মরুভূমি
শহরগুলো লুপ্ত হয়, আর পৃথিবী যে ধুলো ভরা এক ঠেলাগাড়ি,
শুধু কবিতা জানে কীভাবে ভরাতে হয় এই শুন্যতা।
এই বাড়িতে যাবার কোনো রাস্তা নেই, একটি অবরোধ চলছে,
আর তার বাড়ি আসলে খোদ কবরখানাই।
কিছুটা দূর থেকে, তার বাড়ির ওপরে
এক কিংকর্তব্যবিমূঢ় চাঁদ ঝুলছে
ধুলোর সূতা বেয়ে।
আমি বলেছি : বাড়ি যাবার এটাই রাস্তা, সে বলল : না
তুমি যেতে পার না, আর তার বুলেট ছুড়ে মারল আমার দিকে।
খুব ভাল তাহলে, বন্ধুরা আর তাদের বাড়িগুলোই
হয়ে উঠল গোটা বৈরুত জুড়ে আমার সঙ্গী-সাথি।
এখন তবে রক্তের জন্য পথ—
সেই রক্ত যার কথা একটি বালক
ফিসফিসিয়ে বলেছিল তার বন্ধুদের কাছে:
আকাশে এখন গর্ত ছাড়া আর কিছুই নেই
যাদের ডাকা হয় ‘তারা’ নামে।
শহরের কণ্ঠস্বর ছিল বড্ড কোমল, এমনকি বাতাসও
বাঁধবে না তার সেই স্বরে—
শহরের মুখ আলোকদীপ্ত
যেনবা কোনো শিশু রাত নামার জন্য গুছিয়ে নিচ্ছে তার স্বপ্নাবলী
আর সকালকে নির্দেশ দিচ্ছে ওর বিছানার পাশের চেয়ারে বসে থাকতে।
তারা মানুষজনকে খুঁজে পেল থলেতে:
একটি মানুষ মুণ্ডু ছাড়াই
একটি মানুষ হাত ছাড়াই, অথবা
জিহ্বা ছাড়া
একটি মানুষ গলা টিপে মেরে ফেলা।
বাকিদের আকারো নেই, নেই যে নাম।
—তুমি কি পাগল? দয়া করে
লিখো নাকো এসব নিয়ে।
খোলা বইয়ের একটি পাতা
তার ভেতরে বোমাগুলো আরশিতে মুখ যে দ্যাখে।
ভবিষ্যদ্বাণী যত আর ধুলো-বসা প্রবাদবাক্য
এর ভেতরেই আরশিতে মুখ দ্যাখে।
বনপথের একাকীত্ব এর ভেতরেই আয়না দ্যাখে, বর্ণমালার বুননে গড়া গালিচা এক
সূতোয় সূতোয় ফাঁস খুলে যায়
পরে যায় নগরীর মুখের উপর, স্মৃতির সূঁচি মুখ থেকে গলিয়ে আসে।
নগরীর বাতাসে এক হন্তারক, নগরীর ক্ষতের ভেতর সাঁতার কাটছে
তার ক্ষতস্থান যেন এক পতন
যা কিনা কাঁপত এই নগরীর নামে— কাঁপত নগরীর নামে রক্তপাতের নামে
আর যা কিছু আমাদের ঘিরে রাখে—
বাড়িগুলো চলে গেলে পেছনে দেয়াল ফেলে রেখে
এবং আমি আর নই আমি।
হতে পারে এমন একটি সময় আসবে যখন তুমি মেনে নেবে
বোবা ও কালা জীবন, হতে পারে
তারা তোমাকে অনুমতি দেবে অস্ফূটস্বরে কথা বলার : মৃত্যু
এবং জীবন
পুনরুজ্জীবন
এবং আপনার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক।
তাল-রসের মদিরা থেকে মরুর সুনসান নিভৃতি...ইত্যাদি
একটি সকাল থেকে যে নিজেই নিজের অন্ত্র চোরাচালান করে
আর ঘুমিয়ে থাকে বিদ্রোহীদের শবস্তুপের উপর...ইত্যাদি ইত্যাদি
সড়ক থেকে, সিপাই ও সেনাদের ট্রাক থেকে...ইত্যাদি
নর ও নারীদের ছায়া থেকে...ইত্যাদি
একেশ্বরবাদী ও অবিশ্বাসী কাফেরদের প্রার্থনায় লুকনো বোমাগুলো থেকে...ইত্যাদি
লোহা থেকে যা নিঃসরণ করে লোহা আর রক্ত মাংস...ইত্যাদি
ক্ষেত থেকে যে হাহাকার করে গম, ঘাস ও কৃষকের হাতের জন্য...ইত্যাদি
কেল্লা থেকে যে রক্ষা করে আমাদের দেহগুলো
আর আমাদের উপর স্তুপ করে জড়ো করে অন্ধকার...ইত্যাদি
মৃতদের কিংবদন্তী থেকে যারা জীবনকে উচ্চারণ করে আমাদের জীবনকে, করে চালনা...ইত্যাদি
আলোচনা থেকে যা কিনা হত্যা এবং হত্যা এবং গলদেশে
ছুরির পোঁচ...ইত্যাদি
অন্ধকার থেকে অন্ধকার থেকে অন্ধকার
আমি শ্বাস নিই, স্পর্শ করি আমার দেহ, খোঁজ করি আমার নিজের জন্য
এবং তোমার জন্য, এবং তার জন্য, এবং অন্যদের জন্য।
এবং আমি মৃত্যুকে ফাঁসি দিই
আমার মুখ ও কথার এই রক্তপাতের মাঝে...ইত্যাদি
তুমি দেখতে পাবে—
বলো তার নাম
বলো তুমি তার মুখ কাছে টেনেছিলে
বাড়িয়ে দিয়েছিলে হাত সেই ছেলেটির দিকে
অথবা হেসেছিলে
অথবা হেসেছিলে
অথবা বলো আমি একদা সুখি ছিলাম
অথবা বলো আমি একদা ছিলাম বিষণ্ন,
তুমি দেখবে:
সেখানে কোনো দেশ নেই।
হত্যা বদলে দিয়েছে এই নগরীর আকৃতি— এই পাথরটি
একটি শিশুর মস্তক—
এবং এই ধোঁয়া মানবীয় ফুসফুস থেকে নির্গত।
প্রতিটি বস্তুই আবৃত্তি করে তার নির্বাসন...রক্তের
সমুদ্র এক— এবং
অন্ধকারে ধমনীদের পাল তোলা ছাড়া কি তুমি প্রত্যাশা করো
এইসব সকালবেলায়, হত্যার এই জোয়ার লগ্নে?
এই মেয়েটির (নগরীর) সাথে থাক, তাকে ছেড়ে দিও না—
মৃত্যুর আলিঙ্গনে সে বসে থাকে
আর তার আয়ুষ্কালের দিনগুলোর উপর
নির্বিকার উল্টে চলে যত ছেঁড়া পাতা।
তার মৃত্তিকা বিন্যাসের
শেষ ছবিগুলো পাহারা দাও—
বালুর ভেতর সে মুচড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে
ঝলকানির মহাসমুদ্রে—
তার দেহের উপরে ফুটে উঠছে মানবীয় গোঙানির দাগ।
বীজের পর বীজ মাটিতে ফেলা হচ্ছে—
আমাদের কিংবদন্তীর উপর ভূমিগুলো খাওয়াচ্ছে আমাদের,
পাহারা দিচ্ছে রক্তের রহস্য।
ঋতুগুলোর কাছে আমি বলছি একটি সুগন্ধের কথা
এবং আকাশে একটি বিদ্যুচ্চমকের কথা।
মিনার চত্বর— (একটি খোদাই প্রস্তর তার গোপণ কথাটি ফিসফিস করছে
বোমা-বিধ্বস্ত ব্রিজগুলোর কাছে...)
মিনার চত্বর— (একটি স্মৃতি তার আকৃতি খুঁজছে
ধুলো ও আগুনের ভেতর...)
মিনার চত্বর— (একটি উন্মুক্ত মরুভূমি
যাকে পছন্দ করেছে বাতাস এবং তারপর বমি করে দিয়েছে—
বাতাসের মাধ্যমে বমনকৃত...)
মিনার চত্বর— (এটা যাদুকরী
শবদেহগুলো নড়তে দেখা/নাড়াচ্ছে তাদের অঙ্গ যত
একটাই গলিপথে, আর তাদের ভুতগুলো
একে অপরে নিবিষ্ট/আর শোনা তাদের যত দীর্ঘশ্বাস...)
মিনার চত্বর— (পশ্চিম ও পূর্ব
ফাঁসিকাঠ তৈরি—
শহীদেরা, নির্দেশ...)
মিনার চত্বর— (কাফেলার
ভিড় : সুগন্ধ
এবং আরবের আঠা আর মুখোশ
আর মশলা যা সূচনা করে উৎসব...)
মিনার চত্বর— (সময়কে পার হতে দাও...
স্থাণের নামে)
—ধ্বংসের যত শবদেহ,
এই কি বৈরুতের মুখ?
—এবং এই
যে একটি ঘণ্টা, অথবা একটি আর্তনাদ?
—একজন বন্ধু?
—তুমি? স্বাগত।
তুমি কি ভ্রমণ করেছ? তুমি কি ফিরে এসেছ? নতুন কি ঘটেছে তোমার?
—একজন প্রতিবেশী খুন হয়েছেন.../
. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .
একটি খেলা/
—তোমার পাশা থেকে কষ বেরোচ্ছে।
—আহ, নেহাতই একটি সমাপতন।
. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .
অন্ধকারের যত স্তর
আর কথারা টেনে আনে আরো যত কথা।
আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ : খালেদ মাত্তাওয়া,
আদোনিসে’র ‘নির্বাচিত কবিতা’ থেকে গৃহীত (ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস, ২০১০)পুনর্মুদ্রণ
(সাম্প্রতিককালে বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় ১০টি লেখা ঈদুল আযহা উপলক্ষে ক্রমান্বয়ে পুনর্মুদ্রণ করা হলো।)