X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

পতঙ্গ

বিধান রিবেরু
০৬ জুন ২০১৮, ১৩:৫৪আপডেট : ০৬ জুন ২০১৮, ১৫:১৭

পতঙ্গ রক্তের ফিনকির বদলে উড়ে গেলো প্রজাপতি, লাল রংয়ের, এক গাদা প্রজাপতি, ফরফর ফরফর। মনে হয় বুকের খাঁচার ভেতরে বন্দি ছিলো তারা। মুক্তির পর ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে আনন্দে পাখা মেলেছে রক্তিম পক্ষের পতঙ্গরা। উড়ে যাচ্ছে আকাশের দিকে। এমন দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত নয় বদরুল। তাই কেমন যেন ঘাবড়ে গেলো সে। তার অবস্থা দেখে সতীর্থরা জিজ্ঞেস করলো, সে ঠিক আছে কি না। বদরুলের মুখ দিয়ে বিচিত্র আওয়াজ বেরুলো। গোঙানির মতো।

যখনই প্রয়োজন পড়ে, সে সজ্জিত হয়ে চলে আসে। অপারেশন হয়। রক্ত তীরের বেগে ছোটে। তারপর সে চলে যায়। কয়েক সপ্তার জন্য ছুটি। তারপর আবার ডাক আসে। আসার আগে অস্ত্র ঠিক ভাবে কাজ করে কি না তা পরীক্ষা করে নেয় সে। প্রতিদিনের মতোই আজও ভেবেছিলো ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাবে সে। সব প্রস্তুত থাকবে। তাক করে শুধু ঘোড়া টেনে দেবে। একবার, দুইবার, তিনবার। ব্যস। ধরাম করে চাউলের বস্তা পড়ার মতো শব্দ হবে। দূরে কোথাও হয় তো শোনা যাবে ফযরের আযান। তার কাজ শেষ। অস্ত্র গুছিয়ে সে চলে যাবে। আরেক দল তখন ব্যস্ত হয়ে উঠবে।

কিন্তু না। আগের কোন ঘটনার সঙ্গে আজকের ঘটনাটি মিললো না। বদরুল শুধু লাল প্রজাপতি নয়। তার কাছে মনে হল সেই প্রজাপতির জটলার আশপাশে দাঁড়িয়ে আছে কালো আলখেল্লা পড়া স্বয়ং মৃত্যুদূত। মাথার ভেতরে কেমন ঝিম মেরে আছে। ‘বন্দুকযুদ্ধে’আসার আগে খানিকটা নেশা করে নেয় বদরুল। আজ কি তাহলে বেশি হয়ে গিয়েছিল? মনে হয়। এ পর্যন্ত গুনে গুনে একশ আটটি অপারেশন করেছে সে। কোনবারই কোন ব্যতিক্রম হয়নি। এবারই এমন আজব ব্যাপার ঘটলো।

ঝিম ধরা মাথা আর অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে সে লাল-নীল আলো জ্বলতে থাকা কালো জিপে উঠে বসলো। পেছনের মাইক্রোতে উঠে বসলো ফোর্সের অন্যরা। অন্য আরেকটি গ্রুপ রয়ে গেলো লাশটির সাথে। সমানে খিস্তিখেউড় করছে ওই গ্রুপটি। বড় আর ক্লান্তিকর কাজটি এখন এদেরকেই করতে হবে।

একটু পরই দূরে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করবে। বালু নদীতে সূর্য তখন লাল রং ঢেলে দিয়ে ভোর ডেকে আনবে। চিকন একটা আলোকরেখা ফুটতে শুরু করেছে দূর প্রান্তে। এমন ঊষালগ্নে নদীর তীর ছেড়ে দূরে সরে যাচ্ছে সুসজ্জিত বদরুলরা। সবাই চুপচাপ। একটানা শুধু পিচ ঢালা রাস্তার উপর টায়ারের ছুটে চলার শব্দ। আর গাড়ির যান্ত্রিক আর্তনাদ। সামনে তীক্ষ্ণ হেডলাইটের আলো। দুই একটা লোক, যারা খুব ভোরে উঠেছে। দোকানপাট খুলবে। বা কোন জরুরি কাজ আছে। তারা সভয়ে তাকিয়ে থাকে দুটি গাড়ির দিকে। রাস্তা ফাঁকা। দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে গাড়িগুলো।

