X
বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১
আমেরিকার গল্প

আই ডি ।। জয়েস ক্যারল ওটস

অনুবাদ : দুলাল আল মনসুর
১৭ অক্টোবর ২০১৮, ১৯:১০আপডেট : ১৭ অক্টোবর ২০১৮, ১৯:১০

আই ডি ।। জয়েস ক্যারল ওটস তারা বলছিল, একটা এই ডি’র জন্য লিসেত্তে মুলভেকে দরকার।

ঘটনাটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল।

এক শীতের সকালের কথা। নটা চল্লিশ মিনিটে দ্বিতীয় পিরিয়ড চলাকালে লিসেত্তে রহস্যময় এক অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল। সেই অভিজ্ঞতাকে তুলনা করা যেতে পারে সিনেমায় দেখা দূর ছায়পথে পথ হারানোর সাথে। আর বছর হিসেব করলে নতুন বছরের এক শনিবারে।

সেদিন স্কুলে যাওয়ার পথে তারচেয়ে বয়সে একটু বড় কয়েকজন ছেলে ঠাট্টার ছলে লিসেত্তেকে বিয়ার খাইয়েছিল। নিছক মজা করার জন্যই ছেলেগুলো হাসছিল তার দিকে চেয়ে। শুধু তাই নয়, লিসেত্তে নিজেও হাসছিল। মাথাটা এমন একটু আউলা হয়েছিল বলেই হবে হয়তো। হাসির মধ্যে কদর্য কোনো ইঙ্গিত ছিল বলে মনে হয় না তার। কারণ তার প্রতি ভাললাগা ছিল ছেলেগুলোর। তাদের কথার সুরে সেটা বেশ পরিষ্কার। সুর করে তারা লিজ-জেত্তে, লিজ-জেত্তে বলে ডাকছিল। জোরালো তবে মৃদু স্বরে ডাকতে ডাকতে তারা লিসেত্তের বাহু আর পিঠের ওপর দিয়ে হাত বোলাতে থাকলে তাদের হাতের ছোয়ায় তার শরীরে ভাললাগার মোচড়ানিও শুরু হয়ে যায়। 

স্কুলে আসার পথে ছেলেগুলো লিসেত্তেকে তাদের গাড়িতে তুলে নিয়েছিল। তাদের মিড্ল স্কুল হাই স্কুলের পাশেই। অন্যান্য দিন লিসেত্তের বান্ধবীরা থাকে। তাদের মধ্যে অন্যতম কিশা এবং তানিয়া। বয়সের তুলনায় তাদের পাকামিটা একটু বেশিই, বিশেষ করে কিশার। কাজেই মিড্ল স্কুলের অন্যান্য মেয়েদের তুলনায় তাদের মধ্যে লজ্জা-লজ্জা ভাবটা একটু কম। ছেলেদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় তাদের জানা আছে। ছেলেরাও জানে তাদের সাথে কথা বলার কায়দা কানুন। তবে কথা শুধু কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ; অন্য কিছু নয়।

চলছিল গণিতের ক্লাস। নিকুচির গণিতের ক্লাস তাকে বোকার হদ্দ বানিয়ে ছেড়েছে। গণিত দুচোখের বিষ। আসলে সে স্বভাবে বোকা নয় মোটেই। মাঝে মধ্যে তার চিন্তা-চেতনা জট পাকিয়ে যায় তার জট পাকানো চুলের মত। তার ঘন রক্তবর্ণ চশমার প্রেস সিপশন লেন্সের আড়াল থেকে মাঝে মাঝে বেয়াড়া জল গড়িয়ে পড়ে। তখন শিক্ষক বোর্ডে কী লিখছেন দেখতে পায় না। অক্ষরগুলোর অবয়বই দেখতে পায় না। মিস নাউকি হয়তো আশাবাদী উচ্চকণ্ঠে বললেন, তোমাদের মধ্যে কে আমার সাথে যোগ দিতে পার? এরপর কী হবে বলো দেখি!

তখন বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীই সিটের সাথে পাছা এঁটে বসে থাকে। সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে বোকাটে হাসি মুখে ঝুলিয়ে। বোর্ডের কাছে তাকে ডাকা হোক বলে প্রত্যাশা থাকে না লিসেত্তের। গণিতের ক্লাসে তাকে অবশ্য ডাকাও হয় না সাধারণত। চোখ বন্ধ করে গভীর কিছু একটা ভাবার ভঙ্গি করে বসে থাকে। চোখ খুলে দেখতে পায় তিন চারজন ভাল ছাত্রছাত্রীদের কোনো একজন মিস নাউকির কাছ থেকে চক নিচ্ছে। তাকিয়ে থেকে বুঝতেও চেষ্টা করে সে। কিন্তু কালো নয়, বরং ওই সবুজ বোর্ডের ওপর লেখার সময় চকের চিক চিক শব্দের কারণে কী রকম একটা অস্বস্তি চলে আসে তার মধ্যে। অংকের সংখ্যাগুলো থেকে কিছু একটা বোঝার চেষ্টায় থাকলেও মাথা ঘোরা শুরু হয়ে যায়।

সংখ্যা নিয়ে তার মা ইভেত্তের কোনো সমস্যা নেই। ক্যাসিনো রয়েলেতে ব্যাকজ্যাক আড্ডায় তাসের যোগানদারের কাজ করে তার মা। দ্রুত চিন্তা করতে হয়, স্মার্ট হয়ে চোখ কান খোলা রেখে এগুতে হয়—নইলে ব্যাকজ্যাক আড্ডায় তাল মেলানো যাবে না।   

তবে ব্যাকজ্যাক খেলায় তাস গণনা করা নিষেধ। কাউকে এই গোপনকর্ম করা অবস্থায় ধরতে পারলেই অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। ইভেত্তের ইচ্ছে আছে একদিন তার নাম, চুলের রংসহ যা যা বদলানো যায় সব বদলে ফেলবে। গাড়ি চালিয়ে ভেগাসের দিকে কিংবা আরো কোনো অল্প পরিচিত জায়গায় চলে যাবে। সেখানে গিয়ে এমন কৌশলে ব্যাকজ্যাক খেলবে কেউ তার হাতের মারপ্যাচ ধরতে পারবে না। কিন্তু লিসেত্তে যখনই বলেছে, মা আমাকেও সাথে নিতে হবে কিন্তু, ঠিক আছে? মা তখন এমন চোখে তাকিয়েছে যেন লিসেত্তে বোকার মত কিছু বলেছে। মা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেছে, সুইটি, আমি এমনি বললাম। ক্যাসিনোর লোকদের সাথে তোমার কিসের ঘোড়ার ডিমের কাজ?

মা এবার ভেগাস কিংবা রেনোর মত কোনো জায়গায় যায়নি; লিসেত্তে নিশ্চিত। সাথে প্রয়োজনীয় অনেক কাপড়-চোপড়ও নেয়নি।

সপ্তম গ্রেডে গণিত নিয়ে লিসেত্তের কোনো সমস্যা হয়নি। স্কুলের অন্য কোনো পাঠ্য বিষয় নিয়েই কোনো রকম সমস্যা হয়নি। প্রায় সকল বিষয়ে বি পেয়েছে। তার রিপোর্ট কার্ড তার মা রেফ্রিজারেটারের গায়ে আটকে দিয়েছে যেন সেটা একটা গ্রিটিং কার্ড। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সে সব অনেক দিন আগের কথা।

গণিতের ক্লাসে বসে থাকটাই তার খুব কষ্টের মনে হচ্ছে। কাপড়ের নিচ দিয়ে, বোগলে, দুপায়ের সন্ধিস্থলে—সর্বাঙ্গে যেন হেটে বেড়াচ্ছে লাল পিঁপড়ের দল। পিঁপড়েরা কামড় দিচ্ছে আর সুড়সুড়ি লাগছে, চুলকানি ছড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ইচ্ছে মত হাত চালিয়ে চুলকাতে পারছে না। নখের ডগায় চুলকিয়ে রক্ত বের করে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। পারছে না সেখানে হাত বোলাতে। তাতে বরং আরো বেড়ে যাবে চুলকানি। নাকের ডগায় যেখানে কার্টিলেজ আর হাড় ঠিক করা হয়েছে সেখানে এক ধরনের ভোতা অনুভূতি কাজ করছে।

আর চোখ—বাম চোখটা থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। লিজ-এত্তা কাঁদছে! এই যে, লিজ-এত্তা কাঁদছে! কাঁদছো কেন লিজ-এত্তা?

ছেলেগুলো- ওই ধারী ছেলেগুলো লিসেত্তাকে পছন্দ করে; পছন্দ করে বলেই তাকে খেপিয়ে আনন্দ পায়। তাদের কাছে সে যেন সৌভাগ্য আনয়নকারী কোনো ক্ষুদে প্রাণী। 

জে সিকে, মানে জিমি চ্যাংকে, সে প্রথম দেখেছিল ষষ্ঠ গ্রেডে পড়ার সময়। প্রথমবার দেখেই লিসেত্তা কিশাকে কনুই দিয়ে গুতো মেরে বলে উঠেছিল, ওহহহ! কিছুটা এম টিভির ভিডিওর যৌনসুখের গোঁঙানির মত। অবশ্য ওই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তার কোনো ধারণা এখনও হয়নি। তার মায়ের পছন্দের গানের ভিডিওর তালিকায় রয়েছে হালকা রক, রেট্রো রক, লোকগীতি, ওয়েস্টার্ন মিউজিক এবং ডিস্কো। শাওয়ার নেয়ার সময় মা এরকম শব্দ করে থাকে শুনেছে লিসেত্তে। তবে বুঝতে পারেনি সেটা রাগ-ক্ষোভ নাকি সুখের অনিুভূতি প্রকাশ করে থাকে।

চুলোয় যাক গণিতের ক্লাস! এই জায়গাটাই তার কাছে এখন অসহ্য লাগছে। জানালার পাশের সারির একেবারে সামনের দিকে বসে লিসেত্তের মনে  হচ্ছে প্রচন্ড কর্কশ আলোর মধ্যে বসে ভেতরের দিকে তাকিয়ে আছে। সে যেন এই ক্লাস থেকে বিচ্ছিন্ন। মিস নাউকি মাঝে মাঝে বলে থাকেন, এই তো, এভাবে মনোযোগ ধরে রাখতে হয়। সুতরাং লিসেত্তে চেষ্টা করে দিবাস্বপ্ন থেকে নিজেকে বিরত রাখতে যাতে মনোযোগ নষ্ট না হয়। কিন্তু সেটার ফল দাঁড়ায় উল্টো: বেশিরভাগ সময়ই মনে হয় সে এই ক্লাসের কেউ নয়। 

দ্রুত চোখের ওপর হাত বুলিয়ে, পাছার অবস্থান একটুখানি পরিবর্তন করে দেখল পিঁপড়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় কি না। প্রায় পনের মিনিট সে অপেক্ষায় আছে মিস নাউকি তার বেঢপ পাছা ঘুরিয়ে বোর্ডের দিকে তাকান কি না যাতে ভাজ করা একটা কাগজের টুকরো মাঝখানের ফাকা জায়গার অন্যপাশে বসা কিশার কাছে চূড়ে দিতে পারে। কিশা দিবে  পরের সারিতে বসা জে সির কাছে। জিনিসটা আসলে সাধারণ পাতলা কাগজ নয়; টিস্যুর মত মোটা ক্লিনেক্স পেপার। ক্লিনেক্সে গাঢ় আঙ্গুর রঙের চুমু আঁকা আছে। এটা লিসেত্তের তরফ থেকে জে সির জন্য পাঠানো হচ্ছে।

সম্পূর্ণ নতুন লিপস্টিকের চুমু আঁকতে গিয়ে লিসেত্তের মনে হল সে স্বপ্নের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। গাঢ় রক্ত বর্ণের এই লিপস্টিকের খবর তার মা জানে না। কারণ তার বান্ধবীদের মত সে বাড়িতে এটা সাধারণত ব্যবহার করে না। তবে তারা জেনে গেছে লিপস্টিকটা ঠোটে লাগানোর সাথে সাথে মুখের চেহারাটাই মুহূর্তে কেমন বদলে যায়: বয়স যেন কয়েক বছর বেড়ে যায় আর অমোঘ যৌনাবেদন তৈরি করে চেহারায়।

আড় চোখে লেসিত্তে জে সিকে দেখছে: দুসারির মাঝের ফাকা জায়গায় পা ছড়িয়ে বসে আছে। ললাটের সামনের দিকে ছড়িয়ে পড়েছে কালো রেশমী চুলের ঝাক। চেহারাতেই বোঝা যায় জে সিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা যায় না, তার দলবলকেও মোটে খাটো করে দেখা যায় না। অন্যরা তাকে এরকমই বলেছে; সতর্ক করে দিয়েছে বলা যায়। জে সি এবং তার বন্ধুরা লিসেত্তের চেয়ে এক বছর দুবছরের বড়। স্কুলে তাদেরকে ওপরের ক্লাসে উঠতে দেয়া হয়নি। অথবা তাদের সহপাঠিদের তুলনায় স্কুলে যাওয়া শুরুই করেছে পরে। তবে বিয়ারের নেশাটা মাথার পেছন দিক থেকে লিসেত্তেকে যেন বেপরোয়া, বেয়ারা করে তুলেছে।

জে সির বাবা ট্রাম্প তাজমহলে কাজ করে। চীনের বেজিং নামক এক জায়গা থেকে এসেছে এখানে। কিছুদিন নাকি এক সরকারি অফিসারের গাড়ি চালিয়েছে। আবার কার যেন বডিগার্ডও ছিল কিছুদিন। তার বাবার কাধে সে সময় বন্দুক থাকতো। কথাটা বলার সময় জে সির চোখে মুখে অহংকার ফুটে ওঠে। বন্দুকটা জে সি হাতে নিয়ে দেখেছে। তার বাবা নাকি সেটা দিয়ে মানুষকে গুলিও করেছে। একটা মেয়ে জে সিকে জিজ্ঞেস করেছিল সে কাউকে গুলি করেছে কি না। মুখে কিছু না বলে কাধ ঝাকিয়ে শুধু হেসেছে সে।

লিসেত্তের বয়স যখন নয় বছর তখন তার মা লিসেত্তেকে নিয়ে নিউ জার্সির এডিসন থেকে আটলান্টিক সিটিতে চলে আসে। মা বাবা আলাদা থাকা শুরু করেছে ততদিনে। অবশ্য সেনবাহিনীর চাকরিরত অবস্থায় বাবা ছুটির সময় তাদের সাথে এসে থেকেছে মাঝে মাঝে। এরপর বাবা আবার আলাদা হয়ে গেছে। অবশেষে তাদের বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটেছে।

মা যেসব জায়গায় কাজ করেছে সেসব জায়গার নাম মনে আছে লিসেত্তের । নামগুলোর বিশেষত্বও আছে মনে হয়। ট্রাম্প তাজমহল, বেলিস হুররে, দ্য ক্যাসিনো রয়েলে ইত্যাদি। অবশ্য সে নিশ্চিত নয় তার মা এখনও ক্যাসিনো রয়েলেতে কাজ করে কি না, কিংবা এখনও সে ব্যাকজ্যাক আড্ডার তাস সরবরাহ করে কিনা। হতে পারে—ইভেত্তে ককটেল ওয়েট্রেসের কাজেই ফিরে গেছে।

ধুর ছাই! মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। মাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেই হয়, মা, ঠিক ঠিক বলো তো কোথায় কাজ করো তুমি! মা সে সময় নিশ্চয় এমন একটা ভাব করবে যা থেকে কিছুটা আঁচ করা যেতে পারে। কিন্তু পরক্ষণেই পানিতে চোবানো টিস্যুর মত গলে যাবে; অন্যরকম ভাব দেখাবে।

জে সির বাবা তাজে নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করে। সোজা সাপটা কথা। জে সি এবং তার বন্ধুরা তাজের দিকে কখনও যায় না। তবে স্ট্রাইপের দক্ষিণ কোণের দিকে ঘোরাঘুরি করেছে কখনও কখনও। সেখানে আছে সস্তা মোটেল, ফাস্ট ফুডের দোকান, বন্ধকীর দোকান, বেইল-বন্ড শপ, দোকানের সামনের গির্জা, পার্কিং গ্যারাজ না থাকলেও এখানে ওখানে গাড়ি পার্ক করার ব্যবস্থা আছে। সন্ধ্যা নামার পর পার্কিংয়ের এবং রাস্তার আশে পাশে ঘুর ঘুর করা তাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। দেখার মত কেউ না থাকলে পার্ক করা গাড়িগুলো থেকে এটা ওটা টান দেয়া তাদের কাছে খুব কঠিন ব্যাপার নয়। লক করা দরজা কিংবা জানালা গলিয়ে হাত দিয়ে খুলে ফেলাটা এত সহজ যে পরে তারা এই বিষয় নিয়ে আড্ডার সময় বেশ মজা পায়। গাড়ির ভেতরে পাওয়া যায় মহিলাদের হাত ব্যাগের মত জিনিসপত্র। সমুদ্রের ধারে ফুটপাতে হাটার সময় তারা সাধারণত এরকমের জিনিসপত্র গাড়িতেই রেখে যায়। অবশ্য মাঝে মধ্যে হতভাগাগুলোএকেবারে বোকাচোদা হয়ে যায়: ব্যগগুলো খুলে তখন কিছুই পাওয়া যায় না।

লিসেত্তে এতক্ষণ অপেক্ষায় আছে মিস নাউকি অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরান কিনা। মেজাজ খাট্টা হওয়া শুরু হয়েছে। জে সিকে লিপস্টিকের চুমু পাঠানো মানে তাকে বুঝিয়ে দেয়া—তুমি ইচ্ছে করলে আমাকে কষে দিতে পারো। যা খুশি করতে পারো। আমি মুখিয়েই আছি। চুলোয় যাক এই বালের ক্লাস।

হতে পারে নিছক ইয়ার্কি। অনেক কিছুই তো হতে পারে ইয়ার্কি। আসল অর্থ পরে আলাদা করে ঠিক করে নেয়া যায়। পরে কী হবে সে নিয়ে লিসেত্তের আপাতত মাথাব্যথা নেই। আঙ্গুলের ডগা দিয়ে চোখটা মুছে নিল সে। কাজটা এমনভাবে করল যেন সার্জারির পরে আঙ্গুল দিয়ে চোখ মোছাটা অনুচিত। তোমার আঙ্গুলে তো ময়লা লিসেত্তে। ময়লা আঙ্গুলে চোখ ছোয়া উচিত না। ঘা ধরে যাবার আশঙ্কা থাকে। হা ঈশ্বর কী মুশকিল! ঠান্ডার সময়ে আর কড়া আলোতে তার চোখ জলে ভরে যায়। ব্যাপারটা তার বড্ড বিরক্তিকর মনে হয়। স্কুলে সব রুমে আর করিডরে এমন কড়া আলো! এই জন্য তার মা লিসেত্তের জন্য স্কুলে গাঢ় লাল রঙের চশমা পরার অনুমতি নিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। চশমা পরার কারণে তার চেহারায় ভারিক্কি ভাব চলে এসেছে। যেন সে মিড্ল স্কুলে নয়, হাইস্কুলে পড়ে; তার বয়স তের নয়, ষোল সতের। তার মায়ের পুরুষ বন্ধুদের একজন একদিন তার শরীরের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছে, “আরে ধুর, তোমার বয়স তের না।” বয়স নিয়ে লুকোচুরি করে তার লাভ কী? মা’র এই বন্ধু লোকটা একটা হারামজাদা, পোঁদের ফাঁক। লোকটার নাম চেস্টার—চেট। অবশ্য লিসেত্তের মনে আছে এই লোকটাই মাকে একবার কিছু টাকা দিয়েছিল। লিসেত্তের চোখের ডাক্তারকে দেবার সময় মা’র এই টাকাটা খুব দরকার ছিল।

আজ সকালে একা একাই উঠতে হয়েছে লিসেত্তেকে। একাই সাজাতে হয়েছে সকালের নাস্তা—হিমায়িত হুইটিস। টিভির সামনে বসে খাবার তৈরি করতে হয়েছে। সকালবেলার কার্টুন আর আজেবাজে অনুষ্ঠানগুলো মোটেই পছন্দ নয় তার। সবচেয়ে অপছন্দ খবর। পরপর তিনরাত একই পোশাকে ঘুমিয়েছে সে—কালো টি-শার্ট, অন্তর্বাস, জিন্সের ওপর পর্যন্ত আটকানো পশমী মোজা, নীলাভ সাটিনের তৈরী পেছনে তাজ লেখা তার মায়ের একটা ময়লা সোয়েটার আর নিজের বুট। টেলিফোনে কোনো মেসেজ এসেছে কিনা খুঁজতে গিয়ে দেখল নেই।

শুক্রবার রাত নটার সময় মা ফোন করেছিল। নিসেত্তে কলার আই ডি দেখেছে। ধরেনি। চুলোয় যাও তুমি! কোথায় কোন চুলোয় আছো, থাকো সেখানেই। তোমার সাথে কিসের বালের কথা? পরে রাস্তায় লোকজনের চিল্লাচিল্লি শুনে কিছুটা ভড়কে গিয়ে মা’র সেল ফোনে চেষ্টা করে পেল না। কলটা পৌছতে পারল না। নিকুচি করি তোমার! তোমাকে আমি ঘৃণা করি, ঘৃণা করি! তোমাকে ঘৃণা করি!

বাইরে থেকে ফেরার সময় মা অবশ্য ছোটখাটো সুন্দর কিছু একটা নিয়ে আসত। একবার বাবার সাথে মা তাদের দ্বিতীয় হানিমুনে গেছিল ফোর্ট লডারডেলে। মা সেবার লাল শৈবাল রঙের একটা পোশাকের সেট এনছিল। তার মধ্যে ছিল খুব সুন্দর একটা টিউনিক টপ প্যান্ট। ফোর্ট লডারডেলের হানিমুন ভেস্তে গেলেও তার জন্য উপহার আনার কথা ভোলেনি তার মা।

এইবার সুযোগ এসেছে। দ্রুত এসেছে। মিস নাউকি দরজার দিকে এগিয়ে গেছেন। কে যেন দরজায় টোকা দিচ্ছে। কিশার কাছে চিরকুটটা পার করে দেয়ার জন্য মাঝখানের দিকে ঝুকে এল লিসেত্তে। কিশা চিরকুটটা নিয়ে জে সির ডেস্কে ছুড়ে মারল। জে সি চিরকুটটার দিকে চোখ পিটপিট করে এমনভাবে তাকাল যেন ওটা ছাদ থেকে পড়া রহস্যময় কোনো পোকা। কিন্তু একবারও কিশা কিংবা লিসেত্তের দিকে তাকালো না সে। লিসেত্তে চশমার ভেতর দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে—ভঙ্গিটা কিছুটা কাধ ঝাকানির মত—জে সি এতটা ঠান্ডা, নিরাবেগ! চিরকুটটা হাতের মুঠোয় ভাঁজ করে জিন্সের পকেটে ঢুকিয়ে রাখল জে সি।

অন্য কোনো ছেলে হলে চিরকুটটা খুলে দেখত কী আছে। কিন্তু জিমি চ্যাং সে রকম নয় মোটেই। ক্লাসরুমে মেয়েদের ছুড়ে মারা চিরকুটে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। চিরকুটে কী আছে দেখার কৌতুহল তার নেই—জটপাকানো চুলের চশমাপরা মেয়েটা তাকে কী লিখেছে। কিংবা হতে পারে এরকম চিরকুটে কী থাকে তার জানা আছে—চুমু চুমু চুমু। আসল কথা হচ্ছে চিরকুটটা নিয়ে সে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসেনি। কিংবা ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ডাস্টবিনে ফেলেনি।

লিসেত্তের মুখের ভেতর তুলার মত শুকনো একটা অনুভূতি কাজ করছে। জে সিকে কিংবা কোনো ছেলেকে চিরকুট পাঠানোর অভিজ্ঞতা এটাই প্রথম। বিয়ারের যে স্বাদটা তার মধ্যে সুখের অনুভূতি তৈরি করেছিল সেটা এখন আস্তে আস্তেফিকে হয়ে যাচ্ছে।  

সম্ভবত আধা বোতল বিয়ার পান করে ফেলেছে সে। পার্কিং লটের যেখানে বাসগুলো রাখা হয় আর এঞ্জিনের ধোঁয়ায় চারপাশের বাতাসকে কলুষিত করা হয় সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঢকঢক করে পান করেছে সে। আশপাশের কেউ দেখতে পায়নি। তারা জোরে জোরে কথাবার্তা আর হাসাহাসিতে মত্ত। অন্য সময় তার দিকে তাদের বাকা চাহনির কথা মনে আছে লিসেত্তের। লিসেত্তে মুলভে উত্তপ্ত হয়ে আছে গো!

জ্যাকেটের ওপর বিয়ার ঢেলে ফেলেছে সে। গাঢ় সবুজ মোটা কাপড়ের ওপর বিয়ারের দাগ বসে গেছে। যখনই বাড়ি ফিরুক না কেন মা তার পোশাকের কোনোটাকে একটু শুকে দেখলে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলবে।

জানুয়ারি মাসের এই সোমবার। সোমবারই ছিল। সঠিক দিনটার নিশানা হারিয়ে ফেলেছে সে। এরকমই হারিয়ে ফেলেছিল সে মার হাত থেকে নেয়া চোখের ড্রপ কেনার প্রেসক্রিপশনের ছোট কাগজের টুকরোটা। প্রেসক্রিপশনটা মা তাকে দিলেছিল গত সপ্তাহে। মা তাকে সর্বশেষ দেখে গেছে গত সপ্তাহে। সম্ভবত বৃহষ্পতিবার সকালে। কিংবা বুধবার। সার্জারির পর তার চোখের জন্য দরকার ছিল প্রেসক্রিপশনে লেখা ওই স্টেরয়েড সলিউশনটা। কিন্তু প্রেসক্রিপশনটাই সে কোথাও আর খুঁজে পেল না। না জ্যাকেটে, না ব্যাগের মধ্যে, না রান্নাঘরে, না শোবার ঘরে—কোথাও নেই।

মিস নাউকি এখন দরজা থেকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়েছেন। ক্লাসের মধ্যে কার দিকে যেন। কার দিকে? লিসেত্তের দিকে? মনে হচ্ছে ভয়ের কোনো স্বপ্নে অন্যদের থেকে যখন কাউকে আলাদা করা হয়, একজন অপরিচিত ব্যক্তি, পুলিশ, ক্লাস রুমের মধ্যে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করছে, লিসেত্তে, তুমি কি আমাদের সাথে একটু বের হয়ে আসবে হলের দিকে?

নাউকির পেছনে একজন ইউনিফর্ম পরা; আটলান্টিক সিটি পি ডির কেউ হবে। দেহের গঠন আর গায়ের রঙে মনে হচ্ছে স্পেনীয়। কালো চকচকে চুল শক্ত করে পেছনের দিকে বাধা। ক্লাসের সবাই এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আর বেচারি লিসেত্তে নিজের আসনে বসে একেবারে স্থবির হয়ে আছে। ঠোটে কামড় দিয়ে ওঠার চেষ্টা করে সে। ধেত, পায়ের সাথে ব্যাগের ফিতায় প্যাচ লেগে যাচ্ছে! কানের ভেতর কেমন একটা জোর শব্দ হতে থাকে। তার ভেতর দিয়েই একজন মহিলা পুলিশের কণ্ঠ শুনতে পায়। আগের কথাগুলোই বলছে সাথে আরো বলছে, ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সব নিয়ে এস। তার মানে লিসেত্তে আর ক্লাসরুমে ফিরে আসছে না।

ভয়ে ভেতর থেকে বিয়ারের ঠেকুড় বের হয়ে আসে। সারা মুখে টক টক বমিভাবের সাথে মিশে আছে বিয়ারের গন্ধ। ঈশ্বর, পুলিশ মহিলা তার মুখের গন্ধ পেয়ে যায় নাকি!

করিডরে এসে আরো জোরে শ্বদ শুনতে পায় লিসেত্তে। মহিলার কণ্ঠ থেকে উদ্ভট শব্দ বের হয়, এই ডি। তুমি, যদি লিসেত্তে মুলভে হয়ে থাকো তাহলে আমার সাথে এস। 

এই ডি, এই ডি—বাতাসে ভেসে আসা শঙ্খচিলের ডাকের মত: কান পেতে কষ্ট করে শুনতে চাইলেও একবার মিলিয়ে যায় আবার ভেসে আসে।

শেষে দেখা গেল তার খোঁজে এসেছে দুজন পুলিশ।

স্পেনিয় চেহারার মহিলা লিসেত্তের কাছে নিজের পরিচয় দিল: অফিসার মলিনা। তার বলার ভঙ্গিতে মনে হতে পারে লিসেত্তে তার নাম তো ব্যবহার করবেই, মনেও রাখবে। অন্য পুলিশ লোকটা পুরুষ। বয়সে মহিলার চেয়ে আরেকটু ছোট। তার ত্বক আঁচিলের দাগে ভরা। শ্বেতাঙ্গ চেহারাটা বোঝাই মুশকিল।

লিসেত্তের দিকে দুজনের চাহনি একই রকম: কী রকম? যেন দুজনই লিসেত্তের জন্য দুঃখিত, কিংবা তাকে নিয়ে বিপাকে পড়েছে। অথবা—আর কী? লিসেত্তে দেখতে পাচ্ছে পুরুষ পুলিশটার চোখ পড়েছে লিসেত্তের হাঁটুতে টাইট ফিটিং জিন্সের ওপরে লাল রঙের তালি দেয়া জায়গাটাতে। আরেকবার লোকটা তাকাচ্ছে তার ভীত মুখের দিকে।

ক্লাসের মধ্যে চিরকুট চালাচালির জন্য যে তাকে গ্রেফতার করতে এসেছে তা তো নয়। কয়েকদিন আগে রাইট এইডে প্লাস্টিকের লিপস্টিক টিউব সাজানো ছিল একটা ঝুড়িতে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় লিসেত্তে নিজের অজান্তে তিনটে টিউব তুলে নিয়ে পকেটে পুরেছিল। হতে পারে তার জন্য তাকে গ্রেফতার করতে এসেছে।

তুমি ইভেত্তে মুলভের মেয়ে লিসেত্তে মুলভে?

লিসেত্তে নিরাবেগে মাথা ঝাকালো শুধু।

অফিসার মলিনা কথা বলছিল। মহিলা যখন খুব জোর করে না হলেও দৃঢ়ভাবে তার কনুই ধরল লিসেত্তের কোনো রকম প্রতিক্রিয়া জানানোর মত অবস্থা নেই। ভয়ের কারণে। কোনো আত্মীয় মহিলা যেমন করে ধরতে পারেন তেমন করে তার হাত ধরে সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে অফিসার লিসেত্তের সাথে খুব পরিচিত ভঙ্গিতে কথা বলতে লাগল। তার কণ্ঠেই যেন বলে দিচ্ছে, তোমার কিছু হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের সাথে একটু আসতে হবে শুধু।

কয়দিন আগে দেখা হয়েছিল তোমার মায়ের সাথে? কিংবা কথা হয়েছিল? আজকে?

আজকে? কী আজকে? লিসেত্তের কিছু মনে নেই।

লিসেত্তে, তোমার মা কি বাড়ির বাইরে? তিনি কি ফোন করেছিলেন তোমাকে?

লিসেত্তে মাথা ঝাকালো।

তোমার মা বাড়ির বাইরে যাননি? তিনি তো বাড়িতেও নেই, তাই না?

লিসেত্তে ভাবতে থাকে। সঠিক উত্তর কী হতে পারে?

একটা রহস্যময় হাসিতে তার মুখটা একটু বেকে যায়। এরকম হাসি দেখে তার মা ও বোকা বনে যায়।

মলিনা আবার বলল, লিসেত্তে, তোমার মায়ের সাথে সর্বশেষ কখন কথা হয়েছে?

কী যেন একটা অস্পষ্টভাবে বলল সে। কিছুই বোঝা গেল না।

আজ সকালে তো না? মানে তুমি স্কুলে যাওয়ার আগে না, তাই না?

না, আজ নয়, লিসেত্তে মাথা ঝাকিয়ে বলল। স্পষ্ট করে কিছু একটা বলতে পেরেই কৃতজ্ঞ।

ততক্ষণে তারা স্কুলের পেছনে বাইরে চলে এসেছে। ফায়ার লাইনে তাদের গাড়ি দাঁড়য়ে। লিসেত্তের মধ্যে আতঙ্ক চলে এল: তাকে কি গ্রেফতার করে অপ্রাপ্তবয়স্কদের আদালতে নেয়া হচ্ছে? জে সি এবং তার দলবলকে অপ্রাপ্তবয়স্কদের আদালত নিয়ে হাসি তামাশা করতে শুনেছে সে।

ঠান্ডা ভেজা বাতাসে বিয়ারের শেষ নেশাটুকু বাষ্পে মিশে গেল। পুলিশ দুজনের ওপর তার প্রচন্ড ঘৃণা হচ্ছে। তার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন তার মত দুঃখি আর করুণ কাউকে এ জন্মে দেখেনি। সে যেন একটা নাক-সর্বস্ব ঘেয়ো কুত্তা। পুলিশ দুজন লিসেত্তের কপালের ওপরের দিকে যেখানে চুলের শুরু সেখানে আঁচিলের মত কালো দাগ দেখে থাকতে পারে। তার চুলে গত চার পাঁচ দিন চিরুনি কিংবা ব্রাশ ছোয়ানো হয়নি। শ্যাম্পু তো দূরের কথা। হতে পারে তারা লিসেত্তের কোঁকড়া এলোমেলো চুলের দিকেই চেয়ে আছে। কয়েকদিন ধরে গোসলও করতে পারেনি। এতো কদিন ধরেই মা বাইরে। 

এতোদিন বাইরে আছে উইক এন্ড কাটানোর জন্য কারো সাথে—কার সাথে? মায়ের গোপন কৌশলগুলোর এটাও একটা। হয়তো কোনো নতুন পুরুষ বন্ধুর সাথে, ক্যাসিনোতে আলাপের পরই বন্ধুত্ব হয়েছে এরকম কেউ। এরকম অসংখ্য শিকড়হীন, ভাসমান মানুষ আছে আটলান্টিক সিটিতে। ক্যাসিনোতে জিতে গেলে ফুর্তি করার জন্য কাউকে দরকার হয়ে থাকে। আবার হেরে গেলেও মনকে চাঙ্গা করার জন্য কাউকে দরকার হয়ে থাকে। ইভেত্তে মুলভে এমনই একজন! মধু-রং চুল—লিসেত্তের মত ময়লা রং নয়, ঢেউ তোলা কাধ, আলো ঠিকরে পড়া চোখ, পুরুষ-কাঙ্খিত সপ্রতিভ সান্তনাদায়ী হাসি, ঠান্ডা নিরাবেগ তীক্ষ্ণধী নয়, পুরুষকে বেপরোয়া পথের শেষ প্রান্তে নিয়ে যাওয়ার মতও নয়।

কার সাথে উইক এন্ড কাটাতে যাচ্ছে জিজ্ঞেস করেছে লিসেত্তে। মা বলেছে, “তুমি চিনবে না” কথাটা বলে এমনভাবে হেসেছে যেন লিসেত্তের দিকে নয়, নিজের দিকেই তার ইঙ্গিত। অতল, সুগভীর তার চাহনি। যেন সাঁতারের যাত্রাবিন্দু থেকে এখনই লাফিয়ে পড়বে শূন্যে। ভাব দেখে লিসেত্তে ভেবেছে, তাহলে বাবা?

লিসেত্তে জানে বাবার সাথে মা’র এখনও যোগাযোগ আছে। মা তাকে বলেনি। তবে কিভাবে যেন সে জেনে গেছে। এমনকি তাদের কদর্য তালাক হয়ে যাওয়ার পরও তাদের দুজনের মধ্যে যোগাযোগ আছে। বাবার কাছ থেকে শুনেছে সে। যেহেতু বাবা মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেও লিসেত্তে তার বাবারই মেয়ে, কাজেই তাদের যোগাযোগ না করে উপায় নেই। অন্য সবকিছু বদলে যেতে পারে—যেমন বাবার থাকার জায়গা। কিংবা তাদের আবার বিয়েও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সন্তানের সাথে সম্পর্ক ঠিকই থাকবে। বদলাবে না।

সুতরাং লিসেত্তে নাছোড় কণ্ঠে বার বার জিজ্ঞেস করেছে, মা কি বাবার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে? বাবার সাথে? অবশ্য মা হেসে জবাব দিয়েছে, আরে না, চুলোয় যাক ওই বদের সাথে দেখা করা! আমি কি আর ওই পোঁদের ফুটোর সাথে দেখা করতে যাই নাকি?

এই বলেই মা উইক এন্ড কাটাতে চলে গেছে। যাবার সময় বলেছে, আমি কি তোমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারি লিসেত্তে? লিসেত্তে বলেছে, হ্যাঁ, অবশ্যই পারো।

বাড়িতে একা থাকা মানে যতক্ষণ খুশি জেগে থাকতে পারা। ইচ্ছে মত যেকোনো চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখতে পারা। সোফার ওপর হাত ছড়িয়ে যতক্ষণ খুশি সেল ফোনে কথা বলতে পারা।

কেনটাকি ফ্রায়েড চিকেন, ভিতো পিজেরিয়া কিংবা তাকো বেলের মত মিনি মলগুলো খুব কাছেই—কয়েক কদম হাঁটলেই পাওয়া যায়। অবশ্য রাতের খাবার ফ্রিজ থেকে বের করে মাইক্রোওয়েভে গরম করে টিভি দেখতে দেখতে খাওয়া আরো সহজ। প্রথম রাতে কিশা এসেছিল। কিশা যে ডিভিডিটা এনেছিল দুজনে মিলে দেখেছে আর ফ্রিজ থেকে বের করে খাবার খেয়েছে। বিশা জিজ্ঞেস করেছিল, চারদিকে এতো ঠান্ডা! এর মধ্যে তোমার মা বাইরে!  কোথায় গেছে?

লিসেত্তের মনে হল মা এবার ভেগাসে গেছে। সাথে কোনো নতুন পুরুষ বন্ধু। কিংবা কে জানে অন্য কেউ। বছরের এই সময়টাতে সমুদ্রের কাছকাছিও খুব ঠান্ডা আর ভেজা-আর্দ্র। এসময়ে যাওয়ার মত সবচেয়ে সুন্দর জায়গা ভেগাস।

ক্যাসিনো সূত্রে মা’র অনেক বন্ধু আছে। যেকোনো সময় তার ডাক আসতে পারে তাদের সাথে যাওয়ার জন্য। একমাত্র বালের স্কুল ছাড়া আমাকে আর কোথাও নেয়নি।

তাহলে সর্বশেষ কখন তার সাথে তোমার কথা হয়েছে?

পুলিশ দু’জন তার দিকে তাকিয়েই আছে। অপেক্ষায় আছে তার কাছ থেকে কী উত্তর আসে। লিসেত্তে হাতড়ে যাচ্ছে যেন তারই কোনো দোষ হয়েছে, হতে পারে গতকাল কিংবা গত পরশু।

লিসেত্তে একদিন পার্কিং গ্যারাজের জানালায় একটা চড়–ই পাখিকে হতাশায় ডানা ঝাপটাতে দেখেছে। সিলিংয়ে আটকে পড়া পাখিটা ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে নিজেকেই বরং ক্লান্ত করে ফেলছিল। বিপন্ন সেই চড়–ইয়ের মত তার হৃদপিন্ডটা বুকের মধ্যে ছটফট করছে। 

ইভেত্তে মুলভে আইনগত কোনো জটিলতায় পড়েছে—ঘটনা কি সেরকম কিছু?

লিসেত্তে এযাবৎ শুধু একটা আদালতই দেখেছে: ওশান কাউন্টি ফ্যামিলি কোর্ট। সেখানকার বিচারক একবার ইভেত্তে মুলভেকে কাস্টডিতে রেখেছিলেন। আর ডুয়ানে মুলভেকে দেখা করার সুযোগ দিয়েছিলেন। এবার সেরকম কিছু ঘটে থাকলে লিসেত্তেকে ফস্টার হোমে থাকতে হবে। বাবার কাছে থাকা সম্ভব হবে না। কারণ বাবা ইউ এস আর্মির একজন সার্জেন্ট। সে শুনেছে বাবাকে তৃতীয়বারের মত ইরাকে পাঠানো হয়েছে। কথাটা তার কাছে অপরিচিত, অস্বাভাবিক মনে হয়।

লিসেত্তে জানে বাবা তাকে আঘাত দিতে চায়নি। মা অবশ্য বিশ্বাস করে উল্টোটা। সেজন্যই মা ৯১১তে ফোন করেনি। ই আর-এ ডাক্তার যখন জিজ্ঞেস করলেন তার মুখে এত খত হল কী করে, নাক আর চোখের কোটরে আঘাত লাগল কী করে লিসেত্তে বলেছিল সিড়িতে একটা দুর্ঘটনা হয়েছিল, দৌড়ে নামার সময় পড়ে গেছিল।

কথাটা সত্যি ছিল—দৌড়ে নামার সময় সে পড়ে গেছিল। পেছনে বাবা চিৎকার করছিল আর মুষ্টিবদ্ধ হাত উচিয়েছিল। তাকে আসলে মারতে চায়নি বাবা। কিন্তু বাবা তখন ছিল মাতাল অবস্থায়। পরে বাবা যা যা বলেছে লিসেত্তে সেসবই আসলে শুনতে চেয়েছিল। তাদের কথা শুনে লিসেত্তের কান্না এসেছে। তাদের কথা শোনাটা তার জন্য খুব জরুরি ছিল।

আর তোমার বাবা—তার সাথে তোমার সর্বশেষ কখন দেখা হয়েছিল?

পুরুষ পুলিশটা গাড়ি চালাচ্ছে। আর মলিনা বসেছে যাত্রীর আসনে। এমনভাবে বসেছে যাতে লিসেত্তেকে সামনা সামনি দেখা যায়। চেরি ফলের মত তার লাল ঠোট দেখে লিসেত্তের মনে হয় তার মুখটা যেন কোনো বিলবোর্ডে আঁকানো: উজ্জ্বল তবে আবহাওয়ার আঘাতে কিছুটা ক্ষয়ে গেছে। তার মসৃন কালো নরম চুল সিল কোটের মত জ্বলজ্বলে। জ্বলজ্বলে চোখ দুটোতে অবর্ণনীয় প্রজ্ঞার ছাপ। এরকম চাহনি লিসেত্তে দেখেছে তার মায়ের চেয়ে বয়সে বড় মহিলাদের চোখে। সেই চাহনিতে অননুমোদনের কিছু থাকে না; থাকে আকস্মিক সহনুভূতি আর মমতা। তাকে খুটিয়ে ক’টিয়ে দেখে সেই দৃষ্টি।

এধরনের চাহনির সামনে লিসেত্তে অস্বস্তি বোধ করে। এরকম দৃষ্টি লিসেত্তে দেখেছে মিস নাউকির চোখেও। এরকম দৃষ্টির চেয়ে বরং হতাশা আর বিরক্তির দৃষ্টিই সহনীয়।

মলিনা প্রায় দুতিনবার বলে ফেলেছে তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আই ডির জন্য তাকে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু কথা দুটো উচ্চারণের কারণে বোধগম্যতা পায়নি। মলিনা উচ্চারণ করেছে এই ডি।

“তুমি যতক্ষণ চাও ঠিক ততক্ষণই থাকব আমরা। কিংবা মোটেও বেশি সময় লাগবে না। সেটা নির্ভর করছে তোমার ওপর। হতে পারে এক মিনিটেই কাজ শেষ হয়ে যাবে।

মলিনার এরকম সুরে কথা বলার মানে লিসেত্তেকে প্রবোধ দিয়ে রাখা। কিন্তু লিসেত্তের কাছে কোনো রকম অর্থ তৈরি করতেই যেন পারে না তার এই সহানুভূতির সুর। তার উচ্চারিত শব্দগুলোর যে আবেদনই থাকুক না কেন ভেতরের কোনো অর্থ অবশ্যই আছে এবং সেটা লিসেত্তের আয়ত্বের বাইরে। বড়রা মাঝে মাঝে তাকে ভুল বুঝে থাকেন। তাদের মনে হয় লিসেত্তে বোকার হাসি হাসছে। কিন্তু আসলে সেরকম দেখানোর কারণ হল তার বাম চোখের পাশের ত্বক। চোখের কোটর নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরে আবার ঠিক করা হয়েছে। স্নায়ু-পেশীগুলোর বেশ কিছু মরে যাওয়ার কারণে মুখের ওই পাশটাতে শুষ্ক চাহনির ইঙ্গিত তৈরি করে থাকে। কী এক উদ্ভট দুর্ঘটনা! মা বলেছিল। বার বার বলেছি সিড়িতে না দৌড়াতে। জানেন তো বাচ্চারা কেমন দুষ্ট, ডাক্তারকে কিছুটা কৈফিয়তের জবাবের মত করে বলেছিল তার মা। নিজের জানা থাকলেও তার মা ডাক্তারের কাছে জানতে চেয়েছিল, ছিড়ে যাওয়া নার্ভগুলো ঠিক হয়ে যাবে তো?

ছিড়ে যাওয়া কেন বলছেন? মরে যাওয়া।

হাসপাতালে পৌছে তারা মূল ভবনের পেছনে গাড়ি পার্ক করল। মলিনা পুরুষ পুলিশটার সাথে কী যেন আলাপ করছে। লিসেত্তে শুনতে পাচ্ছে না তাদের কথা। দরকার মনেও করছে না। তবে তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে স্পেনিয় মহিলা তার সাথে বন্ধুর মত আচরণ করবে এবং তাকে বিশ্বাস করতে পারবে লিসেত্তে। এই মহিলাকে দেখে লিসেত্তের মনে পড়ছে তার বন্ধুদের স্পেনিয় মাদের কথা: সবাই খুব সুন্দর, কোমল স্বভাবের। মলিনাকেও সেরকমই মনে হচ্ছে। কল্পনায় মা হিসেবে কিংবা দাদি হিসেবে লিসেত্তে দেখতে পাচ্ছে মলিনা বেশ মানানসই। ভিন্ন বিষয়টা হচ্ছে মলিনা একজন পুলিশ এবং ঘাড়ে বন্দুক বয়ে বেড়াচ্ছে।

লিসেত্তের মা’র কয়েকজন পুলিশের লোকের সাথেও পরিচয় আছে। তাদের অনেকের সাথে বাইরেও গেছে। মা বলেছে পুলিশের জীবন শালার একেবারে একঘেয়ে। মাঝে মধ্যে হঠাৎ দ্রুত কোনো ঘটনা ঘটে। তাতে আবার মুহূর্তের মধ্যে ধরাশায়ী হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অসহ্য রকমের একঘেয়ে। ব্যাকজ্যাক খেলায় যেমন কেউ হয়তো মনে করতে পারে হাউসের সবাইকে ফাঁকি দিয়ে জিতে যাবে। জিতে যাওয়া সম্ভব নয়; পারবে না জিততে।

 

তারা এখন দাঁড়িয়ে আছে হাসপাতালের ভেতরে, লিফটের কাছে। লোকজন চারপাশে চলাফেরা করছে। তাদেরকে মনে হচ্ছে ফটোগ্রাফের পেছনে আবছা আবহের মত। মলিনা এখন আবার লিসেত্তের হাত ধরেছে বলে তার মনে হচ্ছে তাদের কথা শোনা এখন জরুরি। মলিনা কি মনে করছে লিসেত্তে পালিয়ে যেতে পারে? পুরুষ পুলিশটা একটু দূরে আছে, মুখের ভাবে কিছুটা তাচ্ছিল্য ধরে আছে।

মলিনার কথা মনে হচ্ছে পরিস্থিতির সাথে বেখাপ্পা। তবে লিসেত্তে পরে হয়তো দেখবে পুলিশ মহিলা যা যা বলছে সবই প্রাসঙ্গিক: দুতিন সপ্তাহ আগে চলে যাওয়া বড় দিনের কথা, কিংবা নতুন বছরের কথা বা আরো যে সব পর্ব লিসেত্তে এবং তার মা ছুটির দিনগুলোতে একসাথে কাটিয়েছে। সেগুলোতে কোনো বিশেষত্ব ছিল কিনা।

লিসেত্তে মনে করতে চেষ্টা করছে ছুটির দিন বলে আলাদা কিছু নেই। মা’র সাথে ছুটির দিনে কিছুই করা হয়নি। শুধু কিছু লোকজন দেখেছে। আর বিশেষ কিছু নয়।

তোমার বাবার সাথে দেখা হয়নি?

না।

সর্বশেষ বাবার সাথে কখন দেখা হয়েছিল?

লিসেত্তে মনে করতে চেষ্টা করছে তার মুখের এবং চোখের সার্জারি করার আগেই বাবা চলে গেছে। সেও স্কুলের বাইরে। খুব সম্ভবত গ্রীষ্ম চলছে তখন। জুলাইয়ের চার তারিখ হতে পারে।

তার পরে আর দেখা হয়নি?

লিসেত্তে হাত দিয়ে চোখে একটা ঝাপটা মেরে বোঝার চেষ্টা করছে এটা টিভিতে দেখা পুলিশের কোনো অনুষ্ঠান নাকি।

নববর্ষে তোমার মা বাইরে যাননি?

হ্যাঁ, অবশ্যই বাইরে গিয়েছিল।

কার সাথে গিয়েছিল জানো?

না।

সে লোকটা তোমার মাকে তুলে নেয়ার জন্য তোমাদের বাড়িতে আসেনি?

লিসেত্তে মনে করার চেষ্টা করছে। যে যখনই এসেছে লিসেত্তে আড়ালে থাকার চেষ্টা করেছে। তার মা’র মেয়ে বন্ধুরা এলেও সে সামনে যায়নি। কেন যায়নি? কোনো কারণ নেই। এমনিই।

লিসেত্তে, তুমি কত বড় হয়ে যাচ্ছ।

লিসেত্তে, তুমি তোমার মা’র চেয়েও লম্বা হয়ে যাচ্ছ!  

 তারা নিচের দিকে যাওয়ার জন্য লিফটে উঠছে। গন্তব্য মর্গ লেখা ফ্লোর।

হাসপাতালের পরিবেশ এখানে ভিন্ন। রাসায়নিক গন্ধ মেশানো বাতাস একটু বেশিই ঠান্ডা। লোকজনের আনাগোনা খুব কম। হাসপাতালের কর্মচারীরাও সংখ্যায় কম এখানে। সাদা প্যান্ট, সাদা শার্ট এবং কার্ডিগান সোয়েটার পরা একজন আয়া জানাল তদন্তকারী এখনই এসে যাবেন।

লিসেত্তেরা বসেছে: দুপাশে পুলিশ দুজন। লিসেত্তের হাটুর দিকে খুব দুর্বল লাগছে। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, নিরাপত্তা হেফজতে রাখা হয়েছে এবং সবার সামনে তার ব্যক্তিগত বিষয় আশয় খোলাসা হবে ভেবে অসুস্থ বোধ হচ্ছে। একথা সেকথার সুরে মলিনা লিসেত্তেকে আটলান্টিক সিটির দক্ষিণ পাশে অবস্থিত ব্লু মুন মোটেল সম্পর্কে জানতে চাইল। লিসেত্তে কি ব্লু মুন মোটেল সম্পর্কে কিছু শুনেছে? লিসেত্তে জানাল, না। শোনেনি। সারা আটলান্টিক সিটি জুড়েই কত কত মোটেল। সেগুলোর মধ্যে কিছু কিছু আবার নোংরা। মলিনা জিজ্ঞেস করে তার মা সেসব জায়গায় কাজ করেছে কি না। লিসেত্তে বলে তার মনে হয় মা ওই সব জায়গায় কাজ করেনি। ইভেত্তে মুলভে ব্লু মুন মোটেলে কাজ করে থাকলে সে শুনে থাকত। লিসেত্তে জানায় তার মা মোটেলের ককটেল ওয়েটার নয়; সে ব্যাকজ্যাক খেলায় তাস সরবরাহ করে। আর তার জন্য মোটামুটি প্রশিক্ষণও দরকার হয়ে থাকে। 

অন্ধকারে লাইটের সুইচের দিকে হাতড়ানোর মত করে লিসেত্তে জানতে চায়, মা’র কি কোনো সমস্যা হয়েছে?

মনের ভেতর মায়ের বিরুদ্ধে ক্ষেভের একটা দলা পাকাতে থাকে। যদি সমস্যা হয়েই থাকে তার জন্য মা নিজেই দায়ী।

মলিনা জানায় তারা এখনও নিশ্চিত নয়। আই ডি পাওয়া গেলেই সব পরিষ্কার বোঝা যাবে।

লিসেত্তে, তোমার সাহায্য দরকার আমাদের। আশা করছি তুমিই পরিচয় সনাক্ত করার ব্যাপারে কিছু একটা করতে পারবে।

স্কুলে থাকতেই এদের মুখে আই ডি কথাটা এই ডি উচ্চারণে শুনেছে। কেমন রহস্যজনক! তাকে কি দ্বিধায় ফেলে দেয়া হচ্ছে? সিড়িতে পড়ে গিয়ে মুখে মাথায় আঘাত লাগানোর পর দেয়াল না ধরলে হাটতে পারেনি। ঠিক তখনকার মত একটা বেঘোর অবস্থা তৈরি হয়েছে। সবকিছু বেভুল লাগছে। মাথার ভেতর শর্ট সার্কিটের মত হয়ে গেছে।

এই জিনিসগুলো কি চিনতে পারো লিসেত্তে? আগে দেখেছো বলে মনে হয়?

মর্গের একজন আয়া একটা বাক্স এনে রাখল সামনে। বাক্সের ভেতর আরো অনেক কিছুর মধ্যে দুটো জিনিস হল—একটা মহিলাদের হাতব্যাগ আরেকটা ওয়ালেট। হাতে দস্তানা পরে মলিনা সাবধানে জিনিসদুটোকে ওপরে তুলল। লিসেত্তে তাকিয়ে আছে হাতব্যাগ আর ওয়ালেটটার দিকে। কী এগুলো? এগুলো কি তার মায়ের ছিল। লিসেত্তের মনে নেই আগে কখনও এগুলো দেখেছে কি না। বাদামী রঙের চামড়ার হাতব্যগটার দিকে তাকিয়ে থেকে দেখতে পেল ব্যাগটার গায়ে তামার কারুকাজ করা। কালো ওয়ালেটটা দেখতে বেশ ময়লা-মলিন। ফুটপাত দিয়ে হাটার সময় পাশের দোকানগুলেতে কিংবা ডাম্পস্টারে ঝুলতে দেখা যায় এরকম ওয়ালেট। ভেতরে টাকা পয়সা আছে কি না দেখার মত আগ্রহও থাকে না কারো এগুলোর প্রতি।

মলিনা জানায় এই জিনিসগুলো ব্লু মুন মোটেলের পেছনের নালা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। সেখানে একজন মহিলার লাশও পাওয়া গেছে। পচে বিকৃত হয়ে যাওয়া লাশ। তার পরিচয় বের করা যায়নি এখনও।

মলিনা কথা বলছে খুব নরম, সাবধানী সুরে। লিসেত্তের হাতটা সে ধরেছে দৃঢ়ভাবে যাতে লিসেত্তে বার বার তার বাম চোখে হাত বোলাতে কিংবা ডলা দিতে না পারে। বার বার এরকমই করে যাচ্ছে মেয়েটা।

ব্যাগের সেলাই খুলে ভেতর থেকে সব বের করে ফেলা হয়েছে। ওয়ালেটের ভেতর থেকে পাওয়া গেছে নি উ জার্সি থেকে ইস্যু করা ইভেত্তে মুলভের নামে ড্রাইভিং লাইসেন্স। ক্রেডিট কার্ড কিংবা টাকা পয়সা নেই। অন্য কোনো আই ডি নেই। এক টুকরো কাগজে একটা নাম এবং ফোন নম্বর লেখা। জরুরি প্রয়োজনে ফোন করার জন্য। কিন্তু ওই নম্বরে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে দেখা গেছে সংযোগ নেই। নম্বরটা তোমার মায়ের কোনো আত্মীয়ের। নাম ইরিস পেডারসেন। নিউ জার্সির এডিসনে ছিলেন কিংবা এখনও আছেন। তার সম্পর্কে জানো কিছু?

লিসেত্তে মাথা ঝাকিয়ে জানায় তার পক্ষে এতোসব জানা সম্ভব নয়। সে হাতব্যাগ দেখে চিনতে পারেনি; ওয়ালেটও চিনতে পারেনি। নিশ্চিত এসবের মধ্যে তাকে জড়ানোই ঠিক হচ্ছে না। আর এই নোংরা জিনিসগুলো তার মা’র হতেই পারে না।

লিসেত্তে ভাল করে খেয়াল করে দেখল মলিনার চোখদুটো বেশ চমৎকার দেখতে: ঘন কালো পল্লব। লিসেত্তের মা মাঝে মাঝে মাসকারার ব্রাশ দিয়ে এরকমই বানাতে চেষ্টা করেছে। চোখের নিচের ত্বক খুব কোমল মসৃন। ছোট ছোট কাটাকুটির দাগ আছে। গলার প্রায় সবখানেই ছোট ছোট সুন্দর কালো তিল। লিসেত্তের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় মলিনার মত একজন নারী পুলিশের দায়িত্ব পালন করছে। চামড়ার বেল্টের সাথে হোলস্টারে বন্দুক বয়ে বেড়াচ্ছে। প্রয়োজনে গুলিও করতে সক্ষম, ইচ্ছে করলেই পারে। কেননা লিসেত্তে বুঝতে পারছে তার শরীরটা মা হওয়ার মতই উপযুক্ত : প্রশস্ত নিতম্ব, ঢলঢল স্তন তার জ্যাকেটের সামনে পর্যন্ত গড়িয়ে পড়েছে। লিসেত্তে কল্পনায় দেখতে থাকে যদি মলিনাকে একটা ঘুসি মারা যায়, লাথি দেয়া যায়, থুথু ছিটিয়ে দেয়া যায় কিংবা কামড়ে দেয়া যায় তাহলে সে গুলি করবে।

পুরুষ পুলিশটার কথা ধরলে ঠিক আছে। তার বন্দুক থাকতে পারে।  সে বন্দুক ব্যবহার করবে—স্বাভাবিক।

বাবা তাদেরকে তার বন্দুক দেখিয়েছে। বাবা ইরাক থেকে বন্দুকগুলো এনেছিল। সেনাবাহিনী থেকে পাওয়া বন্দুক নয় সেগুলো। ব্যক্তিগত: কাঠের হাতলঅলা পিস্তল একটা, আরেকটা ভারী রিভলভার। বাবা বলেছে বন্দুকগুলো সে তাস খেলায় জিতেছে।

হতেও পারে বাবা বন্দুকগুলো ইরাক থেকে আনেনি। বাবার একবার ফোর্ট ব্র্যাগে পোস্টিং হয়েছিল। সম্ভবত সেখান থেকে এনেছে।

লিসেত্তে বলল, যদি তার মায়ের ড্রাইভিং লাইসেন্স ওই ওয়ালেটের মধ্যে পাওয়া গিয়ে থাকে তাহলে ওয়ালেটটি তার মায়ের। কিন্তু সত্যিই সে ওই ওয়ালেটটি আগে কখনও দেখেছে বলে মনে হয় না।

আর ইরিস পেডারসেন সম্পর্কে লিসেত্তে বলল, ভদ্রমহিলা তার নয়, তার মায়ের খালা হন। তাকেও লিসেত্তে খুব সম্প্রতি দেখেছে এমন নয়। তার মা ও তাকে সম্প্রতি দেখেছে এমন নয়। মহিলার বয়স অনেক, লিসেত্তের নানি হওয়ার মতই। তার সম্পর্কে শুধু জানে যে মহিলা আর বেঁচে নেই। 

আমরা তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। এডিসনের পুলিশ বিভাগও চেষ্টা করেছে। কিন্তু....

মলিনা বলল, ইভেত্তে মুলভেকে চিনতে পারে এমন কাউকে দরকার। মৃতদেহ ইভেত্তে মুলভে কিংবা নিদেন পক্ষে তারই কাছকাছি বয়সী কেউ—সেটা নির্ধারন করার জন্যও নির্ভরযোগ্য কাউকে দরকার। মৃতদেহের অবস্থা আর মুখের ক্ষতগুলোর কারণে ড্রাইভিং লাইসেন্সের ছবি থেকে মিলিয়ে দেখা কঠিন হয়ে গেছে। যেসব ক্যাসিনোতে ইভেত্তে মুলভে কাজ করত সেখানকার ফাইলপত্রে রক্ষিত ছবি থেকেও মেলানো ওই কারণেই সম্ভব হচ্ছে না। মলিনা লিসেত্তেকে আরো জানাল তারা লিসেত্তের বাবা ডুয়ানে ডেভিড মুলভের সাথেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু যতদূর তারা জেনেছে ডেভিড মুলভে নিউ জার্সির এডিসন কিংবা অন্য কোথাও নেই।

লিসেত্তে বলল, আমার বাবা সেনাবাহিনীতে। বাবা সেনাবাহিনীর সার্জেন্ট। বাবার পোস্টিং ছিল ফোর্ট ব্র্যাগে। কিন্তু এখন বাবা ইরাকে।

মলিনা বলল, না, লিসেত্তে। তোমার বাবা আর সেনাবাহিনীতে নেই। তিনি আর সার্জেন্ট নন। তিনি এখন আর ইরাকেও নেই। সেনাবাহিনীর দলিলপত্রে ডুয়ানে মুলভের নাম নেই এখন। গত বছরের ডিসেম্বারের ছাব্বিশ তারিখ থেকে তিনি এ ডাব্লিউ ও এল।

লিসেত্তে বিস্মিত। বিস্ময়ের মাত্রায় সে আর কথাই বলতে পারছে না। মলিনা তাকে ধরে না থাকলে সে হয়তো লাফিয়ে পালিয়ে যেত।

তার প্রচন্ড কাঁপুনি হচ্ছে। সুতির জ্যাকেটটা আসলে শীতের জন্য নয়, নোংরা ঠান্ডা তাপহীন। বের হওয়ার সময় মা সামনে ছিল না বলে বকতে পারেনি, গরম কপড় পড়ো। যিশুর দোহাই, এখনও জানুয়ারি মাস।

মর্গের আরেক কর্তা এল। দেখতে অনেকটা ভারতীয় চেহারার। সম্ভবত ডাক্তার ইনি। পুলিশদের সাথে নিচু গলায় কথা বলতে লাগলেন তিনি। লিসেত্তে সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেলল। তারা কী বলছে শুনতে পাচ্ছে না। কল্পনায় ক্লাসরুমের চেহারাটা দেখতে চেষ্টা করছে। মিস নাউকি এখনও তার কিচ কিচ শব্দ তোলা চক হাতে, জে সি অলস ভঙ্গিতে বসে আছে তার সিটে—মুখের ওপর ছড়ানো লম্বা চুল, আছে কিশা উত্তেজনা আর ভয়ে যার মুখ দিয়ে নিশ্বাস বের হয়; লিসেত্তের নিজের ডেস্কও আছে—শূন্য পড়ে আছে। এতক্ষণ তৃতীয় পিরিয়ড চলছে। অবশ্য লিসেত্তের ইংরেজি ক্লাসে জে সি থাকে না। তারপর মনে পড়ে গেল ক্যাফেটেরিয়ার কথা।

১১.৪৫ মিনিটে বেল বাজলে লাঞ্চ টাইম। তখন সবার সাথে সেও লাইনে দাঁড়ায়। সামনে থেকে ভেসে আসে তেল সর্বস্ব খাবারের সুগন্ধ: ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, ম্য্যকারনি, পনির, হালকা মরিচের প্রলেপযুক্ত মিষ্টি রুটি। লিসেত্তের মুখে পানি এসে যাচ্ছে।

জে সি ক্লিনেক্স পেপার খুলে চোখের সামনে লাল টকটকে চুমু আঁকানো দেখে বিস্মিত হয়ে যাবে—ভাবতেই লিসেত্তের হাসি পাচ্ছে।

মা তাকে লিপস্টিক ব্যবহার করতে দেয়নি। চুলোয় যাক মা’র কথা। তার বয়সী মেয়েরা লিপস্টিক পরে।

বাবাকে শেষবার যখন মা’র সাথে দেখেছে, বাবা সেনাবাহিনীর পোশাক পরা। খুব সুদর্শন দেখাচ্ছিল বাবাকে। চুল খুব ছোট করে ছাটা।

আগে একবার বাবা যখন ইরাক থেকে প্রথমবারের মত এসেছিলেন সেবার বাবার সারা মুখ মা লিপস্টিকের চুমু দিয়ে ভরে দিয়েছিল। লিসেত্তে তখন খুব ছোট ছিল বলে ভেবেছিল লিপস্টিকের চুমু মানে আহত হওয়ার মত ব্যাপার। বাবা কোনো আঘাত পেয়ে আহত হয়েছিল বলে রক্ত বের হচ্ছিল।

এরকমের অনেক সময় অনেক রূপে কল্পনায় আসে। একটা থেকে আরেকটাকে আলাদা করতে পারে না লিসেত্তে। বাবারও একেক সময়ের একেক চেহারা। সবগুলোকে নির্দিষ্ট করে দেখতে পারে না।

বাবা এক সময় মাকে ফোর্ট লডারডেলে নিয়ে গেছে। তারা লিসেত্তেকেও নিতে চেয়েছিল। কিন্তু যেতে পারেনি। বছরের ওই সময়টাতে তাকে স্কুলে থাকতে হয়েছে। সে সময় মায়ের বান্ধবী মিষ্টির কাছে থাকার জন্য গেছিল লিসেত্তে। বাবা মা ফ্লোরিডাতে দশদিন থাকবে বলে পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু সাত দিনের মাথায় মা ফিরে এল। মা বলল সব শেষ। আর না। বাবা মাতাল হয়ে তাকে পিটিয়েছিল বলে পুলিশ ডাকতে হয়েছিল মাকে। মাতাল অবস্থায় এক রেস্তরায় বাবা রাগের মাথায় চেয়ার উল্টে পড়ে গেছিল পর্যন্ত। মা’র জন্য সেটাই ছিল শেষ। আর ইচ্ছে হয়নি মোটেই।

ক্যাসিনোসূত্রে ইভেত্তের অনেক পুরুষ বন্ধু ছিল। তাদের কারো সাথে লিসেত্তের দেখা হয়নি। দেখা করার ইচ্ছেও হয়নি কখনও। তাদের মধ্যে একজন ছিল মনমাউথ কাউন্টির রিয়েল এসটেট এজেন্ট। তার নামের প্রথম অংশ লিসেত্তের মনে আছে: আপটন কিংবা আপওয়েল—এরকম কিছু একটা।

ভারতীয় লোকটার বয়স বেশ অল্প। ডাক্তার হওয়ার জন্য অল্প। তার দিয়ে পেচানো রিম-গ্লাসের পেছনে তার চোখ দুটো কোমল, কালো আর গভীর। তার চুলও কালো। তবে জে সির চুলের মত রেশমী কোমল নয়; মোটা মোটা।

পুলিশ দুজন আর লিসেত্তে লোকটা একটা রেফ্রিজারেটেড রুমে নিয়ে গেল। মলিনা লিসেত্তের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। আমরা তোমার জন্য পরিবেশ যতটা সম্ভব সহনীয় পর্যায়ে রাখছি লিসেত্তে। তুমি শুধু হ্যাঁ বুঝাতে আমার হাতে একটা চাপ দিবে।

হ্যাঁ, কোন বিষয়ে হ্যাঁ বলবে সে? লিসেত্তের মনে চলে আসছে ক্যাফেটেরিয়ার চিত্র। কোণার দিকের লম্বা টেবিলটাতে ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা বসে। জে সি এবং তার বন্ধুরা বসে। মাঝে মাঝে অন্য মেয়েদেরকেও ডাকা হয়। আজকে হয়তো জে সি লিসেত্তেকেই ডাকতো, লিজ-এত্তে, এই লিজ-এত্তে। গাঢ় লাল লিপস্টিকের চুমু অবশ্যই জে সির ভাল লাগবে।

সময় নিয়ে ভাল করে দেখো লিসেত্তে। আমি তোমার পাশেই আছি।

তারপর খুব তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গেল।

যে মৃতদেহটা তাকে সনাক্ত করতে হবে সেটা তার পরিচিত কারো নয়। তার মায়ের তো নয়ই।

এই মহিলার চুল ইভেত্তের চুলের চেয়ে বেশি কালো। চুলের গোড়ার রং বাদামী। সস্তা পরচুলার মত অস্বাভাবিক ঘন। কপালটা কেমন অস্বাভাবিকভাকে ফুলে আছে, চোখ দুটো প্রায় দেখাই যায় না। মুখটাও ভেঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে আছে। মুখ দেখে চেনার কোনো উপায় নেই। চেনার জন্য আগে মুখটাকে সাঁড়াশি দিয়ে টেনে সোজা স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসতে হবে। 

না, না এটা মা নয়।

লিসেত্তে খুব তীক্ষ্ণ ও দৃঢ়ভাবে বলল কথাগুলো। মলিনার হাত থেকে সে যেন মুক্ত হতে চায়।

এটা তো মর্গ। আর এটা তো লাশ।

এটা তো কোনো নারী নয়; এটা একটা বস্তুতে পরিণত হয়ে গেছে। বিশ্বাসই করা যায় না এটা একদিন এক মহিলা ছিল। শুধু মাথা আর মুখ খোলা। শরীরের বাকি অংশ একটা সাদা কাপড়ে ঢাকা। শরীরের মাপ দেখে বোঝা যায় এটা লিসেত্তের মা নয়। অবশ্যই নয়। এর বয়স অবশ্যই লিসেত্তের মা’র চেয়ে বেশি। আঘাতের কারণে হয়তো আকারে ছোট দেখাচ্ছে। দুঃখজনক, করুণা জাগানোর মত নারীদেহ যেন ভগ্ন কিছু ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে তীরে এসে ঠেকেছে।

ভাগ্য ভাল যে বুক পর্যন্ত কাপড় দিয়ে ঢাকা আছে। নইলে পেট, নাভির নিচের চুল, এই বয়সী কোনো মহিলার চর্বিসর্বস্ব উরু—এসব কেউ দেখতে চাইবে না অবশ্যই। ব্যাটাছেলেরা দাঁত কেলাতে কিংবা বিরুক্তি প্রকাশ করতে একটুও পিছপা হয় না বা দেরি করে না। দেখতে সুন্দর না হলে, বুকটা বেশি সমতল হলে তাদের চোখের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দ্রুত হাটতে হয়। নইলে তাদের চোখের তীড়ে বিদ্ধ হতে হয়।

এ তো মা নয়। আমার চেনা জানা কেউ নয়।

মলিনা লিসেত্তেকে সাহায্য করার জন্য আরো কাছে এগিয়ে এসেছে। তাকে আরো সময় নিয়ে ভাল করে দেখতে বলছে। সনাক্তকরণ কাজটা খুব জরুরি। মলিনা লিসেত্তেকে বার বার বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছে। যে লোকটা এই মহিলার এই ভয়ঙ্কর অবস্থা করেছে তাকে ধরতে পুলিশের জন্য এই কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

লিসেত্তে মলিনার কাছ থেকে আলাদা হতে চেষ্টা করতে করতে বলে, বললাম তো এটা আমার মা নয়। আমার মা নয়।

গরম আর এসিডের মত অম্ল কিসের যেন একটা স্বাদ উঠে আসে তার গলা পর্যন্ত। লিসেত্তে চেষ্টা করে সেটাকে গিলে ফেলে ভেতরের দিকে ঠেলে দিতে। বার বার ওয়াক ওয়াক করে আবারও গিলে ফেলে। দাঁতগুলো একটার সাথে আরেকটা লেগে কটকট শব্দ করে উঠছে। ইচ্ছে হচ্ছে এই নোংরা রুম থেকে পালিয়ে যায়। রেফ্রিজারেটারের মত ঠান্ডা, মিষ্টি মিষ্ট একটা অসুস্থতার গন্ধ ছড়ানো রুমটা জুড়ে রয়েছে ট্যালকম পাউডার আর ঘামের গন্ধ। লিসেত্তে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলেও মলিনা তাকে আটকে রেখেছে।

তারা এবার লিসেত্তেকে বাক্স থেকে কয়েকটা কাপড়-চোপড় দেখায়। সবগুলোই ময়লাযুক্ত, রক্ত জড়ানো আর ছেড়া ন্যাকড়ার মত। একটা কোট তারা দেখায় যেটা তার মায়ের মখমলের কোটের সাথে কিছুটা মিল পাওয়া যায়। তবে কোটটা ছেড়া আর ময়লা জড়ানো। আর এই কোটটার গড়নও তার মায়ের কেতাদুরস্ত কোটের মত নয়। তার মা’রটা কেনা হয়েছিল শপিং মলের জানুয়ারি ডিসকাউন্টের সময়ে।

লিসেত্তে বলল এসবের কোনোটাই সে আগে দেখেনি। কখনওই দেখেনি। নিজের শ্বাস পতনের ধরন নিজের কাছেই হাস্যকর মনে হচ্ছে। অ্যাজমার কারণে কিশা শ্বাস নেয় হা করে। তারও এখন সেই অবস্থা হয়েছে। মলিনা তার হাত ধরে সান্তনা দেয়ার জন্য এটা সেটা বলে যাচ্ছে। যত্তসব আজেবাজে কথা; তাকে শান্ত হতে বলছে। সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। যদি তার মনে না হয়ে থাকে যে এই মহিলার লাশ তার মায়ের নয় তাহলে সব ঠিক হয়ে গেছে। দুর্ঘনার বলি এই মহিলাকে সনাক্ত করার আরো অনেক উপায় আছে। বলি—এই শব্দটা নতুন। লাশ, নালা, নর্দমা এইসব শব্দের মত এটাও।

মলিনা তাকে একটা রেস্টরুমে নিয়ে গেল। লিসেত্তের বাথরুমে যাওয়া দরকার, খুব তাড়াতাড়ি। পেটের ভেতরটা তরল আগুনে ভরে গেছে। বের করে ফেলা দরকার। বেসিনে বমি করতে চেষ্টা করল। কিন্তু বমি হল না। বার বার হাত ধুয়ে আয়নার দিকে তাকাল: গাঢ় লাল রঙে রঞ্জিত আয়নায় ভাসছে একটি মেয়ের মুখ। তার ঠোট দেখাচ্ছে গাঢ় আঙ্গুরের রঙের মত। ভাল করে না তাকালে তার বাম চোখের পাশের দাগটা চোখেই পড়ত না। ভাল করে দেখার অবশ্য ইচ্ছেও তার আর নেই। তিন তিনটে সার্জারি হয়েছে এবং প্রত্যেক বার মা প্রতিজ্ঞা করেছে, তোমার চোখ আবার সুন্দর হয়ে যাবে। আগের চেয়েও সুন্দর হয়ে যাবে।

তারা লিসেত্তেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যেতে চাইল: ফ্যামিলি সার্ভিসে। লিসেত্তে বলল সে স্কুলে ফিরে যেতে চায়। তার স্কুলে ফিরে যাওয়ার অধিকার আছে। লিসেত্তে কান্না জুড়ে দিল। লিসেত্তের বিরক্তি আর উত্তেজনা এসে গেছে। সে আবারও স্কুলে ফিরে যেতে চাইলে তারা বলল, ঠিক আছে, লিসেত্তে। এখনকার মত এই থাক।

আর কিছু না বলে তারা লিসেত্তেকে স্কুলে পৌছে দিল। লাঞ্চের বেল বেজে গেছে। সুতরাং সে সরাসরি ক্যাফেটেরিয়ায় চলে গেল। কোনো লাইনে আর দাঁড়ানোর দরকার হল না। কোনো ট্রে হাতে নিতে হল না। তার গায়ে এখনও সেই জ্যাকেটটাই। সবার কথাবার্তার আবছা পরিবেশের মধ্যেই সে বুঝতে পারল তার বন্ধবীরা কাছেরই একটা টেবিলে আছে। লিসেত্তেকে দেখে কিশা কিছুটা চিন্তিত চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, লিসেত্তে, বিষয়টা কী? সব ঠিক আছে তো?

উজ্জ্বল, দীপ্ত আবছায়ার ভেতর হাসতে হাসতে লিসেত্তে বলল, সব ঠিক আছে। থাকবে না মানে? যত্ত সব নরকের কান্ড কারখানা! 

 

লেখক পরিচিতি :

জয়েস ক্যারল ওটসের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১৬ জুন নিউ ইয়র্কের লকপোর্টে। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে দাদির কাছ থেকে উপহার পান টাইপ রাইটার। তখন থেকেই লেখালেখির শুরু। একের পর এক লিখে যান উপন্যাস এবং ছোটগল্প। ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করেছেন সেরাকিউস ইউনিভার্সিটি এবং উইসকনসিন ইউভার্সিটিতে।

তার প্রথম উপন্যাস “উইথ শাডারিং ফল ”প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে। অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় “ইউ মাস্ট রিমেমবার দিস”, “বিকজ ইট ইজ বিটার”, “বিকজ ইট ইজ মাই হাটর্” ইত্যাদি। 

জয়েস ক্যারল ওটস এযাবৎ লিখেছেন ৫৬টি উপন্যাস, ৩২টি ছোটগল্প সংকলন, আটটি কাব্যগ্রন্থ, অসংখ্য প্রবন্ধ, নাটক ও পুস্তক সমালোচনা। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন পি ই এন মালামুড পুরস্কার ও ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ডসহ আরো অনেক পুরস্কার। 

২০০৮ সালে তার ৩২তম ছোটগল্প সংকলন “ডিয়ার হাজব্যান্ড” প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি প্রকাশের বিছুদিন আগে মৃত্যুবরণ করেন তার স্বামী রেমন্ড স্মিথ। বর্তমানে কর্মরত আছেন নিউ জার্সির প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হিসেবে।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনে বার্সাকে কাঁদিয়ে সেমিফাইনালে পিএসজি
চ্যাম্পিয়নস লিগঅবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনে বার্সাকে কাঁদিয়ে সেমিফাইনালে পিএসজি
গাজীপুরে ব্যাটারি কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে চীনা প্রকৌশলীর মৃত্যু, অগ্নিদগ্ধ ৬
গাজীপুরে ব্যাটারি কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে চীনা প্রকৌশলীর মৃত্যু, অগ্নিদগ্ধ ৬
নারিনকে ছাপিয়ে বাটলার ঝড়ে রাজস্থানের অবিশ্বাস্য জয়
নারিনকে ছাপিয়ে বাটলার ঝড়ে রাজস্থানের অবিশ্বাস্য জয়
সুনামগঞ্জে বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু
সুনামগঞ্জে বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ১৩ জনের
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ১৩ জনের
উৎসব থমকে যাচ্ছে ‘রূপান্তর’ বিতর্কে, কিন্তু কেন
উৎসব থমকে যাচ্ছে ‘রূপান্তর’ বিতর্কে, কিন্তু কেন
চুরি ও ভেজাল প্রতিরোধে ট্যাংক লরিতে নতুন ব্যবস্থা আসছে
চুরি ও ভেজাল প্রতিরোধে ট্যাংক লরিতে নতুন ব্যবস্থা আসছে
প্রকৃতির লীলাভূমি সিলেটে পর্যটকদের ভিড়
প্রকৃতির লীলাভূমি সিলেটে পর্যটকদের ভিড়