X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

তপন বড়ুয়ার সঙ্গে আলাপচারিতা

.
০৮ জুন ২০১৮, ০৮:০০আপডেট : ০৮ জুন ২০১৮, ১৩:১১

তপন বড়ুয়ার সঙ্গে আলাপচারিতা

তপন বড়ুয়া বললেন, হ্যাঁ। হয়তো বাংলা একাডেমি পুরস্কার আমি নেবো না। তবে জাতীয় পুরস্কার দেবে আমাকে। এখন না দিক, আরও দশ বছর পরে দেবে। এটা মুখে মুখে বললাম।

তপন বড়ুয়া :  আমি এখানে আছি, খুব আরামে আছি। কোনো ঝামেলা নেই। এখানে প্রত্যেকটি বাড়িতে গাছ পাওয়া যাবে, এলাকায় সম্প্রীতি আছে। আমি ভালো আছি।

জাহিদ সোহাগ : আপনি কি দীর্ঘদিন মিরপুরেই আছেন?

তপন বড়ুয়া : হ্যাঁ। প্রায় ৩৬ বছরের মতো। অনেকেই আমাকে বলেছে কেনো আমি এতদূরে থাকি। আসলে এখানে নিজের মতো করে থাকা যায়।

জাহিদ সোহাগ : এই বাসাতেই এতো বছর?

তপর বড়ুয়া : হ্যাঁ। বাসা মানে হচ্ছে বাবা ছিলেন জনতা ব্যাংকে। ১৯৭৫ সালে ওনাকে ঢাকায় ট্রান্সফার করা হয়। তো ওনাকে ঢাকায় ট্রান্সফার না করলে আজকে যে তপন বড়ুয়া বলে কিছু হয়েছি সেটা হতে পারতাম না। তো উনি যেহেতু ঢাকায় পুরোপুরি ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছিলেন সেহেতু মিরপুরে এখানে এসে বাড়ি করেন, যদিও সেটা বেশ পরে, আশির দশকের দিকে। তখন পানি ছিল না, গ্যাস ছিল না। তারপরও এই জায়গাটিকে বেছে নিয়েছিলেন।

জাহিদ সোহাগ : আচ্ছা দাদা, আপনি গাণ্ডীব শুরু করলেন কীভাবে? এই নামটা কীভাবে রাখলেন? গাণ্ডীব করার প্ল্যানটা কীভাবে আসলো?

পন বড়ুয়া : তুমি তো দেখি সাক্ষাৎকার নেওয়ার মতো করে প্রশ্ন করছো!

জাহিদ সোহাগ : না, মানে আমি জানতে চাইছিলাম।

পন বড়ুয়া : ইনফরমালি উত্তর দেই ক্যামন? আসলে সবকথা সবসময় বলা যায় না?

জাহিদ সোহাগ : আপনি কি কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে ভয় পান?

তপন বড়ুয়া : না, আমি কোনো সত্য নিয়ে কথা বলতে ভয় পাই না। আচ্ছা, আমি গাণ্ডীব নিয়ে বলি। আসলে বর্তমানে এমন অবস্থা যে, কিছু বলতে গেলেই সুবিমল মিশ্রের মতো হয়ে যায়। আমিতো কোথাও যাইনি। একটা মানুষের বা একটি ছেলের ব্যক্তিগত জীবনে অনেক কিছু পাওয়ার থাকে। আমিতো ছোটবেলা থেকেই পরিবারে নিগৃহীত। আমি আমার বাবা-মাকে কিছুই দিতে পারিনি। কোনো একটি ভদ্র চাকুরি করিনি। আমাকে তখনকার সময়ে বাড়ি থেকে বড় দোকান করে দিতে চেয়েছে। আমি নিইনি, ভেবেছি আমি দোকানদারি করতে গেলে তো শাহাবাগ ভুলে যাবো। আড্ডা ভুলে যাবো, সাহিত্য ভুলে যাবো। বাবা ভুল বুঝলেন।

জাহিদ সোহাগ : গাণ্ডীব শুরু করেছিলেন কি প্রতিষ্ঠান-বিরোধীতার জায়গা থেকে?

তপন বড়ুয়া : শোনো, যা বলি- আমি স্কুল পাশ করি ১৯৭২ সালে। এরপর কলেজে ভর্তি হই। কিন্তু পড়াশোনা করতাম না। এর ওর পেছনে ঘুরতাম, গানবাজনা করার নেশা ছিলো। তখনো সাহিত্য সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। স্কুল-কলেজের বইয়ের বাইরে কিছু পড়িনি। তখন চিন্তা ছিলো কোনো রকমে পাশ করে আর্মিতে যাবো। ৭৫-৭৮এ ইন্টারমিডিয়েট পাশ করি। কিন্তু চলাফেরা ঠিক নেই। এখানে সেখানে আড্ডা মেরে বেড়াই। সাদী মোহাম্মদের সাথে ঘুরি, গান গাই, এইসব। তো সেই সময়ে একজন মেয়ের সাথে পরিচয় ঘটে। তারা বেশ বড়লোক ছিল। তাদের সাথে সাদীর বেশ খাতির ছিলো। এটা সম্ভবত ৭৭-৭৮ সালের ঘটনা। তো তাদের বাসায় একবার গান করতে গিয়ে একটি বইয়ের খোঁজ পেলাম। বইটির নাম বুড়ো আংলা। দেখার জন্য বইটি তার কাছে চাইলাম। সে দিতে চাইলো না। বলল এটা লাইব্রেরির বই। আমি বললাম কোন লাইব্রেরি—সে বলল, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। তখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র নতুন হয়েছে। সে সময়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ইন্দিরা রোড থেকে স্থান পরিবর্তন করবে। ও বলে নিই, এই সময়ে আরও একজনের সাথে পরিচয় ঘটেছিলো যার নাম নিরন্তর। সে একটি সাহিত্য পত্রিকা করতো, নাম : রৌদ্রের রঙ। ঐ সময়টা আমার কাছে অন্যরকম ছিলো। সাহিত্যের সাথে পরিচিত হচ্ছি। আবার এদিকে কোথাও ভর্তি হইনি। বাবার সামনে যাই না। সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়াই। বাড়ি এসে চুরি করে ভাত খেতাম। তবে সে সময়ে আস্তে আস্তে বন্ধুদের মাধ্যমে একটি অভ্যাস গড়ে ওঠে, তা হলো বিকাল ৫টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত লাইব্রেরিতে সময় কাটানো। তখন বাসা থেকে ফার্মগেট আসতে লাগতো ৭-৮ আনা। বাবা সবসময়ই ক্ষিপ্ত ছিলেন, কারণ পড়াশোনা একপ্রকার ছেড়ে দিয়ে ভবঘুরে হয়ে গেছি। কিন্তু বই পড়ার নেশা বাড়তে লাগলো। বাসায় ধর্মীয় বই রাখা হতো। মা ধর্মীয় বই ছাড়াও অনেক রকমের বই পড়তেন। আশাপূর্ণা দেবী, নিমাই ভট্টাচার্য, এছাড়া কলকাতার যত দ্বিতীয় লেবেলের লেখা আছে সে সময়ে তিনি পড়তেন। তার সাথে সাথে আমিও পড়ে শেষ করি। টুকটাক বই কিনি। সে সময়ে বিমল মিত্র পুরোটাই পড়ে শেষ করেছি। যদি পরে এসে জেনেছি বিমল মিত্র নয় বিমল করই হলো প্রকৃত সাহিত্যিক।

জাহিদ সোহাগ : সে সময়ে বই কিনতেন?

তপন বড়ুয়া : বই তেমন কেনা হতো না। এর ওর কাছ থেকে নিয়ে বই পড়তাম। তবে মাঝে মাঝে মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই কিনতাম। তবে দুইটি বই আমি কখনো কিনিনি। একটি হলো আন্না কারেনিনা আরেকটি হলো ওয়ার অ্যান্ড পিস। আমার ধারণা ওয়ার অ্যান্ড পিস পড়ে শেষ করা সম্ভব নয়। এই পর্যন্ত কেউ পড়ে শেষ করতে পারেনি, এটি আমি বাজি ধরে বলতে পারি।

জাহিদ সোহাগ : সিরিয়াসলি? আমি নিজেও পড়ে শেষ করতে পারিনি তবে অনেকে বলেন যে তারা শেষ করেছেন।

তপন বড়ুয়া : মোটেই সম্ভব নয়। যারা বলেছেন তারা কী পাঠক? যা বলছিলাম, বর্তমানে এই গদ্য যারা লেখে তাদের গদ্য কতটুকু আধুনিক। হালের আনিসুজ্জামানসহ আরও অনেকে। গদ্যের ঢং দেখলে মানিকের দিকে তাকাতে হবে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি রবীন্দ্রনাথের থেকেও বড় গদ্যকার মনে করি। তো তারা বাংলা গদ্যকে যতটুকু এগিয়ে নিয়েছেন তার পরে আর কে ততটুকু পেরেছে? একজন আছে নাম বলবো না, সে কম্পাস দিয়ে মেপে মেপে বাংলা লেখে। এইভাবে চলতে চলতে একসময় এমন হলো যে, বই সামনে যা পাই তাই-ই পড়ি। এভাবে পড়তে পড়তে আবিষ্কার করি রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথ যে হিন্দু না সেটা বুঝতে বেশকিছুদিন আমার লাগে। লালন কিংবা রবীন্দ্রনাথের ভেতর যদি ঢুকি তাহলে দেখি তাদের চাওয়াটা কী ছিলো! তাদের চাওয়াটা ছিলো, ঐ যে জানি না, ঐ জানার আগ্রহ। কি ঘটছে কিভাবে হচ্ছে সে সবের একটি উত্তর। তাদের সাহিত্যের মূল অংশটা দাঁড়িয়ে আছে ঐ অন্বেষণের ওপর ভিত্তি করে। তবে আমি মনে করি প্রকৃতি ভূমিজ কবি হলেন লালন। লালন ও রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি গানই হলো ধর্ম ও মতবাদ নির্ভর।

জাহিদ সোহাগ : ধর্ম মানে কি রিলিজিয়ান অর্থেই ধর্ম?

তপন বড়ুয়া : হ্যাঁ রিলিজিয়ান অর্থেই। তাদের গানগুলো দেখলেই বোঝা যাবে। বিশেষ করে লালনের। আর রবীন্দ্রনাথের গান তো কেউ গাইতে পারে না। এই সাদী ছাড়া। আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথকেই সে গান শেখাতে পারবে।

জাহিদ সোহাগ : আচ্ছা ঐ সময় কি মার্কেজ পড়তেন?

তপন বড়ুয়া : মার্কেজ তখন লেখক হিসেবে এতো আলোচিত হননি।

অহ নওরোজ : সিনেমা নিয়ে তো আপনার বেশ পড়াশোনা আছে। সে সময়ে সিনেমা দেখা শুরু করেছিলেন?

তপন বড়ুয়া : ঐ সময় সিনেমা দেখার ঝোঁকটা তৈরি হয়েছিলো খসরু (মুহম্মদ খসরু) ভাইয়ের মাধ্যমে। আমি মনে করি সিনেমা সম্পর্কে যতটুকু পড়াশোনা করা দরকার ততটুকু তার ছিল। সে সময়ে তারকাভস্কি থেকে শুরু করে ভারতের তিনজন রায়, সেন আর ঘটকের সিনেমা দেখেছি। বিশেষ করে ঋত্বিক ঘটক ছিলেন আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। কারণ এই যে, সিনেমায় বাংলার জন্য সব থেকে বেশি কথা বলেছেন এই একটিমাত্র লোক।

আর শিল্পের সাথে যুক্ত প্রত্যেকটি লোকেরই, সে কবি হোক আর চিত্রশিল্পী হোক আর একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকা দরকার। যেটা আমার নেই আর বর্তমানে কোনো (উনি স্ল্যাং বলেছেন)…এর নাই। দেশকে ভালোবাসে না, নিজের কোনো মতাদর্শ নেই আবার পুরস্কার আশা করে।

জাহিদ সোহাগ : আপনি কি মনে করেন যে আপনি পুরস্কার পাবেন?

তপন বড়ুয়া : হ্যাঁ। হয়তো বাংলা একাডেমি পুরস্কার আমি নেবো না। তবে জাতীয় পুরস্কার দেবে আমাকে। এখন না দিক, আরও দশ বছর পরে দেবে। এটা মুখে মুখে বললাম।

অহ নওরোজ : আপনি কিন্তু এখনো বললেন না, গাণ্ডীবের সৃষ্টি কীভাবে?

তপন বড়ুয়া : প্রায় এসে গেছি সেখানে। তো এই খসরু ভাইয়ের সাথে পরিচয় হওয়ার পর সিনেমা দেখতে শুরু করি। আর এদিকে ভবঘুরে জীবন, বাজারের টাকা থেকে টাকা বাঁচিয়ে হাত খরচ চালানো, লাইব্রেরিতে গিয়ে বইপড়া, শাহবাগে মোহাম্মাদপুরে আড্ডা মারা চলছে। তখন একসময় মনে হলো এই যে এতো বই পড়লাম, বাসায় রাখা দেশের একগাদা পূজা সংখ্যা পড়েছি। আমি বারবার বলি, আমি রবীন্দ্রবাদী নই, তবে রবীন্দ্রনাথ যে মহা জিনিয়াস, নাটকে এবং পেইন্টিংয়ে, ছোটগল্প উপন্যাস ধরছি না, আমাকে গালাগালি করে। এখানে একজন বৌদ্ধ হিসেবে টিকে থাকা অতো সহজ নয়। রোহিঙ্গার মতো জীবন যাপন করতে হয়।

যা হোক, তখন ঐ সময়ে লাইব্রেরিতে যাওয়া আর বিকেলে মুড়িভাজা খাওয়ার সূত্র ধরে পরিচিত হওয়া তিনজন শোয়েব শাদাব, শান্তনু চৌধুরী, সাজ্জাদ শরীফ এর সাথে যুক্ত হয়ে একটি পত্রিকা বের করার চিন্তা করি। ওরা আমার থেকে ৭-৮ বছরের ছোট। তখন আমাদের সামনের বাসা ছিলো লুৎফুর রহমানের বাড়ি। সে সময়ে আস্তে আস্তে চিন্তা হলো আমি পড়াশোনা করলাম না, কোনো কাজ করলাম না। তাহলে করলাম কী, সুবিমল মিশ্র তখন আমি পড়ে ফেলেছি। তখন টুকটাক লেখাও শুরু করেছি। অনিন্দ্য নামে একটি ছোটকাগজ বের হতো। সেখানে লেখা শুরু করেছিলাম। সে সময়ে শাদাব আমাকে বলতো যে কবিতাগুলো ছাপা হবে অনিন্দ্যে সেগুলোর ওপরে আমাকে লিখতে হবে। সে সময়ে সমালোচনা করা এবং সেটা গ্রহণ করার মানসিকতা ছিলো। এখন যেটা নেই। বর্তমানে সমালোচনা সাহিত্য বলতে কিছুই নেই। তো সেটা লিখতে গিয়ে শান্তনুর একটি কবিতার লাইনকে শিরোনাম করে তিনজনের কবিতার উপরে লিখলাম। এর ফলে তাদেরকে আমার থেকেও বেশি প্রগ্রেসিভ হিসেবে খুঁজে পেলাম। বয়সে ছোট হলেও তারা বাংলা ছন্দ খুবই ভালো জানতো। আমি তখন শুনি, পড়ি না, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সুনীল, এরা তখন জলজ্যান্ত। বাংলাদেশে তখন আবৃত্তি, সাহিত্য, ফিল্ম, পেইন্টিং একটা বুম। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আল মাহমুদ চা খেতো, সিগারেট খেতো, তার সাথে সম্পর্কটা সেখান থেকে। রাহমান ভাইয়ের সাথেও ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে সেখান থেকে। রাহমান ভাই আবার অনেক সিস্টেম মেইন্টেইন করতেন। অধিকাংশ সময়ে কথা বলতেন মেপে মেপে। তবে আবার আড্ডার সময় ছিলেন খোলা মানুষ। তো গাণ্ডীব বের করবো সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছি তখন রাহমান ভাইকে সরাসরি বলেছি, ভাই আপনার লেখা ছাপবো না, কিন্তু আপনি আমাদের বিজ্ঞাপন দেবেন। তার অফিসে গিয়ে একথা বলেছিলাম। তিনি ছিলেন খুবই সজ্জন, ভালো মানুষ। রাহমান ভাই, আমাকে বিজ্ঞাপন দিলেন। এবং রাহমান ভাইয়ের সময়ে গাণ্ডীবই ঢাকা থেকে বের হওয়া একমাত্র পত্রিকা যেখানে তার লেখা ছাপা হয়নি।

জাহিদ সোহাগ : তাহলে গাণ্ডীব বের হলো। কিন্তু নাম রাখা হলো কীভাবে?

তপন বড়ুয়া : ও আচ্ছা। যখন অনিন্দ্যে আমি একটি গল্প লিখি, যার নাম ছিলো ‘জাপানের শিশু, সহযাত্রী এবং জলভরা কণ্ঠ’। আমার একটিই বই। সেই বইয়ের প্রধান গল্প এটিই। এই কারণে বইটির নাম একই। তখনো লিটল ম্যাগাজিনের স্বপ্ন ছিলো না। কিন্তু এই অনিন্দ্যে লেখা ছাপা নিয়ে একটি গণ্ডগোল হয় সে কারণে আমরা ঠিক করি আমরা নিজেরাই লিখবো। এ কারণে একটি পত্রিকা করবো। চারজনের বাইরে হয়তো গেস্ট লেখক হিসেবে লেখা নেবো সেলিম মোর্শেদের, আর কারো লেখা নেবো না। তখন পত্রিকা করবো এই সিদ্ধান্ত ছিলো। লিটল ম্যাগাজিনের স্বপ্ন ছিলো না। পরে গাণ্ডীবের প্রথম সংখ্যার জন্য একজনকে ঠিক করা হলো যে ছিলো সাদাফের বন্ধু, সে সহ-সম্পাদক হিসেবে থাকবে এবং ফাইন্যান্স করবে। কিন্তু পরবর্তীতে তার সাথে মতের মিল না হওয়ায় তাকেও বাদ দেওয়া হলো। পরে রাজশাহী থেকে ঢাকা মেডিকেলের প্রজেক্ট ডিরেক্টার হিসেবে ঢাকায় আসলেন ডা. আশরাফ আলী চৌধুরী। অনেক বড়লোক মানুষ। তার ছেলে রনি আমাদের সাথে আড্ডা দিতো বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। সে একদিন শুনে বলল সে ফাইনান্স করবে। ওর টাকা দিয়েই এই গাণ্ডীবের প্রথম সংখ্যা বের হলো।

জাহিদ সোহাগ : গাণ্ডীব নামটা আপনার দেওয়া?

তপন বড়ুয়া : না। গাণ্ডীব নামটা দিয়েছে, জাহেদুর রহিম অঞ্জন। তার বাবা টুকটাক লেখালেখি করতেন, লেখক শিবির করতেন। ও আমাদের ভালো বন্ধু ছিলো। যখন নাম নিয়ে আমরা চিন্তা করি তখন ও বলেছিলো এই নামটি। আমার পছন্দ হয়নি। কিন্তু বাকিরা পছন্দ করেছিলো বলেই এই নাম রাখা হয়েছিলো। এরপর গাণ্ডীবের কভার কি হবে এটা নিয়ে চিন্তা করা হলো, আমি ওয়াকিলকে ডাকালাম। সে করে দিলো। ওয়াকিল তখন জার্মানি যায়নি। খসরু (মুহম্মদ খসরু) ভাইয়ের দুইটি শর্টফিল্মের পোস্টারও সে করে দিয়েছিলো।

জাহিদ সোহাগ : আপনাদের দর্শন কী?

তপন বড়ুয়া : আমরা পুঁজি বাজারের মজা নেবো, শাহাবাগ গিয়ে আড্ডা দেবো আর লিটল ম্যাগাজিন করবো, লিটল ম্যাগাজিন করে টাকা কামানোর ধান্ধা করবো—এরকম লিটল ম্যাগাজিন আমি করি না। ঐ কথায় কথায় মননশীল? ঐ লিটল ম্যাগাজিন আমি করি না। সাহিত্যের একটি পার্ট হলো লিটল ম্যাগাজিন। আমরা তো বড় কথা বলি লিটল ম্যাগাজিন করে বড় বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলবো, কিন্তু মোটা দাগে ভাষার জন্য আমরা কতটুকু কাজ করছি সেটা নিয়ে কি কখনো ভাবি? বিখ্যাত হওয়া আর টাকা কামাই করার ধান্দা ছাড়া বর্তমানে সাহিত্য করতে আসে কয়জন?

এখন সাহিত্য করে অনেকে বাড়িতে, তারা বাংলাদেশের পানি খায় না, খায় ফ্রান্সের পানি। রান্নাও করে ফ্রান্সের পানি দিয়ে। তাহলে এইটাই কি সাহিত্য করার উদ্দেশ্য?

আমি মনে করি লিটল ম্যাগাজিন বলতে যা বোঝায় একমাত্র গাণ্ডীবই সেটি। আমাদের নিজস্ব কোনো সামাজিক রাজনৈতিক বিশ্বাস নেই। আমরা কি শোষণহীন বঞ্চনাহীন সমাজ ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন করি? শেখ মজিবুর রহমান তো চেয়েছিলেন শোষণহীন বঞ্চনাহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য, বাকশাল করলেন সেজন্য। আমরা তার কথায় সায় দিতে পারলাম না, উল্টো তাকে মেরে ফেললাম।

আপনি সাহিত্যে কী এমন কাজ করেছেন, ভাষার জন্যে কী কাজ করেছেন? কথায় কথায় মার্কেস টানেন। ল্যাটিন সাহিত্যে কেমন কাজ হয়েছে তার সাথে আমাদের পার্থক্য করেন। আমরা কী তাদের অনুসরণ করে চলবো নাকি? একটি অনুন্নত দেশ মানেই তো ভরপুর ম্যাজিক রিয়ালিজম। দুই একটা লাতিন গল্প, উপন্যাস, কবিতা পড়েই এদের মতো লিখতে চান। কিন্তু সেটা কি সম্ভব? কলাম্বিয়ায় যে বিপ্লব চলেছে গত বছরগুলোতে সেরকম বিপ্লব কি আছে আমাদের দেশে? ওদের যেরকম মাটি, কলাপাতার ফাঁক দিয়ে সমুদ্র দেখার যে আনন্দ সেটা আছে আমাদের দেশে? আমরা চাইলেই কি তাদের মতো লিখতে পারবো? আর এর থেকে বড় কথা হলো আমরা কেন তাদের অনুসরণ করবো?

জাহিদ সোহাগ : একটু খোলাসা করেন।

তপন বড়ুয়া : একটা উদাহরণ দেই—

“দাদাবাবু তোমার পাশে দাঁড়ালে শরীরটা যেন কেমন করে

কুসুম তোমার কেবলি শরীর, কেবলি শরীর, তোমার মন নেই?”

বাঙ্গালদের এই জঘন্য ল্যাঙ্গুয়েজ এই, পচা কাদা মাটি বৃষ্টি এটা ভালোবেসে, এটাকে ধারণ করেই লিখতে হবে। যে বাংলা এই মাটিকে ধারণ না করে সেতো আসল বাংলা নয়, ভড়ং। বাংলা সাহিত্যে আমি মনে করি প্রকৃত গদ্যকার হলেন—মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ। দেবেশ রায়ের লেখাও এখন ভালোলাগে।

জাহিদ সোহাগ : দেবেশ রায়কে আপনি মাস্টার মনে করেন?

তপন বড়ুয়া : দেবেশ রায় অসম্ভব জিনিয়াস। কিন্তু...(স্ল্যাং)। তার কয়েকটা বই পড়েছি। তার ‘মানুষ কেন খুন করে’ এটাও ভালো ।

জাহিদ সোহাগ : তাহলে ইলিয়াসের গদ্যকে নাকচ করলেন?

তপন বড়ুয়া : আমি নাকচ করছি কিনা? আমিতো নাকচ করিনি। কিন্তু মাস্টার বলিনি। তাই বলে এই না যে তিনি ভালো লেখেন না। এখন আবার দেখা যায় ইলিয়াসের সাথে শহীদুল জহিরের ছবি ছাপায় কেউ কেউ, নাম বলছি না। এদের মাথায় কি কিছু আছে? তুমি যাকে প্রিয়া মনে করো তার জন্য দোজখে যাবা না? বাংলা ভাষাকে তুমি যদি আসলেই ভালোবেসে থাকো তাহলে, বাংলা ভাষাটা কোথা থেকে এসেছে সেখানে যাবা না? এটা তো বড়লোকদের ভাষা না। এটা গরিবের ভাষা। এই ভাষাটা প্রকৃত যারা চর্চা করে তারা তো ইংরেজি মিশিয়ে বলে না। সেই তাদের বাংলাটাই তো প্রকৃত বাংলা। তাদের কাছে তো যেতে হবে। সেই মাটিকে তো উঠিয়ে আনতে হবে।

জাহিদ সোহাগ : আমাদের দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাহিত্য পাতা নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?

তপন বড়ুয়া : [সম্পাদনা করা হলো]...এরাই কি বাংলাদেশে ভালো লেখে, নাকি এটা গ্রুপবাজি করা? যাদের গদ্য ছাপায়, নামের আগে কথাসাহিত্যিক লেখে তাদের গদ্য কি রিডিং পড়া যায়? এই শাহাদুজ্জামান, শহীদুল জহির, এদের যে ভাষা সেই ভাষার পক্ষে আমি না। তোমরা সুবিমল মিশ্রকে দেখো। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পকার হলেন আল মাহমুদ। জলবেশ্যা, কালোনৌকা, পানকৌড়ির রক্ত। এগুলো ফিল্মের মতো। এর থেকে ভালো গল্প লিখতে পারবে আছে কেউ, খুব তো বড় গলা করে। একটা ল্যাঙ্গুয়েজকে ভালো না বাসলে এভাবে লেখা যায় না।

অহ নওরোজ : কিন্তু ভাষার তো গতি আছে। ভাষা একখানে দাঁড়িয়ে থাকে না। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে ভঙ্গিও পরিবর্তন হয়। শব্দকোষের পরিবর্তন ঘটে।

তপন বড়ুয়া : আমি ভাষাকে ভালোবেসে লেখার কথা বলছি। ভাষাকে বাণিজ্য করার ধান্ধায় লেখা আর ভালোবেসে লেখা আলাদা। আমি এখনো লিখতে পারি নাই বলে লিখি নাই। আমি লেখক না। এখন সবাই শুধু ভাব মেরে জিন্স প্যান্ট পরে। কাজের জায়গায় নেই। সাহিত্য তো আইসক্রিম। তুমি একটা আইসক্রিম খেলে একরকম ফ্লেভার পেলে, আবার আরেকটা খেলে আরেকটি ফ্লেভার পেলে। সাহিত্য তো এরকম। একেকজনের লেখার একে রকমের ফ্লেভার। কিন্তু যদি এক লেখার অন্যের ফ্লেভার পাওয়া যায় কিংবা কোনো ফ্লেভারই না পাই তাহলে পড়ে কি লাভ? আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ওনার তো দুইটি উপন্যাস, শওকত আলী—ওনার তো একটি উপন্যাস ধরার মতো, তারপরও তো তাদের স্মরণ করতে হয়, কেন? নিজস্ব ফ্লেভার আছে।

জাহিদ সোহাগ : আগামীতে আপনার কিছু লেখার প্ল্যান আছে কী?

তপন বড়ুয়া : দাঙ্গা নিয়ে বড় কাজ হয়নি, ভাষা ভাষা কাজ হয়েছে। আমি দাঙ্গা নিয়ে লিখতে চাই। আর আমাদের গ্রামের বাড়ি নদীর ওপারে একটি গ্রাম আছে। সেই গ্রামটা নিয়ে আমি একটি গল্প লিখতে চাই। বেঁচে আছি এরকম কিছু কারণে।

জাহিদ সোহাগ : আপনার গল্পের বইটি তো আউট অফ প্রিন্ট, ঐটা পাওয়ার উপায় কি?

তপন বড়ুয়া : ঐ যে উলুখড়। ওদের আছে কাছে, ওদের বললে দেবে। আমার তো একটিই বই। অথবা আমার কাছ থেকে ফটোকপি করে নিতে পারো। শান্তুনুরে আমি বলি, আমি তো লেখক না। আমি পরবর্তীতে ফিল্ম করতেও চাই। দুই একটা ডকুমেন্টরি করার ইচ্ছা আছে।

অহ নওরোজ : এবার তো গান্ডীব করতে পারলেন না টাকার অভাবে।

তপন বড়ুয়া :  আমারে কী কেউ আর টাকা দেবে? টাকা তো দেবে যে ঐ টাকা দিয়ে বাজার করবে তাকে।

অহ নওরোজ : বর্তমান সময়ে তো অনেক লিটল ম্যাগাজিন হচ্ছে, যেমন ধরুন ওবায়েদ ভাই শালুক করছেন, অনিকেত শামীমের ‘লোক’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন বের হয়, আরও বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছোটকাগজ বের হচ্ছে। এগুলো নিয়ে আপনার মতামত কী?

তপন বড়ুয়া : একজন মানুষকে নিয়ে তো সহজেই আমি নিন্দা করতে পারি। কিন্তু যেসব নাম আমাকে বললে সেসব নিয়ে আমি কেন ভাববো, কেন কথা বলবো, ওগুলো নিয়ে চিন্তা করার কোনো প্রশ্নই আসে না। তাদের নিয়ে কোনো মন্তব্য করার সময় নেই আমার।

জাহিদ সোহাগ : আমাদের কথাবার্তা অসপ্পূর্ণ থাকলো। আরেকদিন আসবো।

তপন বড়ুয়া : এসো। যেকোনো দিনই এসো। 

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
নীলফামারীতে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারিসহ ৩ জন গ্রেফতার
নীলফামারীতে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারিসহ ৩ জন গ্রেফতার
পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি জাতিসংঘে তুলে ধরলো বাংলাদেশ
পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি জাতিসংঘে তুলে ধরলো বাংলাদেশ
বার্সার বিদায়ে কান্সেলোর অনাগত সন্তানের মৃত্যু কামনা করেছেন সমর্থকরা!
বার্সার বিদায়ে কান্সেলোর অনাগত সন্তানের মৃত্যু কামনা করেছেন সমর্থকরা!
পাগলা মসজিদের দানবাক্সে এবার মিললো ২৭ বস্তা টাকা
পাগলা মসজিদের দানবাক্সে এবার মিললো ২৭ বস্তা টাকা
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি