারিক সম্পর্ক বিষয়ে তিনি বলেন, এই ভুবন যা ছিল চিরকালই পুরুষদের অধিকারে। আজও তাই আছে। আজও বহাল আছে সব পিতৃতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও মূল্যবোধগুলোর অধিকাংশ। নারী স্বাস্থ্যের ঝুঁকি নেয় বা বিধ্বস্ত হয় অসংখ্য গর্ভধারণে। গৃহকর্ম থেকে সন্তান লালনপালন সবই নারীকেই করতে হয়। ... পিতামাতারা আজও কন্যাদের, তাদের বিকাশের জন্য বড় করে না করে বিয়ের জন্য। তারা এতে এতরকম সুবিধা মনে করে যে এর ফল হচ্ছে তারা থেকে যায় কম প্রশিক্ষিত। ভাইদের তুলনায় তাদের ভিত্তি হয় কম দৃঢ়, তারা তাদের পেশায় তেমন একনিষ্ঠ হয় না। এইভাবে তারা নিজেদের নষ্ট করে, থেকে যায় নিম্ন স্তরে, হয়ে ওঠে নিকৃষ্ট, গড়ে ওঠে পাপচক্র। এই পেশাগত নিকৃষ্টতা তাদের ভেতর বাড়িয়ে তোলে শুধুই একটি স্বামী লাভের কামনা।

বিষয়টা এমন অবস্থায় চলে এসেছে যে, নারী তার নিজস্ব জগৎ পুরুষের প্ররোচণা বা প্রভাবে ভুলতে বসেছে। তার সব কিছুই পুরুষের মতো করে গড়ে ওঠে। তাদের হাতে কোনো কর্তৃত্ব নেই। উত্তরাধিকার সূত্রে হয় কিছু রাজনৈতিক কর্তৃত্ব তারা পায় কিন্তু তাতেও মূলত তারা ব্যবহৃত হয়। সিমোন বলেন, নারীরা নিজেদের কখনো কর্তারূপে প্রতিষ্ঠা করেনি এবং সৃষ্টি করেনি এমন কোনো পুরুষ-পুরাণ, যাতে তাদের পরিকল্পনার প্রতিফলন ঘটেছে। তাদের নিজেদের কোনো ধর্ম নেই, কবিতা নেই; তারা আজও পুরুষের স্বপ্নের ভেতর দিয়ে স্বপ্ন দেখে। পুরুষের তৈরি দেবতারাই তাদের উপাস্য।

নারী বিষয়ক এই মহাগ্রন্থটি সারা বিশ্বজুড়ে ব্যাপক সমাদৃত। নারী সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নানা গবেষণা তুলে ধরেছেন সিমোন। যা স্বল্প পরিসরে আলোচনা প্রায় অসম্ভব। তবে এই বই পাঠ হয়ে ওঠে অন্যরকম অভিজ্ঞতা। সত্যিকার অর্থে যে সমস্ত বইকে আমরা বলি আলোকসঞ্চারী সিমোন দ্য বোভোয়ারের দ্য সেকেন্ড সেক্স সেই বইগুলোর মধ্যে অন্যতম। যা ইতিমধ্যে বিশ্বের সেরা ক্ল্যাসিক নন-ফিকশনগুলোর শীর্ষে জায়গা করে নিয়েছে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি চলমান ভাষায় এই বইটার একাধিক অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

লেখক: কবি ও ভাবুক।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া