X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

নেপালি সাহিত্যের অনুষঙ্গ

মাইনুল ইসলাম মানিক
০৩ জুন ২০১৮, ১৪:৫১আপডেট : ০৩ জুন ২০১৮, ১৫:১১

নেপালি সাহিত্যের অনুষঙ্গ

ভয়ঙ্কর সুন্দর পর্বতমালায় তিন-চতুর্থাংশ ঢেকে থাকা এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি নেপাল। সিদ্ধার্থের জন্মভূমি। তিন দিক থেকে ভারত এবং এক দিকে চীনের সীমানাবেষ্টিত নেপাল ছিল একটি বাফার স্টেট। কয়েক দশক যুদ্ধের পর ১৭৬৯ সালে গোর্খারাজ পৃথ্বীনারায়ণ শাহ কাঠমান্ডু দখল করে বহুধাবিভক্ত নেপালকে একটি রাষ্ট্রীয় সংহতি দান করেন। মূলত হিমালয়কন্যা নেপালের রাষ্ট্রীয় যাত্রা তখন থেকেই শুরু। কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে এক সীমাহীন নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ওপর ভর করে চলতে হয়েছিল দেশটিকে। ১৯৫০ সালে রাজপরিবারে বিদ্রোহ দেখা দিলে দেশটির বংশীয় শাসন কাঠামোয়  বৃহত্তর পরিবর্তন সূচিত হয়। এ সময় ভারত ও চীনের সাথে মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন ও জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে নেপাল। তবে ১৯৯১ সালে বহুদলীয় সংসদ ঘোষণার মধ্য দিয়েই নেপালের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। জনগণের মতপ্রকাশের অধিকার সুরক্ষিত হয়। এ সময় পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হতে থাকে। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত প্রাণ হারায় প্রায় ১২,০০০ মানুষ। ২০০১ সালে রাজা বীরেন্দ্র ও রানি ঐশ্বরিয়াসহ রাজপরিবারের সাতজন নিহত হয়। এ হত্যাকাণ্ডের পর রাজক্ষমতা লাভ করেন জ্ঞানেন্দ্র। তিনি দমননীতি অবলম্বন করে মাওবাদী বিদ্রোহীদের দমনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এর মধ্য দিয়ে ২০০৫ সালে নেপাল তথা পৃথিবীর সর্বশেষ হিন্দু রাজবংশের পরিসমাপ্তি ঘটে।

ভূ-প্রকৃতির মতো নেপালের ভাষায়ও রয়েছে ব্যাপক বৈচিত্র্য। নেপালের রাষ্ট্রীয় ভাষা নেপালি হলেও এই ভাষায় কথা বলে মাত্র ৪৪ ভাগ মানুষ। এছাড়াও রয়েছে আরও ১২০ টি ভাষা। মৈথিলী, ভোজপুরী, থারু, তামাং, নেপাল ভাষা, বাজ্জিকা, মগর, দোতেলি ও উর্দু ভাষার ব্যবহার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেপালি জনগণ এসব ভাষায় কথা বলে থাকেন। নেপালের সাহিত্যচর্চাও এই ভাষাগুলোয় হয়ে আসছে সমানতালে। তবে ইংরেজি ভাষায় লেখার সুবাদে কিছু সংখ্যক নেপালি সাহিত্যিক দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আলো ছড়াতে সক্ষম হয়েছেন। নেপালের সাহিত্যচর্চার ইতিহাস দীর্ঘকালব্যাপী হলেও সত্যিকার অর্থে নেপালের সাহিত্যের উন্মেষ ঘটে গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। দীর্ঘকাল অবরুদ্ধ থাকার পর বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ সাধিত হলে শুরু হয় নেপালি সাহিত্যের নতুন এক পথচলা। ক্রমান্বয়ে নেপালি সাহিত্যের ডানায় যোগ হতে থাকে নতুন নতুন পালক।

নেপালি কবিতার সৌরজগতে যাঁরা নক্ষত্র হিসেবে আলো ছড়িয়েছেন, তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মাধব প্রসাদ গিমায়্যার। তিনি নেপালের কবিতা তথা সাহিত্যের জীবন্ত কিংবদন্তী। লক্ষী প্রসাদ দেবকোটা ও বল কৃষ্ণ সম’র সমকালীন সাহিত্যিকিদের মধ্যে বেঁচে থাকা একমাত্র সাহিত্যিক তিনি। শতবর্ষে পা রাখা এই কবিকে দেয়া হয়েছে নেপালের জাতীয় কবির মর্যাদা। অত্যন্ত সহজ সরল জীবনযাপন করা মাধব প্রসাদের কবিতা মোটেও সহজ সরল নয়। গৌরি, মালতিমঙ্গল, অশ্বথনামা, রাজেশ্বরী, শকুন্তলাসহ অসংখ্য নান্দনিক কবিতাগ্রন্থের স্রষ্টা তিনি। মাধব প্রসাদ গিম্যায়ারের সারিতে আরও যেসব সাহিত্যিকের নাম উঠে আসে তাদের মধ্যে অন্যতম মাধব প্রসাদ রিমেল। কবিতার চিরায়ত ঋজুতা ভেঙে ইংরেজ কবি টিএস এলিয়ট সর্বপ্রথম মুক্তছন্দের প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি বিষয় ছন্দ-প্রকরণের পাশাপাশি মিথ, এতিহ্য, চিত্রকল্প ও গীতিময়তার সমন্বিত ব্যবহারের মধ্য দিয়ে কবিতায় অভিনবত্ব আনেন। তার এ কবিতারীতি দুনিয়াজোড়া ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ইউরোপ আমেরিকার গণ্ডি ছাড়িয়ে এর প্রভাব বলয় গড়ে ওঠে দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্যেও। নেপালে দক্ষিণ এশিয়ার অপরাপর দেশের মতো অনেকের মধ্যে এর প্রভাব না পড়লেও রিমেলকে তা ব্যাপকভাবে ছুঁয়ে যায়। নেপালি সাহিত্যিকদের মধ্যে রিমেলই প্রথম কবিতার চিরায়ত প্রথাকে ভেঙে দিয়ে মুক্তছন্দে লিখতে শুরু করেন। মাইকেল জে হার্টের মতে, রিমেলই নেপালের প্রথম বিপ্লবী কবি। নেপালের জনপ্রিয় কবি বানিরা গিরি রিমেলের কবিতার বিষয়বস্তু নিয়ে গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ নেপালের প্রথম নারী হিসেবে ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের  স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭২ সালে রিমেলকে নেপালের সর্বোচ্চ পদক ‘মদন পুরস্কার’ প্রদান করা হয়।

নেপালি কবিতার আরেক প্রবাদপুরুষ লক্ষী প্রসাদ দেবকোটা। সফল মহাকাব্য লেখা একমাত্র নেপালি কবি তিনি। তাঁর মহাকাব্য ‘মুনা মদন’ নেপালি সাহিত্যের ইতিহাসে সর্বাধিক বিক্রিত গ্রন্থ। এক ভ্রাম্যমান ব্যবসায়ী যিনি তার স্ত্রীকে ছেড়ে দূরের শহরে বাণিজ্যের জন্যে গিয়েছিলেন। বিরহব্যথা ও মৃত্যুযন্ত্রণার এক সকরুণ চিত্র সম্বলিত এই মহাকাব্যটি চলচ্চিত্রায়িতও হয়েছিল। এই চলচ্চিত্রটিতে অস্কার পুরস্কার পাওয়ার মতো সকল উপাদানই বিরাজমান। নেপালি কবিতায় রোমান্টিসিজমের সূচনা করা প্রথম কবিও তিনি। সর্বপ্রথম নেপালি কবিতায় ক্লাসিসিজমের সূচনা করেছিলেন কবি লোকনাথ পদ্যাল। তিনি নেপালি কবিতায় আধুনিকতারও সূচনা করেছিলেন। তাই তাকে নেপালি আধুনিক কবিতার জনক বলা হয়। নেপাল সাহিত্যের আরেকজন উল্লেখযোগ্য কবি হচ্ছেন ভিম নিধি তিওয়ারি। তিনি একাধারে একজন কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও রাজনীতিবিদ। লিখেছেন ৩৮ টিরও অধিক গ্রন্থ। তিনি ইউনেস্কোতে নেপাল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। নেপালি কবিদের মধ্যে ভুপি শেরচান সর্বপ্রথম গদ্যছন্দে কবিতা লেখেন।

নেপালের নারী কবিদের আলোচনায় মতি লক্ষী উপাসিকার নাম চলে আসে সর্বাগ্রে। তিনিই নেপালের প্রথম আধুনিক মহিলা কবি। ধর্মীয় ভাবধারা ও মুক্তগদ্যের মধ্যে প্রথম মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন এই নারী। নেপালের রানি ঐশ্বরিয়াও একজন প্রতিভাবান কবি ও গীতিকার ছিলেন। তিনি চাঁদনী শাহ নামে লিখতেন। আরেকজন প্রতিভাবান মহিলা কবি ঝমক গিম্যায়ার। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার এ নারী বাম পায়ের মাধ্যমে লেখালেখি করেন। লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি মদন পুরস্কার লাভ করেন। ‘চিতার সন্মুখে স্বীয় শেষকৃত্যের প্রার্থনা’ তার অন্যতম একটি কবিতা। নেপালের কবিতার ভূ-মণ্ডলে আরও যারা কবিতার সোনালি ফসল ফলিয়েছেন, তাদের মধ্যে চিত্তবীর হৃদয়, গীরিজা প্রসাদ যোশী, ক্ষেত্র প্রতাপ অধিকারী, রমেশ ক্ষিতিজ, কেশর লাল, সিদ্ধিদাশ মাহাঝু, মদন মোহন মিশ্র, অভি সুবেদী, বানিরা গিরি, নারায়ণ আচার্য, বুদ্ধ শায়ামি, ঘনেশ লাল শ্রেষ্ঠ, ইশ্বর বল্লভ, সুমন পোখরেল, মঞ্জু কাঁচুলি ও বসু শশী অন্যতম।

উপন্যাস নেপালি সাহিত্যের একটি উর্বরতম শাখা। নেপালের সমকালীন ঔপন্যাসিকদের মধ্যে একটি প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অতীতের সফল উপন্যাসকে নতুনভাবে বিনির্মানের প্রয়াস দেখাচ্ছেন অনেক ঔপন্যাসিক। এই ধারার ঔপন্যাসিকদের মধ্যে একটি বিশ্বাস সুপ্রতিষ্ঠিত যে, কোনো সৃষ্টিকর্মই পূর্ণাঙ্গ নয়। প্রতিটি সৃষ্টিকর্মেই পূরণযোগ্য অসংখ্য শূন্যস্থান থেকে যায়, পরিবর্ধনেরও অফুরন্ত সুযোগ থেকে যায়। এই ধারায় লিখিত উপন্যাসের মধ্যে কৃষ্ণ ধারাবাসি’র ‘শরনার্থী’ উপন্যাসটি সবচেয়ে বেশি সফল। কৃষ্ণ ধারাবাসি তার এই উপন্যাসটিতে বিভিন্ন উৎস হতে একাধিক চরিত্রের সমাহার ঘটিয়েছেন। তিনি বিভিন্ন উপন্যাস হতে চরিত্র তুলে নিয়েছেন, ছোটগল্প হতে চরিত্র তুলে নিয়েছেন, লেখকগণকে উপন্যাসের চরিত্রে রূপ দিয়েছেন, সমাজবাস্তবতা থেকে চরিত্র তুলে এনেছেন, কাল্পনিক চরিত্র তুলে এনেছেন। এই উপন্যাসটিতে রোল্যান্ড বার্থেসের ‘লেখকের মৃত্যু ঘোষণা’র প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। চরিত্র ছাড়াও উপন্যাসটিতে আরো কিছু নিরীক্ষার প্রমাণ মেলে। বহুবচনরীতির ব্যবহার এই উপন্যাসটিতে লক্ষণীয়। এই উপন্যাসটিতে একজন পাঠককে বহুবিধ রীতির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। জেমস জয়েসের ইউলিসিস উপন্যাসের চরিত্রের মতো এই উপন্যাসের চরিত্রগুলো হঠাৎ হাজির হয়, হঠাৎ হারিয়ে যায় আবার। উপন্যাসে লেখক ইচ্ছাকৃতভাবেই একটি খেল দেখানোর প্রয়াস দেখিয়েছেন। এটিতে ইতিহাস যেমন উঠে এসেছে, তেমনি উঠে এসেছে দর্শন, গদ্য, গল্প ও সাক্ষাৎকার। ধারাবাসি’র ‘আধা বাতু’তেও একই রকম প্রয়াস দেখা যায়। এই উপন্যাসে তিনি কবি, শিল্পী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, অধ্যাপক, কৃষক, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন চরিত্র তুলে এনেছেন। ধ্রুব চন্দ্র গৌতমের ‘অগ্নিদত্ত’ উপন্যাসেও এ রকম নিরীক্ষা লক্ষণীয়। গৌতম তার উপন্যাসে কাব্যভাষা প্রয়োগের প্রয়াসও দেখিয়েছেন।

নেপালের ঔপন্যাসিকদের মধ্যে একটি নতুন ধারা সৃষ্টির প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। তারা উপন্যাসে গতানুগতিক চরিত্র যেমন—আদর্শ নায়ক, একজন জমিদার, স্বার্থবাদী পুঁজিবাদী শ্রেণি এসব চরিত্রের অবতারণা করেন না। লোকজনও এসব ধরনের সাহিত্যরূচিবোধ উতরে গেছে। খগেন্দ্র সাঁগ্রাউলা’র ‘জুনকিরিকো সংগীত’ ও প্রদীপ নেপালের ‘একুশ শতাব্দীর সামনিমা’ পুরোনো সামাজিক প্রথাকে ভেঙে দিয়ে নতুনত্ব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। সারু ভক্তের ‘পাগল বসতি’, ‘তরুণী ক্ষেতি’, ‘দ্য পিক’ ইত্যাদি উপন্যাসও নেপালের উপন্যাসের জগতে মাইলফলক হয়ে থাকবে।

তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নের প্রভাবে সাহিত্যের অঙ্গনেও সাধিত হয়েছে অভাবনীয় পরিবর্তন। নেপালের সমকালীন সাহিত্যেও এর প্রভাব সুস্পষ্ট। একদল সাহিত্যিক প্রযুক্তির এই উৎকর্ষতাকে কাজে লাগিয়ে সাহিত্যে নতুনত্ব আনার ব্যাপারে প্রবল উৎসাহী হলেও আরেকদল লেখক তাদের নিজস্ব নৃতাত্ত্বিক ঐতিহ্য হারিয়ে যাবার ব্যাপারে শঙ্কিত। শোভা ভাতারাই তার উপন্যাস ‘অন্তহীন অন্ত’- এ ধরনের দ্বৈত সংস্কৃতির সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন। ‘স্বপ্ন  সন্মেলন’ও এই দ্বৈত সংস্কৃতি ধারণ করা আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। সময়ের গণ্ডিকে মুছে দেয়ার এক শুদ্ধতম ধারা এই পদ্ধতি। এই উপন্যাসসমূহে ইতিহাস, নৃতাত্ত্বিক ঐতিহ্য ও ধর্মীয় পুস্তক হতে চরিত্রসমূহ উঠে এসেছে এবং সেগুলোকে লেখকগণ একটি বৈশ্বিক গ্রামের চরিত্র হিসেবে প্রতিভাত করতে সক্ষম হয়েছেন। পিটার জে কার্থাকের ‘ইচ প্লেস : অ্যা ম্যান’, তারানাথ শর্মার ‘ফ্রম নেপাল টু আমেরিকা’ সারু ভক্তের ‘টেম্পোরাল ট্রাজেডি’ ও ‘সো-কলড’ উপন্যাসে এই বিষয়সমূহ ব্যাপকভাবে উঠে এসেছে।

অন্যান্য শাখার তুলনায় নেপালের ছোটগল্পের শাখাটি অতি অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপক সমৃদ্ধি লাভ করেছে। নেপালি ছোটগল্পের ঝুলিতে জমা হয়েছে বিশ্বমানের বেশকিছু ধ্রুপদী ছোটগল্প। গুরু প্রসাদ মৈনালী, পুস্কর রানা, পোজান পান্ডে, ইন্দ্র বাহাদুর রাই, বিশেশ্বর প্রসাদ কৈরালা, ভিম নিধি তিওয়ারি, ভবানী ভিক্ষু ও পারিজাতের মতো গল্পকারগণ এই শাখাটিকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ করেছেন। নতুন গল্পের পসরা নিয়ে এদের উত্তরসূরি হিসেবে যোগ হয়েছেন রমেশ ভিকাল, পারাশু প্রধান, সানাত রেগমি, ধ্রুব সাপকোটা, শৈলেন্দ্র সরকার, নয়ন রাজ পান্ডে, বেঞ্জু শর্মা, সিতা পান্ডের মতো গল্পকারগণ। এই গল্পকারগণ নেপাল ও নেপালি ঐতিহ্যমণ্ডিত জীবন নিয়ে শিল্প এবং বোধের মিশেলে গল্প লিখেছেন, ছোটগল্পকে নেপালের জনসাধারণের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছেন।

ষাটের দশকে নেপালের ছোটগল্পের চরিত্রায়ণ ও স্বরে একটা পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল। তখনকার ‘তেসরো আয়াম’ আন্দোলন ছোটগল্পে প্রভাব  বিস্তার করে। যে ত্রয়ীগণ এই আন্দোলনের এই সূচনা করেছিলেন তাদের  একজন ইন্দ্র বাহাদুর রাই খুবই উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন ছোটগল্পকার ছিলেন। যদিও ‘তেসরা আয়াম’আন্দোলন সাহিত্য অঙ্গনে বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্কের সৃষ্টি দিয়েছিল এবং নেপালি সাহিত্যে এক ধরনের উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল, কিন্তু এই আন্দোলনটি তাদেরকে অনুসরণ করার মতো কোনো প্রজন্ম তৈরি করে যেতে পারেনি। তাই এই আন্দোলনের প্রভাব ধীরে ধীরে স্মিমিত হয়ে আসে। ইন্দ্র বাহাদুর ‘লীলা লিখন’ তত্ত্ব নিয়ে হাজির হন। এই তত্ত্বে দর্শনকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। তার ‘দ্য হার্ট অব অ্যা পাপেট’ নামক গল্প সংকলনটি এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে লেখা প্রথম গ্রন্থ। অনেক লেখকই তাদের লেখায় এটিকে সফলভাবে সংস্থাপন করেছিলেন। নেপালি নারী গল্পকারগণের মধ্যে পারিজাতের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মাত্র ২৬ বছর বয়সে প্যারালাইজড হয়ে যাওয়া এই লেখিকার গল্প আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। ষাটের দশকের হাংরি জেনারেশনের কবিগণ নেপালে পারিজাতের বাসায় নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন।

ছোটগল্প ও কবিতার মতো নেপালি গদ্যসাহিত্যেও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে ষাটের দশকেই। লক্ষী প্রসাদ দেবকোটাকেই নেপালি গদ্যের প্রথম সত্যিকারের গদ্যকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে শঙ্কর লামিশেঁকে নেপালের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গদ্যকার হিসেবে ধরা হয়। তিনিই প্রথম নেপালি গদ্যে স্ট্রিম অব কনশাসনেস বা চেতনার অন্তঃশীল প্রবাহ প্রয়োগ করেছিলেন। তাঁর গদ্যে গীতিময়তাও বিরাজমান ছিল। তাঁর ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট চিন্তন : পায়াজ’ দুনিয়াজোড়া ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল। মাত্র ৪৮ বছর বয়সে প্লেজিয়ারিজমের অভিযোগ ওঠার পর লামিশেঁ চিরদিনের জন্যে লেখালেখি ছেড়ে দেন। যদিও সাহিত্যবোদ্ধাদের মতে, লামিশেঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের কোনো সত্যতা ছিল না। গদ্যসাহিত্যে কৃষ্ণ চন্দ্র সিংহ প্রধান এবং তারানাথ শর্মার অবদানও অনস্বীকার্য। নেপালে হাস্যরসধর্মী এবং বিদ্রূপাত্মক গদ্য ব্যাপক জনপ্রিয়। কেশব রাজ পিন্ডালি ও ভৈরব আড়িয়াল এ ধরনের বেশকিছু সফল গদ্য লিখেছেন। তারা হাস্যরসের মাধ্যমে সামাজিক অশুভ সত্ত্বাকে আঘাত হানতে পারঙ্গম ছিলেন।

অন্যান্য শাখাগুলোর মতো নেপালি গদ্যও সময় হতে বিচ্ছিন্ন নয় মোটেও। অভিনবত্ব ও ভাবপ্রবণতাকে একটি নতুন মাত্রা দেয়ার প্রয়াস রয়েছে নেপালি গদ্যে। রাষ্ট্রে বিরাজমান অনিশ্চয়তা ও বিশৃঙ্খলা এই গদ্যধারায় প্রতিফলিত হচ্ছে। নেপালে গদ্যসাহিত্য কতটা সমৃদ্ধ একটি বিষয় লক্ষ্য করলেই তা সহজেই অনুমেয়। নেপালের কবিতা ও গল্পে যে সংখ্যক সাহিত্যিক রয়েছেন, শুধুমাত্র গদ্যসাহিত্যেই রয়েছেন সে তুলনায় আরো বেশি সংখ্যক সাহিত্যিক। সমকালীন অধিকাংশ গদ্যই বিদ্রূপাত্মক। নেপালের সমাজ বাস্তবতার তিক্ত নির্যাসই তাদেরকে এই বিদ্রূপাত্মক গদ্য লিখতে প্ররোচিত করে। কোনো কোনো গদ্যকার জীবনের অন্যান্য অনুষঙ্গ হতেও নিগূঢ় বিষয়সমূহ তুলে আনেন। রাম মনি হৃশাল, কিশোর নেপাল, বানিরা গিরি, দুর্গা প্রসাদ ভান্ডারি, লীলা সিংহ দার্না, অভি সুবেদী, মঞ্জু বাবু মিশ্র, ধানুস চন্দ্র গৌতম, মাধব পোখরেল, মাঁজুল, রাজেন্দ্র সুবেদী, শ্রী ওম শ্রেষ্ঠ রোদন, কৃষ্ণ ধারাবাসি, জ্ঞানেন্দ্র বিভাস প্রমুখ নিজেদের সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে নেপালের গদ্যসাহিত্যে নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।

প্রাচ্য ও পশ্চিম উভয় দুনিয়াতেই নাট্যকলা সাহিত্যের সবচেয়ে পুরাতন শাখা। প্রাচীনকালে প্রাচ্যে সংস্কৃত ভাষায় ও পশ্চিমে গ্রিক ভাষায় নাট্যকলা লেখা হতো। কিন্তু নেপালি সাহিত্যে নাটকের আবির্ভাব ঘটে অনেক দেরিতে। বীর শমসেরের শাসনামলে ১৮৯৩ সালে প্রথম ডারবার থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হলে নেপালে নাট্যকলার উন্মেষ ঘটে। গত শতকের দ্বিতীয় দশকের পর হতে বলকৃষ্ণ সম শেক্সপিয়রিয়ান শৈলীতে ১৭টি নাটক রচনা করেন যা নেপালি নাটককে জীবনদান করে। তিনিই মূলত সামাজিক পারিপাশ্বিকতা, দার্শনিক গভীরতা, যৌক্তিকতা ও কাব্যময়তার সমন্বয়ে নেপালি নাট্যকলাকে অনন্য উচ্চতা দান করেন। ভিম নিধি তিওয়ারি নাটকে চলিত ভাষারীতি প্রয়োগ করতেন। গোপাল প্রসাদ রিমেল তার নাটকে বাস্তবতার ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করতেন। তাদের মনস্তাত্তি¡ক পর্যবেক্ষণই নাটকগুলোকে অধিক আধুনিকতা দান করেছে। তবে বর্তমানে নেপালের নাট্যকলায় কিছুটা স্থবিরতা এসেছে। বর্তমানে খুব কম সংখ্যক সাহিত্যিক নাটকলা চর্চা করছেন। তার পেছনেও বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একটি কারণ হচ্ছে থিয়েটার সংস্কৃতির দুর্বলতা। খুব সামান্য সংখ্যক নাটক নেপালের থিয়েটারগুলোতে প্রদর্শিত হয়েছে এবং তা নেপালে নাট্যকলার সংস্কৃতি তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে কিছু সংখ্যক স্যাহিত্যিক নিরলস নাটককে প্রতিষ্ঠিত করতে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। তারা কিছুসংখ্যক শক্তিশালী নাটকও গত কয়েক বছরে লিখতে সক্ষম হয়েছেন। মোহন রাজ শর্মা, আশেষ মালা, সারু ভক্ত, গোপাল পারিয়াজুলি, অবিনাশ শ্রেষ্ঠ, ধ্রুব চন্দ্র গৌতম, অভি সুবেদী ও রোশান থাপার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

নেপালি সাহিত্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ভ্রমণ কাহিনি। নেপালে এটি খুব জনপ্রিয় এবং খুব বেশি পরিমাণে লেখাও হয়ে থাকে। তারানাথ শর্মা, রমেশ ভিকাল, ঘনশ্যাম রাজকর্নিকার, মদন মনি দীক্ষিত, শ্রীকৃষ্ণ গৌতম ও মাঁজুল উৎকৃষ্ট মানের ভ্রমণকাহিনি লিখেছেন। তরুণ প্রজন্মের লেখকগণের মধ্যে বিশমা আপরেতি, যুবরাজ নাজাঘারে, রাশমিশেখার ও জ্ঞানেন্দ্র বিভাসের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!