X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১
আর্জেন্টিনার গল্প

ওলিনহিরিস ।। সামান্তা শুয়েবলিন

অনুবাদ : আফসানা বেগম
১৭ অক্টোবর ২০১৮, ১৯:০২আপডেট : ১৭ অক্টোবর ২০১৮, ১৯:০২

ওলিনহিরিস ।। সামান্তা শুয়েবলিন ছয়জনের বসার জায়গা ছিল। আরেকজনের বসার জায়গা হল বাইরে, ওয়েটিং রুমে। আপনমনে বৃত্তাকারে পায়চারি করছিল সে। কয়েক মুহূর্ত লাগলেও সে বুঝতে পারছিল যে নিজের উচাটন মনটার গলা টিপে ধরতে হবে। হয়ত পরের দিন পর্যন্ত, কিংবা তার পরের অথবা আরো পরের কোনো দিন পর্যন্ত, যতদিন না তাকে তারা আবারো ডাকে। তার সঙ্গে এমনটা যে এই প্রথম হলো, তা নয়। যারা সাদা সিঁড়িগুলো বেয়ে দোতলায় উঠল তারা কেউই একজন আরেকজনকে ভালোভাবে চিনত না। কাপড় বদলানোর ঘরে চুপচাপ ঢুকে গেল তারা। নিজেদের হ্যান্ডব্যাগগুলো ঝুলিয়ে রাখল, গা থেকে কোটগুলো রাখল খুলে। একে একে হাত ধুয়ে নিল। একের পর এক আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো ঠিকঠাক করে নিল। কেউ উঁচু করে একটা ঝুঁটি বাঁধল, কেউ বা মাথার উপরে লাগাল একটা ব্যান্ড। প্রত্যেকে আন্তরিক আর নিঃশব্দ; মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি আর একই রকমের কৃতজ্ঞ ভঙ্গি। সারা সপ্তাহ ধরে তারা এটাই ভেবেছিল। কাজের সময়ে ভাবছিল, বাচ্চাদের দেখাশোনা করার সময়ে ভাবছিল, ভাবছিল খেতে খেতে, আর শেষপর্যন্ত তারা ওখানে উপস্থিত। ততক্ষণে কাজের নির্দিষ্ট ঘরে প্রায় পৌঁছে গেছে, কাজ শুরু করতে আর বাকি নেই।

ইন্সটিটিউটের একজন সহকারি দরজা খুলে তাদেরকে ঘরটির ভিতরে যেতে বলে। ভিতরে সমস্তকিছু সাদা রঙের। মেঝের মাঝখানে পায়ের তলায় চাকা লাগানো স্ট্রেচার। তার চারদিক ঘিরে ছয়টা চেয়ার। মাথার উপরের ফ্যানটা ধীর গতিতে ঘুরছে। কাঠের টুলের উপরে বিছানো তোয়ালায় ছয়টা রূপালি চিমটা সারি করে রাখা। স্ট্রেচারের উপরে একটি মেয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ছয়জন মহিলা তার দুপাশের ছয়টি চেয়ার দখল করে। শুয়ে থাকা মেয়েটার পায়ের দু’দিকে তিনজন করে তারা নিজেদেরকে সমানভাবে ছড়িয়ে দেয়। তারপর অপেক্ষা করতে থাকে। উপুড় হওয়া শরীরটার দিকে অস্থির চোখে তাকিয়ে থাকে। যেন বুঝতে পারে না যে তাদের হাতগুলো দিয়ে ঠিক কী করতে হবে। যেন টেবিলের উপরে রাতের খাবারের আয়োজন কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবে তা জানা নেই। সহকারি মেয়েটি তাদের চারপাশে ঘোরাফেরা করে। চেয়ার ঠেলে তাদেরকে স্ট্রেচারের আরো কাছে পাঠায়। তারপর একে একে প্রত্যেকের হাতে ছোটো তোয়ালা আর চিমটা দেয়। স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা মেয়েটি নীচের দিকে মুখ করে স্থির পড়ে থাকে। তার শরীর উলঙ্গ। সাদা একটা তোয়ালা দিয়ে তার কোমর থেকে দুই উরুর সংযোগস্থল পর্যন্ত ঢেকে রাখা। হাতের উপরে হাত ক্রস করে মুখটা মাঝখানে ডোবানো। কারণ এটাই নিয়ম যে, কেউ যেন তার মুখটা দেখে না ফেলে। তার চুলগুলো বাদামি, শরীরটা সরু। স্ট্রেচার থেকে কয়েক মিটার উঁচুতে ঝোলানো ফ্লোরেসেন্ট বাতিটা সহকারি মেয়েটি জ্বালিয়ে দেয়। ঘরটা আলোকিত হয়, সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে থাকা শরীরটা হয়ে ওঠে আরো উজ্জ্বল। বাতিটা সামান্য নিভু নিভু হয়ে ধপ করে জ্বলে উঠলে শুয়ে থাকা মেয়েটির শরীরটা সামান্য নড়ে। হাতের বাহু একটুখানি নাড়িয়ে সে নিজেকে সামান্য নতুন একটা অবস্থানে নেয়। মহিলাদের মধ্যে দুজন তার নড়ে ওঠা লক্ষ করে। সহকারি যখন তাদেরকে কাজ শুরু করার সংকেত দেয়, মহিলারা যার যার হাতের তোয়ালা চার ভাঁজ করে কাপড়ের পরতের বর্গক্ষেত্রটি স্ট্রেচারের উপরে নিজেদের সামনে রাখে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের চেয়ারটা ঠেলে স্ট্রেচারের সামনে আরেকটু এগিয়ে নেয়, কেউ কনুই রাখে স্ট্রেচারের উপরে, কেউ আবার শেষবারের মতো নিজের চুলগুলো ভালোমতো ঘাড়ের পিছনে পাঠায়। তারপর কাজ শুরু করে। চিমটাগুলো শুয়ে থাকা শরীরটার উপরে তাক করে। দ্রুত এক গোছা লোম বেছে নিয়ে চিমটায় চেপে টেনে তুলে আনতে থাকে। চিমটার মুখটা প্রথমে খোলে, তারপর গোছা লোম চেপে ধরে পরমুহূর্তে টেনে তোলে। প্রত্যেকবারে চিমটার চাপ থেকে ফেলে দেয়া লোমের গোছা চামড়াটাকে পরিষ্কার করে। প্রতিবার তোয়ালার উপরে চিমটা থেকে লোমটা ফেলে দেয়ার আগমুহূর্তে তারা সেদিকে তাকায়। আর তারপর পরের বারের জন্য তৈরি হয়। যেন ছয়টি সিগালের ছয়জোড়া ঠোঁট সমুদ্র থেকে ক্রমাগত মাছ সংগ্রহ করে। চিমটায় লোম উঠে এলে তারা শান্তি পায়। কেউ কেউ কাজটা অত্যন্ত সঠিকভাবে করায় মনোযোগ দেয়। কিছু গন্তব্যহীন লোম চিমটার মাথায় অসহায়ের মতো ঝুলতে থাকে। কোনো কোনো লোম যেন শরীরেই আটকে থাকতে চায়। তাদের টেনে তুলতে একাধিক চেষ্টা করতে হয়। তবে তাতে করে মহিলাদের কাজের আগ্রহ এতটুকু কমে না। সহকারি মেয়েটি স্ট্রেচারের চারদিকে হাঁটতে থাকে। চারপাশে ঘুরে ঘুরে লক্ষ রাখে যে মহিলারা ঠিকমতো কাজটা করতে পারছে কি না, ঠিক যেমনটা সে চায়। মাঝে কখনো সহকারি মেয়েটি একখানে দাঁড়িয়ে স্ট্রেচারে শোয়া মেয়েটির দিকেও তীক্ষ্ণভাবে তাকায়। ইনস্টিটিউটের নিয়ম অনুযায়ী তার মুখটা হাত দিয়ে ঢেকে রাখা সহকারির একদম পছন্দ হয় না। মুখ ঢেকে রাখলে চোখে চোখ রেখে বকাঝকা করা একেবারে অসম্ভব। তবে তার একটা নোটবুক আছে, যেটা সে তার অ্যাপ্রোনের পকেট থেকে খানিকটা বের করে রাখে। সেখানে সময়সুযোগমতো সমস্তকিছু লিখে রাখে। স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা মেয়েটি রাবারের স্যান্ডেলের প্যাচ প্যাচ শব্দ শুনতে পায়, শব্দটা তার কাছে এসে হুট করে থেমে গেলেও টের পায়। এই নৈঃশব্দ্যের মানে সে জানে। কোথাও কিছু একটা মনমতো হয়নি, কোথাও একটা কোনো ঝামেলা হয়েছে। আজ না হয় কাল সেসব একসঙ্গে করে তার পাওনা থেকে কেটে নেয়া হবে। দেখতে দেখতে তার পা ছোটো ছোটো গোলাপি বিন্দুতে ভরে যায়। তখন পাদুটো আর কাঁপে না। চিমটার খোঁচা খাওয়া অস্বস্তিও আর থাকে না। থাকে কেবল হালকা জ্বালাপোড়ার অনুভূতি।

স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা মেয়েটির বয়স যখন মাত্র দশ, সে তখন নদীর ধারে তার মায়ের সঙ্গে থাকত। জায়গাটা ছিল এমন যে প্রায়ই বন্যায় ভেসে যেত। সে তখন সেখান থেকে কয়েক মিটার উঁচুতে তার খালার বাড়িতে গিয়ে থাকতে বাধ্য হতো। সেই বাড়িটা পিলারের উপরে মাচার মতো করে বানানো। একদিন মেয়েটি তার খালার বাড়ির খাবার ঘরে কিছু কাজ করছিল। জানালা দিয়ে দেখতে পেল এক জেলে তাদের বাড়ির চারদিকে টহল দিচ্ছে, তাদের নিজেদের বাড়ির চারদিকে। জেলে নৌকা বেয়ে এসেছে যা গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। তার পায়ে উঁচু বুট যেটা হাঁটু পর্যন্ত উঠে তাকে পানি থেকে বাঁচাচ্ছে। সে দেখল জেলে তাদের বাড়ির একদিক থেকে উধাও হয়ে যায় আর আরেকদিকে উদয় হয়। জেলে জানালা দিয়ে বাড়ির ভিতরেও উঁকি দেয়। কিন্তু কোনো দরজা বা জানালায় সে টোকা দেয় না। মেয়েটির মা যখন বাড়ির ভিতর থেকে জেলেকে দেখতে পেল, হাতের ইশারায় তাকে ভিতরে আসতে বলল। স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা মেয়েটি যতক্ষণ পারে জানালা দিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মা জেলেকে চা খেতে বলল। তারপর তারা একসঙ্গে টেবিলে বসল। খানিক পরে সেখান থেকে তারা সরে গেল। স্ট্রেচারে শোয়া মেয়েটি যখন খালার বাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে ফিরে গিয়েছিল, জেলের মুখে মাছ ধরার গল্প শুনেছিল; নদীর গল্প আর নদীতে মাছ শিকারের কাহিনি। পরের দিন মেয়েটিকে মাছ ধরা দেখতে নিয়ে যাবার কথা বলেছিল সে। একে তো বন্যার সময়, তা ছাড়া স্কুলও ছিল বন্ধ, মা তাই আপত্তি করেনি। পরদিন নদী যেখানে লেকের মধ্যে গিয়ে পড়েছে, জেলে মেয়েটিকে সেখানে নিয়ে যায়। সেখানে নৌকা তেমন এগোচ্ছিল না, আয়নার মতো পানিতে ধীরে ধীরে পিছলে যাচ্ছিল কেবল। তবে মেয়েটির ভয় লাগছিল না। শুধু শীত শীত করছিল আর খিদেও পেয়েছিল বেশ। দিন তখন সবে শুরু, ভোরের আলো ফুটছিল। জেলে তার ছিপ তৈরি করল, হুকের মধ্যে টোপ আটকে নামিয়ে দিল। মেয়েটি তার মাকে জিজ্ঞাসা করল নাস্তার জন্য কিছু এনেছে কি না। কিন্তু জেলে তাকে থামিয়ে দিল। ইশারায় চুপ থাকতে বলল। মেয়েটি তখন জানতে চাইল নৌকায় অতিরিক্ত কোনো গরম কাপড় আছে কি না। জেলে তাকে আবারো চুপ করতে ইশারা করল।

‘আচ্ছা, তুমি কি আমার বাবা?’ মেয়েটি শেষ পর্যন্ত জানতে চাইল।

জেলে এক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকল। মেয়েটির কথা শুনে সামান্য হাসলও। কিন্তু মুখে বলল, ‘না’।

তারপর তারা দুজনেই নীরব হয়ে গেল।

স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা মেয়েটির মা বরাবর চাইত তার মেয়ে পড়াশোনা করে শহরে গিয়ে থাকুক। পড়াশোনায় ভালো ফলের জন্য মা তাই তাকে চাপ দিত। মনে করিয়ে দিত যে এখন ভালো ফলের জন্য চেষ্টা না করলে পরে তাকে এজন্যে পস্তাতে হবে যখন হয়ত আর সময় থাকবে না। স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা মেয়েটি তাই পড়াশোনা করছিল। মা তাকে যেভাবে বলেছিল সে তাই করছিল। বাড়ি থেকে তার স্কুল ছিল দুই কিলোমিটার দূরে। সাইকেলে চড়ে সে স্কুলে যেত। বন্যা হলে স্কুল থেকে ফোন করে তাকে বাড়ির কাজের কথা বলে দেয়া হতো। হাই স্কুলে ওঠার পরে সে একটু একটু টাইপ করা, ইংরেজিতে লেখা আর কম্পিউটারের কিছু কাজও শিখেছিল। একদিন সন্ধ্যায় সে যখন বাড়িতে ফিরছিল, তার সাইকেলের চেইন ছিঁড়ে গেল। স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা মেয়েটি রাস্তায় পড়ে গেল। সাইকেলের ঝুড়ি থেকে তার খাতাপত্র রাস্তায় পড়ে কাদায় মাখামাখি হয়ে গেল। রাস্তায় যেতে থাকা একটা পিকআপ ট্রাক থেকে তরুণ চালক তাকে কাদায় পড়তে দেখেছিল। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থামিয়ে সে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেল। ছড়িয়ে থাকা বইপত্র গুছিয়ে দিল। তারপর নিজের কোটের হাতা দিয়ে সেসবের উপর থেকে কাদা মুছে নিয়ে মেয়েটার দিকে বাড়ল। সে তাকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে চাইল। পিকআপের পিছনে তারা সাইকেলটা উঠিয়ে নিল। রাস্তায় তাদের মধ্যে কথা খুব কমই হলো। মেয়েটি তাকে তার পড়াশোনার ব্যাপারে জানাল আর বলল যে সে শহরে চলে যেতে চায়। ছেলেটিকে দেখে মনে হলো মেয়েটি যা বলে তাতেই তার উৎসাহের সীমা নেই। ছেলেটির গলায় খুব সরু একটা চেইন দিয়ে সোনার একটা ক্রস ঝোলানো। মেয়েটার কাছে সেটি দেখতে ভালোই লাগল। মেয়েটি ঈশ্বরে বিশ্বাস করত না, তার মা-ও করত না কিন্তু ছেলেটির মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল যা দেখে তার মনে হলো যে মা তাকে দেখলে বেশ পছন্দ করত। বাড়িতে পৌঁছলে মেয়েটি ছেলেটিকে পরে একবার তাদের বাড়িতে আসতে অনুরোধ দিল। তাকে দেখে মনে হলো দাওয়াত পেয়ে সে খুশি হয়েছে, কিন্তু মুখে বলতে বাধ্য হলো, ‘আমি আসলে কদিনের মধ্যেই কাজে চলে যাব। আমি মাছ ধরার কাজ করি।’ তারপর সামান্য হেসে বলল, ‘আমি কি কালই আসতে পারি?’                                  

‘না,’ মেয়েটি বলল। ‘দুঃখিত, আমার মনে হয় না আগামীকাল আসা ঠিক হবে।’

স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা মেয়েটি যখন শহরে এসেছিল তখন তার বয়স বিশ। শহরে এসে অন্তত এটা দেখে সে খুশি হয়েছিল যে বাড়িঘরগুলো পিলার বা মাচার উপরে বানানো নয়, বন্যায় ভোগা মানুষ আর জেলেদের জীবনে যেরকমটা অবধারিত। শহরটা যে গ্রামের থেকে বেশ গরম এটা তাকে প্রথম কদিন অবাক করে রেখেছিল। প্রতি রবিবারে সে তার মাকে ফোন করত, সারা সপ্তাহে কী করল তার গল্প শোনাত। কখনো কখনো বানানো গল্পও বলত। কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে অবশ্য সে সেসব বলত না, বলত কেবল মায়ের সঙ্গে সময় কাটাতে। যেমন বলত সে তার নতুন বন্ধুদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দিয়েছে। কিংবা হযত বলত যে একটা মজার সিনেমা দেখে এল। কোনোদিন বলত যে কাছেধারের একটা রেস্টুরেন্টে সে মজার কিছু খাবার খেয়ে এসেছে। কখনো কখনো সেসব শুনতে শুনতে মা অস্থির হয়ে ভাবত যে ফোনটা কখন রাখবে, যেন মা তার বোনকে ফোন করে গল্পগুলো শোনাতে পারে।

স্ট্রেচারে শোয়া মেয়েটির জমানো কিছু টাকা ছিল। সে তাই কারিগরি একটা কলেজে ভর্তি হয়ে গেল। কিন্তু খাবারের খরচ, বাসা ভাড়া আর কলেজের বেতন ছিল খুব বেশি। তাই অচিরেই পড়াশোনা বাদ দিয়ে তাকে একটা কাজের খোঁজে বেরোতে হলো। একদিন বিকেলে সে যখন রুটি কিনছিল, যাকে সে প্রায়ই তার সমস্যার কথা টুকটাক বলত, দোকানের সেরকম এক মহিলা বলল যে সে ওর জন্য একটা কাজের খোঁজ পেয়েছে। মহিলা বলল যে ওই কাজটা করলে সে ভালো পয়সা পাবে আবার পড়াশোনার জন্য যথেষ্ট সময়ও হাতে থাকবে। স্ট্রেচারে শোায়া মেয়েটি কিন্তু মোটেও বোকা ছিল না। সে আন্দাজ করতে পারল যে কাজটা নিশ্চয় অস্বস্তিকর কিছু যা যে কেউ করতে রাজি হবে না। কিংবা কাজটা ঝুঁকিপূর্ণও হতে পারে। তবে সে ভাবল যেহেতু জানতে চাইলে করতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, তাই সে একটু পরখ করে দেখে নিতে চায় কাজটা আসলে কী।

দোকান থেকে বেরিয়ে মহিলা তাকে নিয়ে গাড়িতে উঠল। কাছেরই এক রাস্তায় দোতলা এক বিল্ডিঙের সামনে গিয়ে গাড়ি থামল যেখানে সাইনবোর্ডে লেখা, ‘ইন্সটিটিউট’। ঘরের ভিতরে অসংখ্য মেয়েদের আনাগোনা। তাদের মধ্যে একজনের গায়ে পিচের মতো রঙের পোশাক, যার গায়েও লেখা ‘ইন্সটিটিউট’। সে উপস্থিত মেয়েদেরকে সোজা একটা সারিতে দাঁড়াতে বলল। সারির মধ্যে না থাকলে যে কাজের সুযোগ হারাবে, সে বিষয়েও সতর্ক করে দিল। মেয়েরা দ্রæত এক সারিতে দাঁড়িয়ে গেল। সেখানকার আরেকজন স্যুট পরা মহিলা দোকানের মহিলাটিকে চিনতে পারল। তাই সঙ্গে সঙ্গে তাদের পাশে এসে দাঁড়াল। সে ইশারায় তাদের দুজনকে পাশের একটা ঘরে নিয়ে গেল। স্ট্রেচারে শোয়া মেয়েটিকে সে তার প্যান্টের পা উঠিয়ে দেখাতে বলল যেন তার পায়ের ঘন লোম তার নজরে আসে। স্ট্রেচারে শোয়া মেয়েটি এক মুহূর্তের জন্য ভাবল সে হয়ত তার নির্দেশ ঠিকমতো বুঝতে পারেনি। কিন্তু পরমুহূর্তে মহিলা তার নির্দেশ আরেকবার বলে শোনাল। আর তখন তার মনে হলো এটা তো ভারি অদ্ভুত ব্যাপার! তার জন্য এটা কোনো কাজ হতে পারে না। তবে যাই হোক, প্যান্টের পা মুড়িয়ে পায়ের লোম তাকে দেখিয়ে দেয়াতে যেহেতু তার কোনো ক্ষতি নেই তাই সে তাই করল, পা গুটিয়ে লোমগুলো দেখিয়ে দিল। স্যুট পরা মহিলা চোখে চশমা লাগিয়ে তার লোমগুলো ভালোমতো দেখতে লাগল। পকেট থেকে ছোট্ট একটা ফ্ল্যাশ লাইট বের করে তা জ্বালিয়ে নিয়ে ছোটো ছোটো লোমগুলোকে পরীক্ষা করতে লাগল। গোড়ালির কাছে যেখানে লোমগুলো ততটা পুষ্ট নয় সেই জায়গাটা সে খুব ভালোমতো দেখে নিল। তারপর যখন তার মনে হলো একে দিয়ে কাজ চলবে, তখন উঠে দাঁড়িয়ে সে কাজটার ধরণ, মজুরি আর নিয়মকানুনের কথা বলতে শুরু করল। স্ট্রেচারে শোয়া মেয়েটি বুঝতেই পারছিল না তার কী করা উচিত। কারণ কাজটা খুব সহজ; সময়টাও সুবিধার আর বিনিময়ে পাওয়া টাকার প্রতিশ্রুতিও চমৎকার। মেয়েটির মা তাকে নানা রকমের শহুরে প্রতারণার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিল। সে নিজেও বরাবর সেসব বিপদ-আপদ কিংবা প্রলোভন থেকে দূরেই থাকার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ওখানে সবকিছু তার কাছে স্বাভাবিক বলেই মনে হলো। সে কাজটার জন্য রাজি হয়ে গেল।                               

যখন আর একটুও লোম অবশিষ্ট ছিল না, পা-দুটোকে দেখতে লাগছিল লালচে আর দগদগে। স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা মেয়েটি স্থির ছিল। চেয়ারের ছয়জন মহিলাকে দেখে মনে হচ্ছিল ক্লান্ত, তবে সন্তুষ্ট। শেষে তারা তাদের চেয়ারের পিছনের দিকে হেলান দিয়ে বসল। তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে নিজেদের হাত গুটিয়ে কোলের উপরে রাখল। সহকারি তাদের সামনে থেকে ভাঁজ করা তোয়ালাগুলো নিয়ে গেল, যার উপরে মহিলারা লোমের স্তূপ জমিয়ে রেখেছিল। তোয়ালাগুলো হাতে নেবার আগে সে দুবার ভালোমতো পেঁচিয়ে নিল, যেন সেখান থেকে লোম পড়ে হারিয়ে না যায়। আর সেভাবেই সে সেগুলোকে একটা প্লাস্টিক ব্যাগের মধ্যে ভরে ফেলল। ব্যাগটা ভরলে ব্যাগের মাথায় শক্ত করে দুটো গিঁট বাঁধল। এইসমস্তকিছুর পরে সে ফিরে এসে চেয়ার টেনে মহিলাদেরকে উঠতে সাহায্য করল। দুহাতে তাদের জ্যাকেটের সরে যাওয়া কলার আর ঘাড়ের ফোলানো ফোম জায়গামতো বসিয়ে ঠিকঠাক করে দিল। এরপর লোমের ব্যাগটা আলতো করে ধরল, এমনভাবে যেন সেটা এতটুকু কাত না হয়। দরজা খুলে মহিলাদেরকে সাজঘরের দিকে নিয়ে গেল। তারা সাজঘরে ঢুকলে সহকারি বাইরে বেরিয়ে দরজা লাগাল। সে ফিরে এল হল ঘরে। সাজঘরে মহিলারা নিজেদের মধ্যে এইমাত্র শেষ করা কাজটা নিয়ে কথা বলছিল। এ নিয়ে হাসাহাসিও করছিল তারা। আগের কোনোবারের সঙ্গে তুলনা করে মন্তব্য করছিল। সাদা সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসার সময়ে সহকারি তাদের কথাবার্তা আর হাসিঠাট্টা শুনতে থাকল। সে জানত স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা মেয়েটির কাছে ফিরে যাবার আগেই তাকে প্লাস্টিকের ব্যাগটা হস্তান্তর করতে হবে।

সহকারি মেয়েটির জন্ম হয়েছিল গ্রামে। সে এমন এক পরিবারে জন্মেছিল যারা খেতের ফসল আর আঙুর বাগানের উপর নির্ভরশীল ছিল। গাছ-গাছড়া ও বাগানে ঘেরা তাদের একটা গ্রামের বাড়ি ছিল এবং ধনী না হয়েও তাদেও জীবন ছিল স্বচ্ছন্দ। সহকারি মেয়েটি মাছ দেখতে পছন্দ করত। তার বাবা বলতে গেলে বাড়িতে প্রায় থাকতই না। বাবা তাকে সারা পৃথিবীর রঙ-বেরঙের মাছের ছবিওলা নানান আকৃতির বই পাঠাত। সে মাছগুলোর নাম শিখত আর নিজের নোটবুকে তাদের ছবি আঁকত। হাজার মাছের মধ্যে তার কাছে যে মাছটা সবচেয়ে বেশি ভালো লাগত, তার নাম ছিল ওলিনহিরিস। মাছটির ছিল পাতলা আর সরু শরীর। মুখের সামনে ছিল লম্বা আর তীক্ষ্ণ নাক। সমুদ্রের মতো নীল আর হলুদ রঙ ছিল গায়ে। বইয়ে লেখা ছিল, মাছটি কমনীয় এক সৃষ্টি। মাছটির একমাত্র খাদ্য ছিল প্রবালের কীট আর সেই খাবার স্বাভাবিকভাবেই যেকোনোখানে মিলত না। সে ওরকম একটা মাছের জন্য জেদ ধরেছিল। কিন্তু বাড়ির সবাই বলেছিল ওই মাছ এই গ্রামে এনে রাখা যাবে না। সহকারি তার মাকে আরেকটি বই দেখিয়ে, অ্যাকুইরিয়াম কী করে বানানো আর সংরক্ষণ করা যায় তা বুঝিয়েছিল। কিন্তু তার মা বলেছিল যদিও তারা কোনোভাবে মাছের অ্যাকুইরিয়াম আর খাবার সংগ্রহ করে, তবু মাছগুলো তার ভিতরে দুঃখে-কষ্টে মরে যাবে। সহকারির মনে তখনো আশা ছিল, হয়ত তার বাবা এই বিষয়ে মায়ের মতো মতামত না-ও দিতে পারে। বাবাকে যদি সে অ্যাকুইরিয়ামের ছবিগুলো দেখায় তবে বাবা নিশ্চয় বুঝবে আর রাজিও হবে। কিন্তু বাবা যখন শেষ পর্যন্ত বাড়িতে ফিরেছিল, মাছের অ্যাকুইরিয়াম নিয়ে লেখা সেই বইটি সে আর কোথাও খুঁজে পায়নি।

সহকারি মেয়েটির অনেকগুলো ভাই ছিল। ভাইয়েরা তার চেয়ে বড়ো আর বাবার সঙ্গে কাজ করতে চলে যেত। তাই মেয়েটি বেশিরভাগ সময়ে একাই থাকত। সাত বছর বয়স হলে সে গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করতে শুরু করল। তার বাবার অধীনে কাজ করত এমন একজন মানুষ তাকে সকাল সাড়ে সাতটায় বাড়ি থেকে নিতে আসত আর আটটার মধ্যে স্কুলে পৌঁছে দিত। স্কুল ছুটি হলে দুপুরে লোকটি আবার স্কুলের সামনে উপস্থিত হতো। সহকারি মেয়েটি তার জীবনের এই নতুন নিয়মকানুনের সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। প্রথম দিকে কিছুই ভালো লাগত না। মা তার জন্য গৃহশিক্ষিকার ব্যবস্থা করল। তাই সহকারি মেয়েটি সকালে স্কুলে যেত আর বিকেলে বাড়িতে শিক্ষিকার কাছে পড়ত। মেয়েটির মাছের প্রতি আগ্রহ দেখে গৃহশিক্ষিকা তাকে মাছ সংক্রান্ত ছবি আর গল্প দিয়েই পড়ানো শুরু করল। কখনো কখনো শিক্ষক তাকে কিছু কবিতা পড়ে শোনাত। আর একদিন যখন তারা বাক্যের যতিচিহ্ন নিয়ে আলাপ করছিল, গৃহশিক্ষিকা হঠাৎ তাকে কয়েক লাইন কবিতা লিখতে অনুরোধ করল। সহকারি মেয়েটি তার অনুরোধকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে একটা কবিতা লিখে ফেলল যা দেখে শিক্ষক অবাক হয়ে গেল। তারপর শিক্ষক তাকে বাড়ির কাজ হিসেবে তার প্রিয় মাছের নামগুলো নিয়ে একটা  কবিতা লেখার কাজ দিয়ে গেল। মেয়েটি খুব মনোযোগ দিয়ে বাড়ির কাজটি করতে শুরু করল। কিছু কাগজ, একটা পেনসিল আর একটা ইরেজার রেখে সে তার পড়ার টেবিলটা একেবারে পরিষ্কার করে ফেলল। সে মাছ নিয়ে সত্যি সত্যি একটা কবিতা লিখে ফেলল। কিন্তু সেসব আসলে তার মনে মনে বানানো মাছ; কোনো সকালে হয়ত সে ওরকম কল্পিত মাছ নিয়ে ভেবেছিল। ঘুম ভাঙলে চোখ মেলেই মানুষ যখন বুঝতে পারে না সে কে আর সে কোথায়। তখন সে সেই কথাগুলো ভাবত যা তাকে আনন্দ দেয়, আবার ভাবত সেগুলো যা তাকে দুঃখী করে আর ভাবত তার বাবার কথা।

একদিন বিকেলে গৃহশিক্ষিকা এসে মেয়েটিকে জানাল যে তার জন্য একটা বিস্ময় অপেক্ষা করছে। তারপর নিজের ব্যাগ থেকে বড়োসড়ো একটা প্যাকেট বের করল। দেখে মনে হলো বড়ো একটা দাপ্তরিক খাতা, তবে সুন্দর মোড়কে মোড়ানো। মোড়ক খোলার আগে শিক্ষক তাকে প্রতিজ্ঞা করাল যে এই উপহারটা কেবল সে আর মেয়েটিই জানবে, এটা হবে তাদের ছোট্ট একটা গোপন ব্যাপার। মেয়েটি যেন কখনো কাউকে এই উপহারের কথা না বলে। সহকারি মেয়েটি রাজি হলো। উপহারের মোড়কটি সে ছিঁড়ে ফেলল তারপর। আর যখন সে মোড়কের ভিতরে দেখতে পেল, মনে হলো তার সমগ্র জীবনও এই উপহারের উপযুক্ত প্রতিদান দেয়ার জন্য যথেষ্ট হবে না যা সে এইমাত্র গৃহশিক্ষিকার কাছ থেকে গ্রহণ করল। সেটা ছিল মাছের অ্যাকুইরিয়াম নিয়ে একটা বই। এটা পুরোপুরি সেই বইটার মতো নয় যা সে হারিয়েছে, তবে এই বইটাও সেটাই, কেবল সামান্য আলাদা।

সহকারি মেয়েটির বয়স বারো বছর হতে হতে তার স্কুলের ফলাফল বেশ ভালো হতে লাগল। তাই তার মা সিদ্ধান্ত নিল যে মেয়েটির আর গৃহশিক্ষিকার প্রয়োজন নেই। তারপর একটা লম্বা সময় জুড়ে মেয়েটি তার আঁকা মাছের ছবিগুলোতে গৃহশিক্ষকের ছবিও আঁকত। যেমন, কিছু ছবি এঁকেছিল যে তার শিক্ষক একটা ওলিনহিরিস মাছকে চুমু খাচ্ছে। আরেকটা ছিল, গৃহশিক্ষক অন্তঃসত্ত্বা আর তার গর্ভে একটা ওলিনহিরিস মাছ। গৃহশিক্ষিকাকে নিয়ে মেয়েটি কয়েকটি কবিতাও লিখেছিল। তারপর শিক্ষিকাকে পৌঁছে দেবার জন্য তার মাকে দিয়েছিল। কিন্তু সেসববের কোনো জবাব কোনোদিন আসেনি।

মেয়েটি হাইস্কুল শেষ করে তার বাবার ব্যবসা দেখাশোনা শুরু করল। খামারের দেখাশোনাও করতে লাগল। সে তখন আর ছবি আঁকে না বা কবিতাও লেখে না। কিন্তু সে নিজের আঁকা একটা ওলিনহিরিসের ছবি ফ্রেমে বাঁধিয়ে তার টেবিলের উপরে রেখেছিল। কখনো অবসরে যখন সে কিছুটা জিরিয়ে নেয়ার জন্য বসত, ফ্রেমটা হাতে নিয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকত। সেদিকে একভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে ভাবত তার গৃহশিক্ষক এখন কোথায়, ঠিক এই মুহূর্তে সে কী করছে। আর তারপর ভাবতে থাকত একটা ওলিনহিরিস মাছের জীবন যাপন করাটা কেমন হতে পারে।

মেয়েটি বিয়ে করেনি আর তার সন্তানও হয়নি। মায়ের জটিল অসুখের লক্ষণ দেখা দিলে তারা গ্রাম থেকে শহরে চলে এসেছে। তাছাড়া, সে বছর খরায় বাড়ির আশেপাশের আঙুর খেত আর জমির ফসল শুকিয়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই পারিবারিকভাবে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে সহকারি মেয়েটি তার মাকে নিয়ে রাজধানীতে চলে যাবে। কয়েক বছর আগে তার বাবা ওই শহরে যে অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছিল, সেখানেই তারা থাকবে। মেয়েটি জায়গা বদলের সময়ে মাছের অ্যাকুইরিয়াম নিয়ে লেখা ওই বইটি সঙ্গে নিয়ে এসেছিল যেটা তার শিক্ষিকা তাকে দিয়েছিল। অ্যাপার্টমেন্টটা খুব বড়ো নয় তবে দুজন মানুষের জন্য যথেষ্ট। বাসাটাতে বড়ো একটা জানালা ছিল যার ওপাশে বড়ো রাস্তা আর অগুনতি আলো। পাইন কাঠের একটা টেবিল আর দুটো খাট কিনল তারা। মেয়েটি তখন উপহার পাওয়া সেই বইটি থেকে কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখল। দেখলে মনে হতো ফ্রেমে বাঁধানোর জন্যই আঁকা। মেয়েটি রান্না করতে শিখল। বিছানাপত্র গোছানো আর কাপড় ধোয়াও শিখে গেল। একটা ড্রাই ক্লিনারসের দোকানে সে চাকরি পেল। তার কাজ ছিল ধোয়ার পরে পরিষ্কার কাপড়গুলোকে একের পর এক কাপড় বাস্পের মেশিনে ঢোকানো, যেন কোনোটা এতটুকু কুঁচকে না-থাকে। প্রতিটা কাপড়ের উপর থেকে নীচ পর্যন্ত সোজা ধরে রাখা তারপর কিছুক্ষণের অপেক্ষা, এক এক করে সমস্ত কাপড়ের জন্য একই নিয়ম। আরেকজন কাপড়টা নিয়ে ভাঁজ করত আর তাতে লাগাত সুগন্ধী। কখনো কখনো কোনো কাপড়ে বেশ জেদি কোনো দাগ থাকত। তখন কাউকে সেটা দ্বিতীয়বার ধুতে নিয়ে যেতে হতো। এরকমটা হলে সহকারি মেয়েটি ট্যাপের সারির প্রথম ট্যাপাটই বেছে নিত। ট্যাপ চালু করার পরে দশ সেকেন্ডের অপেক্ষা। সেইটুকু সময়ে সে সামনের আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকত। সে তাকিয়ে থাকত নিজের চোখের দিকে।

মেয়েটির মা যখন মারা গেল, শোকে সে তার চাকরিটা ছেড়ে দিল। মায়ের ফেলে যাওয়া কাপড়চোপড়ের মধ্যে সে তার সেই হারানো বইটা খুঁজে পেল, মাছের অ্যাকুরিয়ামের বই, সেই প্রথম পাওয়া বইটা। পাইন কাঠের টেবিলটা খালি করে নিয়ে সে দুটো অ্যাকুইরিয়ামের বই পাশাপাশি মেলে নিয়ে বসল। দুটোরই প্রথম পাতা খুলল। একের পর এক পাতা উলটে পাশাপাশি দুটো বইয়ের একইরকমের পাতাগুলো পরপর দেখতে লাগল। তার ধারণা ছিল একসঙ্গে দেখলে দুটোর মধ্যে কিছু না কিছু পার্থক্য সে পাবেই। এক নজরে তার কাছে বরাবর দুটোকে আলাদা মনে হয়েছিল। একটার কিছু জিনিস বদলে নিয়ে আরো সুন্দর করে পরেরটা বানানো হয়েছিল, অন্তত এ বিষয়ে সে নিশ্চিত ছিল। আসলে পার্থক্যটা সহজে হয়ত সে উল্লেখ করতে পারত না। আর বহু খোঁজাখুঁজির পরেও তা ধরতে পারল না। সে দুটো বইই বন্ধ করল আর মন খারাপ করে বসে থাকল। সে বুঝল যে ওই বইগুলো এখন আর তার কোনো কাজে আসবে না। বইগুলোকে চোখের আড়াল করতে খাটের নীচে চালান করল সে। দিনের পর দিন ঘরের মধ্যে নিজেকে বন্দি করে বসে থাকল। তারপর একদিন তার টাকা-পয়সা আর জমানো খাবার শেষ হয়ে গেলে সে বাইরে বেরোল। বাড়ির আশেপাশের রাস্তায় যখন সে একটা কাজের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, দেখল একখানে ‘সহকারি চাই’ লেখা বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনটি যে বিল্ডিঙে টাঙানো, তার উপরে লেখা ‘ইন্সটিটিউট’। কাজটা ছিল খুব সহজ আর তার জন্য বেতনটাও বেশ আকর্ষণীয়। কাজের জন্য তাকে সঙ্গে সঙ্গেই পছন্দ হয়ে গেল তাদের। প্রথম মাসের টাকা থেকেই সে অ্যাপার্টমেন্ট রঙ করা আর নতুন কিছু আসবাব কেনার টাকা বাঁচিয়ে ফেলল। দেয়ালে মাছের অ্যাকুরিয়ামের বই থেকে যে ছবিগুলো কেটে লাগিয়েছিল যেসব এক টানে খুলে ফেলে দিল সে। এখন তার নিয়ম প্রতি সকালে নির্দিষ্ট পোশাক পরে ইন্সটিটিউটের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়া। সেখানকার দরজা খোলা, ফর্মে কারো বিষয়ে তথ্য লেখা, মহিলাদেরকে সাজঘরে নিয়ে যাওয়া, বিশেষ একটা ঘরের দরজা খোলা, সেখানকার জিনিসপত্র নিয়ম অনুযায়ী সাজিয়ে ফেলা, স্ট্রেচারের উপরে শুয়ে থাকা মেয়েটার দিকে নজর রাখা, লোম সংগ্রহ হলে সেটা ব্যাগে ভরা, ব্যগটার মুখ শক্ত করে আটকানো, ব্যগটাকে নিজের হাতে ঝোলানো, মহিলাদেরকে বিদায় জানানো, স্ট্রেচারের মেয়েটিকে তার পাওনা টাকা বুঝিয়ে দেয়া, ঘরের বাতিগুলো নিভিয়ে দেয়া, আর সব শেষে ঘরটির দরজা বন্ধ করে আসা। বাড়িতে তার কাজ হলো কোনেরকমে বাজার করা জিনিস দিয়ে রাতের খাবারের আয়োজন করা, টেলিভিশনের সামনে বসে খেয়ে নেয়া, তারপর সামান্য ধোয়াধুয়ি আর গোসল সেরে নেয়া, দাঁত ব্রাশ করা, শেষে বিছানাটা টান টান করে গুছিয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়া। কখনো তার কাছে থাকা ফর্ম ফুরিয়ে যায়, তখন তাকে আরো ফর্ম বানাতে কাছের দোকানে যেতে হয়। কখনো আবার স্ট্রেচারে থাকা মেয়েটি নড়ে উঠলে তার পাওনা থেকে কিছু টাকা কেটে রাখতে হয়। কিংবা কোনোদিন সে ভেবেই পায় না রাতে কী খাবে, আর তখন ভাবতে ভাবতে না-খেয়ে আগেভাগেই ঘুমিয়ে পড়ে।

সহকারি মেয়েটি রিসেপশনের দিকে গেল। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল সন্ধ্যা নেমে গেছে। হাতের ব্যাগটা সে রিসেপশনিস্টের টেবিলের নীচের তাকে একই রকমের আরো তিনটা ব্যাগের পাশে রাখল। আর ঠিক তখনই রাস্তার দিকের দরজাটা হাট হয়ে খুলে গেল। বাইরের শীতল বাতাস সঙ্গে নিয়ে এক মহিলা ঢুকল। মহিলা ছোটোখাটো তবে বেশ শক্তপোক্ত। মহিলার গায়ে ভারী কালো কোট, আর যথারীতি তার সঙ্গে মেলানো উঁচু বুট, যেরকম বুট দেখলে সহকারি মেয়েটির বরাবর মনে হতো এটা কোনো পুরুষের ব্যবহারের জন্য, যে মানুষ মাছ ধরে। তবে ওরকম বুট এর-ওর পায়ে দেখতে দেখতে ততদিনে সে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। মহিলা ইশারায় অভিবাদনের ভঙ্গি করল, সহকারি মেয়েটিও সামান্য মাথা নেড়ে উত্তর দিল। মহিলা তার দুই হাত টেবিলের উপরে রাখল। সহকারি দেখে নিল যে বরাবর আসা গাড়িটাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে, ইঞ্জিনও চালু আছে। সে এক এক করে চারটা ব্যাগ মহিলার হাতে দিল। মহিলা ব্যাগগুলো সাবধানে ধরে একেক হাতে দুটো করে নিল। তারপর বিদায় না জানিয়েই বেরিয়ে গেল। বেরোবার সময়ে কেবল একটিই কথা সে উচ্চারণ করল, ‘দরজা বন্ধ করার আগে বাতিগুলো নেভাতে ভুলো না যেন।’

সহকারি জানাল সে ভুলবে না। সহকারি সেখানেই কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে মহিলার গাড়িতে ওঠা দেখল। মহিলারা সব নীচে নেমে এসেছে। তাদের গায়ে বিচিত্র পোশাক। রাস্তায় নামার আগে তারা বিদায় জানিয়ে গেল। কেবলমাত্র স্ট্রেচারে শোয়া মেয়েটি থাকল উপরের তলায়। সে ততক্ষণে তৈরি হয়ে নিয়ে হয়ত সহকারি মেয়েটির জন্য অপেক্ষা করছে। সহকারি মেয়েটি ধীরে ধীরে উপরের তলায় উঠল। ঘরের দরজা খুলেই চমকে উঠল। দেখল মেয়েটি তখনো উলঙ্গ; একভাবে স্ট্রেচারের উপরে বসে আছে। সে তার হাঁটুদুটো জড়িয়ে দুই বাহুর মাঝখানে মাথা ডুবিয়ে বসেছে। পিঠটা ঘন ঘন ওঠানামা করছে। সে হয়তবা কাঁদছে। সহকারি মেয়েটির সামনে এরকমটা এই প্রথম ঘটল। তাই আচমকা সে বুঝতে পারল না তার কী করা উচিত। ভাবল ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া যেতে পারে, তারপর কিছু পরে ফিরে এলেই হবে। কিন্তু তার বদলে সে পকেট থেকে তার নোটবুক বের করল। মেয়েটির পাওনা টাকার পরিমাণ চড়া গলায় জানিয়ে দিল। আর তারপর স্ট্রেচারের উপরে বসে থাকা মেয়েটির দিকে রিসিটসহ টাকাটা বাড়িয়ে ধরল। স্ট্রেচারে বসা মেয়েটি এই প্রথম সহকারি মেয়েটির দিকে সরাসরি তাকাল। তার দৃষ্টি পড়তেই সহকারি মেয়েটি নিজের পেটের মধ্যে প্রচণ্ড টান অনুভব করল, টানটা যান্ত্রিক। তার বুকে যেন বাতাস ভরে উঠল, ঠোঁট এমনি এমনি গেল খুলে। বাতাসের প্রবাহে তার জিব শুকিয়ে এল। পাশে দাঁড়িয়ে সে এমনভাবে অপেক্ষা করতে লাগল যেন স্ট্রেচারে বসে থাকা মেয়েটিকে কিছু বলতে এসেছিল। কিন্তু কী সেই কথা? সেই কথাটাই কি তার মুখ বন্ধ করে রেখেছে? সে কি জানতে চেয়েছিল মেয়েটির কেমন লাগছে? কেমন লাগছে বলতে আসলে কী? ব্যাপারটা এমন নয় যে সত্যিই মেয়েটির কাছে সে তা জানতে চাইবে। যদিও তাদের দুজনের শরীরের মাঝখানে তখন যথেষ্ট দূরত্ব, তবু ওই বিল্ডিঙে ওই সময়ে তারা দুজন ছাড়া আর কেউ ছিল না। যে কথা বলা হয়নি তা কেবল সহকারি মেয়েটির মাথা থেকে বেরিয়ে বাতাসে ভাসছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কথা শুরু করল সেই স্ট্রেচারে বসা মেয়েটিই, বলল, ‘তুমি ঠিক আছ তো?’

সহকারি চুপ করে থাকল। তার জানতে ইচ্ছে করছিল যে মেয়েটির কী হয়েছে। সে ভালোমতো তার সমস্যাটা বুঝতে চাচ্ছিল। কিন্তু তার কেন যেন মনে হলো কিছু একটা তাকে দখল করে ফেলেছে। তার গলায় কঠিন হয়ে কিছু একটা বিঁধে আছে। কোথাও যেন তীব্র একটা ব্যথা তাকে সেই পাইন কাঠের টেবিলের উপরে মেলে রাখা পাশাপাশি দুটো বইয়ের ছবিগুলোর মধ্যে নিয়ে গিয়ে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি দুটো ওলিনহিরিস। একটির পাশে আরেকটা। সে এমনভাবে পাশের জনের দিকে তাকিয়ে আছে যেন এটাই সেই সুযোগ, পার্থক্য খুঁজে বের করার নতুন সুযোগ। প্রবল আগ্রহে সে সেদিকেই তাকিয়ে থাকল, তাকাল চোখের দিকে, আঁশগুলোর দিকে, পাখনার দিকে, দুজনের রঙিন শরীরের পার্থক্য খুঁজতে লাগল।

(দানিয়েল আলার্কোনের ইংরেজি অনুবাদ অবলম্বনে)

লেখক পরিচিতি :

সামান্তা শুয়েবলিন ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেস-এ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বুয়েনোস আইরেস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিল্ম বিষয়ে ডিগ্রি নিয়ে বর্তমানে নিজের ডিজাইন এজেন্সির ব্যবসায় নিযুক্ত। ২০০১ সালে তার রচিত প্রথম বই ‘এল নুক্লেও দেল দিস্তুর্বিও’ (২০০২) একযোগে ন্যাশনাল ফান্ড ফর দ্য আর্টস এবং আরোলদো কোন্তি জাতীয় প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরষ্কারে ভূষিত হয়। ২০০৮ সালে তার দ্বিতীয় বই ‘পাহারোস এন লা বোকা’ ‘কাসা দে লা আমেরিকা’ পুরষ্কার অর্জন করে। বিভিন্ন সংকলন, পত্রিকা ও সাংস্কৃতিক পত্রিকায় তার গল্প জার্মান, ইংরেজি, ইটালিয়ান, ফ্রেঞ্চ, পর্তুগিজ, সুইডিশ এবং সার্বিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন