X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১
ব্রাজিলের গল্প

ভালদির পেরেস, জুয়ানিতু এবং পোলোস্কেই ।। আন্তোনিও প্রাতা

অনুবাদ : হামীম কামরুল হক
১৭ অক্টোবর ২০১৮, ১৯:০০আপডেট : ১৭ অক্টোবর ২০১৮, ১৯:৩২

ভালদির পেরেস, জুয়ানিতু এবং পোলোস্কেই ।। আন্তোনিও প্রাতা প্রথম কথা হলো এই মহল্লার সবারই কেনাকাটার সামর্থ্য একইরকমের, এবং যে মাথাপিছু আয় তাতে একটি বাইসাইকেল, একটি ফুটবল এবং এক বাক্স খেলনা মোবাইল, কিছু খেলনা বাড়ি এবং হাবিজাবি আরো অনেক কিছু তাতে কেনা যায়। সঙ্গে অবমুক্ত করা ৮২-এর বিশ্বকাপের স্টিকার। যাই হোক, আমাদের সম্পদের বণ্টনে একটু পরিবর্তন লক্ষ করছিলাম: কেউ পেল একদিনে পাঁচ প্যাকেট, অন্যদের থাকত দশ প্যাকেট বরাদ্দ, কিন্তু সত্যিকার অর্থে এটা আমাদের মহল্লায় অর্থনৈতিক সাম্যের জন্য হুমকিস্বরূপ ছিল না। যখন সব কিছুই বলা ও করা হয়ে গেছে, তখন সবচেয়ে দুর্লভের জন্য আর কোন জ্বালাযন্ত্রণা বাকি থাকতে পারে—সোক্রেতিস, মারাডোনা এবং পাওলো রসি—এবং তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা তাদের নকল—ভালদির পেরেস, জুয়ানিতু এবং পোলোস্কেই—আমরা সবাই সরবরাহ ও চাহিদার নিয়ম জেনে গিয়েছিলাম, এবং আমরা বুঝেছিলাম মধ্যবিত্ত সমাজের আনন্দ-বেদনাগুলি। যদ্দিন না সেই দিনটি এল, যখন রোদ্রিগু তার রিমোট কন্ট্রোল জিপ নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হলো।

***

রোদ্রিগুর বাবা আমাদেরই পড়শি। থাকতেন আমাদের বাড়িরই বাঁ পাশে, ছিলেন একজন টেনিস খেলোয়াড়। বারো বছর বয়স থেকে উনিশ বছর  বয়স পর্যন্ত তিনি একটি ম্যাচও হারেননি। এটা যারা জানত, ধরেই নিয়েছিল, তিনি সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়দের একজন হতে চলেছেন, কিন্তু তার কুড়িতম জন্মদিনে এক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় তিনি কাঁধে যে আঘাত পান তাতে তিনি আর পাল্লা দিতে পারেননি। তখন থেকে তিনি বাড়িতেই সময় কাটাতেন আর শুনতেন রক গানের অনুষ্ঠান। পরিবারের ভার নিয়ে ছিলেন তার স্ত্রী, তিনি ছিলেন একজন অফথালমোলজিস্ট। তখন রোদ্রিগুর বাবা পাড়াপড়শিদের নানান সময় ডেকে ডেকে ব্যবসাবাণিজ্য নিয়ে আলাপ করতেন, তার কথায় কেউই তেমন ভরসা পেত না।

সপ্তাহের প্রত্যেক রাতে একই দৃশ্যের অবতারণা হতো। তিনি সম্ভাব্য ব্যবসায়িক পার্টানারকে তার টিভি রুমে ডেকে নিতেন, তাকে বিয়ার দিয়ে আপ্যায়ন করতেন এবং তারপর শুরু করতেন ফুটবল নিয়ে আড্ডাবাজি, যেটাতে মনে হতো তিনি আসল কথায় যাওয়ার আগে স্রেফ একটু ওয়ার্ম আপ করে নিচ্ছেন। তারপর একেবারে আলগা ধাঁচে তিনি সেই পড়শির কাছে জানতে চাইতেন গত রোববারে কোর্নেথিয়াসদের ম্যাচটা দেখেছে কিনা। এর উত্তরে তারা যা-ই বলত না কেন, তিনি এতে যোগ করতেন: ‘আসলে আমি নিজেও ওই  ম্যাচটি দেখিনি, কিন্তু আমি সেটা এখনই দেখতে যাচ্ছি।’ তার সঙ্গে আড্ডারত ব্যক্তি চোখেমুখের আগ্রহ ও বিস্ময় দেখে তিনি তার টেলিভিশন সেটের ওপর ঢাকনি দেওয়া তোয়ালে মতো কাপড়টা সরাতেন, যার তলে লুক্কায়িত একটা রূপালি রঙের চৌকো জিনিস। ‘এটা হলো ভিডিও ক্যাসেট প্লেয়ার।’ তিনি বর্ণনা করতেন, ওই নতুন জিনিসটার দিকে তর্জনী তুলে, তাঁর শ্যালক, সবেমাত্র ইউ.এস. এ থেকে ফেরা, এটি নিয়ে এসেছে। ‘এটাতে অনুষ্ঠান রেকর্ড করা যায় এবং সেই রেকর্ড করা ছবি দেখা যায়, এ জিনিস তুমি কিনতে পারো বা ভাড়ায় পেতে পারো আমেরিকার যেকোনো রাস্তার কোণে কোণে।’

এই হাতেকলমে জিনিসটি দেখিয়ে বিষয়টি বিস্তারিত বর্ণনা করার শুরু হলো বিগত রোববারের খেলার সূত্রে, এতে দেখানো হলো ‘স্টার ওয়ার্স’ থেকে কিছু দৃশ্য এবং এর ক্লাইমেক্স, স্পষ্টতই, ‘ডিপ থ্রোট’, এটাও, যা তার শ্যালক একই যাত্রায় কিনে নিয়ে এসেছিল। ‘এটা বেশি দিন চালু থাকবে না,’ তিনি বলেন, ‘ যখন প্রত্যেকেরই ভিডিও ক্যাসেট প্লেয়ার হবে। প্রত্যেকেরই। আর তখন কী দশা হবে ভাবো তো এই চোখ ধাঁধানো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির?’ প্রাক্তন এই টেনিস খেলোয়াড় জিজ্ঞাসা করতো, নিজেকে বাতাস করতে করতে, কোনো কিছুকে কোনো রকম পাত্তা না দিয়ে অবলীলায় ওই পর্নোছবির ভিডিও টেপের কাভারটা দেখিয়ে। যদি তারা, পাড়াপড়শিরা মিলে, প্রত্যেকে দশ হাজার ক্রুযেইরো (সেকালে আস্ত একটা ফ্রিজের দাম) নিয়ে এগিয়ে আসে,  তাহলে তারা অ্যাডাল্ট ছবি ভাড়া দেওয়ার একটা দোকান খুলতে পারে, এবং মাত্র বছর খানিকের ভেতরে তারা পয়সাওয়ালা হয়ে যেতে পারে, তিনি কসম কেটে বলতেন।

ওই মহল্লার কেউ তার এই টোপ গিলল না।  কিছু লোক ভদ্রতাবশত, অন্যরা সেটা গিলল না, কারণ এই আইডিয়াটি এসেছে এমন এক লোকের কাছ থেকে যে তার দিন কাটায় পাথরের মতো, তার বাড়ির বসার ঘরে, শুনতে তাকে জেরো টুল, এবং একা একা গিটার বাজায়। একদিন রাতে, আমার কানে এলে, আমাদের বাড়ির ডানদিকের পড়শি, হেনরিকের বাবা তার স্ত্রীকে বলছেন, ‘ওই তাক লাগানো জিনিসটা  আসলেই দারুণ, কিন্তু ওটা গ্রিংগোদের জিনিস ছাড়া আর কিছু না। আমার কাছ থেকে এটি নেওয়া হোক, এই পাগলামিতে এখানে কোনো হৈহল্লা হবে না।’

রোদ্রিগুর বাবা, যাই হোক, হাল ছেড়ে দিলেন না: তিনি তার শ্যালকের কাছ থেকে কিছু টাকা নিলেন, কিছু জোগাড় করলেন ব্যাংক থেকে, আর স্ত্রীকে রাজি করিয়ে গাড়িটি বিক্রি করালেন এবং  একটা ভিডিও ভাড়া দেওয়ার দোকান খুললেন। ছয় মাস পর, ক্রিস্টমাসের সময়, তিনি তখনও বড়লোক হননি, কিন্তু তার অন্তত এতটা পয়সা হলো যে তিনি তার পুত্রকে ফোর বাই ফোর রিমোট কন্ট্রোল জিপ কিনে দিলেন।

***

ডিসেম্বরের পঁচিশ তারিখে, যেসময়টায় ক্রিস্টমাসের টার্কি খেতে বড়দের আরো কিছু সময় বাকি ছিল, বাচ্চারা ফুটপাতে হৈল্লায় মেতে উঠেছিল গতরাতে পাওয়া উপহারাদি নিয়ে। আমি মনোযোগ দিচ্ছিলাম প্লেমোবাইল থেকে নিজেকে সরিয়ে আনার, কেননা ঠিক সেই সময় কানে এল বোঁ বোঁ শব্দ—যেটা একটা মৌমাছি করে থাকে, তবে সেটিকে হতে হবে কমপক্ষে একটা বিড়ালের সমান বড়। আমাদের থেকে এক মিটার দূরে দেখি একটা ছোঁ মারতে উদ্যত জিনিসের মতো, একটা জিপ, মনে হলো লম্বায় চল্লিশ সেন্টিমিটার মতো। এটা পেছনে গেল, বাঁ দিকে ঘুরল এবং আমাদের ঘিরে চক্কর দিতে লাগল। যখন এটা ঠিক সে জায়গাটাতে এল যেখান থেকে এটা চলতে শুরু করেছিল, তখন রদ্রিগো হাজির হলো গাছের আড়াল থেকে, হাতে সেই রিমোট কন্ট্রোল আর  চোখে মুখে ফুটে উঠেছিল না লুকাতে পারা গর্ব। সে আমাদের দিকে হেঁটে এল, গভীর একাগ্রতার সঙ্গে, মুখের ভেতরে জিভ দিয়ে গালের একটা দিকে খোঁচা দিতে দিতে, যেন সে জিপটাকে কর ফাঁকি দিয়ে ভাগিয়ে নিচ্ছে। যখন সে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল, সে রিমোট কন্ট্রোলের ওপর দিয়ে তাকাল, এবং আমাদের ডানে তাকিয়ে বিরাট দেমাগের সঙ্গে বলল, ‘এটা কিন্তু আমেরিকান।’

আমরা স্থির চোখে খেলনাটিকে চুপচাপ দেখছিলাম, যখন রোদ্রিগু খেলনাটি দিয়ে আমাদের টাসকি লাগানোর ধ্যানে ছিল। তখন হেনরিকেস সাহস করে একটা প্রশ্ন করেই ফেলল, যে প্রশ্নটা আমাদের সবার মনে তখন জেগে উঠেছিল:‘আমি কি এটা চালাতে পারি?’ আর ঠিক এই প্রশ্নের জন্যই যেন রোদ্রিগু অপেক্ষা করছিল। ‘মোটেও না। তুমি তো জানোই না কীভাবে এটা চালাতে হয়, উল্টার চালাতে গিয়ে এটা তুমি ভেঙে ফেলবে।’ এ কথা বলে সে পিঠ ঘুরিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল, পাশে তার গাড়িটি, অবিকল ট্রেনিং পাওয়া কুকুরের মতো চলল তার সঙ্গে।

***

ই জিপটি হয়ে থাকতে পারত ওই মহল্লার একেবারেই আলাদা এক ব্যাপার—একটি বিশেষ পরিবারের উত্থান, যারা অল্প পরেই আরেকটি মহল্লায় চলে গিয়েছিল, পেছনে রেখে এসেছিল ঈর্ষা জাগানিয়া কিছু স্মৃতি—যদি না হেনরিকের বাবাও  কিছু অর্থকড়ি জোগানোর কাজ শুরু না করতেন।

হেনরিকের বাবা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার। কিন্তু তিনি ওই চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন দুই বছর আগে। এবং দায়িত্ব নিলেন একটা কার্পেটের দোকানের,  যেটি তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন তার পিতামহের কাছ থেকে, যিনি লেবানন থেকে এদেশে এসেছিলেন। প্রথমে তিনি কষ্ট করে বুঝতে চেষ্টা করলেন কীভাবে পুরো ব্যবসাটা চলে, এর ধারাগতি কী; এবং তিনি দোকানটা প্রায় বন্ধই করে দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু এ বছরের ভেতরে হাঁড়ভাঙা খাটুনিতে, তার বিক্রি বাড়তে শুরু করল।  তিনি জোনা নোর্তে এর একটা শাখাও খুললেন, এবং তার আয়-উন্নতি বাড়ার প্রথম নমুনা দেখা দিল ছ-মাস পর জিপের ওই ক্রিস্টমাসের পর, হেনরিকের জন্মদিনে।

সেদিন শেষ বিকাল, জুন মাস। রোদ্রিগু আর আমি আর্জেন্টিনার গোলকিপার ফিইয়োলের স্টিকার জমানো নিয়ে পাল্লা দিচ্ছিলাম যে সময়টায় অন্যরা আমাদের দেখছিল, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বা বাইসাইকেলে বসে। ঠিক সে সময়  আমার বোঁ বোঁ  শব্দটা পেলাম, রোদ্রিগুর জিপের চেয়েও  শব্দটা ছিল জোরালো—তিনটা মৌমাছি মিলে যেমনটা শব্দ করতে পারে যদি সেটা হয় আকারে তিনটা বিড়ালের সমান। যখন আমরা ফিরলাম, আমরা দেখলাম হেনরিকে আমাদের মুখোমুখি, চোখে কালো চশমা, ব্যাগি উর্দি পরা, সে বসেছিল ছোট একটা ইলেকট্রিক মোটর বাইকে, অবিকল ‘চিপসে’ ব্যবহৃত গাড়ির মতো, টেলিভিশানে হাইওয়ে পুলিশদের কর্মকাণ্ড নিয়ে যে-টিভি সিরিজটা হতো। সে এগিয়ে গেল পার্কল্যান্ডের দিকে, যেটা রাস্তার শেষে, যেটাকে আমরা ‘বুশ’ নামে ডাকতাম, তারপর ফিরল, ধীরেসুস্থে যেভাকে জন বার্কার বা ফ্রাঙ্ক পোনচেরেল্লো ঠাঁট নিয়ে ফেরে, ওই যে টিভি সিরিজের পুলিশরা। রোদ্রিগু ভাব দেখাল যে, এসব দিয়ে তার বোধ করবার কিছু নেই, কিন্তু যখন সে হাতে চাপড় দিয়ে স্টিকার লাগাতে গেল, ফিইয়োল তার হাতের তালুর ঘামে আটকে গেল।

সেই থেকে পরে, আর কারো জিপ নিয়ে আগ্রহ রইল না। সবাই আমরা চিন্তা করলাম চিপসের মোটরবাইকের মতো কিছু নিয়ে। মাঝে মাঝে হেনরিকে আমাদের কাউকে কাউকে তাতে চড়তে দেয়, কিন্তু তা একেবারেই মাঝেমধ্যে, এবং এমন কি সে দৌড়ে পাশে চলে আসে। ‘না না, এত জোরে না, এটা ভেঙে যাবে তো!’ ‘সাবধান দেখো, গর্তটর্ত দেখো চলো,’ ‘শুধু ওই গাছটি পর্যন্ত এর পর ফিরে এসো।’

হেনরিকের রাজত্ব কয়েকমাস টিকল, ক্রিস্টমাসের আগ পর্যন্ত সেভাবে আর ঠাটবাট ভয় দেখানোর মতো আর কিছু এল না, কিন্তু আশির দশকের শুরু গতে পর্নো ইন্ডাস্ট্রি ঘূর্ণি ঝড়ের মতো এল, যেটার লক্ষণ মিলল সেপ্টেম্বরে, একেবারে গড়পরতায় মঙ্গলবারে, তখন এল রোদ্রিগুর পাল্টা জবাব।

***

প্রায় দুপুর হয় হয়, এসময় আমরা ফ্রাঞ্চেস্কার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কাজে ব্যস্ত, আর্নেস্তোর অস্ট্রেলীয় এই টিয়াপাখিটা মরে গেল। লাল চুলের এর্নেস্তো থাকত মহল্লার রাস্তা শেষ প্রান্তে। অস্ট্রেলীয় টিয়াপাখিটা মান মর্যাদায় কুকুর বা বেড়ালের স্তরেও ছিল না, ছিল না এমন কি কচ্ছপ বা ধেঁড়ে ইঁদুরের মতোও। এর্নেস্তো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানটার আয়োজন করেছিল পাখিটার প্রতি তেমন কোনো দরদ ছাড়াই, যেটা কিনা এক সকালে  এর খাঁচার তলের দিকে মরে শক্ত হয়ে পড়েছিল, খুব বেশি হলে এর জন্য স্রেফ মাটি চাপা দেওয়াই যথেষ্ট ছিল। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পদযাত্রা শুরু হয়েছিল এর্নেস্তোর বাড়ি থেকে কাছের একটা ঝোঁপের দিকে, সেটা খুব বেশি হলে চল্লিশ মিটার দূরে, যেখানে ছোট্ট কবরটি আমাদের অপেক্ষায় ছিল, ইতিমধ্যে সেটা গাছের ডাল আর লালিপপের কাঠি দিয়ে খোঁড়া হয়েছিল, পেতে দেওয়া হয়েছিল ভায়োলেট ফুলের শয্যা। মরা পাখিটা ছিল একটা জুতার বাক্সে, আনা হচ্ছিল হেনরিকের মোটরবাইকে দিকে, যেটা ওই শববাহনের জন্য অপেক্ষায় ছিল, এর্নেস্তো হাঁটছিল একটা হাত মোটর বাইকের একটা হ্যান্ডোলের ওপর রেখে, সে যাতে তার গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারে, হেনরিকে সেটা নিশ্চিত করেছিল, আমি জানি না মৃত পাখির সম্মানে, নাকি এটা যে মোটর বাইকে বহন করা হয়েছিল—এই ঠাঁট দেখাতে এটা করা হয়েছিল।

আমরা তখন প্রায় ঝোপটার কাছাকাছি চলে এসছিলাম। ঠিক তখন ওই ছোট্ট বাইকটার শব্দের প্রচণ্ডতায় আমরা একেবারে হতবিহ্বল হয়ে গেলাম, সেটা এতটাই প্রচণ্ড যে, মৌমাছির শব্দের সঙ্গে এর কোনো তুলনাই চলে না, এমন কি সেটা যদি কোনো বাঘের গর্জনের সঙ্গেও হতো: যেটা আমরা শুনেছিলাম সেটা নির্ভুলভাবে কোনো ইঞ্জিনের ভেতরে জ্বালাও-পোড়াওয়ের শব্দ। শোকমিছিল থামল, আমরা পুরোই ঘুরে দাঁড়ালাম, এবং আমরা নিজেদের দেখতে পেলাম যে আমাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রোদ্রিগু, হেলমেট ও গ্লোভস পরা, এটা লাল ফাপিনাহ প্যারামবুলেটরের ওপর চড়া।

(বলা যেতে পারে ছোট্ট-প্যারামবুলেটর যেমন বাচ্চা ছেলেপেলের জন্য, তেমনি ফেরারি হচ্ছে বড় মানুষের জন্য—কারণ আমরা সবাই বড় হয়ে একাধারে গাড়ির প্রতি আকৃষ্ট হই না, যেখানে আট বছরের একটি ছেলে নেই যে ফাপিনাহ পাওয়ার স্বপ্ন দেখবে না। কিন্তু ওই ষাট থেকে আশির দশকের সময়টাতে বলা যেতে পারে একটা বাচ্চাছেলেপেলেও ছিল না যে, ওটা-যে একটা দারুণ লোভনীয় জিনিস এটা না ভেবে থাকতে পারত।)

সবকিছুই ছিল রোদ্রিগুর জন্য অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হতে যতক্ষণ লাগে, এবং হেনরিকের মোটরবাইকের ঠাটবাটের সময়ও শেষ হয়ে এসেছিল, কিন্তু রোদ্রিগু আরো বেশি কিছু চাইছিল। তার জিপের ঠাকঠমকের পতনের পর থেকে সে অনেকদিন যন্ত্রণা পুহিয়ে আসছিল এবং অন্য ছেলেটিকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত তার ‘চিপসে’র পোষাকে বিগত তিন মাসের কাছাকাছি সময় ধরে দেখে দেখে : সে কেবল তার ছোট্ট প্যারামবুলেটরে অন্যদের চড়ায়ই শুধু সেটা করতে করতে একেবারে ভচকানো দশায় এনে ফেলেছিল, তার সেই সদ্যনতুন জিনিসটাকে, কিন্তু সে যাত্রীদের সেই সিটে বসতেও প্রস্তাব করত, যেটাতে করে মৃত পাখি ফ্রেঞ্চাস্কাকে বহন করা হয়েছিল। হেনরিকে আসছিল পেছন পেছন, একা একা তার বাইকে, নিঃশেষিত ধোঁয়া নিশ্বাসে টেনে টেনে। এ ঘটনার পর সে এক সপ্তাহ চুপ করে রইল, রাস্তার কাঁকরে কাঁকরে লাথি মেরে মেরে, গাছের ডাল ভেঙে ভেঙে, পোকামাকড় ধরে কেটে কেটে এবং পিঁপড়াগুলি থেবড়ে থেবড়ে মেরে। সে জানতে যে এই পাল্লা-প্রতিযোগিতা একদিন শেষ হবে। এরপর তার বাবা তাকে কী কিনে দেবে? একটি ছোট হেলিকপ্টার? একটা ছোট সাবমেরিন? কোনো জায়গা আর বাকি ছিল না যাওয়ার, কেবল মাত্র ছাদে ধাক্কা খাওয়া ছাড়া:  একটাই পথ বাকি ছিল যাওয়ার, এখন থেকে, সেটা ছিল নিচের দিকে নেমে আসা।

***

তেইশ ডিসেম্বরে, ডিনারের পর, হেনরিকে আমার বাসায় এলো, একটু নার্ভাস দেখাচ্ছিল তাকে।  আমি তখনও খাবার টেবিলে বসে এবং আমার মা কেবলই প্লেট নিয়ে রান্নাঘরের দিতে গেছেন। ‘আমার একটা প্ল্যান আছে,’ সে ফিসফিস করে বলল, একটু উঁকি দিয়ে দেখল ভেতরে, না জানি কেউ সেটা শুনে ফেলে এই ভয়ে, এবং এরপর সে আমাকে ইশারা করল তার পিছে পিছে রাস্তায় বেরিয়ে আসার জন্য।

আমরা রোদ্রিগুর বাড়ির বাইরে এসে থামলাম। আমি হেনরিকেকে মনে করালাম যে আমাদের পড়শি বাড়িতে নেই এখন। সে ক্রিস্টমাসে সপরিবারে চিলিতে বেড়াতে গেছে তার জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখতে। রোদ্রিগু একটু হাসল। ‘এক্কেবারে কাঁটায় কাঁটায়!’ সে বলল। ঝোপের আড়াল থেকে একটা ঝাড়–র হাত বের করে এনে সদর দরজার দিকে তাক করল: দরজাটা লোহার তৈরি কাঠামোতে চারটি চতুর্ভূজাকৃতির টিনের প্রলেপ দেওয়া কাঁচ, একটার ওপরে আরেকটা। ‘যদি আমরা এসব ভেঙে ফেলি, তাহলে আমরা পেতে পারি।’ আমি বুঝলাম না ব্যাপারটা। যে জায়গাটা কাঁচ ছাড়াও আছে, সেটা যথেষ্ট আমাদের জন্য তা গলে বাড়ির ভেতরে ঢোকার জন্য, কিন্তু তা কখনোই এতটা বড় নয় যাতে আমরা ওই গাড়িটা বের করে নিয়ে আসতে পারি। ‘এটা তো প্যারামবুলেটারের বিষয় না।’ সে তার দাঁতে দাঁত চেপে বলল। একমাত্র তখনই আমি বুঝলাম : কী ফন্দিটা আমার বন্ধু এঁটে যাচ্ছিল, যেটা আক্রমণের প্রতীকী অর্থ তৈরি করবে। সে তার যুদ্ধে হেরে গেছে, সে এটা জানত, এবং সে তার এই শোধ নিচ্ছে তাদের শত্রুতা শুরু হওয়ার এক বছর পর, যে জিনিসটা এই সংঘাতের জন্য প্রথম দায়ী সেটা ছিল বাড়ির দোতলার রোদ্রিগুর রুমে, একটা কাপবোর্ডের পেছনে, সেই রিমোট কন্ট্রোল জিপটা। হয়তো রোদ্রিগু সেটা তার বিছানার তলে লুকিয়ে ফেলতে চাইছিল, অথবা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ভেঙে ফেলতে চাচ্ছিল এবং বাকি অংশটুকু ঝোপে ফেলে আসতে চাইছিল, আমি ঠিক জানি না : সবচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল এটা চুরি করে নিয়ে আসা।

আমার ভয় হতে লাগল, এমন কি আরো ভয় করতে লাগল তাকে এটা করতে নিষেধ করার জন্য, এবং যখন সে ঝাড়ুর হাতল দিয়ে হামামদিস্তার মতো দরজার কাচে আঘাত হানছিল, ভিরু কাপুরুষের মতো আমি স্রেফ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। প্রথম আঘাতে কিছুই হলো না, দ্বিতীয় আঘাতেও কিছু ঘটল না। তখন সে একটু পিছু হটল, যে সে নিজেকে একাগ্র করল এবং এই সময়, হ্যাঁ, সে করতে পারল সেটাই যা সে করতে চাইছিল অথবা এর কাছাকাছি : যেই মাত্র হাজানো খোলামকুচিতে কাচটা ভেঙে চূর্ণ হলো, শব্দটা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হলো পুরো রাস্তা জুড়ে, এবং আমরা দৌড়ে পালালাম, প্রত্যেকে যে যার যার নিজের বাড়িতে ফিরে এলাম। আমি জানি না কীভাবে, আমাদের কথা জানাজানি হয়ে গেল, বেড়ে-ওঠা ছেলেপেলেরা আমার সঙ্গে জুড়ে গেল যে এটা একটা কীর্তিময় ব্যাপার হয়েছিল, অন্যদিকে দরজাটা ঠিক করার জন্য যে খরচা হয়েছিল তাতে আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে হেনরিকের বাবা-মায়ের সম্পর্কচ্ছেদ হলো।

পরের মাসে, হেনরিকের পরিবার, যাদের তখন শহর জুড়ে  এখানে ওখানে কার্পেটের দোকান, তারা মৌনম্বির পেন্টহাউস অ্যাপার্টমেন্টে চলে গেল। এর থেকে খুব বেশি সময় পরে নয়, রোদ্রিগু এবং তার পরিবার চলে গেল জার্দিন আমেরিকার সুইমিংপুলওয়ালা বাড়িতে—সেই সময় পর্নো ভাড়া দেওয়ার সাতটি জায়গা কিনল সাঁউ পাউলুতে, দুটো হিউ জি জানেইরুতে এবং আরেকটা ব্রাসিলিয়াতে।

রোদ্রিগুরা চলে যাওয়ার পরের সপ্তাহে, এক রিয়াল স্টেটের এজেন্ট হাজির হলে ওই মহল্লায়, তার সঙ্গে এক যুগল নর-নারী। সে তার সম্ভাব্য ক্রেতাদের বাড়িটা দেখাল, এবং তার চলে যাওয়ার পর আমি দেখলাম সে ফিউজ-বাক্সে চাবিটা লুকিয়ে রাখল। সেদিনের পর রাতের বেলা আমার বাবা-মাকে না জাগিয়ে, আমি বিছানা থেকে নামলাম, সেই চাবিটা নিলাম ও সন্তর্পনে বাড়িটাতে ঢুকলাম। আমি হলঘর পেরিয়ে গেলাম, অন্ধকারে আমার পড়শিদের সেটা নজরে  আসার কথা ছিল না, সিঁড়ি ডিঙিয়ে আমি পৌঁছলাম আমার বন্ধুর সেই ঘরে, এবং কাপবোর্ড খুললাম যেখানে ওই জিপটা রাখা হতো। আমি জানি একটা বেতালের কাজ ছিল, বলতে গেলে অসম্ভব, কিন্তু আমার কি হারানোর ছিল কিছু? আমি পেলাম একটা নীল মোজা, একটা ন্যাড়া প্লেমোবাইল, ভালদির পেরেসের আটটা, তিনটা জুয়ানিতুর এবং সতেরোটা পোলোস্কেইর স্টিকার।

লেখক পরিচিতি :

আন্তোনিও প্রাতার জন্ম ১৯৭৭ সালের ২৪ আগস্ট, ব্রাজিলের সাঁউ পাউলু-তে। এ পর্যন্ত তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৯টি; এর ভেতরে আছে ‘ডাউগলাস’ (২০০১), ‘আস পেরনাস দা তিয়া কোরালিয়া’(২০০৩), ‘আদালতারাদো’(২০০৯), ‘মেইয়ো ইন্তেলেকতুয়াল, মেইয়ো দে এস্কেরদা’ (২০১০) এবং অতি সম্প্রতি ‘এলিগেটর, নো’ (২০১৬)। প্রকাশিত বইয়ের ভেতরে ‘ন্যুড ইন বুট’ (২০১৩) বইটিকে তার সেরা কাজ হিসেবে ধরা হয়। এছাড়াও ‘ফোলিয়া দা সাঁউ পাউলু’ পত্রিকায় সাহিত্য বিষয়ক কলাম এবং টেলিভিশনের জন্য লেখেন প্রাতা। ‘ভালদির পেরেস, জুয়ানিতু এবং পোলোস্কেই’ গল্পটি পর্তুগিয থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন দানিয়েল হান। নেওয়া হয়েছে ‘গ্রন্ত’ সংকলন থেকে। বর্তমান রচনাটি দানিয়েল হান-কৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় ভাষান্তর করা হয়েছে।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
রবিবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
রবিবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
চুয়াডাঙ্গায় ৪২ পেরোলো তাপমাত্রা, জনজীবনে হাঁসফাঁস
চুয়াডাঙ্গায় ৪২ পেরোলো তাপমাত্রা, জনজীবনে হাঁসফাঁস
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি