X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কবি আল আজাদের প্রস্থান

সরোজ মোস্তফা
১৪ নভেম্বর ২০১৮, ১৪:০৬আপডেট : ১৪ নভেম্বর ২০১৮, ১৪:০৯

কবি আল আজাদের প্রস্থান ‘ষাট দশকের শুরুতে নেত্রকোণা থেকে মরহুম খালেকদাদ চৌধুরীর সম্পাদনায় একটি পাক্ষিক পত্রিকা বের হয়। নাম ‘উত্তর আকাশ’।পত্রিকাটি ছিলো আইয়ুব-সরকারের প্রচারপত্র। কিন্তু সুসাহিত্যিক খালেকদাদা চৌধুরী অত্যন্ত সুকৌশলে ঐ পত্রিকাটিকে একটি সাহিত্য পত্রিকায় পরিণত করেন। ...... ঐ পত্রিকায় কবিতার জন্য নির্ধারিত স্থানটুকু দখল করেছিলেন দু’জন— কবি আল আজাদ ও কবি রফিক আজাদ। সাংবাদিক এবং একজন দক্ষ প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠক হিসেবে তিনি নেত্রকোণায় জনপ্রিয়তা লাভ করেন। কবি আল আজাদের ছত্রছায়ায় তখন নেত্রকোণায় একঝাঁক তরুণ কবির উত্থান ঘটে। তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। কবি আল আজাদই আমাদের আদিকবি। কিন্তু বিস্ময়কর ঘটনা হলো, আজও আমার এই অগ্রজের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি, যদিও নেত্রকোণার ‘উত্তরা আকাশ’, ‘সৃজনী’ ও ঢাকার সমকালসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার অসংখ্য কবিতা মুদ্রিত হয়েছে।’ -কবি নির্মলেন্দু গুণ

খুব নির্জনে বারহাট্টা রোডের বাড়িটা রেখে চলে গেলেন নেত্রকোণার আদিকবি আল আজাদ। যাবার আগে কবির শবগাড়ি প্রেসক্লাস হয়ে,  ছোট্ট শহরটা ঘুরে মানুষের ভালোবাসা নিয়ে গেল। হায়! ফুলেল আদরে মানুষ কেন শব গাড়িতে শায়িত কবিকে সম্মান জানায়। কে জবাব দেবে, জীবিত কবি কেন পায়না সমাজের কুর্নিশ ও আদর! তো, চলে যাওয়ার দিন সমাজ, শহর আদিকবিকে ফুলের তোড়ায় শ্রদ্ধা জানালো। ফুলের মালায় স্নাত হয়ে কবির খাটিয়া গোরস্তানে গেল। সামাজিক আচার সেরে কবির দেহকে গোরস্তানে রাখা যায়। কিন্তু কবির কবিতাকে রাখা যায় না। রক্ত জবার মতো হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ায় কবির কবিতা। সে কবিতার রঙ, ভাষা ও কল্পনাকে কোন এক নতুন কবি গ্রহণ ও বহন করেন। প্রকৃত অর্থে কোন কবিতাই হারিয়ে-ফুরিয়ে যায় না। সময়ের মরুঝড় অনেক পুরাতন ভাষাকেও অতল থেকে সচলে আনে। ভাষা ও জনসমাজের প্রত্ন-প্রবাহে কবিতার রূপান্তর চলতেই থাকে। নতুন কবির চোখে বেঁচে থাকে পুরাতন কবির চোখ, ভাষা, কল্পনা ও অমোচনীয় ঐতিহ্য। মূলত কবিই বহন করেন কবিদের লাশ।

কামিনি ফুলের উচ্ছ্বাস মাখতে মাখতে এই শহরে একজনকেই কবি হিসেবে চিনতাম। কদম ফুলের মতো গোল একটা মুখ। শান্ত ও অনন্য। আবৃত্তি, প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার বিচারক তিনি। দূর থেকে হাসি নিয়ে ডাকেন। সামনে এসে মাথার চুল এলোমেলো দেন। নিচু স্বরে কথা বলেন। খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলেন না। কিন্তু কথাগুলো শুনতে ভালো লাগে। আমরা জানতাম ক্রিকেটার আমিনুল ইসলাম বুলবুলের দুলাভাই তিনি। তিনি কবি। তিনি সাংবাদিক। আমরা মানে, শহরের কদম কিংবা কৃষ্ণচূড়া’র ছায়ায় বেড়ে উঠা কয়েকজন অকৃত্তিম বাউন্ডেলে। আমরা জানতাম উঁনি কখনো ধমক দেবেন না। উঁনার চোখে আদর। উঁনার ঝোলায় কবিতা। আমরা মানতাম, আজাদ কাক্কুর মতো না হলে কবিতা লেখা যাবে না।

একটা ঝোলা কাঁধে পুরো শহরে হাঁটতেন তিনি। সে হাঁটায় মন খারাপ নেই। আশ্চর্য সুন্দর সে হাঁটা। কোন তাড়াহুড়ো নেই। শুধু কবিতা লেখার আনন্দিত মুখে তিনি হাঁটছেন। শহরের কোন তরুণকে কবিতা শোনাচ্ছেন। প্রবীণ যতীন সরকারকে কবিতা শোনাচ্ছেন। কিন্তু পত্রিকায় কবিতা পাঠাবেন না। পত্রিকার সম্পাদক উনার নাম জানেন না। উনার নাম জানতেন কবি রফিক আজাদ। দুজনেই ষাটের কবি। কবি রফিক আজাদ যখন নেত্রকোণা কলেজে পড়তেন, তখন কবিতা শোনাতে শোনাতে দুই বন্ধু ইট-সুরকি্র লালপথে হাঁটতেন। কবি রফিক আজাদের নাম তখন রফিকুল ইসলাম। কিন্তু মগরার তীরে দাঁড়িয়ে আল আজাদের নামের সাথে মিলিয়ে টাঙ্গালের কবি তার নাম পরিবর্তন করে হয়ে যান রফিক আজাদ। বাংলা কবিতায় দুই আজাদ হয়ে দু’জনেই আজ চলে গেছেন। পৃথিবী বহন করছে দুই আজাদের কবর।

লেখা ছাপার ব্যাপারে উনার তেমন আগ্রহ দেখিনি। এখনকার সম্পাদকেরা উনার লেখা ছাপেন না বলে আক্ষেপ করতেও দেখিনি। একটার পর একটা কবিতা লিখে গেছেন। একটা কবিতাকে বারবার কেটেছেন। কোন শব্দ পছন্দ না হলে নতুন শব্দের খোঁজে হাঁটছেন। খুব সাধারণ এই হাঁটা। আক্ষেপহীন সহজ জীবনের সরল একটা হাঁটা। মোহহীন এই হাঁটার ভেতরে আমরা দেখেছি কবির জীবন।

পাদ্মা বিধৌত মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার পাটুলী গ্রামে কবির জন্ম ও স্বপ্নময় শৈশব। তারপর পিতার হাতধরে ভাগ্যান্বেষণে চলে আসেন মগরার তীরে। নদী ও প্রকৃতি নির্ভর জীবন থেকেই উঠে এসেছে কবির ভাষা ও কল্পনা। সাংবাদিকতা তার পেশা। কিন্তু রক্তের ভেতরে ছিলো কবিতা। ক্রমাগত লিখে গেছেন। একটা বই করার খুব আগ্রহ ছিলো। কিন্তু বই করতে টাকা লাগে। সেই ভয়ে হয়তো উদ্যোগ নেন নি। কবি নির্মলেন্দু গুণ-ই কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অনন্যা অনিন্দিতা’ বের করে দিয়েছিলেন। কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় গুণ লিখেছেন, ‘আসুন আমরা আমাদের ষাটদশকের কবিকূলগুরু আল আজাদ বন্দনায় মুখরিত হই। তাকে স্বাগত জানাই’। কিন্তু আল আজাদ অগোচরেই থেকে গেলেন। সম্ভবত ২০১৭ সালে নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক ড. মুশফিকুর রহমান প্রেস ক্লাবের অনুরোধে কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘আহত চিতা’ প্রকাশ করেন। বাংলা কবিতায় তিনি ‘আহত চিতা’ হয়েই থাকলেন। কী পরিমান কবিতা লিখেছেন—এই খবর বের করা খুব কষ্ট হবে নিশ্চয়।

কবিতায় নিবেদিত সহজ এই মানুষটা চলেই গেলেন। একটা স্বচ্ছ দৃষ্টিতে তিনি ফিচার লিখেছেন। প্রবন্ধ লিখেছেন। মফস্বলে সংবাদ সংগ্রহ করেছেন। সাংবাদিকতা করেছেন। টাকা নিয়ে সংবাদ ছাপেন নি। সততার একটা নির্মোহ দৃষ্টিতে তিনি হেঁটেছেন। তার ঝোলায় কলম, কবিতা, সততা। স্পষ্টত অভাব ছিলো। কিন্তু হাসিতে লুকানো ছিলো সে অভাব। তিনি জানতেন হাসিতে শক্তি।

কুয়াশার ঘ্রাণে মগরার তীরে ছড়িয়ে পড়ছে শীত। এই শীতে কমলালেবুর ঘ্রাণ না নিয়েই চলে গেলেন কবি আল আজাদ। পৃথিবীতে দেখা যাচ্ছে আরেকটা নতুন কবর। কবির কবর। বাংলা কবিতাকে তিনি কী দিতে পেরেছেন-এই প্রশ্নের চেয়ে জরুরী বিষয় হচ্ছে ছোট-বড় কবরের ভিড়ে এটা কবির কবর। এই কবরে অনেক দোলনচাঁপা। এই দোলনচাঁপা প্রশস্থ ও উজ্জ্বল। এই দোলনচাঁপা ভাষার প্রতিনিধি। এই দোলনচাঁপায় প্রজন্মের হাসি।

আমরা তার কাছে সরলতা ও সততা শিখেছি। কবিত্বের শক্তি ও কলমযাপন শিখেছি। তেরি বাজারের মোড়ে, সিটি আর্ট প্রেসে, পুঁথিঘরের আড্ডায়, প্রেস ক্লাবে, কুন্তল দা’র বাসায়, রবীন্দ্র চর্চা কেন্দ্রের অনুষ্ঠানে, আমরা তার কাছে শিখেছি কবির জীবন। গত ১১ নভেম্বর ২০১৮ রাত ১২টায় কবি পৃথিবীর একটা কবরে ঢুকে গেছেন। আমরাও কবরে ঢুকবো। কবরে দেহ রাখার আগে আমরাই বহন করবো কবি আল আজাদের কবর।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মেলা থেকে অস্ত্রের মুখে দুই নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ
মেলা থেকে অস্ত্রের মুখে দুই নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ
তীব্র গরমে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুন
তীব্র গরমে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুন
দ্বিতীয় বিয়ে করায় স্বামীর অঙ্গহানি করলেন স্ত্রী
দ্বিতীয় বিয়ে করায় স্বামীর অঙ্গহানি করলেন স্ত্রী
প্রচণ্ড গরমেও ভোটকেন্দ্রে ভোটার, ভোটদানের হার ৬১ শতাংশ
ভারতে দ্বিতীয় দফায় ভোটপ্রচণ্ড গরমেও ভোটকেন্দ্রে ভোটার, ভোটদানের হার ৬১ শতাংশ
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি