X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জীবনানন্দ দাশের গল্পে মতাদর্শ

রহমান মতি
২২ অক্টোবর ২০১৮, ১৬:৫৪আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০১৮, ১৭:০২

জীবনানন্দ দাশের গল্পে মতাদর্শ যে কোন কবি যখন কথাসাহিত্যে হাত দেন তার বাঁক নির্ধারিত হয় তখনই। কবি যেভাবে লেখেন কথাসাহিত্যিক সেভাবে লেখেন না। কবি ও কথাসাহিত্যিকের রচনার স্বাতন্ত্র্য এবং পার্থক্য আধুনিককালের সাহিত্যচর্চায় বড় আলোচনা-সমালোচনার বিষয়। বিশ শতকের জীবনানন্দ দাশ কবি হিসেবে সবচেয়ে আধুনিক কিন্তু কথাসাহিত্যে তিনি কি আলোচনার এ কেন্দ্রে এসে তাকে নিয়ে সমালোচনা হয়েছে।

উপন্যাসও গল্প কবিতার রেখায় চলে না। চলাটা উচিতও নয়। বিশ শতকের অন্যান্য কথাসাহিত্যিকরা কেউ কেউ কবি। কেউ পুরোদস্তুর কথাসাহিত্যিক। জীবনানন্দ দাশের কথাসাহিত্যে উপন্যাস গল্পের সার্থকতার প্রশ্ন-ই উত্থাপিত হয়। আমাদের বিবেচনায় রবীন্দ্রনাথ যেমন তেমন আর কেউ নয়। জীবনানন্দ দাশের উপন্যাস-গল্প কাঠামো ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে এসেছে। পাঠের পর পাঠক ও সমালোচকদের মনে হয়েছে ঠিক উপন্যাস বা গল্পের ধাঁচ যেমন হয় জীবনানন্দ দাশ তা মানেননি।

আপত্তির জায়গায় অবশ্যই যুক্তি রয়েছে। আরো বলা যায় জীবনানন্দের ব্যক্তিজীবন থেকে। তিনি তার উপন্যাস ও গল্প প্রকাশ করেননি। পড়তে দিয়েছেন একজনকে। প্রভাকর সেন। প্রভাকর সেন জীবনানন্দকেই উপদেশ দিয়েছেন তার গদ্যকে পুনর্গঠিত করার জন্য এবং আদর্শ হিসেবে অন্নদাশঙ্কর রায়কে সামনে রাখতে বলেছেন। কারণ অন্নদাশঙ্করকে বিশ্বসাহিত্যের পাঠে সর্বাপেক্ষা পরিশীলিত ভাবা হত। জীবনানন্দ তা মানেন নি। তবে কি প্রভাকর সেন জীবনানন্দের গদ্যকে বুঝতে পেরেছেন? উৎকৃষ্ট পাঠক আসলে ছিলই না। অথবা, রাজনৈতিক ঘেরাটোপে জীবনানন্দ এক অব্যক্ত লোক হিসেবে পরিচালিত ছিলেন।

কবিতায় ধূসর পান্ডুলিপি থেকে তার যে প্রকৃত বাঁক নির্মিত হয়েছিল, তার মাত্রা ছিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের। ক্রমশ বনলতা সেন ইতিহাসমুখর রোমান্টিক চেতনার কাব্য, মহাপৃথিবীর বৈশ্বিক চেতনা, সাতটি তারার তিমির-এর আন্তর্জাতিকতা কিংবা বেলা অবেলা কালবেলা-র রাজনৈতিকতা প্রচন্ডভাবে তাকে আধুনিক করেছে। উপন্যাসে গল্পে যে বাঁক নেই এটা নেহায়েৎ প্রচারমুখী প্রচলিত ভাবসম্পদ এবং তৈরী করা সংস্কারমূলক মানসিকতা। স্পষ্টই উপন্যাস কবিতা থেকে আলাদা কারণ এতে আছে মনস্তাত্ত্বিক প্রবাহ, যা বাংলা উপন্যাসে মাল্যবান ‘র মাধ্যমেই শুরু। কারুবাসনা—যার কেন্দ্রীয় শক্তিই হচ্ছে লেখকসত্তা। প্রতিটি লেখকই তো এই বাসনার শিকার এবং বাস্তবতার কারিগর। গল্পতে জীবনানন্দ মানসিকতা ও মনস্তত্ত্বের ধারাবাহিক অথচ ভিন্নভাবে ছড়ানো বহুমুখী বদলকে যেভাবে দেখান তাতে বিশ শতকের একমাত্র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে সেখানে উজ্জ্বল মনে হয়। গল্পের প্রচলিত ফর্ম এবং তাকে মানা না মানার যে প্রশ্ন আসে তা কেনই বা আবদ্ধ থাকবে একই রীতিতে। তাকে যদি আলাদাভাবে উপস্থাপন করা যায় তাহলে জীবনানন্দের গল্প আর ব্যর্থ থাকে না।

জীবনানন্দ দাশ গল্পে সাধারণ বা প্রথাগত বিষয়কে পুঁজি করে তার চর্চা করেননি। তিনি বারবার প্রচলিত ফর্মকে ভেঙেছেন। প্রথমতই তার গল্প পাঠের অভিজ্ঞতা আমাদের প্রচলিত অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলে না। জীবনানন্দ একান্তভাবেই বিশ শতকে বেঁচে থাকা একজন মানুষ। সেই বিশ শতকে যেখানে উপনীত হতে না হতে মানুষের জীবনযাপন ক্রিয়া হঠাৎ নানারকম দার্শনিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক সংঘাতের মুখোমুখি হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত সর্বজনীন শৃঙ্খলাকে ভেতরে-বাইরে আক্রমণ করে স্থানীয়তা আর তাতে স্থির না হতে দেয়া বহিরাগত অভিজ্ঞতা সময়প্রবাহের মাধ্যমে নানা জ্ঞান-নির্জ্ঞান, ভেদ-অভেদকে স্পর্শ করে। সূত্রগুলি যৌথতার পরিপূরক। সেজন্যই তার গল্প হয়ে ওঠে নানা রকমের গঠনকৌশল ও বিষয়সমৃদ্ধ। তার গল্পের মতাদর্শও অভিজ্ঞতানির্ভর ব্যক্তিক-জৈবিক-সামাজিক কঠিন বাস্তবতামুখর।

গঠনকৌশলের চিত্রে তার গল্পের চরিত্র ও পরিবেশের তারতম্য এরকম—

ক. অবিভাজ্য একজন ব্যক্তিপুরুষ ও মানবী

খ. পরোক্ষ গল্প যা কথকের আওতাভুক্ত

গ. নাটকীয়তা (যা থাকে মূলত বর্ণনাভঙ্গিতে)

ঘ. ইতিকথা। অতিকথন বা বক্তৃতার বির্তক

ঙ. কেন্দ্রীয় চরিত্রকে খাড়া করার স্বাভাবিকতা

বিষয়কে বারবার তিনি কেটেকুটে নেন তা নয় কিন্তু বিষয়ের মধ্যেই তার অন্তঃবৈচিত্র্য আনেন। নর-নারী এটাই তো বিশ্বব্রহ্মান্ডের চরিত্র। তাই একে ভেঙে-গড়ার যে প্রবণতা তাতেই জীবনানন্দ গল্পে ব্যবহার করেন নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের রেখা এবং সেগুলো তার শিল্পদৃষ্টির পাশে মতাদর্শিক চিহ্ন হিসেবে প্রকাশিত হয়। যেমন—

     ক. ব্যক্তিমানুষ              খ. অর্থনৈতিকতা

     গ. স্বগত কথন             ঙ. চরিত্র ও তার মতাদর্শ

     ঘ. মনস্তত্ত্ব, ছেদ-বিচ্ছেদ (প্রেম, যৌনতা ইত্যাদি)

ক. ব্যক্তিমানুষ

কেন্দ্রীয় চিন্তায় জীবনানন্দ গল্প রচনা করেছেন এবং প্রতিটি গল্পের ক্ষেত্রে এই কেন্দ্রীয় চিন্তাটি উদ্ভূত হয়েছে। সর্বাত্মকভাবেই তা অস্তিত্বের উপস্থিতিকে বারবার জানান দিয়েছে। তার গল্পের চরিত্র বা জীবনবৃত্তের পরিধির অথবা কিনারের অধিবাসী। যা তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতাই তার কাছে নিজস্ব জীবনবোধ। তিনি যে জীবনে বাস করেননি তার বাইরের জীবন যেটি সেটা তাকে টানেনি। 

কিনার—পরিধি

এই বৃত্তের কাঠামোতে অস্তিত্বের মাত্রানির্ণয় করাই আধুনিক বিশ শতকের অভিজ্ঞতালব্ধ শিল্পবীক্ষার অন্যতম সূত্র। গদ্যরীতিতে ‘আমি’-কে কথকরূপে ব্যক্তিক করে তুলতে জীবনানন্দ সামাজিক অন্তর্বয়ানের প্রতিভূ যে ব্যক্তিসত্তা, তাকেই নির্মাণ করেন। ব্যক্তিসত্তা তার মৌল জীবনযাপনের সংক্ষুব্ধ সমস্যাগুলি আত্মার অনু-পরমাণু স্তরে উদঘাটনস্পৃহা নিয়ে থাকে। বিচ্ছিন্নতাবোধ, বিপন্নতা বা অনির্দিষ্টতা এই গদ্যে বাস্তবতাকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। অস্তিত্ববাদী দার্শনিক কিয়ের্কেগার্দ ব্যক্তিমানুষকে অস্তিত্ব রক্ষায় বাস্তববাদী হতে বলেছেন। জীবনানন্দের ব্যক্তিমানুষ এই ‘আমি’র মধ্যে ঘুরে ফিরে কথোপকথনে মনোলগ ব্যবহার করে—

‘এই বিকৃত শবদেহ নিয়ে মানুষ বলে আপনাকে চালিয়ে দিচ্ছি—মনুষ্যত্বের এত বড় অপমান তার বড় অসহ্য মনে হল।‘ (ছায়ানট)

কথক আরো বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে ‘সঙ্গঃনিঃসঙ্গ’ গল্পে হয়ে আসে এককেন্দ্রিক। চিঠি ও ডায়েরির ভঙ্গিতে লেখা। চিঠি বা গল্পের বিষয়বস্তু কী? এ প্রশ্ন খুব হালকা মনে হতে পারে। অথচ এর ভেতরেই বিচ্ছিন্ন বা নিঃসঙ্গ ব্যক্তি ‘আমি’ নানাভাবে বিকশিত হতে থাকে। জীবনানন্দের স্বভাবসুলভ হতাশা, মৃত্যু, মরুভূমি, মৃত্যু ও বিচ্ছেদ—এখানে তার প্রকাশ তীব্র। তার বিকশিত জগৎ তার নিঃসঙ্গতার মধ্যেই যেন এক ধরনের অহমকে প্রতিষ্ঠা করেছে। দাম্পত্য সম্পর্ক সেখানে একপ্রকার নেইই, কারণ স্ত্রীটি বহুদিন থেকেই স্বামীর কাছে নেই। শূন্যতা কে তিনি আদরণীয় করে তোলেন যখন আর কোনো হিসাব থাকে না। মনে হয় ব্যক্তি যেভাবে মৃত্যুবরণ করে একা তাতে মনে হয় মৃত্যুটার দায় সবারই। কবিতায় যেমন—

     ‘কেবল ব্যক্তির—ব্যক্তির মৃত্যু শেষ করে দিয়ে আজ/ আমরাও মরে গেছি সব-’ (সূর্যপ্রতিম/ সাতটি তারার তিমির)

খ. স্বগতকথন

‘স্বগতকথন’ একটি টার্ম হিসেবে সাহিত্যে ব্যবহৃত। নামে তার পরিচিতি। জীবনানন্দ দাশের গল্পে ব্যক্তিকেন্দ্রিক বয়ানের প্রাধান্যে এই বৈশিষ্ট্য থাকে যেখানে নিজেরা অর্থাৎ নায়করা কথা বলে বেশি। বলবার জন্য তার কথার যেন অভাব নেই। উপন্যাসে হেম, মাল্যবান, সুতীর্থ, হারীত-রাও এ ধরনের বেশি বেশি আত্মভাব প্রকাশকে বড় করে তোলে। মূলত ব্যক্তির স্ফূরণেই তার বিকাশ। ‘Self’— বলতে যে বিষয়টি আছে তার জন্য আমাদের এই ব্যক্তির প্রতি নির্ভরশীল হতে হয়। সে যতক্ষণ বলে একাই বলে এবং যতক্ষণ বলে তার বলায় ধীরে ধীরে সমগ্রতা আসে এবং পরিপার্শ্বকে বড় পরিবেশে দেখায়।

আফসার আমেদের ‘সঙ্গ নিঃসঙ্গ’ উপন্যাসে সম্বোধনহীন চিঠিতে বর্ণনার ধাঁচটি স্বগতোক্তির। স্ত্রী অনুপমাকে বিয়ের পর কয়েক মাস তার কাছে রাখার সৌভাগ্য হয়েছিল। তার স্ত্রী সেই যে পিতৃগৃহে গেল আর এল না। পত্রলেখক পুরুষটি তখন কেবল হতাশায় ভোগে এবং তা ক্রমশ মর্ষকামী হয়। স্বগতোক্তিতে তার একান্ত মনস্তত্ত্ব প্রকাশ পায়—

এই যে দীর্ঘকাল তুমি আমার কোনো খোঁজখবর নেও নাই। আমিও তোমাকে কিছু লিখি নাই- এই শূন্যতা আমার কাছে বড়ো গভীর পরিতৃপ্তির জিনিস। (সঙ্গ নিঃসঙ্গ)

গ. মনস্তত্ত্ব, ছেদ-বিচ্ছেদ

আধুনিক সাহিত্যকর্মের মূল বৈশিষ্ট্য চৈতন্যের এমন একটি স্তরকে ছোঁয়ার আকাঙ্ক্ষা যা সমাজ-সংস্কার, লোকশিক্ষা, ধর্মপ্রচার, ইতিহাসচেতনা, রাজনৈতিক প্রচার এসব ছাড়াও সৃষ্টিরহস্য যা মূলত এক কালহীন অনন্ত গূঢ় শৃঙ্খলার সঙ্গে সম্পৃক্ত। স্মার্ট, ঝরঝরে, চালাক, রাগী বা আক্রমণাত্মক গদ্য নয় বরং সম্পূর্ণ একা একক গদ্যরীতির ভাষা। বোধ-এর জগতে যা ‘স্বপ্ন নয় কোনো এক বোধ কাজ করে’। বোধের স্তরে বহুস্তরকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে মনস্তাত্ত্বিক স্ফূরণ ঘটে। সেখানে গতি-প্রকৃতি এত বিচিত্র ও স্বতন্ত্র যে প্রতিটি গল্পই সে রেখাকে স্পর্শ করে। ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি গল্পে তা দেখা যাবে—

‘ছায়ানট’ গল্পটি সম্পর্কে প্রেমেন্দ্র মিত্রের মন্তব্য—

ত্রিশের দশকের শুধু বাংলা কেন সমস্ত আলোকিত পৃথিবীর পক্ষেই অগ্রসরতম মিথুন-সমীক্ষণ যে গল্পের প্রেরণা তাকে কটি সংকেত-বিন্দুর বাইরে ছড়াতে দিলে তার উদ্দেশ্যেই ব্যর্থ হয়ে যেত নাকি?

বর্ণিত যে মিথুন সমীক্ষণ তা মূলত গল্পের কেন্দ্র। কেন্দ্রকে বহমান করেছে একটি সংকেত। প্রেমেন্দ্র মিত্র যে সংকেতবিন্দু-র কথা বলেছেন তা অবশ্যই আছে এ গল্পে। বস্তুত এই মিথুন সমীক্ষণ-ই অনেক গল্পের কেন্দ্রে কাজ করে যায়। কথকের কাছে রেবা ও ডাক্তার—একই সমরেখায় আসে একটি অংশে। যখন বিকৃত শবদেহ মনে হয় তার নিজেকে। আত্মখেদ আনে অ্যালিয়েনেশন। রেবা ও ডাক্তারের রূপ অবৈধ এবং চুমু’র শব্দ আর খানিক পরে আবার কথককে বলে ‘ডাকছিলে তুমি?’ প্রশ্নবোধকচিহ্নই সম্পর্ক এবং অন্য আসক্তির কথা মনে করায়। কিন্তু কথকের মনস্তত্ত্ব শেষ পর্যন্ত ঘৃণাই ছড়ায় আর এইসব অবিচারের ভিতরের সত্যটাকে স্পষ্ট করে দেখায়—

     ‘ওরা যত গরম হয়ে ওঠে, যত নগ্ন হয়ে পড়ে—আমার মনে হচ্ছিল, ওরা তত আড়ষ্ট হয়ে আসে’

আবার নিজেকে বাসি মড়াও মনে করেছে কথক। কারণ, তার কাছেই আবার নির্ভরতা। রেবার ‘ডাকছিলে’- এই উচ্চারণই তার প্রমাণ। অর্থাৎ মনের ওপরে নানা ডকুমেন্টেশন আছে। জীবনানন্দের গল্পে এটি স্বাভাবিক ও বিশেষ বিষয়।

‘সঙ্গ নিঃসঙ্গ’ একটি সুন্দর দাম্পত্য জীবন বা সংসারের গল্প। একটি স্মৃতিচারণার ছকে বলে যাচ্ছেন। এ গল্পের পত্রলেখক যিনি আদতে একজন স্বামী। ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার মত যেখানে নাটকীয়তা মূল এবং সেভাবেই স্মৃতিচারণ এবং জীবনের অন্যান্য লক্ষণ শেষে একটি কেন্দ্রীয় আবহ ‘বিপন্ন বিস্ময়’ ছিল মৌলিক।

সঙ্গঃনিঃসঙ্গ গল্পেও এরকম বাঁক আছে। মানসিকভাবেই এর নির্মাণ হয়েছে কয়েকটি স্তরে।

     ক. আকস্মিকতা বা আকস্মিক আরম্ভ

     খ. নাটকীয়তা

     গ. মূল চরিত্রের অন্য পরিপার্শ্ব

     ঘ. চূড়ান্ত মনস্তাত্ত্বিক প্রবাহ

এ গল্পের কথককে জীবনানন্দ গবেষক ক্লিন্টন বি সিলি ‘অ্যা পোয়েট অ্যাপার্ট’ গ্রন্থে সংবেদনশীল বলেছেন। গল্পের পান্ডুলিপিতে মে, ১৯৩৩ লেখা। ৩ বছর আগে লাবণ্যর সঙ্গে বিয়ে হয় এই মাসেই। ১৯৩৩ এ গল্পের পত্রলেখক ও তাদের ৩ বছর পূর্ণ হয়। অর্থাৎ এটি জীবনানন্দের ব্যক্তিজীবনের প্রতিনিধিত্বমূলক গল্প। শুরুটা ছিল আকস্মিক ‘বাপের বাড়ি গিয়া এবার তুমি খুব কায়েমি হইয়া বসিয়াছ দেখিতেছি’ এখানে ‘কায়েমি’ শব্দটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্থায়ীভাবেই স্ত্রী অনুপমা চলে গেছে বর্ণনায় তাই আসে। নাটকীয়তা এরপরেই আসে। স্ত্রীর না আসাই তার কাছে অর্থবহ হয়ে ওঠে। নিঃসঙ্গতাই পুরো গল্পের কেন্দ্রীয় বোধ হয়ে ওঠে। নিঃসঙ্গতার অনেক বাঁকে বিকশিত হয় এক একটি স্মৃতিচারণা। বাংলা গল্পে এ ধরনের বোধ দেখা যায় না।

পারিপার্শ্বিকতাকে গল্পে অভাবনীয় সম্পদ হিসেবে দেখানো হয়েছে। নিঃসঙ্গ নায়কের তার নারী স্ত্রীর সাথে সম্পর্কের খাতিরে পূর্বের ঘটনা এবং বর্তমান ভবিষ্যৎ মিলে একটি রিক্ততার পরিবেশ বড় হয়ে ওঠে। যে বিষয়গুলো মূর্ত হয় তা হল—

     ক. প্রতিটি দিনের সকাল-দুপুর রাত কীভাবে কাটে তার বর্ণনা

     খ. প্রাণী ও উদ্ভিদজীবনের প্রতি বৃদ্ধি পাওয়া কামনা

     গ. স্ত্রী-মা-বোন সবার চলে যাওয়া

      ঘ. সন্তানের আকাঙ্ক্ষা— ‘পৃথিবীর পথে পথে ঘুরিতে ভালোবাসে সে ঘুরুক। আমার যদি কোনো সন্তান থাকিত তাহলে এইরকম ঘুরিতে দেখিলেই ভাল লাগিত আমার’

      ঙ. কাজের লোক হিমাংশুর মা-র রান্না ও অন্যান্য বিবরণ

      চ. সামগ্রিক বিবরণে একাকীত্ব

গল্পের শেষ মোড়ে যে আকস্মিকতা সেটাই মনস্তাত্ত্বিক প্রবাহের চুড়ান্ত কথা।

প্রেম, বিচ্ছেদ, বেদনা, কাতরতা এসব তো আমাদের অজানা জিনিস নয়; কিন্তু তুমি হইাদের যে রূপ দিয়াছ তাহা তো আমাদের রক্তের স্রোতে কোনোদিন ছিল না।

বিচ্ছেদ, বেদনা, কাতরতা ইত্যাদি ব্যক্তিহৃদয় থেকে উৎসারিত একান্ত ব্যর্থতার প্রকাশ। কিন্তু, ঐ রক্তে থাকার ব্যাপারটিই প্রধান, যা পৌরুষকে নির্দেশ করে। ‘কথক-পুরুষের অপৌরুষেয় মানস’ই গল্পের কেন্দ্রীয় মনস্তত্ত্ব।

জীবনানন্দের গল্প যেখানেই স্থাপিত হোক সব সময়েই তা প্রকৃতার্থে নাগরিক ও আধুনিক। ‘গ্রাম ও শহরের গল্প’ এ গল্পটি প্রধানত নাগরিকতার। পরিণত বয়সের ত্রিকোণ দ্বন্দ্বই প্রধানত শচী-সোমেন-প্রকাশকে বিদ্ধ করে। পুঁজিবাদী উৎকেন্দ্রিকতার বিকাশে গ্রামীণ অর্থনীতির সীমাবদ্ধতা চেতনা প্রবাহমূলক আকার পেয়েছে। শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-সামাজিক অনুভূতি ইত্যাদি আছে সমান্তরালে। সোমেনের বেকার বিপর্যস্ত তিক্ততায় মাত্র ৬০ টাকা বেতনের চাকরি করার জন্য শচীর স্বামী প্রকাশের কাছে তদবির করতে আসার মাধ্যমে গল্পের শুরু। এরপর কথায় কথায় নানা প্রসঙ্গ আসে তাদের।

গ্রামীণ অবস্থানটি শচীর ভাবনায় অপরূপ। কলকাতায় বদলি হয়ে আসার পেছনে শচীর কলকাতার প্রতি দুর্বলতা বেশির কারণ বাংলার পাড়াগুলোকে সে ভালোবেসে কলকাতায় তার স্বাদ সে পেতে চায়। প্রকাশ আধুনিক। পোশাকে ও চলনে-বলনে। আধুনিকতা তাই শহুরেপনার জিনিস হয়ে ওঠে।

ব্যবসা ও জীবনকে সোমেন ভাবে আলাদা করে। চেতনাপ্রবাহ তাই সচ্ছলতা-অসচ্ছলতা সমান কার্যকরী। অর্থনৈতিক প্রয়োজনই বড় গ্রাম ও শহর এই পার্থক্য ও বাস্তবতায় প্রকাশের নাগরিক প্রতিষ্ঠা ও নারীর প্রতি হ্রাসকৃত মূল্যবোধ ও আচরণ এবং সোমেনের গ্রামীণ বিপর্যস্ততা ও শচীর প্রতিদায়িত্বশীল অবস্থানকে জীবনানন্দ বড় করে দেখান। প্রকাশের আবার মনস্তাত্ত্বিক মোড় হয় আলাদা। স্ত্রীর মনমত চলতে সে পছন্দ করে এবং শচীও তাতে তৃপ্ত বোধ করে। কিন্তু এ যেন প্রকাশের কাছে একঘেয়েমি-

স্ত্রীর মর্জি মতো পদে পদে সে ঢের চলে দেখেছে; তাতে ঢের প্রয়াস লাগে বটে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাতেই জীবনের শান্তি থাকে। মানুষের জীবনের রঙ্গরসের ক্ষমতাও তাতে বেড়ে যায়। নিজেকে প্রখর আর্টিস্টের মতো মনে হয়।

শচীরও এমন একঘেয়েমি’র প্রকাশ আছে। কাসুন্দি তৈরীর সাংসারিক দৈনন্দিনতা থেকে ভাবে-

কিন্তু জীবন কি এই কাসুন্দি নিয়েই শুধু?

কিংবা, প্রকাশের রাত করে ঘরে ফেরা—

সোমেন রাতের বেলা এসেছে—যতখানি রাত করে এলে স্বামীদের ঘরে পাওয়া যায়।

কিছু সূক্ষ্ম কেন্দ্র আছে গল্পে। বলেছেন যাকে জীবনানন্দ শচী তার শিকার। সোমেনের বেকারত্ব তার কাছে একটি হাস্যকর ব্যাপারও বটে। ভ্যাগাবন্ড ভাবতে থাকে তাকে। জীবনানন্দ বলেছেন—

কোনো ভ্যাগাবন্ডকেই তার ন্যায্য জায়গা দিতে পারে না মেয়েরা—যে কোনো ভ্যাগাবন্ডের সঙ্গেই গুলিয়ে ফেলে।

সোমেনের এবড়ো-থেবড়ো চেহারা যাকে শচী বলেছে- ‘grotesque’ এটি হল বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে ব্যক্তির লেনদেন। বাখতিন এই তত্ত্ব দেন। ‘grotesque’ এর নমুনা এ গল্পের আছে—

     ক. শার্টে চুরুটের ছাই

     খ. মুখের দাড়ি

     গ. মাথার চুলে তেল নেই

     ঘ. চোখ মেহেদি রঙের।

অর্থনৈতিক সংকট হয়ে ওঠে মানসিকতার সংকট। গ্রাম ও শহর উভয়েই যা কখনো কখনো সত্য।

‘মেয়েমানুষ’ গল্পের মানুষ চারজন। দুজন মানব, দুজন মানবী। হেমেন ও চপলা, দ্বিজেন ও লীলা। দম্পতিদ্বয়ের মানসিক প্রবাহ কোথাও সহজ-স্বাভাবিক, কোথাও জটিল। জীবনানন্দের গল্পে তৃতীয় স্বর বলে একটা ব্যাপার থাকে। যা থাকে মূলত অন্তঃপ্রবাহ হিসেবে। সম্পর্কের মধ্যে একটি স্বাভাবিক ঘটনাও আছে এ গল্পে কিন্তু শৈল্পিক প্রবাহ থাকে। মেয়েমানুষ গল্পে এরকম কেন্দ্রীয় প্রবাহ বিদ্যমান—

     ক. হেমেন-চপলা স্বাভাবিকতা।

     খ. দ্বিজেন-লীলা দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক।

     গ. হেমেন-দ্বিজেন কথোপকথন।

     ঘ. মেয়েমানুষ’র কেন্দ্রগত ব্যাখ্যা।

     ঙ. তুলনা প্রতিতুলনা।

হেমেন ও চপলার সম্পর্ক স্বাভাবিক। স্বাভাবিক বলেই তাদের মধ্যে কম। অন্যদিকে বৈশাখের যে দুপুরবেলায় হেমেন ও চপলা লীলাদের বাড়ি যাবার চিন্তা করে তাতে দ্বিজেনের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। কারণ দ্বিজেন-লীলা-র মধ্যকার সম্পর্ক ভালো নয়। সামান্য রসিকতায় ছুরি ছুঁড়ে মারার কারণে দ্বিজেনের ও লীলার স্বতন্ত্র মনের অবস্থান হেমেন ও চপলার কাছে স্বচ্ছ হয়। রান্নাঘরে যে স্টোভ জ্বলে তাই যেন জ্বলন্ত সম্পর্ক ফাঁদের প্রতীক হয়। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘স্টোভ’ নামে একটি গল্প ছিল। শশীভূষণ ও মল্লিকার মধ্যকার নাগরিক দ্বন্দ্ব প্রধান তাতে। দ্বিজেনের কষ্ট যা লীলারও তাই। প্রতিফলনে যা ব্যক্তিক পার্থক্য।

হেমেন ও দ্বিজেনের কথোপকথনে কোন বয়সে কি করা উচিত এ নিয়ে কিছু তর্ক হয়। কুড়ি বছরের মেয়ে দ্বিজেনকে ভালোবাসবে না এটি দ্বিজেন বিশ্বাস করে। সে ৪০-৪১ বছরের গিন্নিকেও বিশ্বাস করে না। তার সঙ্গে তার প্রেম অসম্ভব ও রাবিশ মনে করে। রোমান্সের ব্যাপার তার মধ্যে আর কাজ করে না। কিন্তু হেমেন তাকে স্মরণ করায় তার অতীত। যখন সে অনেক মেয়েকে দেখেছে। যারা তার কাছে স্বেচ্ছায় এসেছে। এ বিষয়ে এর কথা তোলে হেমেন—

মানুষের জীবনে আসল জিনিসটাই তো তুমি পেয়েছো—মেয়েরা তোমাকে ভালোবাসে। নিজের সেন্টিমেন্টালিজম কত জায়গায় গিয়ে মেটাতে পারো।

‘সেন্টিমেন্টালিজম’ই সত্যিই দ্বিজেনের সম্পদ। ব্যবসা তার মধ্যে আলাদা। ‘মেয়েমানুষ’র ব্যাখ্যায় দ্বিজেন তার অভিজ্ঞতায় এগিয়ে। হেমেন বিজনেস বুঝলেও রোমান্স বোঝে নি। রোমান্সকে দ্বিজেন কাজে লাগিয়েছে। সেন্টিমেন্টালিজমকে যৌন আকাঙ্ক্ষার চাবিকাঠি ভেবেছে সে। বুদ্ধির পরিবর্তে হৃদয়ধর্মের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা এ মতবাদের বৈশিষ্ট্য। তাই হৃদয়ের রোমান্স-কে প্রতিষ্ঠা করে।

তাই হেমেন ও দ্বিজেন-এর মানসিক গঠন হয় এমন:

হেমেন—দ্বিজেন

বিজনেস—মেয়েমানুষ

অর্থ—রোমান্স

অর্থাৎ হেমেন বিজনেস বোঝে সে বিজনেসের মানুষ অর্থই তার আসল। চপলার স্বাভাবিকতায় সেও স্বাভাবিক। কিন্তু, দ্বিজেন মেয়েমানুষ চেনে তাই সে রোমান্স করতে শিখেছে। পরবর্তী ধাপেই হেমেনের অনুপস্থিতিতে দ্বিজেন আসে তার বাসায়। দেখে চপলা গড়াচ্ছে। এখানেও একটা মনস্তত্ত¡ দেখান জীবনানন্দ-

 বিরাট মেদ—চপলা

 হৃদয়—ভোগ

‘মেদ’  শব্দের সাংকেতিকতার মধ্যেই আছে চপলার মেয়েমানুষসুলভ হৃদয়। তাকে ভোগ করেছে দ্বিজেন। আর সেটা আধঘন্টা-এক ঘন্টা- দুই ঘন্টা। অসাধারণ এই শব্দবন্ধে জীবনানন্দ ভোগবাদিতাকে দেখান। শেষের দিকে চ‚ড়ান্ত মনস্তত্ত¡ চপলার। যেখানে সে চালাক মেয়েমানুষ। অবশ্য জীবনানন্দ তাকে গিন্নী বলতে চান। হেমেন আসার ব্যাপার আছে। এ ভেতর থেকে হেমেনের মতই চপলা বা গিন্নি এই মিথুন মুহূর্তে স্বামীকে অতিরিক্ত ভাবে বা সে আসলেই চায়। স্বামী নামক বিশেষ্যকে গুরুত্ব দিতে—

গিন্নিরাও চায় যে তাদের স্বামী আসুক- এ অতিথি বেরিয়ে যাক।

তুলনা-প্রতিতুলনায় মেয়েমানুষ গল্পের শৈল্পিক প্রবাহ অসাধারণ হয়ে ওঠে। যৌনতা ও সম্পর্ক যে কত বিচিত্র তার মনস্তত্ত্ব দেখাতে জীবনানন্দ অনন্য হন এক্ষেত্রে।

‘কিন্তু ব্যবসাকে যদি একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট জিনিশ বলে ধরো। বাস্তবিক বিজনেস একটা আইডিয়াল আর্টের মতো।’

ঐ অ্যাবস্ট্রাক্ট বা বিমূর্ত সত্যই ‘হিসেব-নিকেশ’ গল্পের আসল হিসেব-নিকেশ। ব্যবসাই অবনীশ ও রাখালের মনস্তত্ত্বকে আলাদা দেখায়। অবনীশকে পাত্তা দেয় না অমলা। রাখাল ব্যস্ত লোক। ব্যস্ততা এই ব্যবসার জন্যেই। অবনীশ তাতে ব্যর্থ। শেষের দৃশ্যে অমলার প্রতি রাখালের দায়িত্বশীল মনোভাব মূলত অবনীশের যে দুর্বলতা তারই সুযোগে।

অবনীশের আছে বই। প্রেম নেই। স্ত্রীর অন্য পুরুষে আসক্তি থাকলেও তাতে তার আপত্তি নেই। অর্থনৈতিক অবস্থান রাখালের সুযোগ তৈরী করে। জীবনানন্দ বাস্তবকে ঐ অর্থেই বড় করেন।

ঘ. অর্থনৈতিকতা

জীবনানন্দ দাশের বাস্তব জীবনই এই। অর্থনীতির জন্য বিপর্যস্ত ছিল। উপন্যাসে গল্পে যে বেকার চরিত্ররা ছিল তারা সবাই প্রাইভেট-টিউশনি বা সম্পাদনা, শিক্ষকতা করে। এর বেশি কেউ নেই। তৎকালীন বঙ্গদেশের আর্থ-সামাজিকতার পাশে এতসব বৈচিত্র্য ছিল না। অর্থনৈতিক সমস্যা ছিল রাষ্ট্রীয় সমস্যাই।

‘অর্থনৈতিক দিক’ নামে জীবনানন্দের একটি প্রবন্ধ ‘দৈনিক স্বরাজ’ পত্রিকায় সম্পাদকীয় নিবন্ধ হিসেবে ছাপা হয়। তাতে তিনি ব্যাখ্যা করেন অবস্থাগুলো—

১.নবীন ভারত-এর অর্থনৈতিক কল্যাণের প্রয়োজন।

২.ভারতবর্ষের বস্তিগুলি মর্মান্তিক ও নিঃসহায়।

৩.নিন্মবিত্ত ও নিন্মমধ্যবিত্ত প্রভৃতি শ্রেণীর সমাজজীবনে যে হৃদয়হীন অর্থনৈতিক বিপর্যয় ইহার সুসঙ্গত পথেই সাম্প্রদায়িক মিলন ও জাতীয় ঐক্য সম্ভব হইতে পারে।

৪.অনাগত স্বাধীন ভারতের বেকার সমস্যা, কুটি শিল্প, বাণিজ্য ও সর্বসাধারণের জীবনধারণের পদ্ধতির সমস্ত প্রশ্নই বিশেষভাবে অর্থনৈতিক।

‘গ্রাম ও শহরের গল্প’-তে সোমেন ৬০ টাকার বেতনের কাজ করতে প্রকাশের কাছে এসেছে। বেকারত্বের প্রতিকূল সময় তাই তার কাছে এমন—

‘একটা চুরুটের দরকার, টাকা, ফ্ল্যাট, মেয়েমানুষ সবকিছুর থেকে এই জিনিসের অভাব মাঝে মাঝে কাবু করে দেয়।’

চুরুট কিনতে বেশি অর্থ দরকার পড়ে না। অথচ, অর্থনৈতিক সংকট বোঝাতে জীবনানন্দ একেই বেছে নিলেন। অবনীশ, অমলা চরিত্রগুলি এ সংকটে পতিত।

‘কথা শুধু—কথা, কথা, কথা, কথা, কথা’- দীর্ঘ নামের কথকতার ভঙ্গির এই গল্প জীবনানন্দ প্রথম লেখেন। কথার ভঙ্গি হল অনেক কথা। অর্থনৈতিকতা এতে সবচেয়ে বড়। মূলত ‘কী হবে ভবশঙ্করের এত টাকা দিয়ে?’ এই হল প্রশ্ন। পূর্বে সে ছিল অবস্থাসম্পন্ন এখনও মোটামুটি কিন্তু বাঙালি লাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান হলেও সেক্রেটারির প্যাঁদানি খায়। রেজিগনেশন দিতে চাইলেও ঐ চেয়ারের লোভ থেকেই যায়। আসলে টাকাই তার নেশা। সে বলশেভিক মতবাদী হলে সবাই তাকে পছন্দ করে। মানুষের শ্রদ্ধা বা বাহক কিছুই তাকে তৃপ্ত করে না। করতে পারে না। টাকা জমানো তার কাছে বড়।

‘অদ্ভুত আঁধার এক’—কবিতার মত পুঁজিবাদী ধনতান্ত্রিক সমাজ একদিকে বড় হচ্ছে আর একশ্রেণী নিচে বা তলানিতেই পড়ে থাকছে। অর্থনৈতিক সংকট তাই জীবনানন্দের গল্পে মনুষ্যত্বেরই চরম সংকট। লাবণ্য দাশ’র সঙ্গে তার দাম্পত্য জীবনের চিত্র তাই দেখায়।

কার্ল মার্কস তার ‘Economic and Philosophic Manuscripts of 1844’-এ দেখান, ‘অর্থ’ হল সেই পণ্য যার বিনিময়যোগ্যতা সবচেয়ে বেশি। রাখাল, ভবশঙ্কর, হেমেন’র মত চরিত্র যখন জীবনানন্দ আনেন তাতে তাদের ব্যঙ্গ করেন কৌশলে। তীব্র হাইপার-রিয়ালিটির মাধ্যমে অর্থবান এই পুরুষদের অবয়ব ও প্রসঙ্গ ধরা পড়ে।

মতাদর্শের কাছে তাই জীবনানন্দের নায়ক কখনো ব্যর্থ সংগ্রামী, প্রতিবাদী, জীবন ব্যবচ্ছেদকারী, মানসিক পরিচলনে সিদ্ধ। জটিল-গরল আকারে ইঙ্গিতে জীবনানন্দ নিজে তার বাস্তবতা এবং গল্পের নিয়মপ্রধান চির অন্ধকার থেকে মুক্তিও চান। বিশ শতকের ফরাসী আধুনিক কবি বোদলেয়ার নিঃসঙ্গতা নিয়ে কবিতা লিখলেও তার কবিতায় আশাবাদী মনোভাবও দেখা যায়। বিশ শতকের বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ দাশও আশাবাদী একজন কবি ছিলেন।

     ‘তিমির হননে তবু অগ্রসর হয়ে

     আমরা কি তিমির বিলাসী?

     আমরা তো তিমির বিনাশী

     হতে চাই

     আমরা তো তিমির বিনাশী’  

(তিমির হননের গল্প/ সাতটি তারার তিমির)

তার সেই আশাবাদিতা গল্পের মধ্যেও প্রবাহিত হয়েছে। জীবনানন্দ দাশের গল্প আশাবাদী, আলোময় সেই জীবনের কথা বলে যেখানে জমাটবাধা জীবনের সব অন্ধকারগুলোকে তার গল্পের চরিত্ররা বিনাশ করতে চায়। অবশ্যই তা মানসিকভাবে। কারণ, মানসিকতার পরিবর্তন ও সমাজসংস্কার সবচেয়ে আগে জরুরী। জীবনানন্দ সেই মতাদর্শেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!