বদরুলের মাথায় আরো দ্রুত লয়ে চিন্তার ঘোড়া ছুটছে। ভাবছে—এমন তো হওয়ার কথা নয়? রক্ত কোথায়? রক্ত কেন দেখা গেলো না আজ? লাল প্রজাপতি কেন দেখলো সে? তাহলে কি লোকটা বুকের পাঁজরে প্রজাপতি পুষে রাখতো? নাকি তার চোখ আর রক্ত সহ্য করতে পারছে না? তার কি আজ একটু আঙুল কেপে উঠেছিল? সেটাই বা কেন হবে? মনটাকে বহু চর্চার মধ্য দিয়ে শক্ত ধাতুতে গড়ে তুলেছে সে। সেটা কি তবে গলতে শুরু করেছে?

ফটাস করে সশব্দে ফেটে গেলো গাড়ির চাকা। বদরুলের চিন্তায় এমনভাবে ছেদ পড়লো, যেন কেউ মুহূর্তে লাঠি দিয়ে আঘাত করে চৌচির করে দিয়েছে একটি পাকা তরমুজকে। নাশকতা! উৎকণ্ঠায় হাতপা টানটান করে উঠলো সবাই। উঁচিয়ে ধরলো অস্ত্র। পরক্ষণেই বুঝলো ঘটনা কি। একটা চাকা, চাপ সহ্য করতে না পেরে প্রাণবায়ু ত্যাগ করেছে। পেছনের গাড়িটিও থামলো। দুই ধারে ধানক্ষেত। গাছগাছালিও আছে ফাঁকে ফাঁকে। চারদিকে নানা বর্ণের সবুজ। সবুজের ওপর সোনালি আলোর চিকন রেখা ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে।

বদরুল গাড়ি থেকে নেমে হাত পা টানটান করলো। এরপর প্যান্টের সাইড পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলো সে। দৃঢ় হাতে সিগারেট ধরাতে চায়। দেয়াশলাইয়ের আগুনটা কেঁপে কেঁপে উঠলো। প্রথম টান দেয়ার পরই কপাল কুচকে ওঠে বদরুলের। কেমন যেন রুহআফজার স্বাদ পায় বদরুল। রুহআফজা না গোলাপজল? মিষ্টি একটা স্বাদ। তার কি হলো আজ? এই সিগারেট থেকে তো এমন স্বাদ বা গন্ধ হওয়ার কথা নয়? তার তো রুহআফজার স্বাদ ভালো লাগে না। মনে হয় গোলাপের পাপড়ি গুলে দেয়া হয়েছে। বমি বমি লাগে। সিগারেট খেয়ে এমনটাও কখনো হয়নি। আরো দুই একবার টান দিলো সিগারেটে। না, স্বাদ একটুও পরিবর্তন হয়নি। সেই একইরকম। বরং ধোয়ার গন্ধটাকে মনে হচ্ছে আগরবাতির সুবাস মাখা! প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে বদরুলের। রাস্তার পাশে ছুড়ে ফেলল সিগারেটটা। জিপের চাকা কেবল খোলা হয়েছে। বাড়তি চাকা লাগানো হবে।

তলপেটে চাপ অনুভব করলো বদরুল। জল বিয়োগ করা দরকার। একটু দূরে একটা কাঁঠাল গাছ দেখা যাচ্ছে। সেটার আড়ালেই কাজ সাড়তে হবে। বদরুল ইশারায় কড়ে দেখালো সতীর্থদের। তারপর সেদিকে হাঁটা শুরু করলো। পেছনের গাড়িটা থেকেও নেমে দাঁড়িয়েছে অন্যরা। চোখেমুখে সতর্ক দৃষ্টি। চাপা স্বরে কথাও বলছে। ভর্ৎসনা করছে চালককে। ঠিকঠাক করে দেখে বের হয়নি কেন? রাস্তায় তারকাটা ছিলো, চালকের জবাবদিহি। দুই একটা গালি খেলো সে। সেটাও চাপা গলায়।

বিশ কি পঁচিশ গজ দূরে, সড়ক ছেড়ে একটু নিচে দাঁড়িয়ে থাকা কাঁঠাল গাছের গোড়ায় মূত্র ত্যাগ করতে শুরু করলো বদরুল। বা হাতে মাথায় বাধা কালো পট্টিটা খুলে সামনে বেল্টে গুজে নিলো। প্রাকৃতিক কর্ম শেষ হলে জিপার লাগাতে যাবে, তখনই তার চোখ যায় গাছের খোড়লে। লাল পিঁপড়ার ঢিবি। দলা পাকিয়ে আছে। নিচে তাকিয়ে দেখে ত্যাগ করা জল নেই, সেখানে দলা দলা লাল পিঁপড়া। বিশাল আকৃতির। আৎকে উঠলো বদরুল। কোন রকম জিপার লাগিয়ে সে উঠে গেলো মূল সড়কে। অনেকটা হুড়োহুড়ি করেই গাড়ির কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু যেন মনে হচ্ছে কয়েক লক্ষ মাইল দূরে দাঁড়িয়ে আছে দুটি গাড়ি। পায়ের পাতাগুলোও কেমন ভারি হয়ে উঠছে। বহরের কাছে পৌঁছুনো যাচ্ছে না। মাথা বিগড়ে যাচ্ছে বদরুলের!

বদরুল আরো জোড়ে হাঁটার চেষ্টা করলো। সে প্রফেশনাল লোক। তার এমন মানসিক বৈকল্য হওয়ার তো কথা নয়? প্রথমে সে ভেবেছিল নেশার কারণেই বোধহয় লাল প্রজাপতি দেখেছিল তখন। কিন্তু এতক্ষণ তো নেশা থাকে না তার। কেটে যাওয়ার কথা। তাহলে? নিজের প্রস্রাব কেন লাল পিঁপড়া হয়ে যাবে? শরীর থেকে কি ওগুলোই বেরুলো? বদরুল এবার ছোটার চেষ্টা করলো। যতই সে দ্রুত পা ফেলতে চাইছে, ততই যেন শরীর ভারি লোহার মতো হয়ে যাচ্ছে, গাড়িগুলোও যেন দূরে সরে যাচ্ছে। সূর্যোদয়ের আলো আরো ছড়িয়ে পড়ছে দিগন্ত জুড়ে। বদরুল আর আলোর দিকে যেতে পারছে না। একটা অদৃশ্য শক্তি যেন তার পা টেনে ধরছে মাটির দিকে। বদরুল ভাবে, এখানেই কি তার কবর রচিত হবে? পাতাল থেকে কারা তার পা এমন টেনে ধরছে? বদরুলের হঠাৎ মনে হলো— সত্যি সত্যি কয়েক জোড়া হাত তার পায়ের গোড়ালি চেপে ধরেছে। শক্ত করে। আর ছাড়বে না!

অভ্যাসবশত বদরুলে হাত চলে গেলো কোমড়ে থাকা অটোমেটিক পিস্তলের দিকে। বদরুল ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলো লাল পিঁপড়ের দল, হাতের অবয়ব নিয়েছে, দুই পা আটকে রাখতে চাইছে তারা মাটির সাথে। যেন শেকলে বাঁধা পড়েছে পদযুগল। পিস্তল বের করে ফেললো বদরুল। চোখেমুখে আতঙ্ক ফুটে উঠেছে স্পষ্ট। ঠোঁট বেঁকে উঠলো তার। চোখ ছোট ছোট করে চিৎকার করে উঠলো বদরুল। ছাড়! ছাড়!

দুম! দুম! কয়েক রাউন্ড গুলি চালালো বদরুল। দেখলো রক্ত নয়, তার হাঁটুর নিচের অংশ থেকেও দুই একটা করে প্রজাপতি বেরিয়ে আসছে। তারা উপরে আকাশের দিকে যাচ্ছে। বদরুল উন্মাদ হয়ে গেলো। সে সোজা পিস্তল তাক করলো তার মুখের ভেতর। ট্রিগার দাবানোর আগে সে আকাশের দিকে দেখলো। ঝাকে ঝাকে লালাভ প্রজাপতি  গোল গোল হয়ে উড়ছে। আশপাশের খোলা প্রান্তরের ওপরেও তাদের ছায়া পড়ছে। বদরুল সূর্যালোকের দিকে যেতে চাইছে। হয়ে উঠছে না। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে শুরু করেছে। বিকট চিৎকার দিয়ে উঠলো বদরুল। একটা বুলেট তার খুলি ভেদ করে বেড়িয়ে গেলো। খুলি থেকে রক্ত নয়, উড়ে গেলো আরো লালরঙা প্রজাপতি, আকাশের দিকে। আলো গ্রাস করলো তাকে। চোখ ধাঁধানো আলো।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া