X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

মেটামরফসিস।। অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের গল্প

জাহেদ সরওয়ার
২৯ জুন ২০১৮, ১২:৪২আপডেট : ২৯ জুন ২০১৮, ১২:৪৪

মেটামরফসিস।। অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের গল্প ফ্রানজ কাফকার ‘মেটামরফসিস’ নামের নভেলা অথবা বড় গল্প সম্ভবত তার লেখার ভেতর সবচেয়ে প্রচার পাওয়া। যুগ যুগ ধরে এটা নিয়ে তর্ক বিতর্ক চলছেই। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বলেছিলেন তিনি শুধু প্রথম লাইনটা পড়েই অনস্তিত্বের দ্বন্দ্বে পড়েছিলেন। আর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন গল্প লিখবেন। অনেককেই প্রভাবিত করেছিল এই বইয়ের প্রথম লাইনটা ‘একদা ভোরবেলা এক অস্বস্তিকর স্বপ্ন দেখার পর ঘুম ভেঙ্গে গেলে বিছানায় শুয়েই গ্রেগ্রর স্যামসা দেখতে পেল যে, সে একটা ভয়াবহ পোকায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে।’ এটা ওরাকলের ভবিষ্যত বাণীর মতো মনে হয় প্রথমবার শুনলে। মানুষ কী করে ভয়াবহ পোকায় রূপান্তরিত হয়? এটা আসলে একটা ঘোষণা একই সাথে অস্তিত্ব আর অনস্তিত্বের। মেটামরফসিসের বহুরকম ব্যখ্যা আছে। এখনও এটা নিয়ে নতুন নতুন পাঠ তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে। 

গ্রেগর স্যামসা একটা চালু কোম্পানির একজন ব্যস্ত সেলসম্যান। সেই তার সংসারের অন্ন জোগানদাতা। সুতরাং পরিবার বা সমাজের অনেক কিছুর সাথেই তার সম্পর্ক গড়ে ওঠবে এটাই স্বাভাবিক। এইরকম একজন মানুষের অনস্তিত্ব বা অন্য প্রাণিতে রূপান্তরিত হয়ে যাবার কারণে পরিবার কর্মক্ষেত্র ও সমাজের সাথে যে তার সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি হতে পারে সেটার মারাত্মক একটা খেলা মেটামরফসিস। গ্রেগরের দিক থেকে সেটা অস্তিত্বের প্রশ্ন। একজন উৎপাদনশীল মানুষের অনুৎপাদনশীল হয়ে যাওয়া। পুঁজিবাদের এই ভয়াবহ শ্রমশোষণ। সে কাউকেই শ্রমবিহীন থাকতে দেবে না। আমৃত্যু সে অন্যের শ্রম শোষণ করে বাঁচে। যে শ্রম দেওয়ার যোগ্য নয় তার যেন বেঁচে থাকার অধিকারই নাই তার দুনিয়ায়। কাফকা গ্রেগর স্যামসাকে একেবারে মেরে ফেলতেও পারতেন। কিন্তু তাকে তিনি মেরে ফেলেন নাই। অন্য একটা প্রাণিতে ট্রান্সফার করে দেখেছেন পরিবার সমাজ আর অফিসের কাছে ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়।

জীবনানন্দ বলেছিলেন, ‘যে জীবন শালিকের দোয়েলের মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা।’ আর সত্যিকার অর্থে তিনি যদি শালিক দোয়েলে রূপান্তরিত হতেন তাহলে হয়ত আমরা দেখতে পেতাম তাকেও গ্রেগর স্যামসার অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। জগতে অনেক কবি সাহিত্যিকের এই মেটামরফসিসের অভিজ্ঞতা আছে। অন্য প্রাণিরা যেন ধর্তব্যই নয়। আবার এই ধর্তব্যহীনতাই যেন সাধারণ মানুষের কাম্য। সেটাই যেন সাধারণের অস্তিত্ব সেটা ক্যাপিটালিজমের কাছে অনস্তিত্ব।

পোকা হয়ে যাবার পর গ্রেগরের প্রথম ভাবনা হচ্ছে ‘ প্রত্যেকদিন সাতসকালে বিছানা থেকে ওঠার চেয়ে বাজে ব্যাপার আর কিছুই হতে পারে না।... বাবা-মার ভরণপোষণের ঝক্কি না থাকলে কিছুতেই আমি এ চাকরি করতাম না। সোজা খোদ কর্তার কাছে গিয়ে বলতাম, দিনরাত ঘুরে ঘুরে চাকরি করা আমার পোষাবে না।’

এখন মূল প্রশ্নটা কোথায়? এই জগতে জন্ম নেয়া প্রতিটি প্রাণিরইতো জগতে খেয়েপড়ে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এটা সে জন্ম নেয়ার পরপরই অটোমেটিক তৈরি হয়। কিন্তু সেই অধিকার থেকে সে জন্মগতভাবেই বঞ্চিত। নিদেনপক্ষে তার পছন্দসই একটা কাজ পাওয়ার অধিকারও তার জন্মগত। কিন্তু প্রায়শই সে তা পায় না। আধুনিক অফিস সভ্যতায় সারাদিন কাজ করে একজন মানুষের কাছে তার নিজের জন্য আর কোনো সময় থাকে না। সে পরিণত হয় স্রেফ একটা মেশিনে, উৎপাদনের টুলে।

শুধু বুদ্ধিমান প্রাণি হিসাবে মানুষের ক্ষেত্রেই এটা ঘটে। অন্যান্য প্রাণিরা কিন্তু তাদের নিজেদের জন্মগত অধিকার নিয়েই বেঁচে থাকে। তাদের বনে-বাদাড়ে। যদি মানুষ নামের প্রাণিটা কারো জন্যই পৃথিবী নিরাপদ রাখেনি। তবুও অন্যান্য প্রাণিদের খাদ্য সংগ্রহ বা বাসস্থান তৈরি মানুষের মতো এত কঠিন হয়ে পড়েনি। সেটা শালিক দোয়েল বা আরশোলা যাই বলি না কেন।

আরও কী কী কারণে অফিস-সভ্যতাকে কাফকা সমর্থন করেন না দেখা যাক। গ্রেগরের উপলব্ধি- এই ফার্মের সবচেয়ে নোংরা ব্যাপার হল কেউ কাজে একটু ঢিলে দিলেই তাকে যাচ্ছেতাই সন্দেহ করে বসা। এরা কি মনে করে? কিছু পা-চাটা কর্মচারী বাদে সবাই কি অপদার্থ?

পুঁজিতো তাই চায়। কেটে ছেটে সে তার নিজস্ব ধরনের কর্মী তৈরি করে। প্রায় প্রতিটি কর্পোরেট অফিসের নিজস্ব নিয়মকানুনের আলাদা কেতা আছে, ইউনিফর্ম আছে। গৃহপালিত কুকুরের গলায় বাধা চেনের মতো গলায় ঝুলানোর কার্ড আছে। সেসব মানতে মানতে মানুষও হয়ে পড়ে গৃহপালিত। পৃথিবীর অধিকাংশ কর্মচারীদের আলাদা কোনো জীবন নাই। নিজের অস্তিত্ব থেকে ক্রমশ সে সরে গিয়ে অফিসের অস্তিত্ব ধারণ করে। বিনিময়ে অফিস তাকে দিচ্ছে বেঁচে থাকার অন্ন। আর সে বেঁচে থাকছে পরেরদিনও তার অফিসের জন্য। নিজের জন্য তার কোনো জীবন নাই। এই শূন্যতায় বহু গল্প কবিতা গান দর্শন হয়েছে। তাতে মানুষের আত্মসাধন হয় না। নিজেকে নিজে চিনতে পারে না। দুদণ্ড শান্তি তার নাই।

গ্রেগর স্যামসা পোকায় রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ার পর তার বাড়িতে ছুটে আসে অফিসের ম্যানেজার। সে চায় না তার একজন কর্মী একদিনও ছুটি নিক। তার কর্মীও কোনো অসুখ বিসুখ হোক। এমনকি অনেক অফিসে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সেবা দিয়ে কর্মীকে সচল রাখার পদ্ধতিও আছে। ম্যানেজার এসেই পরিস্থিতি না বুঝেই মেশিনের মতো তার অফিসিয়াল বুলি আওড়াতে থাকে। একদিকে গ্রেগর চেষ্টা করছে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে সেটা কেউ বুঝতেই পারছে না। তার অল্পস্বল্প নাড়াচাড়া উপলব্ধি করেই ম্যানেজার বলতে থাকে, ‘দেখ স্যামসা তোমাকে উপদেশ দেবার ইচ্ছা আমার নাই। তবে আমার যতদূর মনে হচ্ছে তোমার শরীর এমন একটা কিছু খারাপ নয় যাতে করে...। তিনি ইশারায় বলেন যা কিছু বলার। কারণ অফিস-সভ্যতার স্লোগনই কথা কম কাজ বেশি। এরপর তিনি মোক্ষম কথাটি বলেন, যাহোক আমরা বুঝি ব্যবসা, কাজ চাই। আমি বলছি, তুমি আজ অফিসে এসো।’

মানুষকে বোঝার ক্ষমতা অফিসের নাই। সে উৎপাদনের মেশিন ছাড়া তার কাছে আর কিছু নয়। সে চায় কাজ আর কাজ। জন্ম মৃত্যু কবিতা সাহিত্য দর্শন এসবই তার কাছে বাহ্য। এটা একটা সিস্টেম বুর্জোয়াদের তৈরি। এই সিস্টেমের ভেতরই অজস্র মানুষ নিজের অস্তিত্ব নিয়ে বিপন্ন। এই যে গার্মেন্টের এত এত শ্রমিক, তাদের খাবার-দাবার জীবন যাপনের মান নিয়ে মালিকদের কোনো ভাবনা চিন্তা নাই। ভাবনা চিন্তা নাই বললে ভুল বলা হবে। তারা ভাবে যাতে তাদের সমস্ত প্রাণিতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদের শ্রম শোষণ করা যায়। তাদের তিন ঘণ্টা শ্রমের মজুরি দিয়ে কিভাবে বাকি সাত ঘণ্টার শ্রম চুরি করা যায় সেটাই তাদের ভাবনা। আর তাদের সম্মুখ থেকে সরিয়ে দেয় হয় বেঁচে থাকার বাকি সব উপাদান।

শুধু কী অফিস- পরিবারও একটা অফিসের মতো আসলে। কারণ সেটাও বর্তমান সিস্টেমের অংশ হয়ে পড়েছে। গ্রেগর সম্পর্কে অফিসের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর সাথে সাথে পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে থাকে। গ্রেগর চেয়েছিল তাদের সহমর্মিতা। কিন্তু এতদিনের পরিচিত পরিবার আস্তে আস্তে তাদের সমর্থন তুলে নিতে থাকে। কারণ গ্রেগর এখন অনুৎপাদনশীল। সে পরিবারের ভরণপোষণ করতে এখন অপারগ। এরপর পরিবারের অনেক অজানা বিষয় বেরিয়ে আসতে থাকে। পরিবারের বাকি সদস্যরা যারা এতদিন গ্রেগরের ইনকাম নিয়ে চলতো তাদের অস্তিত্বেও টানাপোড়েন শুরু হয়। তারা প্রথমে গ্রেগরের প্রতি সহানুভূতি দেখায় পরে করুণা দেখায়। এরপর গ্রেগরের অস্তিত্বই মুছে ফেলার পরিকল্পনা করতে থাকে। এই গল্পের মারাত্মক ক্লাইমেক্সটা হচ্ছে আরশোলারূপী গ্রেগরের মৃত্যু। এই মৃত্যুতে যেন কারোই কোনো কিছু আসে যায় না। গ্রেগর ছাড়া তার পরিবার যেন মুক্তি পায়। তারা নতুন করে বাঁচার জন্য এই ফ্ল্যাট ছেড়ে দেয়। এ যেন এক মহাযাত্রা অস্তিত্ব আর অনস্তিত্বের।

 

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’