X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১
গল্প

ভিডিও দেখলে চমকে উঠবেন ।। রাজর্ষি দাশ ভৌমিক

.
০২ জুন ২০১৮, ০৭:৪৭আপডেট : ০২ জুন ২০১৮, ০৭:৪৭

ভিডিও দেখলে চমকে উঠবেন ।। রাজর্ষি দাশ ভৌমিক

— বাবা কি সত্যি এইকাজ করেছে?

— অ্যাই; ছেলে হয়ে বাপের ভুল ধরিস! এই শিক্ষে পেয়েছিস তুই।

— ভিডিও তে আজকাল কারিকুরি করা যায়, জানো মা!

— অত জেনে আমার কাজ নেই। মানুষটাকে এখন বাঁচাতে হবে।

— আমাদের কলেজের একটা ছেলে তার গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে একটা ভিডিও বানিয়েছিল, সেটা নিয়ে কী বিশাল কেস! ইউনিয়ান ইন্টারফেয়ার করল। মেয়েরা একদিন আলাদাভাবে প্রিন্সিপালের গিয়ে পিটিশান জমা দিল। পরে জানা গেল সব ভুয়ো। দত্তপুকুরের সাইডে একটা স্টুডিও আছে। ওদের পাঁচশো—হাজার না-জানি কত টাকা দিলে সব বানিয়ে দেয়।

—  বাজে বকবি পরে। এখন ভাবতে দে, মানুষটাকে কি পুলিশে দেবে?

—  পুলিশে তো দিয়েইছে। ভিডিও পোস্ট করার পর তিনঘণ্টা হয়ে গেল। দেখলে না, ক্যামেরার সাইড থেকে একটা পাবলিক বললো, পুলিশ ডাক পুলিশ ডাক!

—  সকালেও বেরলো সব ঠিকঠাক, এর মধ্যে এত কিছু,কীভাবে!

—  আমাদের কলেজে, রবি আছে না, মুকুল মাস্টারের ছেলে, দরজির কাজ করে, ও আমাকে ডেকে ভিডিওটা দেখালো, বলে দ্যাখ ভিডিও-এর লোকটাকে তোর বাপের মতো লাগছে না। সকাল থেকে ভিডিওটা তিরিশ হাজারবার শেয়ার হয়েছে। আমি চিনতে পেরেছি। কিন্তু ভয় খেয়ে গেছিলাম, তাই বললাম, ও আমার বাবা না, অত চুল আমার বাবার মাথায় পাকেনি। আমার মোবাইল তো সারাদিন বন্ধ।

— এই তোর এক বাপের মতো বাজে কথা বলার স্বভাব হয়েছে, ভাবতে দিবি কি না, কোন থানায় নিয়ে যাবে বলতে পারবি?

— অফিসের ঘটনা যখন, আফিসের কাছাকাছি থানাতে নেবে।

— কার কাছে গেলে খোঁজ পাব, কার কাছে যে যাই, মা-মা-মা বিপদতারিণী গো।

— আমরা কি পালাব,মা?

কৃষ্ণেন্দুর প্রশ্নে উর্মিলা চমকে ওঠেন, হাতের মুঠোয় ধরা মোবাইল ফোন আলগা হয়ে যায়, তার কোলের ওপর এসে পড়ে। দুপুরের ঘুম থেকে তুলে কৃষ্ণেন্দু উর্মিলার মোবাইলের খোঁজ করছিল। ঘুমলাগা চোখে উর্মিলা ভাবছিলেন ছেলে বুঝি ক্লাস কামাই করে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এল। বালিশের নিচে, হাতড়ে উর্মিলা নিজের সস্তার,কালো স্মার্টফোন কৃষ্ণেন্দুর হাতে দিলে, কৃষ্ণেন্দু ফোন নিয়ে নাড়াঘাটা করে ফের তা মায়ের হাতে ধরিয়ে দেয়। উর্মিলা বিছানায় উঠে বসেন, চুলে খোঁপা করেন,কৃষ্ণেন্দু ফোনের স্ক্রিন উর্মিলা বুকের কাছে ধরে ছিল। বামে ফিরে গুরুদেবের ছবিতে প্রণাম করতে করতে উর্মিলা মোবাইলের ভিডিও-তে স্বামীকে নিগৃহীত হতে দেখে, প্রণাম বাদ রেখে খপ করে কৃষ্ণেন্দুর হাত থেকে ফোন ছিনিয়ে নিয়ে, ফেসবুকে পোস্ট করা গোটা ভিডিওটা দেখলেন।

উর্মিলা বিছানার থেকে নেমে এলেন, বিশাল শরীর তার, বাতের ব্যথা, মাথা ধরে আছে, শাড়ি এলামেলো, মনে হয় একটা কুমির যেন বিছানা থেকে মেঝেতে নেমে এল। কৃষ্ণেন্দু এক পা পিছনে সরে উর্মিলাকে দাঁড়াবার জায়গা করে দেয়। উর্মিলা কৃষ্ণেন্দেুর বুকে তার ভারি ও গয়নাময় হাত রেখে বললেন—এখন পালাব না। এখন মানুষটাকে বাঁচাতে হবে। তুই গিয়ে এখনই একটা উকিল ধর। কোটকাছারিতে যা, যেভাবে পারিস, দরকার হলে কলেজের মাস্টারকে ফোন করে বলবি, উকিলের ঠিকানা দিতে। পারবি না?

কৃষ্ণেন্দু ঘাড় নাড়ায়, উর্মিলা ছেলের সংশয় আন্দাজ করে বললেন—আমরা কোন অন্যায় করেছি? আমরা কেন পালাব?

মায়ের কথায় কৃষ্ণেন্দু অল্প ভরসা পায়, ঘাড় নাড়ে, বলে—তুমি যাবে না আমার সঙ্গে?

—  আমি কি এই শরীরে এত তাড়াতাড়ি ছোটাছুটি করতে পারব! আমি থাকলে তোর পিছুটান পড়বে।

— লোকজন জানাজানি হলে বাড়িতে চড়াও হতে পারে। তোমাকে, একা মেয়েমানুষ পেলে ওরা ছাড়বে না।

উর্মিলা ভয় পান, স্বামীর কর্মের ফল যে তার পরিবারকে ভুগতে হতে পারে তা প্রথমবার ভিডিও শুনে উর্মিলা আন্দাজ করতে পারেননি। অথচ কৃষ্ণেন্দুর মাথায় আশঙ্কাটা ছিল, কৃষ্ণেন্দু পালাবার কথা উল্লেখ করলে উর্মিলার মনে হয়—ছেলে তো ঠিক বলছে, ঠিকই বলছে,এমনটা তো কত শোনা যায়। খবরের কাগজে আকছার রিপোর্ট হয় জনতার রোষে অপরাধীর বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনটা তো তাদের সঙ্গেও হতে পারে, অবিশ্বাস্য মনে হয় না। যেন এতদিন যাবত দূর থেকে দেখা কোনো ঘটনা তাদের ভাড়াবাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে।

কৃষ্ণেন্দু তার হাত বাতাসে ঘুরিয়ে বলে—কাপড় পরো, চলো আমার সঙ্গে। উর্মিলা তার মনের ভয়কে ছেলেকে বুঝতে দিলেন না। তার মুখ—হাত চর্বিময়, তিনি জানেন তার চেহারায় দৃঢ়তা আছে, কথাবার্তায় দাপট আছে, স্বামী তার তাঁবে থাকে, বাড়িওয়ালা ঘাটায় না, পাড়াপড়শি সমঝে চলে। কুড়ি বছর একার হাতে সংসার করে তার চরিত্রের বলিষ্ঠ ভাব তৈরি হয়েছে, তিনি দৃঢ়ভাবে কৃষ্ণেন্দুকে নির্দেশ দিলেন—আমি সব ভেবে রেখেছি, তুই আমার প্ল্যানমতোন কাজ কর, আমি আজ রাতটা বাড়িতেই কাটাবো, কাল ভোরের আলো ফোটবার আগে আমি পালাব। সব বুঝিয়ে বলছি, আগে কয়েকটা জিনিস ধরিয়ে দিই।

কৃষ্ণেন্দুকে দাঁড় করিয়ে রেখে উর্মিলা কাপরের খুট থেকে একগোছা চাবি বের করে আলমারি খুললেন। জামাকাপড়ের আড়াল থেকে একটি ভেলভেটের ছোট বাক্স বের করে আনলেন, আলমারির লুকানো, চ্যাপ্টা দেরাজ থেকে  দশটি পাঁচশো টাকার নোট খুঁজে পেলেন, টাকা ও গয়না উর্মিলা কৃষ্ণেন্দুকে হিসেব করে বুঝিয়ে দিয়ে বললেন—উকিলের খরচ, জামিন লাগলে জামিন, নিজে খাবি, লোকটাকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করবি, পুলিশ টাকা-পয়সা চাইলে মুখ বুজে দিবি না, দাম-দর করবি, বাজার করার মতোই, যদি টাকা-পয়সায় মিটমাট পুলিশ ছেড়ে দেয় তবেই মঙ্গল!

কৃষ্ণেন্দু টাকা-পয়সা গুনেগেঁথে নিতে নিতে জানতে চাইল—বাড়িওয়ালাদের কিছু বলতে হবে?

উর্মিলা ধমকে উঠলেন—ব্যানার্জিদের দিকটা আমি দেখব, তুই নিজের কাজটা কর, আর খবরদার যেন বাড়ি আসবি না। রাতের কাজ মিটলে মছলন্দপুরে মাসিদিদার বাড়ি চলে যাবি। ওদের কিছু বলিস না যেন, ওরা সবাই বুড়ো মানুষ। আমি ভোর ভোর মছলন্দপুর চলে যাব। তারপর ঠাকুর যা চাইবেন একটা ব্যবস্থা হবে। আর,ও, হ্যাঁ আমাকে মেসেজ করবি, কি হচ্ছে সব জানাবি, মনে থাকে যেন।

কৃষ্ণেন্দু জামা পালটে নেয়, নিজের মোবাইল খাটের উপর রেখে, উর্মিলার মোবাইল নিজের জামার বুকপকেটে ভরে। উর্মিলা অবাক হয়ে জানতে চাইলেন—তোর মোবাইল কি দোষ করলো?

— ব্যালেন্স নেই। বাবা টাকা ভরিয়ে দেবে বলেছিল। তোমার কাছে রইল।

— অল্প কিছু টাকা ভরে দিস, মনে করে। উর্মিলা বললেন।

কৃষ্ণেন্দু কোলাপসিবল গেট টেনে বেরিয়ে যায়, বাইরে, পথেঘাটে শেষ বিকেলের আলো। উর্মিলা গেট খুলে দোতলার দিকে তাকিয়ে দেখলেন বাড়িওয়ালারা কেউ কৃষ্ণেন্দুকে বেরতে লক্ষ্য করলো কি না। খানিকক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে, যেন কিছুই হয়নি, উর্মিলা বাড়ির ভিতরে, ঢুকে পড়লেন, কোলাপসিবল গেট টেনে দিলেন, কিন্তু তালা দিলেন না। সাড়ে আটহাজার টাকার ভাড়া বাড়ি, মফস্বলের গেরস্থ পল্লীতে, বাড়িওয়ালার স্ত্রী, দুইমেয়ে আর বৃদ্ধা মাকে নিয়ে দোতলার থাকে, হার্ডওয়ারের ব্যবসা। দুপুরে দোকান বন্ধ করে বাড়িতে খেতে আসে, বেলা তিনটার দিকে স্কুটারে করে বাড়িওয়ালা দোকানে চলে যায়। বাড়ির সামনে অযত্নের বাগান, নিচু পাঁচিল, কাচ বসানো, সামনে অপ্রশস্তগলি, ছয়টি বাড়ি পেরলে বড়রাস্তা।

উর্মিলা বসবার ঘরে ঢুকে একটি জানলার পাল্লা বন্ধ করে ছিটকিনি আটকে দিলেন, অপর জানালাটি বসবার ঘরের এককোণে দেওয়ালের সঙ্গে সাঁটিয়ে রাখা চৌকানো ডাইনিং টেবিলের উপরে। ডাইনিং টেবিলে রাতের খাবার চাপা দেওয়া থাকে তাই উর্মিলা দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ হলে এই জানলাটি বন্ধ করে দেন। বসবার ঘর আর শোওয়ার ঘরে যাওয়ার মাঝের দরজার পর্দা টেনে কাঠের পাল্লা বন্ধ করে দিলেন। শোওয়ার ঘরের তিনখানি জানালার পাল্লা খোলা, সিলিঙে ফ্যান চলছে, জানালার পর্দা উড়ছে। উর্মিলা ফ্যান অফ করে দিলেন, পর্দার ছটফটানি কমলো, একে একে জানালার পাল্লাগুলি সন্তর্পণে বন্ধ করলেন। এমনভাবে ছিটকিনি তুললেন যেন মনে হবে ছিটকিনির লোহায় আজো মরছে পড়েনি। বিড়াল আসবার ভয়ে রান্না ঘরের খুপড়ি জানালাটি বন্ধ রাখা হয়। উর্মিলা ছেলের ঘরে আসলেন, চৌকি পাতা, পড়বার ডেস্ক, টুল, চৌকির পায়ের কাছের জানালাটি দিয়ে গলির মানুষজনকে দেখা যায়। উর্মিলা ভেবেছিলেন যে ছেলে হয়তো কলেজে যাওয়ার সময় জানলার পাল্লা বন্ধ করেছে। এই জানালাটি বিশেষ মুশকিলের, কাঠের পাল্লা ঠান্ডা গরমে বেঁকে আছে, ভালোভাবে সাঁটে না। উর্মিলা রান্নাঘর থেকে একটি নারকেল দড়ি নিয়ে এসে জানালার পাল্লার কড়া আর লোহার সিকে বেঁধে দিলেন। জানালার ব্যবস্থা শেষ করে উর্মিলা ফের রান্নাঘরে এলেন, রান্নাঘর থেকে কলতলায় যাওয়ার একটি দরজা আছে, এই দরজাটিতে কোলাপসিবল গেট নেই, এপথে ঠিকে ঝি আসে, দরজাটি রান্নাঘরের ভিতর থেকে বন্ধ করা হয়। উর্মিলা দরজার তালা খুলে, শিকলি নামিয়ে রাখলেন।

শোওয়ার ঘরে ফিরে উর্মিলা তার ঘরে—পড়বার শাড়ি ছেড়ে একটি তাঁতের শাড়ি পড়লেন, অনুজ্জ্বল রঙের, খোঁপা করলেন,ঘাড়ে আর বুকে পাউডার দিলেন, আয়নার গায়ে লেগে থাকা টিপ নখ দিয়ে আঁচড়ে তুলে কপালে পড়লেন। হাতের কয়েকটা গয়না খুলে তোষকের নিচে লুকিয়ে রাখলেন। একটি কাপড়ের ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে উর্মিলা ঠাকুর দেবতা ও গুরুদেবের ছবিকে নমস্কার করে কোলাপসিবল গেট খুলে বাড়ির বাইরে পা রাখলেন। দোতলার দিকে তাকিয়ে দেখলেন—বাড়িওয়ালার মা আর বউ বারান্দায় বসে চা খাচ্ছে।

— বউমা বেরচ্ছ বুঝি? বাড়িওয়ালার মা জানতে চাইলেন।

উর্মিলা বললেন—বেলঘরিয়া যাচ্ছি মাসিমা। বোনপোর জন্মদিনে তারা ডেকেছে।

বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম করে, উর্মিলার ফের পিছনে ফিরে, উপরে তাকিয়ে বললেন—মা একবার টুসুকে পাঠাবেন, ঘরের চাবিটা রেখে যাই, কৃষ্ণের বাবা যদি তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন, বলা আছে যদিও...।

সামান্য অভিনয়টি করতে পেরে উর্মিলা নিজের ওপর সন্তুষ্ট হলেন, ঘামছিলেন, কোমরে গোঁজা রুমাল হাতে তুলে নিয়ে ঘাড়ের ঘাম মুছলেন। বাড়িওয়ালার বড় মেয়ে নিচে এল, উর্মিলা তার হাতে চাবি ধরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—আজ টিউশন নেই মা?

মেয়েটি মাথা দুদিকে নেড়ে চাবি হাতে নিয়ে ফের সিঁড়িঘরের পথে উপরে উঠে গেল।

উর্মিলা গেট খুলে গলিতে এসে দাঁড়ালেন।

হাঁটতে হাঁটতে বড়রাস্তা অবধি এলেন, মোড়ের মাথায় রিকশাস্ট্যান্ডের পিছনে বট গাছের নিচে সন্ধ্যের অন্ধকার জমাট বাঁধছে। উর্মিলা সেদিকে, রাস্তার পাশের হাইড্রেন ঘেঁষে, রিক্সা ইউনিয়নের নোটিশ বোর্ডের পিছনে দাঁড়িয়ে রইলেন। ভাড়াবাড়ির দোতলা সন্ধ্যের অন্ধকার,বট গাছের ঝুড়ি, নারকেল পাতার মধ্যে ঢেকে আছে। উর্মিলা সেসবের আড়াল থেকে নিজের সংসারটিকে দেখতে পেলেন না। পরপর দুটি ফাঁকা রিকশা এসে স্ট্যান্ডে থামলো, চালকরা নিজেদের মধ্যে দু-একটি মস্করা করে ঘাম মুছে বিড়ি ধরালো। উর্মিলা আরোতর অন্ধকারে সরে এলেন। তার গরম লাগছিল না আর, বরং যেন শীত করছিল, যেন নির্জন পাহাড়ী রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। রিকশাচালক দুটিকে আমল না দিয়ে উর্মিলা ভাড়াবাড়ির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। একটি ছোকরা চালক পরণের লুঙ্গি হাঁটুর উপর তুলে হাইড্র্যান্টের দিকে আসতে গিয়ে উর্মিলাকে দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়ালো—বউদি যাবেন?

উর্মিলা রিকশাচালকটিকে এ অবস্থায় দেখে পাশ কাটিয়ে ভাড়াবাড়ির গলিতে ঢুকে পড়লেন, মনে মনে গুরুদেবের নাম জপছিলেন। অপ্রশস্ত গলিটিতে পথচারি নেই, উর্মিলা খেয়াল করলেন আজ রেশন তুলবার দিন, তাই হয়তো বাড়ির মেয়েরা রেশন দোকানে কেরোসিন আর চিনি তুলতে গেছে। উর্মিলা সন্তর্পণে গেট খুলে বাগানে ঢুকলেন, যেন শিশুর মাথাকে তুলোর বালিশে রাখছেন—এমন যত্নে গেট বন্ধ করলেন। দোতলার বারান্দায় তাকিয়ে দেখলেন—সেখানে কেউ নেই, আলো নেভানো, পর্দার ওপারে বাড়িওয়ালাদের শোওয়ার ঘরে আলো জ্বলছে, মেয়েরা আওয়াজ করে পড়ছে। উর্মিলা এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন, তার ভীষণ হিংসা হলো, এমন একটা শান্ত সংসার প্রতিদিন সন্ধ্যায় তার জন্যও থাকত, আর কী থাকবে, উর্মিলা জানেন না। নিজেকে সংযত করে তিনি বাগানের এক পাশে চলে এলেন, পাঁচিল আর দেওয়ালের মাঝের সংকীর্ণ পথ ধরে হেঁটে বাড়ির পিছনে এলেন। এ পথে ঠিকে ঝি প্রতিদিন সকালে আসে বাসন মাজতে আর ঘর পরিষ্কার করতে। উর্মিলা দেওয়ালের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে হাঁটছিলেন। দোতলার জানালা থেকে ঝুঁকে যেন কেউ তাকে দেখতে না পায়। তবু একেকবার তার ভুঁড়ি বাড়ির চৌহদ্দির পাঁচলের সঙ্গে ঘষে যাচ্ছিল, কাপড়ে শ্যাওলা লেগে গেল, উর্মিলা বড় হীনমন্য বোধ করলেন। বাড়ির পিছনে একটি পেয়ারা গাছ আছে, কলতলার পাড়ে। পেয়ারা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে উর্মিলা আঁচলের খুটে চোখ মুছতে গিয়ে ঠাউর করলেন তার চোখ খটখটে শুকনো, অথচ তিনি অন্তরে কাঁদছেন।

— এর চাইতে কি লোকটার মৃত্যু সংবাদ পেলেও কম কষ্ট হতো! নিজের কাছেই উর্মিলা প্রশ্ন রাখলেন, উত্তর না পেয়ে উর্মিলা বুঝলেন তার দায়িত্ব এখনো শেষ হয়নি। স্বামীর মৃত্যুতেও তাঁর দায়িত্ব শেষ হতো না। স্বামীর হাজতবাস হলেও তাকে তার কর্তব্য করে যেতে হবে।

উর্মিলা রান্নাঘরের দরজায় আলতো টোকা দিলেন, শিকলি নামানো ছিল,দরজাটি খুলে গেল, উর্মিলা অন্ধকার ঘরে পা রাখলেন, নিচের দিকে তাকিয়ে ঘরের মেঝে দেখতে পেলেন না। পিছনে ঘুরে দরজা বন্ধ করে, তালা লাগিয়ে, হুড়কো দিয়ে, শিকলি তুলে উর্মিলা ততক্ষণ অবধি দাঁড়িয়ে থাকলেন যতক্ষণ না তার চোখ এই অন্ধকারে সয়ে যায়।

শোওয়ার ঘরে ঢুকে উর্মিলা খাটের উপর দুই পা ছড়িয়ে বসলেন, তার হৃদস্পন্দন লাগাম পেল, মাথা ঠান্ডা হলো, বুকের উপর থেকে আঁচল টেনে সরিয়ে দিলেন। ফ্যান চালবার উপায় নেই, শব্দ করা যাবে না,আলো জ্বালাবেন না, আজ রাতটা না খেয়েই কাটাতে হবে—ভোর হলে স্টেশন অবধি হেঁটে নিয়ে ফার্স্ট ট্রেন ধরবেন—এই মোটের ওপর পরিকল্পনা। বালিশের নিচে হাতড়ে উর্মিলা ছেলের মোবাইল খুঁজে পেলেন, প্রথমেই তিনি ফোনটি সাইলেন্ট মোডে দিলেন, দেখলেন দুটি মেসেজ এসেছে—পঞ্চাশ টাকা রিচার্জ হয়েছে, আর কৃষ্ণেন্দু লিখেছে যে সে এক উকিলেন খোঁজ পেয়েছে, শিয়ালদায় যাচ্ছে উকিলের সেরেস্তার কথা বলতে। উর্মিলা ফের বালিশের নিচে ফোনটি গুঁজে দিলেন, সাইলেন্ট মোডে থাকা সত্ত্বেও; স্ক্রিনের আলোটুকু নিভে গেলে ঘর আবার অন্ধকার হলো, উর্মিলা দরদর করে ঘামছিলেন।

—লোকটা তো শান্ত মানুষ, কোন ঝুটঝামেলায় থাকে না, উর্মিলা ভাবলেন,অফিসে হাতটান আছে বলে কোনো দিন শুনিনি, মেয়েছেলের দোষ নেই। রাইট টাইমে অফিসে নিয়ে রাত হবার আগে ফেরে। বসতে বললে বসে, উঠতে বললে ওঠে। জমি কিনেছে,বাড়ির কাজে আশ্বিন পেরলে হাত পড়বে। দাবি দাওয়া, চাহিদা নেই, কোনো দিনও মুখ ফুটে বলে না এটা খাবো, ওটা দাও। উর্মিলা বুঝতে পারেন না স্বামীর কী করে মতিভ্রম হলো। অন্ধকার ঘরে তার চোখের মনির সঞ্চলন দ্রুত হয়, বুক ওঠানামা করতে থাকে, উর্মিলা কুড়ি বছরের সংসারিক জীবন ঘেঁটে এমন কোনো দোষ পান না। যার ফলে তার স্বামীকে থানা পুলিশের কেসে ফাঁসতে হবে। উর্মিলা নিশ্চিতভাবে নিজেকে প্রবোধ দেন—কিছুতেই ওঁর দোষ হতে পারে না, আমি মানুষটাকে চিনি, ঘর করছি কুড়ি বছর, বাচ্চা আছে। মানুষটাকে তবে কি কেউ ফাঁসিয়ে দিল, উর্মিলা উৎকণ্ঠায় মৃদু মৃদু দুলতে থাকেন—কৃষ্ণেন্দু বলেছিল আজকালকার দিনে নকল ভিডিও বানান যায়, সব কিছুতে কারচুপি হয়, ডিমেদুধেমাংসে কোথায় ভেজাল নেই! নিজের নিক্তিকে স্বামীকে মেপে যখন বেকসুর খালাস দিয়ে দিয়েছেন উর্মিলা, তখন তিনি এও ভাবতে শুরু করেন,লোকটা নির্দোষ হলে, কে তার সঙ্গে শয়তানি করল। এ যাত্রার মতো স্বামী বেঁচে গেলে, আসল শয়তানটাকে খুঁজে বের করা দরকার। যে শয়তান গর্ত থেকে মাথা উচিয়ে একবার ছোবল দিয়ে আবার নিজের গর্তে লুকিয়েছে—সে দুদিন পরে আবার ফণা তুলবে। কিন্তু দত্তপুকুরের স্টুডিওতে গিয়ে জাল ভিডিও এর তত্ত্বতালাশ করা উর্মিলার পক্ষে সম্ভব নয়, তিনি ভাবলেন—ভালো মানুষ, নিরীহ বলেই কি তার স্বামীকে ফাঁসালো, মৃদু দুলতে দুলতে উর্মিলার মনে পড়ল স্বামী কয়েকবার অফিসে ক্যাশের ঝামেলা নিয়ে তার কাছে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন, একজন ডেপুটি ম্যানেজারের সঙ্গে বছর পাঁচেক আগে মানুষটার খিটমিট হত। দিনের শেষে বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে এসে উর্মিলাকে অফিসের একটা কি দুটো গল্প বলতেন। আড্ডা নেই,বন্ধুবান্ধব নেই,উর্মিলা তাই জানতেন শত্রুও নেই। তবু তার মনে হয়, পুলিশ, প্রেস বা পাড়াপ্রতিবেশী জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলবেন—আমার স্বামী নির্দোষ। অফিসের লোকেরা ফাঁসিয়েছে।

পাড়া প্রতিবেশী হলে একরকম সামলে দেওয়া যায়, প্রথমবার উর্মিলার মনে হলো পুলিশ বা প্রেসও তার খোঁজে আসতে পারে। তখন উপায় কি। তারা তাকে মারবে—ধরবে না, গ্রেফতারও হয়তো করল না, কিন্তু জেরা করল, পেট থেকে কথা বের করল। যেন ছেলে বা বরকে ধমকাচ্ছেন,সেই দাপটেই উর্মিলা নিজেকে বোঝালেন, যে যাই জিজ্ঞাসা করুক, আমার স্বামী নির্দোষ, এরপর যদি জিজ্ঞাসা করে কত বছর হলো বিয়ে হয়েছে, কুড়ি, কটা ব্যাংক একাউন্ট আছে, দুটো, তার মধ্যে একটা জয়েন্ট, সাইড বিজনেস আছে, নেই, আপনি কি করেন, হাউজ ওয়াইফ, ছেলেপুলে, ছেলে, বাচ্চা, সবে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে, স্বামী আগে কখনো এমন করেছেন, গোটা এলাকা জানে এমন অনেস্ট লোক দুটো পাবেন না।

বাংলা টেলিসিরিয়ালের আদলে উর্মিলা নিজেকে জেরা করতে থাকেন, প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন পড়ে, প্রশ্নের সঙ্গে উত্তর হয়তো খাপ খাচ্ছে না ভেবে উর্মিলার বুকের ওঠানামা দ্রুত হয়, বিকেলের সামান্য সাজ ঘেঁটে যায়, বুকের কাছে শাড়ির আঁচল টানতে গিয়ে উর্মিলা বুঝতে পারলেন তার হাত কাঁপছে। ঘরের অন্ধকারে যেন একটা আদালত বসেছে, বিচারক নেই উকিল নেই আসামী নেই কিন্তু সাক্ষী কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থরথর কাঁপছে। সাক্ষীর কাঠগড়া থেকে উর্মিলা ভয়ে ভয়ে মেঝেতে নেমে আসলেন, সুরকির লাল মাঝে, দিনের শেষে তাপ বিকীরণ করে শীতল, শাড়ির আঁচল মেঝেতে বিছিয়ে দিলেন, ঘামে আঁচল মেঝেতে লেপটে গেল, উর্মিলা আধশোয়া হলেন। স্বামীকে আর নিজেকে বাঁচানোর নানা যুক্তি এক নাগাড়ে বানাতে আর কাটতে থাকলেন।

যুক্তির জাল ছিন্ন করে মাঝেমধ্যে নিজের অন্ধকার শোওয়ার ঘরটিকে ঠাউর করার চেষ্টা করলে উর্মিলা ব্যর্থ হন, জানালা গলে কোনো আলো আসছে না, বালিশ কোথায়, বালিশের তলা থেকে মোবাইলের আভা কোথায়, চ্যাটচ্যাটে মেঝেতে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে উর্মিলা বসবার ঘরে যাওয়ার দরজা অবধি যাওয়ার চেষ্টা করলেন। সাত বছরের পুরানো টিনের ট্রাঙ্কে তার হাত ঠেকল। মনে পড়ল, ট্রাঙ্কের ভিতর তার স্বামীর একটি প্রশংসাপত্র ছিল। গেল বছর কো-অপারেটিভের লোন সময়মত শোধ করে একটা সার্টিফিকেট পেয়েছিলেন। এটা তো লোকটার একটা ক্যারেকটার সার্টিফিকেট হতে পারে,পুলিশ বা প্রেস এলে দেখানো যাবে! ভারী,স্যাতস্যাতে আর জং পড়া তালায় উর্মিলার হাত ঠেকল। চাবি খুঁজে পাবার উপায় নেই। ট্র্যাঙ্কের গায়ে ঠেস দিয়ে বসে উর্মিলা ভাববার চেষ্টা করলেন ট্রাঙ্কটা কি পুবমুখো করে রাখা ছিল!

গেট খোলার শব্দ হল, একটি পুরুষকণ্ঠ চিৎকার করছে, উর্মিলা চিনতে পারলেন, বাড়িওয়ালার গলা, সাধারণত আরো রাতে বাড়ি ফেরে, তবে কি ভাড়াটের কীর্তি শুনে তাড়াতড়ি বাড়ি ফিরলো! গেট বন্ধ করবার শব্দ এল না, বাড়িওয়ালার পাশাপাশি আরো কয়েকটি পুরুষ ও মহিলা কণ্ঠ উর্মিলা শুনতে পেলেন। একবার ভাবলেন বসবার ঘরে গিয়ে ভালো করে তাদের কথাবার্তা শুনবেন, পরমুহূর্তে ভাবলেন—জানালার ফাঁক গলে দেখবার চেষ্টা করা যায়—পুলিশ এলো কি না! পুলিশ এলে তো গাড়ি নিয়ে আসবে, গাড়ির শব্দ হবে, ওহ্‌,  এই গলিতে তো গাড়ি ঢুকবে না। পরিস্থিতি বিচার করে উর্মিলা ট্রাঙ্কের গায়ে হেলান দিয়ে বসে রইলেন। বাড়ির বাইরে একটা জটলা হয়েছে, পাঁচ ছয় জন হতে পারে, সাত আটজনও হতে পারে, হয়তো পাড়ার লোকেরা জড়ো হয়েছে, বাড়িওয়ালার গলা শুনে মনে হচ্ছে সে উপস্থিত মানুষগুলোকে শান্ত করবার চেষ্টা করছে। সিঁড়িঘরের দরজা খুলবার শব্দ হলো,বাড়িওয়ালার পরিবার একতলার চাতালে নেমে এল। সমবেত ভিড়টি বাড়ির সামনের বাগান থেকে বাড়ির পাশে, বাড়ির পাশ থেকে বাড়ির পিছনের দিকে এগিয়ে আসছে,উর্মিলা তাদের গলার আওয়াজ পাচ্ছেন, সস্তার রাবারের চপ্পলের ফ্যাট-ফ্যাট শব্দ হচ্ছে।

কেউ বুঝি জানালায় জানালায় টোকা দিচ্ছে,চিৎকার করে বলছে—উর্মিলা, বউদি,ও দিদি, দিদি শুনছেন, বোনটি,দিদি ভাই,পিসি কাকিমা কৃষ্ণ আছিস রে, কৃষ্ণেন্দু—দরজা খুলুন, বাড়িওয়ালা ধমকাচ্ছে, বাড়িওয়ালার বউ বলছে—বললাম না,বিকেল বিকেল থাকতেই কলকাতায় নেমন্তন্ন আছে বলে পালিয়েছে।

ভিড়টা বসবার ঘর থেকে শোয়ার ঘরের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। ঘরে দ্বিতীয় কোনো মানুষ থাকলে অন্ধকারে উর্মিলার চোখের মনির সাদা হয়তো আন্দাজ করতে পারত, শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও উর্মিলা গিলে ফেলেছেন, দুই হাত সুরকির মেঝের উপর চিৎ করে পেতে রাখা। ভিড়ের আওয়াজ কখনো বেশি, কখনো মৃদু, কখনো উত্তেজিত, ভিড়ের আওয়াজে কখনো অনুকম্পা। যেন একটা সাপ উর্মিলাদের বারো বছরের ভাড়াবাড়ি আর কুড়ি বছরের সংসারকে পেঁচিয়ে ধরছে।

— কলকাতার কোথায় গেছে, বলেছে? ভিড় জানতে চাইল।

— বললে, কলকাতায় যাচ্ছি, নেমতন্ন আছে। তখন তো আর জানি না তলে তলে কি কান্ড বাঁধিয়েছে। বাড়িওয়ালার বউ বললো।

— চাবি আছে আপনাদের কাছে?

— চাবি আমরা রাখি না। দিনকাল যা খারাপ। কিসের দোষ কোথায় চাপাবে। বাড়িওয়ালা বললো।

বাড়িওয়ালার বউ বললো—আমি বলেছিলাম, আমাদের কাছে চাবি রেখে যান। বললে— না,রাতের মধ্যেই ফিরব।

বাড়িওয়ালা ভিড়কে ধমকালো—দেখছ না কোলাপসিবল বন্ধ,লাইট পাখা সব অফ, কেউ নেই, ল চল, এখানে দাঁড়িয়ে লাভ নেই।

আরো কয়েকবার জানালায়, রান্নাঘরের দরজায় টোকা মেরে, উর্মিলা-কুষ্ণেন্দুকে ডেকে, ভিড়টা বাড়ির সামনের দিকে চলে যায়, সেখানে খানিকক্ষণ জল্পনা হয়, তারপর ভাড়াবাড়ির গেট বন্ধ করার শব্দ আসে, সিঁড়িঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, ভিড়ের গুঞ্জন আর কানে আসে না, ক্লান্তি আর ভয়ে উর্মিলা মেঝেতে বসা অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েন।

ঘুম তখন ছেড়ে আসছে,তন্দ্রাদশায়, কত রাত হলো ঘরের অন্ধকার দেখে উর্মিলা আন্দাজ করতে পারেন না। এই পরিস্থিতিতে এমনভাবে ঘুমিয়ে যাওয়ার কথা মনে পড়ে উর্মিলা লজ্জা পেলেন, চোখ ডললেন, মেঝেতে পড়ে থাকা, ঘাম শুকিয়ে কড়কড়ে হয়ে যাওয়া শাড়ির আঁচলকে বুকে টেনে নিলেন, ভাবলেন—সব সমস্যা কি তবে মিটে গেল! হয়তো গোটাটাই একটা ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন ছিল।

ঘুম থেকে উঠামাত্র উর্মিলা তার সংসারকে যথাস্থানে ফিরে পাবেন ভেবে হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। উর্মিলা ভারী শরীরে হ্যাচোড় প্যাচোড় করে উঠবার চেষ্টা করলেন। হাঁটু গেড়ে বসে মোবাইল ফোনটিকে দেখবার চেষ্টা করলেন, নতুন কোন মেসেজ এল কী!

শোওয়ার ঘরের জানালার ওপাশ থেকে একটি হিসহিস শব্দ এল, যেন ফিসফিস করে,চাপাস্বরে একজন মহিলা কিছু বলছেন। উর্মিলা কান পাতলেন—বউমা রান্নাঘরের দরজাটা খোল,আমি মাসিমা। উর্মিলা গলার স্বরটিকে শনাক্ত করতে পারলেন—বাড়িওয়ালার বৃদ্ধা মা।

— দরজা খোল বউমা,ভয় নেই কিচ্ছুটি।আমি তোমার কোন ক্ষতি করব না। কেউ নেই গো ধারেকাছে। আমি একা মানুষ। খুব মশা এখানে। কলতলার ড্রেনের উপর দাঁড়িয়ে আছি।

উর্মিলা মেঝেতে ফের থেবড়ে বসে পড়লেন, উত্তর দিতে ইচ্ছে হয়,পাল্টা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, কতক্ষণ মুখ বুজে বসে আছেন। কিন্তু ভয়ে আর ক্লান্তিতে উর্মিলার মুখ থেকে কোন কথা বেরোল না, জমাট কথাগুলো উর্মিলার মাথার ভিতরে ঘুরতে থাকে, নীরবে, মাথার ভিতরে তিনি বাড়িওয়ালার বৃদ্ধ মায়ের সঙ্গে কথোপকথন শুরু করলেন।

— আমি কিন্তু যেমন তেমন মেয়ে নই মাসিমা,আমরা নবদ্বীপের চক্রবর্তী, আমার দাদু ফ্রিডম ফাইটার ছিলেন, এরম ভালো পুলিশ—খারাপ পুলিশ আমি অনেক শুনেছি। খারাপ পুলিশ এসে লাঠির বাড়ি মারবে,  তারপর ভালো পুলিশ এসে চা—জল খাবার দিয়ে বাবাবাছা করবে। পাড়ার লোক এঁটে উঠতে না পেরে এখন খোঁজ নিতে আপনাকে পাঠিয়েছে। আমি খুলব না, মোটেই খুলব না দরজা।

বাড়িওয়ালার মা বললেন—আমি জানি মা, তুই ঘরে আছিস,সন্ধ্যেবেলা তুই যখন ফিরে এসে কলতলার দিকে গেলি,আমি তখন উপরের বারান্দায় সন্ধ্যাআহ্নিক সেরে এসে কাপড় পাল্টাচ্ছি। অন্ধকারে তুই আমায় দেখিসনি।

উর্মিলা মাথার ভেতর জবাব দিলেন—দেখেছিস, দেখেছিস, বুড়ি, এখন কোন দরদটা দেখাতে এসেছিস। আমাকে কোন দয়া করতে হবে না। আমি চক্রবর্তীদের মেয়ে, স্বামীর সঙ্গে কুড়ি বছর ঘর করছি, আট বছরের ছেলেকে নিয়ে জয়েন্ট ফ্যামিল ছেড়েছি। কারোর কাছে ভিক্ষা করিনি, নিজে খাই, দয়া দেখাস না বুড়ি।

— দরজাটা খোল না মা, এই দ্যাখ, তোর জন্য এক বাটি জল মুড়ি এনেছি। কলা আছে। দুটো মুখে দে মা। তোর যে ব্লাড সুগারের বংশ। মরবি না হলে। তারা কেউ জানে না। সব ঘুমুচ্ছে, ঘরের আলো নিভলে আমি চুপিচুপি এসেছি। ঘরে আর রান্না কিছু পড়ে নেই। এটুকু নে মা। বলে, বুড়ি জানালার পাল্লায় দুটো টোকা দেয়।

উর্মিলার মাথায়, বুকে, আর শরীরে সহস্র কথারা জমে যাচ্ছে, মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু ঠোঁট নড়ছে না। বেশির ভাগ তার আক্ষেপের কথা, সাংসারিক দুঃখ, লড়াই তার অভিমানের কথা, উর্মিলা বুঝতে পারলেন, চোখ ভারী হতে শুরু করেছে।

বাড়িওয়ালার মা বললেন—তোর তো কোনো দোষ নেই, নিজেকে কষ্ট দিস না মা, আত্মাকে কষ্ট দিলে ঠাকুর রাগ করেন, গুরুদেবের কথা স্মরণ কর।

উর্মিলার সহস্র কথারা এক লহমায় উবে যায়, মাথার ভিতর একটি বাক্য কেবল ঘুরতে থাকে—হ্যাঁ মাসিমা, দোষ তো আমার, দোষ তো আমারই।

উর্মিলা সশব্দে কেঁদে ফেললেন, চোখের জল গাল থেকে গড়িয়ে নেমে তার বুক আর শাড়ির আঁচল ভিজিয়ে দেয়, উর্মিলা  ফুঁপাতে থাকে। জানালার ওপাশ থেকে বাড়িওয়ালার মায়ের সাড়া পাওয়া যায় না, উর্মিলাকে কাঁদতে শুনে তিনি সরে আসেন, সিঁড়িঘরে ঢুকে হুড়কো টেনে দেন।

বালিশের নিচে মোবাইল ফোনটা জেগে ওঠে, শব্দ হয় না শুধু আলো,মেসেজ ঢুকলো,নীলচে আভায় উর্মিলার বেডরুম ভরে ওঠে। উর্মিলা তার আয়না, আলমারি আর সিলিং পাখা দেখতে পেলেন। নীলচে আলোয় ঘরটাকে দেখে উর্মিলার মনে পড়ে যায় কুড়ি বছর আগের তাদের ফুলশয্যার রাত,খালিগায়ে বর বলছে—বউ আয়, কাছে আয়!

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
ইউক্রেনের মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে স্বাক্ষর বাইডেনের
ইউক্রেনের মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে স্বাক্ষর বাইডেনের
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা