ভাষাদের শস্যদানা
০১
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে আমরা অনেকেই সাঁতার প্র্যাকটিস করতাম। আমাদের
অনেকের সাথে মহাকবি কালিদাসও সাঁতার প্র্যাকটিস করতে আসতেন। তিনি বলতেন,
জলের নিচে শ্বাস নাও; মনে রেখো জলের নিচে শ্বাস নেওয়ার অর্থ ‘প্রেম’; যেখানে সুখের
বদলে বুকের গভীরে চেপে থাকে সবুজ জলের সীমাহীন চাপ।
০২
আমার জাহাজি দাদাঠাকুর বোতলের ভেতর এক টুকরো প্রেমপত্র লিখে ভাসিয়ে
দিয়েছিলেন ভারত সাগরে। শুনেছি সেই থেকে কবিতার জন্ম। একশো বছর পর
দাদিঠাকুরণ সেই বোতলবন্দি প্রেমপত্র খুঁজে পেয়ে লুকিয়ে রাখলেন কোন এক কালো
পাথরের বাক্সে। আমি সেই কালো পাথরের বাক্সটি খুঁজছি। আমি তোমাকে ভালোবাসার
আগে কালো পাথরটির ঢাকনা সরিয়ে দেখতে চাই কী লেখা ছিল বোতলবন্দি-লিপিচিহ্নের
ভেতর।
কবিতা অর্থ, প্রেম। আর প্রেম অর্থ, শ্বাস ও প্রশ্বাসের সাথে ঝরতে থাকা লিপিচিহ্নের
অদৃশ্যপাঠ উদ্ধার।
০৩
সেলাই করা রাত্রির নিচে দাঁড়িয়ে মেয়েগুলো ভাবছে, ছেড়া আকাশের ভেতর দিয়ে
পৃথিবীতে শীত নেমে এলে আমরা সাতরাত সাতদিন কথা বন্ধ রেখে মৃতদের হাড়গোড়
গুণে দেখবো এ পর্যন্ত পৃথিবীতে কতজন মানুষের মৃত্যু হলো।
শীতঋতু আসতেই মেয়েগুলো হাড়হাড্ডি গুণতে শুরু করলো; তারপর গুণতে গুণতে এক
সময় বুঝতে পারলো এগুলোর একটিও মানুষের হাড়হাড্ডি নয়; সবগুলো পশুপাখি আর
গাছেদের কঙ্কাল। তাহলে মরার পর মানুষের হাড়হাড্ডিগুলো কোথায় যায়? এই
জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজতে খুঁজতে এক সময় মেয়েগুলো বুঝতে পারলো ওরা নিজেরাও
ক্রমশ পশু অথবা পাখিতে বদলে যেতে শুরু করেছে।
০৪
দেহ থেকে চলে গেছে ‘হৃদয়’। বুঝতে পারিনি। শুধু শরীর নিয়ে শুয়ে আছি আমরা। যে
হৃদয়ের জন্ম হয়েছিল আমাদের জন্মেরও আগে, তাকে আমি কায়রোর বন্দরে বসে
কাঁদতে দেখে আসলাম। রাত্রিগুলো গুছিয়ে নাও, যেতে হবে; শীত আসছে ঝাঁক ঝাঁক
হাঁসপাখি ছানাদের সাথে নিয়ে। এই শীতে আরও এক যুদ্ধের জন্য তৈরি হচ্ছে মানুষ; যে
যুদ্ধে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্ত থেকে অংশ নেবে পাখি, বাঘ আর কবুতর। দেখো, একটিমাত্র
চাঁদ কী অসম্ভব আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অপেক্ষায় আছে; অথচ এখনো ফিরলো না ‘হৃদয়’। রাত্রি
গুছিয়ে রাখছে আমাদের পড়ার টেবিল, যৌথঘুম আর আমাদের আয়ু।
বাদ-ফজর, আমরা ভাঁজ করে রাখলাম আমাদের যৌথঘুম ও বিশ্রাম। তালা দেয়া দরজার
বাইরে অপেক্ষা করছে সাত-আসমান, সাতটি বেহেশত; যে বেহেশতগুলো আমানত
রেখেছিল আমাদের শিশুরা আমাদের কাছে। হারিয়ে ফেলেছি চাবি;
বেহেশতের চাবি। ঘুম থেকে জেগে দেখতে পেলাম, রহমত চলে যাচ্ছে; তোমাকে আর আমাকে, একা
রেখে।
০৫
কলেজে যাওয়ার পথে একটি মেয়ের সাথে দেখা হতো আমার। প্রতিদিনই আমি
মেয়েটির চুলের ক্লিপ গুণে দেখার চেষ্টা করতাম; ক্রমশ ক্লিপের সংখ্যা হয়ে উঠতো
গণনাবিহীন।
অফিসে যাওয়ার পথে প্রায়ই একটা পাখির সাথে দেখা হচ্ছে আমার; পাখিটির পালকের
রঙ গণনার চেষ্টা করছি; গুণে শেষ করতে পারছি না।
০৬
শুনেছি বিশ্বাসীরা যে পথে যেতে ভয় পায় সেই পথ ধরে হাঁটলে পাওয়া যায় ফিনিক্স
পাখির কংকাল। আরো কিছুটা হাঁটলে পাওয়া যাবে মমিবৃক্ষ; যার প্রতিটি শেকড়ে জড়িয়ে
রয়েছে চন্দ্রবোড়া সাপ। সেইসব সাপেদের কোনোটি দ্রব্যগুণ বিশারদ, কোনোটি শক্তি
আবার কোনোটি বা ভার্চুয়াল বিদ্যার রঙে ভরাট ও শান্ত।
অনেক দিন হলো আমি মমিবৃক্ষের শেকড়ে লুকিয়ে থাকা সাপগুলোর ভেতর থেকে প্রেম
ও সৌন্দর্যের সাপটিকে খুঁজছি; যাকে প্রশ্ন করলে শিল্প বিষয়ে কোন উত্তর পাওয়া যাবে না;
বলা হবে অমীমাংসিত সৌন্দর্যই কবিতা; যাকে কবিগণ জ্ঞান হিসেবে দেখে আত্মপ্রসাদে
বিভোর। আমি সেই বিভোরতার সরোবর থেকে উঠে আসা জ্ঞানচক্রের সাপটিকে
দেখলাম; বুঝতে পারলাম, ‘অবিশ্বাসীরাই যথার্থ প্রেমিক’। এই বাণী লেখা হবে একদিন
কোন এক মানবীয় গ্রন্থে।
পাঠ-প্রতিক্রিয়া
‘কবিতা থেকে পাঠক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে’ এ ধরনের কথা হরহামেশা কানে আসে। কিংবা ‘এখনকার কবিতা বোঝা যায় না’ এমনটাও হয়তো অনেকে বলে থাকেন। তবে এ কবির কবিতাটি বেশ কয়েকবার পড়লাম। পড়ার পর মনে কোথাও যেন দাগ কেটে গেল। একটা গল্পের ছোঁয়ার ভেতর দিয়ে তিনি কবিতা বলে চলেছেন। মনে হয় গ্রামের সেই সহজ সেতুর ওপর দিয়ে আমাদের ভ্রমণ করিয়ে আনছেন নিজের কাছে। রূপ ও অরূপের মায়া দিয়ে ঢেকে রেখেছেন কবিতার বুনন দেহ। যা পাঠের সময় কোথাও কোথাও চমকে যেতে হয়। ‘জ্ঞানচক্রের সাপটিকে’ জমা দিয়ে আসতে হয় মহাকালের ইন্দ্রজালে। তবে পুরো কবিতাটি একটা গল্পের ডালপালায় ভরপুর। যেন গল্প গল্প ভাব দিকবিদিক ডানা মেলেছে। যা হয়তো আমাদের ভাবনাকে আরো অধিকতর উসকে দিতে সাহায্য করবে। এ ধরনের সহজতর কবিতা পাঠক পড়লে হয়তো কখনোই আর মুখ ফিরিয়ে নেবেন না। কবিকে শুভেচ্ছা। আগামীতে আরো নতুন চিন্তাবিশ্বে তার সাক্ষাত পাবো— এ কামনা করি।
[আমরা গল্প ও কবিতার সঙ্গে পাঠ-প্রতিক্রিয়া জুড়ে দেবার সীদ্ধান্ত নিয়েছি। যিনি পাঠ-প্রতিক্রিয়া লিখবেন তাকে শুরুতে জানতে দেয়া হয় না লেখকের নাম। আবার লেখক কখনোই জানতে পারবেন না পাঠ-প্রতিক্রিয়া কে লিখেছেন।–বি.স.]