X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১
মোজাম্বিকের গল্প

জীবন সায়াহ্নে বৃদ্ধ লোকটি এবং বাগিচা ।। মিয়া কুতো

অনুবাদ : ফজল হাসান
১৭ অক্টোবর ২০১৮, ১৯:১৯আপডেট : ১৭ অক্টোবর ২০১৮, ১৯:১৯

জীবন সায়াহ্নে বৃদ্ধ লোকটি এবং বাগিচা ।। মিয়া কুতো ডোনা বার্টা বাগানের একটা বেঞ্চে বসে আছে। সেখানে একটা মাত্র বেঞ্চ। বাকিগুলোর অবস্থা খুবই করুণ, ভাঙাচোরা। আগুন জ্বালানোর জন্য অনায়াসে সেগুলো কড়িকাঠ হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। বাগানের শেষের দিকের সেই বেঞ্চে বাস করতো এক বৃদ্ধ। প্রতি রাতে বেঞ্চের আসন এবং লোকটি, এমনকি শক্ত কাঠ এবং নরম মাংস, যেন একে অপরের সঙ্গে জড়াজড়ি করতো। বলা হয়, শোওয়ার কারণে লোকটির পিঠের বাহ্যিক অবয়বে শক্ত কাঠের ভাঁজ ফুটে উঠেছে। বুড়ো ভদ্রলোকটির একটা নামও আছে: ভ্লাদেমিরো। একাকীত্ব এবং নির্জণতার কথা মনে রেখে তার নাম রাখা হয়েছে পাশের একটা সড়কের নাম অনুসারে: ভ্লাদেমির লেলিন সরণী।

আজ আমাকে বলা হয়েছে যে, বেঞ্চটা সরিয়ে ফেলা হবে। তারপর কর্তৃপক্ষ ব্যস্ত শহরের এক প্রান্তে নতুন বেঞ্চ বসাবে। খবরটা শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। কেননা সেই অপরিসর বাগানটি আমার বন্ধুর একমাত্র পৃথিবী, তার শেষ ভরসা। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি মানবিক কারণে ভ্লাদেমিরোকে দেখতে যাবো ।

—দুঃখিত? কে বলেছে আমি দুঃখিত?

আমি নিজের দু’কানকে বিশ্বাস করতে পারিনি: খবর শুনে বৃদ্ধ লোকটি মহা খুশি। গাছের গুড়ির তৈরি জায়গা থেকে অবশ্যই ঝলমলে শহরের ইট-পাথরের নির্মিত বাসস্থান অনেক বেশী আরামদায়ক হবে। ইতোমধ্যে কর্তৃপক্ষ তাকে সবকিছু বলেছে, যেমন থাকার জায়গা কত বড় হবে। সেই ঘরে পোষা প্রানীর সঙ্গে নির্বিঘ্নে ঘুমানো যাবে। কে জানে, সে হয়তো সেখানে কোন কাজও পেতে পারে,এমনকি তা যদি শুধু আশেপাশের বাগান পরিচর্যার কাজও হয়। সুতরা সে গাছ-গাছালির শাখা-প্রশাখা ঘেরা বাগান থেকে বাগান ভর্তি জায়গায় যাবে।

—আমি এক শাখা থেকে অন্য শাখায় যাব।

তা ছিল লোকটির দুঃখের হাসি। অচিরেই গভীর হয়ে দেখা দিবে। রাত্তিরের অন্ধকার যখন নেমে আসবে, তখন ভ্লাদেমিরো পানীয় পান করে বেশামাল হবে এবং বোতলের শেষ ফোঁটাটুকু পর্যন্ত নিংড়ে নিবে। সে যখন মাতাল হবে, তখন শামুকের মতো নিজেকে গুটিয়ে রাত্তির পার করবে। সড়কের অন্যদিকে বারবিলাসীদের আনাগোণা। কিন্তু সে তাদের সম্বোধন করে রজনীবিলাসী। সে প্রত্যেকের নাম জানে। তাদের হাতে খদ্দের না থাকলে তারা বাগানে ঢুকে ঘোরাঘুরি করে এবং একসময় তার পাশে বসে। ভ্লাদেমিরো তাদেরকে তার জীবন কাহিনীর পুরোটাই বলেছে এবং তারা তা ঘুমপাড়ানি কিচ্ছা হিসাবে মেনে নিয়েছে। কখনোবা সে রাতের বেলা রজনীবিলাসীদের চিৎকার-চেঁচামেঁচির শব্দ শুনতে পায়। বৃদ্ধ লোকটি বাহুর ওপর নিজেকে অক্ষম করে শুয়ে থাকে। সে তখন ওদের কান্নার জবাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে না, বরং সে ঈশ্বরকে দেখভাল করার কথা বলে ।

—ঈশ্বর খুবই মহান । তিনি এই সময় কাউকে শাস্তি দেন না ।

ভ্লাদেমিরো ঈশ্বরের কাছে অনুযোগ করেছিল। তার সেই ঐশ্বরিক কথা আমাকে আশ্চর্য্যান্বিত করেছে। একসময় ঈশ্বরের প্রতি ভ্লাদেমিরোর অগাথ বিশ্বাসের জন্য অনেকে হিংসা করতো। কিন্তু বৃদ্ধ লোকটি তার ব্যাখ্যা দিয়েছে এ রকম: বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ধর্মের সঙ্গে স্বাধীন চেতনাকে গ্রহণ করা শুরু করি। তার কারণ আমরা ভয়কে জয় করার জন্যই করি। এটা কী সত্যি না যে, আমরা যত বেশী জানি, তত কম বিশ্বাস করি? সে জানেও না কিংবা বিশ্বাসও করে না। কখনো তার মাথায় প্রশ্ন জাগে:

—ঈশ্বর কী অবিশ্বাসী ?

বৃদ্ধ লোকটি কী জীবনের ভয়-ভীতির হাত থেকে নিস্কৃতি পেতে পারে না? আজীবন সে একাকী। নিজের কোন বাড়ি নেই, বসবাস যোগ্য বাড়ি। এই বিষয়ে সে আমাকে চ্যালেঞ্জ করেছে:

—বসবাস যোগ্য বাড়ি? এই বাসস্থনের চেয়ে কারোর কী ভালো থাকার জায়গা আছে?

কখনো তার অসুস্থতার সময় সে ভাবে, কাছাকাছি কোথাও মৃত্যু ঘাপটি মেরে আছে। কিন্তু ভ্লাদেমিরো কয়েকটি কৌশল জানে এবং তার কাছে জীবিত মানুষের ছায়ামূর্তি ধরে যে-ই আসে, তাকে জানিয়ে দেয়। প্রচন্ড জ্বরের ঘোরে দাঁত কিটমিট করা এবং চোখ জ্বলে পুড়ে যাওয়ার সময়ও সে গান করে। তার কন্ঠস্বর কাঁপতে থাকে এবং সে মহিলাদের মতো ভাণ করে। সে বলে, মহিলারা দীর্ঘ সময় বাঁচে।

—মৃত্যু গান শুনতে পছন্দ করে। তাই সে আমার কথা ভুলে যায় এবং নৃত্য করে ।

এবং এ ভাবেই তার জীবন চলে যায়, লুকোচুরি খেলার মতো । একদিন পরিস্থিতি দখল করে মৃত্যু প্রথম গান গেয়েছিল। কিন্তু কেউ গোপন জায়গায় লুকিয়ে থাকলেও মৃত্যু ঠিকই তাকে খুঁজে নিবে। ভ্লাদেমিরো নিজের বেঞ্চে আরামে আছে। সে মনে করে চির বিদায় নেওয়ার বয়স তার হয়নি। বৃদ্ধ তারাই, যারা নিজেদের বিভিন্ন বয়সে পরিভ্রমণ করে না।

ইতোমধ্যে ভ্লাদেমিরোর ঘুম কমে গেছে এবং হালকাও হয়েছে। তার কাছে সময়ের ঘন্টাধ্বনি হচ্ছে ব্যাঙ। সে পায়ের সঙ্গে উভচর প্রানীটি বেঁধে ঘুমায়। সে গম্ভীর স্বরে ব্যাখ্যা করে: প্রানীটি বেঁধে রাখার কারণ হলো উঠে যাওয়া থেকে তাকে নিবৃত্ত করে।

—ব্যাঙ উড়তে পারে না, কেননা সে হৃদপিন্ডের ভেতর পানি ঢুকতে সুযোগ দিয়েছে।

এক সময় সবকিছু শেষ সীমান্তে এসে পৌঁছে। কতৃপক্ষ বাগান গুড়িয়ে দিবে এবং জায়গাটি আরো বেশী শহুরে হবে, জনারণ্য কম হবে। তাই আমি বৃদ্ধ লোকটিকে দেখার জন্য গিয়েছি। সেখানে যাওয়ার কারণ হিসাবে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছি:

—এ জায়গার ঘটনা সম্পর্কে বলুন। আপনি কী সত্যি খুশী ?

ভ্লাদেমিরো সময় নেয়। সে সবচেয়ে বেশী সত্য কথা খুঁজতে থাকে। তার মুখমন্ডল থেকে দ্রুত হাসির প্রভা মিলিয়ে যায়।

—তুমি ঠিকই বলেছ। আমার হাসিখুশী ভাবটা আসলে মিথ্যা।

—তাহলে কেন মিছেমিছি অভিনয় করছেন?

—আমি কী কখনো আমার মৃত স্ত্রী সম্পর্কে তোমাকে কিছুই বলিনি?

আমি নেতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা দোলাই। বৃদ্ধ লোকটি তার মৃত স্ত্রীর কাহিনী বলা শুরু করে। দীর্ঘ ভোগান্তির পর তার মৃত্যু হয়েছে। ধীর এবং পচনশীল রোগ। সারাদিন সে স্ত্রীর সম্মুখে ভাঁড়ামি করতো এবং মৃত্যুকে ভয় দেখানোর জন্য কৌতুক করতো। মহিলা হাসতো। হয়তো লোকটির মহানুভবতার কথা ভেবে সে সমবেদনা জানাতো। তখন রাত ছিল। মহিলা যখন ঘুমে বিভোর ছিল, তখন লোকটি হতাশায় আকুল কান্নায় ভেঙে পড়েছিল।

—এই সময়ের মতো। বাগান যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখনই আমি কাঁদি।

আমার হাত তার কাঁধের ওপর। বিদায় নেবার পালা। পরিত্যাক্ত হওয়ার অনুভূতির চেয়েও ভয়ঙ্কর একটা ভীতিতে আমার সম্বিত ফিরে আসে। ভ্লাদেমিরো, প্রশস্ত সড়ক এবং বাগিচার নিঃসঙ্গ বেঞ্চ পেছনে রেখে আমি চলে আসি। সেটি ছিল বাগানের শেষ বেঞ্চ।

গল্পসূত্র: ‘জীবন সায়াহ্নে বৃদ্ধ লোকটি এবং বাগিচা’ গল্পটি মিয়া কুতোর ইংরেজিতে ‘ওল্ড ম্যান উইথ গার্ডেন অ্যাট দ্য এন্ড অব টাইম’ গল্পের অনুবাদ। পর্তুগীজ ভাষা থেকে গল্পটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ডেভিড ব্রুকশ ইংরেজিতে গল্পটি ‘ওয়ার্ডস্ উইথআউট বর্ডার্স’ ম্যাগাজিনের ২০০৭ সালের ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এবং সেখান থেকেনেয়া হয়েছে।

 

লেখক পরিচিতি :

আফ্রিকা মহাদেশে পর্তুগীজ ভাষার অন্যতম লেখক মিয়া কুতো (পোশাকী নাম আন্তোনীয় এমিলিও লিতে কুতো)। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্প লেখক, কবি এবং সাংবাদিক। তিনি ১৯৫৫ সালের ৫ জুলাই মোজাম্বিকের বেইরা শহরে,  জন্মগ্রহণ করেছেন সেখানেই তিনি শৈশব কাটিয়েছেন। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে স্থানীয় সংবাদপত্রে তার কবিতা প্রকাশিত হয়। তিনি মেডিসিন পড়ার জন্য ১৯৭৪ সালে মপুতো শহরে গমন করেন । কিন্তু সেখানে পড়াশুনার সময় রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন । ১৯৭৫ সালে মোজাম্বিক স্বাধীনতা অর্জণ করার পর তিনি মেডিসিন পড়ায় ইস্তফা দেন এবং সাংবাদিকতা শুরু করেন । একাধিক সংবাদপত্র এবং ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছাড়াও তিনি রাষ্ট্র পরিচালিত মোজাম্বিক ইনফরমেশন এজেন্সির ডিরেক্টর ছিলেন। গত শতাব্দির আশির দশকে জীব বিজ্ঞানে পড়াশুনা করার সময় তার কবিতা এবং ছোটগল্প প্রকাশিত হয় । তার প্রথম কা্ব্যগ্রন্থ (রুট অব ডিউ) প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ সালে এবং প্রথম ছোটগল্প সংকলন (ভয়েসেজ মেইড নাইট) প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে । এই সংকলন তাকে আন্তর্জাতিক সাহিত্য জগতে পরিচয় করিয়ে দেয় । ‘এভরি ম্যান ইজ এ রেইস্’ (১৯৯৪) তার অন্য ছোটগল্প সংকলন। সংকলন দু’টির বেশির ভাগ গল্পের পটভূমি মোজাম্বিকের দশ বছরের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা পরবর্তী গৃহযুদ্ধের পাশবিক ঘটনা । তার প্রথম উপন্যাস (স্লিপওয়াকিং ল্যান্ড) ২০০২ সালে প্রকাশিত হয় । এই উপন্যাসটি বিংশ শতাব্দির আফ্রিকার প্রথম ছয়টি উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে একটি। এছাড়া এই প্রথম উপন্যাসই তাকে এনে দেয় ‘জিম্বাবুয়ে ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ার’ পুরস্কার । সাহিত্য কর্মের স্বীকৃতি হিসাবে তিনি একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন, যেমন ‘লাতিন ইউনিয়ন’ সাহিত্য পুরস্কার (প্রথম আফ্রিকার লেখক) (২০০৭), ‘নিউস্টাড ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ফর লিটারেচার’ (২০১৪) এবং ‘ক্যামোস প্রাইজ’ (২০১৩)। বর্তমানে তিনি মপুতোতে পরিবেশ বিজ্ঞানী হিসাবে কর্মরত আছেন।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
রাশিয়ায় বোমারু বিমান বিধ্বস্ত
রাশিয়ায় বোমারু বিমান বিধ্বস্ত
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীদের নিতে জাহাজ আসবে এ সপ্তাহেই
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীদের নিতে জাহাজ আসবে এ সপ্তাহেই
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কড়া নিরাপত্তায় চলছে ভোটগ্রহণ
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কড়া নিরাপত্তায় চলছে ভোটগ্রহণ
পাকিস্তানে জাপানি নাগরিকদের লক্ষ্য করে জঙ্গি হামলা
পাকিস্তানে জাপানি নাগরিকদের লক্ষ্য করে জঙ্গি হামলা
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন