উধাও হয়ে গেছে সবুজ অরণ্য, খাঁচায় বন্দী বাঘ। কিন্তু অরণ্যের কথা ভুলতে পারে না সে। ঘৃনামিশ্রিত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে খাঁচার বাইরের মানুষগুলোর দিকে তাকায়। নির্ভীক ও কৌতূহলী অসংখ্য চোখ তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। তাদের একজন খুব শান্ত ও কর্তৃত্বপূর্ণ কণ্ঠে কথা কলছেন,‘আমি যে কাজটি করছি, তোমরাও যদি সেটি করতে চাও, মানে চিড়িয়াখানার একজন তত্ত্বাবধায়ক হতে চাও, এক মুহূর্তের জন্যেও তোমরা ভুলে যেতে পারবে না যে তোমাদের প্রতিপক্ষের পাকস্থলিই হচ্ছে তোমাদের প্রথম লক্ষ্যবস্তু। তোমরা দেখবে, এটি এমন এক পেশা যা একই সময়ে সহজ ও কঠিন—উভয়ই হতে পারে। বাঘটার দিকে তাকাও : সে হিংস্র, দাম্ভিক এবং তার স্বাধীনতা, শক্তি ও ক্ষমতা নিয়ে খুবই অহংকারী। কিন্তু সে বদলে যাবে, একটা ছোট্ট শিশুর মতো বিনম্র, নিরীহ এবং বাধ্যগত হয়ে যাবে। যার কাছে খাবার আছে আর যার কাছে খাবার নেই, এই দুইয়ের মধ্যে কী কী ঘটে দেখো এবং শেখো।’
তত্ত্বাবধায়ক পেশায় দক্ষ হতে হলে শিক্ষার্থীদের করণীয় কী হতে পারে, তা শেখানোর উদ্দেশ্যে লোকটি সামনে অগ্রসর হলেন। তিনি মুচকি হাসি দিলেন আর তারপর বাঘটিকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে সম্বোধন করলেন,‘কেমন আছেন সম্মানিত অতিথী?’
বাঘ বলল,‘এখন খাবারের সময়। আমার খাবার প্রস্তুত করো।’
একটা বিদ্রূপের হাসি দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক বললেন,‘তুমি আমার বন্দী হয়ে আমাকেই আদেশ করছো? কী অদ্ভূত বাঘ তুমি! তোমার বোঝা উচিত, এখানে আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে কাউকে আদেশ করার ক্ষমতা রাখে।’
বাঘ বলল, ‘বাঘদেরকে কেউ আদেশ দেয় না। সে ক্ষমতা কারও নেই।’
তত্ত্বাবধায়ক বললেন, ‘তুমি এখন আর বাঘ নও। বনের ভেতর তুমি বাঘ ছিলে, কিন্তু এখানে চিড়িয়া। এখন তুমি বড়জোর একজন গোলাম, যে আমার আমার আদেশ পালন করবে এবং আমাকে মান্য করবে।’
খিটখিটে মেজাজে বাঘ জবাব দিল,‘আমি কারও গোলাম নই।’
এবার তত্ত্বাবধায়ক প্রত্যুত্তর করলেন,‘আমার কাছে ছাড়া আর কারও কাছে খাবার নেই।’
বাঘের জবাব,‘আমি তোমার খাবার চাই না।’
তত্ত্বাবধায়ক বললেন,‘তুমি উপোস থাকতে চাইলে থাকতে পারো। তুমি যা করতে চাও না, তোমাকে তা করতে জোর করব না আমি।’ তারপর শিক্ষার্থীদেরকে বললেন, সে কীভাবে তার মনকে বদল করে সেটা তোমরা দেখতে পাবে। কারণ উপরে থাকা মাথা ক্ষুধার্ত পাকস্থলিকে সন্তুষ্ট করতে পারে না।’
বাঘ ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ে। গভীর হতাশায় তার মনে পড়ে পুরনো দিনের স্মৃতি—উন্মত্ত বাতাসের মতো ছুটে চলা, অপরিমেয় স্বাধীনতা, শিকারকে ধাওয়া করার আনন্দময় সময়গুলো খুব মনে পড়ে তার।
পরের দিন তত্ত্বাবধায়ক ও তার শিক্ষার্থীরা খাঁচার চারপাশে দাঁড়ায়।
তত্ত্বাবধায়ক জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি ক্ষুধার্ত? তুমি ক্ষুধার্ত এজন্য খারাপ লাগছে। তুমি ক্ষুধার্ত একথা তোমার নিজের মুখে বলতে হবে। তাহলে তুমি যেটুকু মাংস খেতে পারবে, সেটুকু তোমাকে খেতে দেয়া হবে।’
বাঘটি চুপ করে থাকল।
তত্ত্বাবধায়ক বললেন, ‘আমি যা বলি তা করো। বোকামি কোরো না। স্বীকার করে নাও তুমি ক্ষুধার্ত। তাহলে তোমাকে দ্রুতই খাবার দেয়া হবে।’
বাঘ মুখ খোলে, ‘আমি ক্ষুধার্ত।’
তত্ত্বাবধায়ক হাসলেন এবং তার শিক্ষার্থীদেরকে বললেন, ‘এবার সে এমন একটা ফাঁদে পড়েছে যা থেকে সে আর মুক্তি পাবে না।’ তিনি আদেশ দিলেন এবং বাঘকে যথেষ্ট পরিমানে মাংস দেয়া হলো।
তৃতীয় দিনে তত্ত্বাবধায়ক বাঘটিকে বললেন, ‘যদি খাবার পেতে চাও তবে আমি যা বলি তা করো।’
বাঘ জবাব দিলো,‘আমি তোমার কথা শুনবো না।’
এবার তত্ত্বাবধায়ক বললেন, ‘এত অস্থির হোয়ো না। আমার আদেশ খুব সাদামাটা। এখন তুমি তোমার খাঁচায় হাঁটছো। আমি যখন তোমাকে থামতে বলব, থেমে যাবে।’
বাঘ নিজে নিজে ভাবল, ‘সত্যিই তো এটি খুব সাদামাটা কাজ। এটাতে আমার বিরক্ত হওয়ার কিছু নেই, অনাহারে থাকারও কোনো কারণ নেই।’
খুব রুক্ষ ভাষায় তত্ত্বাবধায়ক আদেশের সুরে বললেন, ‘থামো।’
বাঘ সাথে সাথে থেমে গেল।
বন্ধুত্বপূর্ণ গলায় তত্ত্বাবধায়ক বললেন, ‘তোমার উন্নতি হচ্ছে।’
তত্ত্বাবধায়ক যখন তার শিক্ষার্থীদেরকে বোঝাচ্ছিলেন, ‘বাঘটা অল্প দিনের মধ্যেই কাগুজে বাঘে পরিণত হবে’, বাঘটা তখন খুব আনন্দিতভাবে হৃদয়ভরে খাবার খাচ্ছিল।
চতুর্থ দিনে বাঘটা বলল,‘আমি খুবই ক্ষুধার্ত—আমাকে থামতে বলো।’
তত্ত্বাবধায়ক তার শিক্ষার্থীদের বললেন,‘সে আমার আদেশকে ভালোবাসতে শুরু করেছে।’ তারপর বাঘটার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন,‘আজ যদি তুমি ছোট্ট বিড়ালছানার মতো মিউমিউ না ডাকো, তবে কোনো খাবার পাবে না।’
বাঘ তার ক্রোধ সংবরণ করল এবং ভাবল,‘বিড়ালছানার মতো মিউমিউ ডাকা এক ধরনের রসিকতা।’ সে মিউমিউ ডাকল।
তত্ত্বাবধায়ক কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে অসম্মতি জানালেন,‘এটা ভয়ঙ্কর রকম শুনিয়েছে। গরগর আওয়াজ কখনো মিউমিউ হতে পারে না।’
বাঘ আবার চেষ্টা করল। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক ভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হলো না। খুব অবজ্ঞাসূচক ভঙ্গিতে বললেন,‘তোমার মিউমিউ খুবই ভয়ঙ্কর। মিউমিউ চর্চা করার জন্যে তোমাকে একদিন সময় দিলাম। আগামিকাল তোমার পরিক্ষা নেবো। যদি তুমি সফল হও, তুমি খাবার পাবে, নইলে তোমাকে অনাহারে থাকতে হবে।’
তত্ত্বাবধায়ক বাঘের খাঁচার কাছ থেকে খুব শান্ত ও ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলেন। তার মুখে তখন চাপা হাসি আর শিক্ষার্থীদের সাথে ফিসফিসানি কথাবার্তা। বাঘ খুব কাকুতিমিনতি করে অরণ্যকে ডাকতে থাকে, কিন্তু অরণ্য তখন অনেক দূরে।
পঞ্চম দিনে তত্ত্বাবধায়ক বাঘকে বললেন,‘যদি ছোট্ট বিড়ালছানার মতো মিউমিউ ডাকতে পারো, তবে আজ তুমি তাজা বড়সড় এক টুকরো মাংস পাবে।’
বাঘ নিখুঁতভাবে মিউমিউ ডাকল এবং তত্ত্বাবধায়ক হাততালি দিলেন। খুব আনন্দের সাথে বললেন,‘চমৎকার। একেবারে বিড়ালছানার মতোই মিউমিউ ডেকেছো তুমি।’ এরপর বাঘটির দিকে বড় এক টুকরো মাংস ছুড়ে দিলেন।
ষষ্ঠ দিনে তত্ত্বাবধায়ক বাঘের খাঁচার কাছে পৌঁছা মাত্রই বাঘটি মিউমিউ ডাকতে শুরু করল। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক অসন্তুষ্টচিত্তে ভ্রূ কুঁচকে রইলেন।
‘আমি তো বিড়ালছানার মতোই মিউমিউ করেছি।’
‘গাধার মতো হি-হ আওয়াজ করো।’ তত্ত্বাবধায়ক আদেশ করলেন।
তীব্র অসন্তোষ নিয়ে বাঘ জবাব দেয়,‘আমি বাঘ। বনের পশুরা আমাকে ভয় পায়। গাধার মতো হি-হ আওয়াজ আমি করব? আমি বরং মরে যাব তবু একাজ করব না।’
কোনো রকম শব্দ না করেই তত্ত্বাবধায়ক খাঁচার কাছ থেকে চলে গেলেন।
সপ্তম দিনে তত্ত্বাবধায়ক খুব নম্র হাসিতে বাঘের খাঁচা পর্যবেক্ষণ করলেন।
‘তুমি খেতে চাও?’
বাঘের প্রত্যুত্তর,‘আমি খেতে চাই।’
‘তুমি যে মাংস খাও সেটা বিনা পয়সায় আসে না। গাধার মতো শব্দ করো, তুমি খেতে পাবে।’
বাঘ অরণ্যের কথা ভাবতে চাইল। কিন্তু সে ব্যর্থ হলো। সে চোখ বন্ধ করল এবং হি-হ ডেকে উঠল।
তত্ত্বাবধায়ক বললেন,‘তোমার হি-হ খুব একটা ভালো হয়নি। তবু তোমাকে করুণা করে এক টুকরো মাংস দিচ্ছি।’
অষ্টম দিনে তত্ত্বাবধায়ক বাঘটিকে বললেন,‘আমি একটা বক্তব্যের প্রারম্ভিক অংশটুকু বলব। যখন আমার বলা শেষ হবে, তুমি এমনভাবে হাততালি দেবে যেন মনে হয় তুমি খুব পছন্দ করেছ।’
বাঘ বলল,‘আমি হাততালি দেবো।’
এবার তত্ত্বাবধায়ক তার বক্তব্য শুরু করলেন,‘হে নাগরিকগণ...আমরা আমাদের সময়ের হেতু ব্যাখ্যা করে অসংখ্যবার আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছি, আর যত যা-ই হোক না কেন, এই দৃঢ়তাপূর্ণ সৎ অবস্থান কখনোই পরিবর্তন হবে না। শত্রুরা আমাদের বিরুদ্ধে যত চক্রান্তই করুক না কেন, বিশ্বাস রেখেই বলছি, আমরাই বিজয়ী হবো।’
বাঘ বলল,‘আপনি যা বলেছেন, আমি তার কিছুই বুঝিনি।’
‘আমি যা-ই বলি না কেন, তুমি তার সবটুকুই পছন্দ করবে এবং খুব স্পৃহা নিয়ে খুব উদ্যম নিয়ে হাততালি দেবে।’
বাঘ বলল,‘আমাকে ক্ষমা করুন। আমি অক্ষরজ্ঞানহীন। আপনার বক্তব্য অনেক গভীর, অনেক মূল্যবান। আর আপনি যেহেতু চাচ্ছেন, আমি হাততালি দেবো।’ তারপর বাঘ হাততালি দিলো।
‘আমি শঠ ও শঠতা—কোনোটাই পছন্দ করি না। শাস্তিস্বরূপ আজ তুমি কোনো খাবার পাবে না।’
নবম দিনে তত্ত্বাবধায়ক এক ঝুড়ি খড়কুটো নিয়ে এলেন এবং বাঘের সামনে নিক্ষেপ করলেন।
‘খাও।’
বাঘ বলল,‘এসব কী? আমি মাংস খাই।’
‘এখন থেকে তুমি খড়কুটোই খাবে। এছাড়া আর কোনো খাবার পাবে না।’
যখন বাঘের ক্ষুধা বাড়ল, সে খড়কুটো খেতে চেষ্টা করল। খড়ের স্বাদ ও গন্ধে সে অস্বস্তি বোধ করল। খেতে না পেরে ফিরে গেল। বিরক্ত হয়েও আবার খড়ের কাছে ফিরে এলো। সে আবার ফিরে গেল। একটু পর আবার খড়ের কাছে ফিরে আসলো। এভাবেই খড়ের সাথে তার মিথস্ক্রিয়া হয়ে ওঠে।’
দশম দিনে তত্ত্বাবধায়ক, তার শিক্ষার্থীরা, বাঘ এবং খাঁচা—সবকিছু উধাও হয়ে গেল, বাঘ নাগরিক হয়ে গেল আর তার খাঁচা হয়ে গেল একটা শহর।
লেখক পরিচিতি :
ঝাকারিয়া তামের একজন সিরিয়ান ছোটগল্পকার, কলামিস্ট ও সম্পাদক। তিনি ১৯৩১ সালে সিরিয়ার দামেস্কে জন্মগ্রহণ করেন। তামের আরবি ভাষার অন্যতম প্রভাবশালী ছোটগল্পকার। শৈশবে পারিবারিক দারিদ্রের কারণে তাকে স্কুল ছাড়তে হয়। তবে বই পড়ার অদম্য বাসনা তাকে নৈশকালীন স্কুলে ভর্তি হতে প্রেরণা জোগায়। তার ছোটগল্প পৃথিবীর অসংখ্য ভাষায় অনূদিত ও বহুল পঠিত। বর্তমানে আরব বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হিসেবে তাকে ধরা হয়। ‘দশম দিনে বাঘ’ তার অন্যতম ছোটগল্প সংকলন। এটি ইংরেজিতে অনূদিত হওয়ার পর দুনিয়াজোড়া ব্যাপক সাড়া পড়ে। এপর্যন্ত তার প্রায় পনেরটি ছোটগল্প সংকলন, দুটি গদ্যগ্রন্থ ও ডজনখানেক শিশুতোষ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার গল্প সংকলন ‘ভাঙা হাঁটু’ ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয়। তামেরের উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থের মধ্যে স্প্রিং ইন দ্য অ্যাশেজ, দ্য থান্ডার, দামেস্কাস ফায়ার, উই শ্যাল লাফ, সাওয়ার গ্রেপ, ইফ, দ্য হেজহগ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ব্যঙ্গাত্মক গদ্যের
মধ্যে ‘দ্য ভিকটিমস স্যাটেয়ার অব হিজ কিলার’ অন্যতম। ২০০৯ সালে তিনি ‘ব্লু মেট্রোপলিস মন্ট্রিয়েল ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ’ লাভ করেন। ২০১৫ সালে তিনি স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতার জন্য মাহমুদ দারবিশ পুরস্কারসহ এ পর্যন্ত আরও অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন।