X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১
পাকিস্তানের গল্প

শেষ মানুষ ।। ইনতেজার হুসেইন

অনুবাদ : সালেহ ফুয়াদ
১৭ অক্টোবর ২০১৮, ১৯:১৬আপডেট : ১৭ অক্টোবর ২০১৮, ১৯:১৬

শেষ মানুষ ।। ইনতেজার হুসেইন ইলিয়াস ছিল এ গ্রামের সর্বশেষ মানুষ। সে কসম খেয়ে বলেছিল, আল্লার কিরে, আমি মানুষের বেশে জন্মেছি, মানুষের বেশেই মরব। শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত সে মানুষের দেহ নিয়ে থাকার চেষ্টাও করে।

এ গ্রাম থেকে দিন তিনেক আগে সব বানর গায়েব হয়ে গিয়েছিল। প্রথমে সবাই অবাক হয়। পরক্ষণেই খুশি হয়ে ওঠে—যাক, ফসল বরবাদ আর বাগান বিনষ্টকারী বানরগুলো বিলীন হয়ে গেছে! তারপর সাপ্তাহিক উপাসনার দিনে মাছ শিকার করতে মানা-করা ব্যক্তিটি বলে, বানর তো তোমাদের মাঝেই রয়েছে, তোমরা দেখছো না এই আর কি!

লোকেরা রেগেমেগে বললো, ‘আমাদের সঙ্গে তামাশা করো?’

সে বলে, ‘নিশ্চয় তামাশা তোমরা খোদার সঙ্গে করেছ। তিনি উপাসনার দিনে মাছ ধরতে মানা করেছেন অথচ তোমরা সে দিনেও মাছ ধরেছ। জেনে রেখো, তিনি তোমাদের চে’ বড় কৌশলি।’

তিন দিন পর, কাজের মেয়েটি আলেয়াযরের শোয়ার ঘরে গিয়ে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আলেয়াযরের বউয়ের কাছে উল্টোপায়ে ফিরে আসে। এরপর আলেয়াযরের বউ শোয়ার ঘরে উঁকি মেরে হতবুদ্ধি হয়ে যায়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আলেয়াযরের বাড়িতে আসতে থাকে। শোয়ার ঘরে গিয়ে সবাই তাজ্জব বনে যায়। আলেয়াযরের বিছানায় আলেয়াযরের বদলে একটি বড় বানর আরাম করছে। আলেয়াযর গত উপাসনার দিনে সবচে’ বেশি মাছ শিকার করেছিল।

এরপর একজন আরেকজনকে খবর দেয়, ‘হা রে, আলেয়াযর বানর হয়ে গেছে’। এ কথা শুনে দ্বিতীয়জনের প্রচণ্ড হাসি পায়। ‘তুমি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করলে’ বলে হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে মুখ লাল হয়ে যায়, দাঁত বেরিয়ে আসে। নাক-মুখ খিঁচতে খিঁচতে সে বানর হয়ে যায়। এসব দেখে প্রথমজন হতভম্ব, বিমূঢ়। বিস্ময়ে মুখ তার হা-খোলা এবং চোখগুলো বিস্ফারিত হতে থাকে। সে-ও বানর হয়ে যায়।

জবলুনের ছেলেকে দেখে ভয় পেয়ে আলিয়াব জিজ্ঞেস করে, ‘হা রে, জবলুনের ছোকরা, হলোটা কী তোর, চেহারা অমন বদলে গেল কেন রে?’ জবলুনের বেটা এ কথায় ক্ষেপে যায়, রাগে দাঁতে দাঁত পিষতে থাকে। আলিয়াব আরো ভয় পেয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘রে জবলুনের ছাওয়াল, তোর মা তোর শোকে মরুক, নিশ্চয় তোর একটা কিছু হয়ে গেছে!’ তা শুনে রাগে জবলুনের ছেলের মুখ লাল হয়ে যায়। দাঁত কামড়ে সে আলিয়াবের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভয়ে আলিয়াবের কাঁপুনি শুরু হয়। ইবনে জবলুনের চেহারা রাগে এবং আলিয়াবের চেহারা ভয়ে বিগড়ে যেতে থাকে। প্রচণ্ড ক্রোধে ইবনে জবলুন নিজেকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে আর আলিয়াব ভয়ে নিজেকে নিজের ভেতর আরো গুটিয়ে নেয়। এক টুকরো ক্রোধের শরীর আরেক টুকরো ভয়ের কাঁচের ভেতর গেঁথে যায়। চেহারা বিগড়ে যেতে থাকে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গও। তাদের স্বর পরস্পরের শব্দের ভেতর হারিয়ে যেতে যেতে অনুচ্চারিত চিৎকারে পরিণত হয়। সেই নিঃশব্দ চিৎকার পরিণত হয় জন্তুর চিৎকারে। এরপর তারা বানরে পরিণত হয়।

এখনও মনুষ্য অবস্থায় থাকা ইলিয়াস ছিল গ্রামের সবচে’ বুদ্ধিমান ব্যক্তি। সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বলল, নিশ্চয় আমাদের কিছু একটা হয়ে গেছে। চলো আমরা তার কাছে যাই যে আমাদেরকে উপাসনার দিনে মাছ শিকার করতে নিষেধ করেছিল। সবাইকে নিয়ে সে ঐ লোকটির ঘরে যায়। দরজায় টোকা দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ডাকতে থাকে। হতাশ হয়ে ফিরে এসে উচ্চ স্বরে বলে, ‘আরে ও গ্রামবাসী, উপাসনার দিনে মাছ ধরতে নিষেধকারী লোকটি আজ আমাদের ফেলে চলে গেছে। চিন্তা করলে দেখবে এতে আমাদের ধ্বংস রয়েছে।’ এ কথা শুনে গ্রামবাসী আরো ঘাবড়ে যায়। প্রচণ্ড ভয় তাদেরকে চেপে ধরে। ভয়ে তাদের অবয়ব বদলে যেতে থাকে। নাক-মুখ বিকৃত হয়ে যায়। ইলিয়াস চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখে। বানর ছাড়া আর কিছুই পায় না।

জেনে রাখা ভালো, এটি একটি জনবসতি ছিল। সমুদ্রতীরে উঁচু মিনার এবং বড় বড় দরজার ঘরবাড়ির বসতি। বাজার জুড়ে নানা সুর ছড়িয়ে থাকত। কাঁসা বাজত। ভোজবাজির মতো সে বাজার বিরান হয়ে গেছে। উঁচু দেয়ালগুলো হয়ে গেছে শূন্য। উঁচু মিনারের আলিশান ছাদে এখন শুধু বানর আর বানর। ইলিয়াস চারদিকে চোখ বুলিয়ে আবিষ্কার করে, আমিই একা মানুষ! এটা ভেবে সে এতটাই ভয় পেয়ে যায় যে তার রক্ত জমে যেতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে আলিয়াবের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে ভয়ের কারণে কিভাবে তার চেহারার বিকৃতি ঘটেছিল। কিভাবে সে বানরে পরিণত হয়েছিল। ইলিয়াস ভয়কে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে দৃঢ়সঙ্কল্প হয়, আল্লার কিরে, আমি মানুষের বেশে জন্মেছি, মানুষের বেশেই মরব। অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে বিকৃত স্বজাতিকে দেখে বলে, ‘অবশ্যই আমি এদের মধ্যে নাই। এরা বানর আর আমি মানুষের বংশে জন্ম নেওয়া একজন।’ ইলিয়াস তার স্বজাতিকে ঘৃণা করতে থাকে। ওদের দুর্গন্ধময় লাল চেহারা এবং পশমে ঢাকা শরীরের দিকে তাকায়। ঘৃণায় তার চেহারার বিকৃতি ঘটতে শুরু করলে আচানক জুবানের কথা মনে পড়ে। প্রচণ্ড ঘৃণার কারণে জুবানের চেহারা বদলে গিয়েছিল। নিজেকে নিজেই বলে, ‘ইলিয়াস, ঘৃণা করো না। ঘৃণার কারণে মানুষের কায়া বদলে যায়।’ ইলিয়াস ঘৃণা থেকে বেরিয়ে আসে।

ইলিয়াস ঘৃণা দূর করে বলে, ‘কোনো সন্দেহ নাই, আমি এদেরই একজন ছিলাম।’ সে ওদের মধ্যে কাটানো দিনগুলোর কথা স্মরণ করে। ভালোবাসায় তার হৃদয় মোচড়াতে থাকে। বিনতুল আখজরকে মনে পড়ে। সে ছিল ফারাউয়ের দুর্গের দুগ্ধবতী ঘুড়িগুলোর একটির মতো। তার বড় ঘরের দরজা ছিল সাইপ্রাস গাছের, জানালা ছিল দেবদারুর। মনে পড়ে যায়, একদিন সাইপ্রাসের দরজা আর দেবদারুর জানালার সে বাড়িতে লুকিয়ে ঢোকে পড়েছিল। সে রাতে পালঙ্ক ছুঁয়ে তাকে খুঁজেছিল, যাকে তার হৃদয় খুব চাইত। সে দেখেছিল, তার দীর্ঘ চুল রাতের আদ্রতায় ভেজা। তার বুক হরিণ ছানার মতো স্পন্দিত। পেট তার গন্ধমের অলিন্দ, পাশেই চন্দনের গোল পেয়ালা।

ইলিয়াস বিনতুল আখজরকে স্মরণ করে। হরিণছানা, গন্ধমের অলিন্দ আর চন্দনের গোল পেয়ালার দৃশ্যকাব্যে সে সাইপ্রাস গাছের দরজা এবং দেবদারুর জানালার ঘর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তার চোখ শূন্য ঘরের পালঙ্কে তাকে খোঁজে। যার জন্য হৃদয় আন্দোলিত হতো তাকে ডাকতে থাকে, ‘আরে ও বিনতুল আখজর, তুমি কোথায় গেলে? ক্যালেন্ডারের বিশ্রি মাস অতীত হয়ে গেছে। বাগানগুলো এখন ফুলে ফুলে ভরে গেছে। ডালে ডালে ভোমরার গান। কোথায় তুমি? উঁচু ছাদে বসানো পালঙ্কে আরামকারীনী হে আখজরের কন্যা, বনের দুরন্ত হরিণী আর পাথরের খোপে লুকিয়ে থাকা কবুতরের মতো নিচে নেমে এসো। এখনই আমার কাছে এসো, এ হৃদয় তোমাকে চায়।’ ইলিয়াস বার বার ডাকতে থাকে আর বিনতুল আখজরকে স্মরণ করে কাঁদতে থাকে।

ইলিয়াস বিনতুল আখজরের স্মরণে কাঁদে। কিন্তু হঠাৎ তার আলেয়াযরের বউয়ের কথা মনে পড়ে। বউটি আলেয়াযরকে বানর হতে দেখে কেঁদেছিল। কিন্তু তার সে বিলাপও আটকে যায়। গড়িয়ে পড়া অশ্রু তার রূপবিকৃতি ঘটায়। শোকশব্দ জান্তব হতে থাকে। আখেরে আলেয়াযরের বউয়ের দেহগঠনও বদলে যায়। ইলিয়াস ভাবে বিনতুল আখজর তার স্বজাতির সঙ্গে মিশে গেছে। কোনো সন্দেহ নেই, প্রত্যেককেই তার স্বজাতির সঙ্গে ওঠানো হবে। ইলিয়াস নিজেকে নিজেই বলতে থাকে, ‘ইলিয়াস, তুমি তাকে ভালোবেসো না। তাহলে তুমিও তাদের জাতের হয়ে যাবে।’ ইলিয়াস প্রেম মুছে ফেলে এবং স্বজাতিকে অসভ্য জেনে নিঃসম্পর্ক হয়ে যায়। ইলিয়াস হরিণছানা, গন্ধমের অলিন্দ এবং চন্দনের গোল পেয়ালাকে ভুলে যায়।

ইলিয়াস প্রেম ত্যাগ করে। স্বজাত বন্ধুদের লালচে দুর্গন্ধময় চেহারা আর খাড়া লেজ দেখে হাসে। গ্রামের সবচে’ সুন্দরী নারী আলেয়াযরের বউয়ের কথা মনে পড়ে। সে ছিল নেশাবৃক্ষের মতো। তার স্তন ছিল আঙুরের দুটি বৃন্ত। আলেয়াযর তাকে বলেছিল, ‘জেনে রেখো, আমি আঙুরের বৃন্ত ভাঙবো।’ আঙুরের বৃন্তাধিকারিনী ব্যস্ত হয়ে সমুদ্রতীরের দিকে চলে যায়। আলেয়াযর তার পিছু নেয়। সে ফল পেড়ে নেশাবৃক্ষকে নিজের ঘরে নিয়ে আসে। আর এখন উঁচু দেয়ালের উপর আলেয়াযরের নেশাবৃক্ষ কুট কুট করে গম খাচ্ছে। আলেয়াযর গম নিয়ে আসে আর সে লেজ তুলে নরম পায়ের উপর ভর করে উঠে দাঁড়ায়। হা হা হা ...। হাসির আওয়াজে পুরো বসতি গমগম করে ওঠে। এত জোরে হাসায় ইলিয়াস চিন্তিত হয়ে পড়ে। তার ঐ লোকটির কথা মনে পড়ে যায় যে হাসতে হাসতে বানরে পরিণত হয়েছিল। ইলিয়াস নিজেকে শাসন করে, ‘ইলিয়াস ওকে নিয়ে হাসাহাসি করো না, তাহলে নিজেই হাসির খোরাক হয়ে উঠবে।’ ইলিয়াস হাসি ত্যাগ করে।

ইলিয়াস হাসি ত্যাগ করে। সে প্রেম-ঘৃণা, রাগ-সহানুভূতি, হাসি-কান্না সমস্ত অনুভূতিকে অতিক্রম করে ফেলে। স্বজাতিকে অসভ্য জেনে নিঃসম্পর্ক হয়ে যায়। তাদের গাছের উপর চড়ে বসা, দাঁতে দাঁত কামড়ে হুপ হুপ করা, কাঁচা ফল নিয়ে লড়াই আর একে অন্যকে রক্তাক্ত করা, এসবই তাকে কখনো কাঁদাতো, কখনো হাসাতো। তার দিকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাকিয়ে যখন ওরা দাঁতে দাঁত পিষতো তখন ওর রাগ হতো। এমনও হয়েছে ওদেরকে লড়তে দেখে কখনো কখনো ভীষণ জোরে ধমকে দিয়েছে। এরপর নিজেই নিজের শব্দের তীব্রতায় অবাক হয়েছে। কোনো কোনো বানর তার দিকে অবহেলার চোখে তাকিয়ে আবারো লড়তে শুরু করে। ইলিয়াসের খরচ-করা শব্দগুলোর কদর করছে যেন। যেন তার এবং তার স্বজাতের মধ্যে কোন সম্পর্কই ছিল না। এ জন্য আফসোসও করে। ইলিয়াসও আফসোস করে স্বজাতির জন্য, তার নিজের জন্য, শব্দের জন্য। স্বজাতির জন্য আফসোস কারণ তারা আজ শব্দ থেকে বঞ্চিত, নির্বাক। আমার জন্য আফসোস, কারণ শব্দরা আজ আমার হাতে শূন্য পাত্রের মতো পড়ে আছে। চিন্তা করলে দেখবে আজ বড় আফসোসের দিন। শব্দরা আজ মৃত। ইলিয়াস নিশ্চুপ হয়ে শব্দের মৃত্যুর শোকগাঁথা রচেছে।

ইলিয়াস মূক হয়ে যায়। প্রেম-ঘৃণা, রাগ-সহানুভূতি, হাসি-কান্না সমস্তকে অতিক্রম করে ফেলে। স্বজাতিকে অসভ্য জেনে নিঃসম্পর্ক হয়ে যায়। নিজের ভেতর আশ্রয় নেয়। ইলিয়াস নিজের ভেতর নিরাপদ দ্বীপ হয়ে ওঠে। ইলিয়াস সবার থেকে নিঃসম্পর্ক। অথৈ জলে এক টুকরো ভাসমান ভূমির প্রতীক। সেই দ্বীপ বলে, গভীর জলের ভেতর আমি ভূমির প্রতীক উঁচু করে রাখব।

ইলিয়াস তার কল্পিত মনুষ্যতার সীমা জানে। সে অথৈ জলের সঙ্গে লড়তে শুরু করে। নিজের চার দিকে শক্ত দেয়াল তুলে দেয়, যেন প্রেম-ঘৃণা, রাগ-সহানুভূতি, আমোদ-প্রমোদ, ক্লান্তি-অবসাদ তাকে আর ধাওয়া না করে। আবেগের ঢল যেন তাকে ভাসিয়ে না নেয়। ইলিয়াস আবেগকে ভয় পেতে থাকে। তারপর দেয়ালটি নির্মিত হয়ে গেলে তার মনে হয় বুকের উপর ভারী পাথর চেপে বসেছে। চিন্তিত হয়ে বলে, হায় খোদা, আমি ভেতরে ভেতরে বদলে যাচ্ছি। সে তার বাইরের দিকে চোখ ফেরায়। মনে হয়, ভেতরের পাথরটা ফেটে বেরিয়ে আসছে। অঙ্গ অবশ, চামড়া বিবর্ণ এবং রক্ত গতিহীন হতে চলেছে। নিজেকে নিয়ে সে আরো ভাবে। আরো শঙ্কা চেপে ধরে। মনে হয়, সারা শরীর পশমে ঢেকে যাচ্ছে। চুল বিবর্ণ ও লাল হয়ে যাচ্ছে। এবার শরীর নিয়ে সে শক্সিকত হয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ করে ফেলে। ভয়ে নিজের ভেতর আরো গুটিয়ে যেতে থাকে। যখন মনে হলো হাত-পা সংক্ষিপ্ত এবং মাথা ছোট হতে চলেছে তখন ভয়টা আরো বেড়ে যায়। ভয়ে প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আরো সঙ্কুচিত হতে থাকে। মনে মনে ভাবে, আমি কি একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব?

ইলিয়াসের আলেয়াবের কথা মনে পড়ে। ভয়ে নিজের ভেতর গুটিয়ে গিয়ে ও বানর হয়ে গিয়েছিল। ইলিয়াস মনে মনে বলে, ভেতরের ভয়কেও আমি জয় করব, ঠিক যেভাবে বাইরের ভয়কে জয় করেছি। ইলিয়াস ভেতরের ভয়কে জয় করে ফেলে। তার গুটিয়ে যাওয়া অঙ্গগুলো ফের খুলতে শুরু করে, বিস্তৃত হতে থাকে। শরীরের জোড়া ঢিলে হতে থাকে। আঙুলগুলো লম্বা আর চুলগুলো বড় আর খাড়া হতে থাকে। হাতের তালু আর পায়ের পাতা চ্যাপ্টা এবং নরম হতে থাকে। জোড়াগুলো খুলতে শুরু করে। ইলিয়াসের মনে হতে লাগল তার সমস্ত অঙ্গ বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে। সে শক্ত করে দাঁত কামড়ে ধরে এবং হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজেকে একত্রিত করতে চেষ্টা করে।

ইলিয়াস দেহের বীভৎসতা সহ্য করতে না পেরে চোখ বন্ধ করে ফেলে। চোখ বন্ধ করার পর মনে হয় তার আকৃতি বদলে যাচ্ছে। ভয়ে ভয়ে নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করে, আমি কি আর আমি নেই? এ কথা ভেবে আতঙ্কে বুকের ভেতর ঢোলপেটা শুরু হয়। প্রবল ভয়ে এক চোখ খুলে নিঃশব্দে অঙ্গের দিকে তাকায়। অঙ্গ যেমন ছিল তেমনি আছে দেখে সাহস পায়। সাহস করে চোখ খোলে এবং স্বস্তি নিয়ে নিজের শরীরটাকে দেখে বলে, নিঃসন্দেহে আমি আমার আকৃতিতেই আছি। এরপরেই তার মনে হয়, ফের দেহ বিকৃতি ঘটছে। আবারো সে চোখ বন্ধ করে ফেলে।

ইলিয়াস চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। চোখ বন্ধ করায় এবার মনোযোগ তার ভেতরের দিকে যায়। বুঝতে পারে, সে কোনো অন্ধকার কূপে ডুবে যাচ্ছে। ডুবন্ত ইলিয়াসের পিছু নিয়েছে স্বজাতির পুরনো মুখ। অতীতের রাতগুলো তাকে ঘিরে ধরেছে। উপাসনার দিন স্বজাতির মাছ শিকারের কথা মনে পড়ে। ওদের হাতে মাছে-ভরা সমুদ্র মাছশূন্য হতে চলেছে। লোভ ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। উপাসনার দিনেও মাছ শিকার করতে শুরু করে। তখন উপাসনার দিনে মাছ শিকার করতে নিষেধকারী ব্যক্তিটি বলে, সেই খোদার কসম, যিনি সমুদ্রকে গভীর পানি দিয়েছেন এবং গভীর পানিকে মাছদের আশ্রয়স্থল বানিয়েছেন, সমুদ্র তোমাদের লোভী হাত থেকে নিস্তার চাইছে। উপাসনার দিনে মাছদের উপর জুলুম করা থেকে বিরত থাকো। নইলে তোমরা নিজেদের উপর অত্যাচারী বলে সাব্যস্ত হবে। ইলিয়াস বলে, ঈশ্বরের কসম, আমি উপাসনার দিন মাছ শিকার করব না। ইলিয়াস ছিল সেয়ানা লোক। সমুদ্র থেকে খানিকটা দূরে সে একটা গর্ত খনন করে। একটা নালা খনন করে সমুদ্রের সঙ্গে সংযোগ করে দেয়। উপাসনার দিন মাছেরা পানির উপরের দিকে এসে সাঁতরাতে সাঁতরাতে নালার পথ ধরে গর্তে গিয়ে পড়ে। পরের দিন ইলিয়াস সে গর্ত থেকে প্রচুর মাছ ধরে নিয়ে আসে। উপাসনার দিনে মাছ ধরতে মানা-করা লোকটি এসব দেখে বলে, নিশ্চয় যে ব্যক্তি ঈশ্বরের সঙ্গে প্রতারণা করেছে ঈশ্বরও তার ব্যাপারে কৌশলী হবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সবচে’ বড় কৌশলী। এ-সব স্মরণ করে ইলিয়াস আফসোস করে। শঙ্কিত হয়ে পড়ে। হায়, আমি কি তাহলে সেই কৌশলে ডুবে গেছি। তৎক্ষণাৎ নিজের পুরো অস্তিত্বকেই একটি ধোঁকা মনে হয়। সে ঈশ্বরের দরবারে প্রার্থনা শুরু করে, হে সৃষ্টিকর্তা, আপনি আমাকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যেমনভাবে সৃষ্টি করা উচিত। আপনি আমাকে সর্বোত্তম অবয়বে সৃষ্টি করেছেন। আমাকে আমার মতো করে বানিয়েছেন। আর এখন আপনি আমার সঙ্গে কৌশল খাটাবেন। আমাকে নিকৃষ্ট বানর বানাবেন। ইলিয়াস তার দুরবস্থার জন্য বিলাপ করে। তার নির্মিত দেয়ালে ফাটলের সৃষ্টি হয়েছিল। সমুদ্রের পানি দ্বীপের দিকে ধেয়ে আসছিল।

ইলিয়াস তার দুরবস্থার জন্য বিলাপ করে। বানরে ভরা পল্লী ছেড়ে সে জঙ্গলের দিকে বেরিয়ে পড়ে। এ পল্লীকে জঙ্গলের চেয়েও ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছিল। দেয়াল এবং ছাদতোলা ঘরগুলো তার কাছে শব্দের মতই অর্থ হারিয়ে বসেছিল। গাছের ডালেই রাতটা চুপচাপ কাটিয়ে দেয়।

সকালে যখন জাগে তখন পুরো শরীর ক্লান্ত। মেরুদণ্ডের হাড়জুড়ে ব্যথা। সে তার বিকৃত অঙ্গের দিকে তাকায়। কিছুটা বেশিই বিকৃত মনে হচ্ছে। ভয়ে ভয়ে সে ভাবে, আমি কি আমিই? তখন তার মাথায় আসে, ইশ্ গ্রামে যদি এমন কোনো ব্যক্তি থাকত যে তাকে বলে দেবে সে আসলে কোন আকৃতি নিয়ে আছে! এ ভাবনা থেকেই নিজেকে প্রশ্ন করে, মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য মানুষের সান্নিধ্যে থাকাটা কি জরুরি? নিজেই আবার উত্তর দেয়, অবশ্যই, আদম একা অসম্পূর্ণ, মানুষ মানুষের সঙ্গে বাঁধা। যার সঙ্গে যার বাঁধন তার সঙ্গেই তাকে উঠানো হবে। এ কথা ভাবতেই তার হৃদয়টা কষ্টে ভরে যায়। সে ডাকতে থাকে, হায় বিনতুল আখজর তুমি কোথায়, তুমিহীন আমি অসম্পূর্ণ। ইলিয়াসের প্রবলভাবে হরিণের স্পন্দিত শাবক, গন্ধমের অলিন্দ এবং চন্দনের গোল পেয়ালার কথা মনে পড়ে। দ্বীপে সমুদ্রের পানি আছড়ে পড়ছিল, এদিকে ইলিয়াস কাতর স্বরে ডেকে যাচ্ছে, হে বিনতুল আখজর, হে আমার জীবনের কামনা, তোমাকে আমি উঁচু ছাদে টাঙানো শামিয়ানায়, বড় বড় গাছের শাখায় এবং মিনারের চূড়ায় খুঁজব। তীব্র তেজস্বী দুধরঙা ঘোড়ার কসম, উড়ন্ত কবুতরের কসম, রাতের কসম যখন তা আদ্র হয়ে যায়, রাতের অন্ধকারের কসম যখন তা শরীরে নামতে শুরু করে, অন্ধকার এবং নিদ্রার কসম, চোখের পাতার কসম যখন তা নিদ্রায় ভারী হয়ে আসে, তুমি এখুনি আমার সঙ্গে এসে মিলিত হও। আমার হৃদয় তোমাকে চায়। যখন সে ডাকছিল তখন তার শব্দগলো গড়বড় হয়ে গিয়েছিল। যেন শেকল ভেঙে গেছে। যেন শব্দ লোপ পাচ্ছে। যেন তার স্বর বদলে যেতে থাকে। ইলিয়াস তার পাল্টে যাওয়া স্বরের প্রতি কান পাতে। জবলুন এবং আলেয়াবকে স্মরণ করে, কিভাবে ওদের স্বর পাল্টে গিয়েছিল। ইলিয়াস তার বদলে-যাওয়া স্বরকে উপলব্ধি করে ভয় পায় এবং ভাবে, হে ঈশ্বর, আমি কি তাহলে বদলে গেছি। এ সময় তার অদ্ভুত আকাক্সক্ষা জাগে―হায়, এমন কিছু যদি পাওয়া যেত যা দিয়ে আমি আমার মুখাবয়ব দেখতে পারতাম। এ চিন্তা অসম্ভব স্বপ্ন মনে হয়। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলে, হা ঈশ্বর, কিভাবে জানব যে আমি বদলে যাই নি।

ইলিয়াস গ্রামে ফিরে যেতে চেয়েও ভীত হয়ে পড়ে। শূন্য এবং উঁচু ঘরগুলোকে সে ভয় পেতে থাকে। জঙ্গলের উঁচু বৃক্ষরা থেমে থেমে তাকে নিজেদের দিকে টানতে থাকে। ইলিয়াস গ্রামে ফেরার ভয়ে হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলের আরো গভীরে ঢুকে পড়ে। অনেক দূর চলার পর পানির একটি ঝিল চোখে পড়ে। ঝিলপারে বসে সে পানি পান করে। আত্মা ঠান্ডা করে। পরিষ্কার পানিতে ঝুঁকে দেখতে গিয়ে সে চমকে ওঠে। এটা কি আমি? পানিতে তার প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছিল। সে চিৎকার শুরু করে। ইলিয়াসকে তার চিৎকার পেয়ে বসে। সে পালাতে শুরু করে।

ইলিয়াসকে তার চিৎকার পেয়ে বসেছিল। আচানক সে পালাতে শুরু করেছিল যেন ঝিল তার পিছু ধাওয়া করছে। পালাতে পালাতে তার পায়ের পাতায় ব্যথা শুরু হয়। চ্যাপ্টা হতে থাকে। কোমরে তীব্র ব্যথা শুরু হয়। তবু সে পালাতেই থাকে। কোমরের ব্যথাও বাড়তে থাকে। মনে হয়, মেরুদণ্ডের হাড় যেন দু’ভাজ হয়ে যেতে চাইছে। হঠাৎ সে কিছুটা ঝুঁকে পড়ে। তৎক্ষণাৎ দু’হাতের তালু মাটিতে ঠেকায়। সে বিনতুল আখজরের ঘ্রাণ নিতে নিতে চার হাতপায় ভর দিয়ে তীরের মতো ছুটতে থাকে।

লেখক পরিচিতি :

কথাসাহিত্যিক ইনতেজার হুসেইনকে তুলনা করা হয় প্রখ্যাত উর্দু ছোটগল্পকার সা’দত হাসান মান্টোর সঙ্গে। কেউ কেউ তাকে মান্টোর চেয়েও শক্তিশালী গল্পকার বলে দাবি করেন। মান্টোপরবর্তী উর্দু ছোটগল্পের সবচে’ শক্তিমান স্রষ্টা ইনতেজার হুসেইন প্রথম কোন পাকিস্তানী লেখক হিসেবে ম্যানবুকার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন। বিখ্যাত উপন্যাস ‘বাস্তি’-এর জন্য ২০১৩ সালে ম্যানবুকার শর্টলিস্টের চতুর্থ নামটি ছিল তার। তার গল্পের প্লট, চরিত্র কিংবা ভাষা সবই প্রতীকি। এছাড়াও দেশভাগের সময় ভারত ছেড়ে আসা এই লেখকের লেখায় বারবার ঘুরেফিরে এসেছে নস্টালজিয়া।

ইনতেজার হুসেইন উর্দু ছাড়াও ইংরেজিতে লেখালেখি করেছেন। পেশাজীবনে পাকিস্তানের বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক ডন-এ কাজ করেছেন। অনুবাদ করেছেন চেখভসহ বিশ্বসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ নানা লেখাজোখা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষের এই কথাসাহিত্যিক আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও লিখেছেন একাধিক অসাধারণ ছোটগল্প। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার বিখ্যাত দু’টি ছোটগল্প হচ্ছে, ‘স্লিপ’ এবং ‘সিটি অব সরো’। এ ছাড়াও তার বিখ্যাত উপন্যাস বাস্তি এর একটি বড় অংশ জুড়েই রয়েছে সাতচল্লিশ, উনসত্তর এবং একাত্তরের দিল্লি, ঢাকা এবং লাহোর। ২০১৬ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি উর্দু সাহিত্যের এই শক্তিমান লেখক মারা যান।

‘শেষ মানুষ’ বনি ইসরাইলের পৌরাণিক কাহিনিকে সূত্র করে লেখা ইনতেজারের একটি বিখ্যাত ছোটগল্প। গল্পটি সরাসরি উর্দু থেকে অনূদিত।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা