X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

চেনা সুরের রাগ-রঙ

বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়
২৪ অক্টোবর ২০১৮, ০৬:০০আপডেট : ২৪ অক্টোবর ২০১৮, ০৬:০০

চেনা সুরের রাগ-রঙ (পর্ব-১৬)

বর্তমানে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে প্রচলিত সমস্ত রাগগুলির একটা খতিয়ান নিলে দেখা যাবে সমস্ত ঠাটের মধ্যে কাফী ঠাটের অন্তর্গত রাগের সংখ্যা সবচাইতে বেশি; যদিও কেন যে বেশি, সেটা বলতে পারব না। সম্ভবত কেউই পারবেন না। অথচ রাগ গঠনের নিয়মানুসারে প্রতিটি ঠাটেই রাগের সংখ্যা সমান হওয়ারই কথা; কিন্তু তা যে হয়নি, তা দেখাই যাচ্ছে এবং তার থেকে মনে হয় মানুষের সৌন্দর্য চেতনা শুধুমাত্র যুক্তির দ্বারা বা অঙ্ক কষে নির্ধারণ করা যায় না। তা যদি সম্ভব হতো, তবে নানাজনের রুচি নানারকম হতো না!

কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, সৌন্দর্যের নিরূপণ যদি যুক্তির দ্বারা না হয়, তবে, কোনো রাগ জনপ্রিয় হয় আবার কোনো রাগ অবলুপ্ত হয়ে যায় কেন? মনে হয়, সেটা শুধুমাত্র যুক্তির বিষয় না হলেও মানুষের মনস্তত্ত্বের সঙ্গে তার একটা সুগভীর যোগ আছে যার, সন্ধান আমরা আজও পাইনি।

তবু আরো একটা সম্ভাবনাও থেকে যায়, আর তা হলো, কোনো রাগের সংগঠক যে স্বরসমষ্টি, তাদের অন্তর্নিহিত গাণিতিক শৃঙ্খলা বা সারল্য যা তাদের মধ্যে ঝংকার বা অনুরণন সৃষ্টি করে আমাদের চেতনাকে পরিতৃপ্ত করে...

এরকম অসংখ্য সম্ভাবনার কথাই বলা যায়, যার কোনোটিই এখনো পরীক্ষিত নয়, অতএব নিশ্চিতভাবে সত্য, এ কথাও বলা যায় না।

কারণ যাই হোক, প্রচলিত/অপ্রচলিত প্রায় দু’শটি রাগের একটি তালিকা উপস্থাপন করে সঙ্গীতিজ্ঞ অপূর্ব সুন্দর মৈত্র তাদের শ্রেণী বিভাজন করে দেখাচ্ছেন (সঙ্গীত কথা। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যপুস্তক পর্ষদ, কলকাতা) যে, তার মধ্যে কল্যাণ ঠাটের রাগের সংখ্যা ২২, বিলাবল ঠাটে ৩৫, খাম্বাজ ঠাটে ২৩, ভৈরব ঠাটে ২১, পূরবী ঠাটে ১৬, মারোয়া ঠাটে ১৫, কাফী ঠাটে ৪২, আশাবরী ঠাটে ১৬, ভৈরবী ঠাটে ৬ এবং চৌড়ি ঠাটে ৪টি।

অতএব কাফী ঠাটের অন্তর্গত রাগের সংখ্যাই সবচাইতে বেশি এবং তাদের মধ্যে মল্লার শ্রেণীভুক্ত অধিকাংশ রাগ, সারং শ্রেণীভুক্ত অধিকাংশ রাগ, কানাড়া শ্রেণীভুক্ত বেশ কিছু রাগ ইত্যাদি রয়েছে। বিকেলের রাগগুলির মধ্যে পটদীপ, ভীমপলশ্রী, রাত্রির রাগগুলির মধ্যে বাগেশ্রী, আভোগী, মালগুঞ্জ, বাহার প্রভৃতি। এর মধ্যে মল্লার এবং বাহার রাগ দুটি ঋতুরাগ। বাহার বসন্ত ঋতুর এবং মল্লার বর্ষার। আমরা এবার মল্লারে ...........

প্রথমেই বলে নিই, ‘মল্লার’ রাগটি অতি প্রাচীন এবং এককালে বহুল প্রচলিত ছিল বলে শোনা যায়; কিন্তু বর্তমানে ‘মল্লার’ নামে কোনো রাগ আর প্রচলিত নেই। মল্লার বলতে এখন একটি স্বর সমন্বয়কেই বোঝায় এবং সে স্বরসমন্বয়টি হলো ‘রেমারেপা’ যা নানা প্রকার মল্লারের প্রত্যেকটিরই আবশ্যিক অঙ্গ হিসাবেই স্বীকৃত। সেই কারণে মল্লারকে এখন একটি ‘অঙ্গ’ বা ‘অঙ্গ্’ বলা হয়, যা পৃথক কোনো রাগ নয়। তবে সমস্ত রকমের মল্লারের মধ্যে সবচাইতে জনপ্রিয় এবং প্রচলিত যেটি, অনেক সময় চলতি কথায় সেই মিঞা মল্লারকে শুধুমাত্র মল্লার বলেও উল্লেখ করা হয়।

‘মিঞা’ শব্দটি দ্ব্যর্থহীনভাবেই যার নামকে চিহ্নিত করে, আগেই বলেছি, তিনি মিঞা তানসেন। বলা হয়, মিঞা মল্লার রাগটির স্রষ্টা তিনিই। এ নিয়ে কিছু কিছু মতান্তরও আছে, কিন্তু এটাই প্রচলিত মত।

স্রষ্টা যিনিই হউন, সমস্ত মল্লারের মধ্যে গভীরতা এবং সৌন্দর্যের বিচারে মিঞা মল্লারই যে শ্রেষ্ঠ, তা নিয়ে খুব একটা দ্বিমত হবে বলে মনে হয় না।

যারা ভাবছেন, এই রাগটি তারা চেনেন না, তারা যদি বাঙালি হন, তবে বলব, তারা খুব সম্ভবত ভুলই ভাবছেন, কারণ, ‘স্নিগ্ধ শ্যাম বেণীবর্ণা’—গানটি তারা শোনেন নি এমন সম্ভাবনা কম। ফিরোজা বেগমের গাওয়া গানটির রেকর্ড তো নিশ্চয়ই শুনেছেন? সুরটা মনে করার চেষ্টা করুন। হ্যাঁ, ওটাই হলো মিঞা মল্লার! গানটির বাণী লক্ষ্য করুন—

‘স্নিগ্ধ-শ্যা-বেণী-বর্ণা এস মালবিকা!

অর্জুন-মঞ্জুরী-কর্ণে-গলে নীপ-মালিকা,/মালবিকা /

ক্ষীণা তন্বী জল-ভার-নমিতা

শ্যাম জম্বু-বনে এস অমিতা।

আনো কুন্দ মালতী যূঁই ভরি খালিকা/মালবিকা / ...’

মালবিকা, মহাকবি কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যের বিরহিনী নায়িকা। এমনি এক মেঘমেদুর বর্ষায় সেও প্রতীক্ষায় ছিল রেবা নদীর তীরে... গানের বাণীতে তারও উল্লেখ আছে। ...‘এস অঞ্জনা রেবা নদীর তীরে’।

এই অনুষঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আরেকটি গানও মনে পড়ছে, কিন্তু সেটি মিঞা মল্লারে নয়, কেদারা রাগাশ্রিত। সে গানটি হলো—

‘বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ় এল আমার মনে

কোন্ সে কবির ছন্দবাজে ঝরো ঝরো বরিসনে/...

গানটির অন্তরায় পাই,

সে দিন এমনি মেঘের ঘটা রেবা নদীর তীরে

এমনি বারি ঝরেছিল শ্যামল শৈলশিরে।

মালবিকা অনিমিষে চেয়েছিল পথের দিকে...’

অর্থাৎ পটভূমিকায় সেই মালবিকা, সেই রেবা নদীর তীর, সেই উদগ্রীব প্রতীক্ষা আর দিগন্তবিস্তৃত মেঘ সমারোহ ঝরো ঝরো বরিষণে যে কবির ছন্দ—তিনি যে কালিদাস, তাতে আর সন্দেহ থাকে না। সেই একই মেঘদূত—ফিরে আসছে কখনো মিঞা মল্লারে কখনো বা কেদারায়। মেঘদূতের সেই শ্লোকটি মনে করুন—

‘তন্বীশ্যামা শিখরীছশনা পক্ববিম্বাধরোষ্ঠী

মধ্যেক্ষামা চকিতাহরিণীপ্রেক্ষণা নিম্ননাভিঃ’।

স্নিগ্ধ-শ্যাম-বেণী-বর্ণা, ক্ষীণা-তন্বী—নজরুলের মালবিকাও ইনিই।

আসলে আমাদের চেতনায় বর্ষার যে ছবি, তার সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে আছেন মহাকবি কালিদাস এবং মিঞা তানসেন।

মিঞাকি মল্লারের প্রকৃত রূপ আমি প্রথম দর্শন করি বীরভূম জেলার দিগন্তবিস্তৃত একটি মাঠের মাঝখান থেকে। মাঠের নাম তারামায়ের ডাঙা। গ্রাম লাভপুর। কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রাম। হ্যাঁ, সেই সঙ্গে আমারও। ওই তারামায়ের ডাঙা আর তারাশঙ্কর—দুটি নামেরই উৎস যে ‘তারা মা’, তার একটি বহুপ্রাচীন মন্দির আছে ওই মাঠের মাঝখানে। তারই ভাঙা ভগ্ন চাতালে বসে আমি যখন প্রথম মিঞা মল্লার দর্শন করি, তখন আমার বয়স কতই বা! দশ...বারো! রাগের রূপ দেখলাম, কিন্তু নাম জেনেছি আরো পরে—এবং সেটা ঘটেছিল একটি সারেঙ্গীর রেকর্ড শুনে। শিল্পী ওস্তাদ বুন্দু খাঁ, রাগ-মিঞা মল্লার। অমন আর শুনলাম না, দেখলামও না আর।

তারামায়ের ডাঙার সেই অবাধ বিস্তৃতি তো কবেই হারিয়ে গেছে আর সেই সারেঙ্গীও আর নেই। প্রায় অবলুপ্তির পথেই বলা যায়। আকাশবাণীতে কর্মসূত্রে যখন যুক্ত ছিলাম, তখনই জেনেছিলাম, বিজ্ঞাপন দিয়েও এখন আর সারেঙ্গীবাদক পাওয়া যায় না! যারা সারেঙ্গীবাদক, ওস্তাদ যারা, তারা তাদের ছেলেদের আর সারেঙ্গী শেখান না। শিখতেও চায় না কেউ। কারণ, অর্থ, সম্মান—কোনোটাই নেই।

শোনা কথা। হয়তো এর অনেকটাই সত্য, কিন্তু সবটা নয়। ওস্তাদ মহম্মদ সাগিরুদ্দীন খাঁ, ওস্তাদ সুলতান খাঁ, পণ্ডিত রামনারায়ণ যে শ্রদ্ধা এবং সম্মান পেয়েছেন, তা তো এই সাম্প্রতিক কালের ঘটনা। সে তো আমরা নিজের চোখেই দেখেছি! তবু যে ক্রমবর্ধমান অনাগ্রহ এর একটা কারণ নিশ্চয়ই এই যে, সারেঙ্গীতে সিদ্ধিলাভ সহজ নয় বরং, অতীব দুরূহ। আধুনিক জীবনে এত সাধনার সময় কোথায়, ধৈর্যই বা কই?

ফলে সেই দিগন্তবিস্তৃত বর্ষার রূপও নেই, ওস্তাদ বুন্দু খাঁও আর নেই। কিন্তু তবু সে রূপ আজও ভুলিনি।

মিঞা মল্লার রাগটি বলা হয়, পূর্বাঙ্গ প্রধান রাগ। অর্থাৎ খাদ্দের সুরের দিকেই এর বিচরণের প্রবণতা বেশি। কিন্তু, মনে হয়, এক কথায় সবটা বলা হয় না। মনে হয়, উত্তরাঙ্গে দুটি নিখাদের লুকোচুরি খেলার মধ্যে এই রাগের যে সৌন্দর্য, তা নজর এড়িয়ে গেল। পূর্বাঙ্গের মন্ত্র সপ্তকেও এ খেলা আছে। তখন দিগন্তবিস্তৃত মেঘ পূর্বাকাশ আচ্ছন্ন করে মধ্যসপ্তকের গান্ধারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তারপর আন্দোলিত গান্ধার থেকে মধ্যাকাশ অতিক্রম করে যখন দূর থেকে পশ্চিমাকাশের দূরান্তের দিকে ধাবমান তখন দিকচক্রবালের কাছে সরু, আবছা ধূসরাঙ নীল পাড়ের মতো আকাশের দীর্ঘ নদীটি ফুটে ওঠে চড়ার দুটি নিখাদ আর ধৈবতের চকিত উদ্ভাসে। সেই স্বরগুচ্ছ হলো, ‘ণি ধা নি র্সা’—যা মিঞা মল্লারের সৌন্দর্যকে অনন্তে পৌঁছে দেয়। কিন্তু আন্দোলিত কোমল গান্ধারেই মেঘের কেন্দ্রবিন্দু এবং সেখান থেকেই সে বিস্তৃত হয় দিকচক্রবালের অভিমুখে।

এ বর্ণনা কিন্তু বহিরাকাশের বর্ণনা নয়। এ আকাশ আমাদের হৃদয়ের গভীরে, যাকে চিদাকাশ বলি। এই সমগ্র বিশ্ব তো সেই অন্তহীন চিদাকাশেই ভাসমান। মিঞা মল্লারে তারই বিরহের ছবি।

বুন্দু খাঁর সারেঙ্গীতে তাকেই প্রত্যক্ষ করুন।

এই রাগে অসাধারণ বহু রেকর্ডের মধ্যে এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, পণ্ডিত ডি. ভি. পালুস্করের কণ্ঠে একতালে নিবদ্ধ (১২ মাত্রার তাল) দ্রুত খেয়ালটি, যার বাণী হলো, ‘আয়ি সমদন মোরা...’। ‘সমদন’ শব্দটির অর্থ হলো উপহার এবং এটি স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ। এখন অনুমান করুন, উপহার কি হতে পারে। প্রায় একই আঙ্গিকের আরেকটি খেয়ালও অনবদ্য; এটিও এক তালে নিবদ্ধ। শিল্পী পণ্ডিত ভীমসেন যোশী।...

এসব গান শুনলে, যেন বৃষ্টির স্নিগ্ধ স্পর্শ শরীরে অনুভব করা যায়! (চলবে)

আরও পড়তে ক্লিক করুন : চেনা সুরের রাগ-রঙ ।। পর্ব ১৫

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
হাসপাতালের বদলে শিশুরা ঘুমাচ্ছে স্বজনের কোলে
হাসপাতালের বদলে শিশুরা ঘুমাচ্ছে স্বজনের কোলে
পারটেক্সের বিপক্ষে হেরে রূপগঞ্জ টাইগার্সের অবনমন
পারটেক্সের বিপক্ষে হেরে রূপগঞ্জ টাইগার্সের অবনমন
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
বিএনপির বিরুদ্ধে কোনও রাজনৈতিক মামলা নেই: প্রধানমন্ত্রী
বিএনপির বিরুদ্ধে কোনও রাজনৈতিক মামলা নেই: প্রধানমন্ত্রী
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!