X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০
চার পর্বে

বাংলা চলচ্চিত্রের সুবর্ণ সময়

রহমান মতি
২২ নভেম্বর ২০১৮, ১০:০০আপডেট : ২২ নভেম্বর ২০১৮, ১০:০০

বাংলা চলচ্চিত্রের সুবর্ণ সময় আশির দশক

সত্তর দশকের সুন্দর নামের ছবি নির্মাণের ধারাবাহিকতা আশির দশকেও ছিল। পাশাপাশি মিশ্র ক্যাটাগরির বেশকিছু ছবি নির্মিত হয়েছিল। এ দশকের বিশেষত্ব ছিল বাণিজ্যিক ছবির বাজার প্রতিষ্ঠিত করা। যার বদৌলতে পরবর্তী নব্বই দশকে বাণিজ্যিক ছবির আরো বেশি প্রসার ঘটে।

বাস্তব ঘটনা থেকে নির্মিত 'ছুটির ঘণ্টা' ছবি দিয়ে পরিচালক আজিজুর রহমান প্রথমেই ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। দর্শক সিনেমাহলের ভেতর থেকে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়েছে। ছবিটিতে রাজ্জাক দফতরি চরিত্রে এবং শাবানা মেথরানীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ছাত্রের ভূমিকায় মাস্টার সুমন তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। 'আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী, একদিন ছুটি হবে' গান দুটিতে তার অভিনয় অসাধারণ। শাবানার রাজত্বের সময়ে নতুন সূচনা হয় আশির দশকে। 'সখি তুমি কার' ছবিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৮০ সালে; বছরের দ্বিতীয় ছবি হিসাবে। রোমান্টিক ও রোমান্টিক ড্রামা ছবির মধ্যে 'মেঘ বিজলি বাদল’, ‘আনারকলি’, ‘জীবননৌকা’, ‘আশার আলো’, ‘কালো গোলাপ’, ‘উজান ভাটি’, ‘লাইলী মজনু’, ‘ঝুমুর, আঁখি মিলন’, ‘নাজমা’, ‘পুনর্মিলন’, ‘নয়নের আলো’, ‘নরম গরম’, ‘নেপালী মেয়ে’, ‘অসাধারণ’, ‘সোনালি আকাশ’, ‘ওগো বিদেশিনী’, ‘নিষ্পাপ’, ‘সহযাত্রী’, ‘ভেজা চোখ’, ‘হীরামতি’, ‘ছলনা’, ‘অবুঝ হৃদয়’, ‘সারেন্ডার’, ‘পাহাড়ি ফুল' ইত্যাদি আছে। এগুলো গানের দিক থেকেও সমৃদ্ধ ছবি ছিল, তাই মিউজিক্যাল সিনেমার গুণ আছে কিছু ছবিতে। যেমন : নয়নের আলো সিনেমার ‘আমার বুকের মধ্যেখানে’, ‘আমার বাবার মুখে’, ‘আমার সারাদেহ খেওগো মাটি’ সহ সে দশকের অন্য বিভিন্ন গান যেমন ‘ও বন্ধুরে প্রাণবন্ধুরে’ ‘আমার মন বলে তুমি আসবে’ ‘লাইলী তোমার এসেছে ফিরিয়া’ ‘প্রেমেরও ছোট্ট একটি ঘর’ ‘আমার গরুরগাড়িতে বৌ সাজিয়ে’ ‘চন্দনা গো রাগ কোরো না’ ‘ওগো বিদেশিনী তোমার চেরি ফুল দাও’ পৃথিবীর যত সুখ’ ‘এই বৃষ্টি ভেজা রাতে’ ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’ ‘আশায় আশায় দিন কেটে যায়’ গানগুলো নিঃসন্দেহে কালজয়ী। মিউজিক্যাল ছবি ছিল 'নয়নের আলো, দুই জীবন, ভাইবন্ধু, বাল্যশিক্ষা, ঝিনুক মালা, সওদাগর, বেদের মেয়ে জোসনা'। এগুলোর সবগুলো গান জনপ্রিয় এবং ক্লাসিক।

সাহিত্যভিত্তিক ছবির সুনির্মিত সময় গিয়েছে আশির দশকে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস 'দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শ্রীকান্ত' থেকে ছবি নির্মিত হয়েছিল। প্রথম দুটি চাষী নজরুল ইসলামের পরিচালনায়। পরেরটি বুলবুল আহমেদের পরিচালনায় 'রাজলক্ষী শ্রীকান্ত' নামে। এছাড়া মহিউদ্দিন ফারুক পরিচালিত 'বিরাজ বৌ' এবং চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিতত 'শুভ দা, রামের সুমতি' ছবি দুটিও শরৎচন্দ্রের সাহিত্য থেকে নির্মিত। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প থেকে রাজ্জাক নির্মিত 'চাঁপা ডাঙ্গার বৌ' ছবিটি আরেকটি মাইলফলক। ছবিতে 'আমার সাধ না মিটিল' গানটি আশির দশকের অনন্য সৃষ্টি।

জীবনমুখী ক্লাসিক ছবির মধ্যে এই দশকের শ্রেষ্ঠ ছবি 'ভাত দে।' শাবানার অভাবনীয় অভিনয়ে আমজাদ হোসেনের এই ছবিটি ক্লাসিকের মর্যাদা পেয়েছে। আমজাদ হোসেনের 'দুই পয়সার আলতা’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘সখিনার যুদ্ধ’ আরো দুটি জীবনমুখী ছবি। অন্যান্যের মধ্যে আজিজুর রহমানের 'মহানগর', মহিউদ্দিনের 'বড় ভালো লোক ছিল', শামসুদ্দিন টগরের 'গলি থেকে রাজপথ', রফিকুল বারী চৌধুরীর 'পেনশন', কাজী হায়াৎ-এর 'যন্ত্রণা, পাগলী', শেখ নিয়ামত আলীর 'দহন', দেলোয়ার জাহান ঝণ্টুর 'মাটির কোলে', আফতাব খান টুলুর 'দায়ী কে?', শফিকুর রহমানের 'ঢাকা-৮৬', রায়হান মুজিবের 'ভাইজান', মতিন রহমানের 'রাঙ্গা ভাবী' উল্লেখযোগ্য।

ফোক-ফ্যান্টাসি ছবির মধ্যে আকবর কবির পিন্টু-র 'গাঁয়ের ছেলে', মাসুদ পারভেজের 'যাদুনগর', এফ কবির চৌধুরীর 'সওদাগর', শামসুদ্দিন টগরের 'বানজারান', আব্দুস সামাদ খোকনের 'ঝিনুক মালা' উল্লেখযোগ্য।

ব্যতিক্রমী বাণিজ্যিক নিরীক্ষামূলক ছবি ছিল আলমগীর কবিরের 'মহানায়ক', সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকীর 'ঘুড্ডি'। 'মহানায়ক' ছিল প্লেবয় অ্যাডভেঞ্চার। বুলবুল আহমেদের অনবদ্য অভিনয়ের ছবি। অপরাধ ও বিবেককে কাজে লাগানোর দক্ষতা দেখিয়েছেন পরিচালক। বিভিন্ন দেশ ঘুরে মেয়েদের ধোঁকা দিয়ে টাকা কামানোই থাকে লক্ষ্য। ছবিতে ব্যবহৃত 'আমার এ তুটি চোখ পাথর তো নয়’, ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে' গান দুটি ক্লাসিকের মর্যাদা পেয়েছে। 'ঘুড্ডি' ছিল আধুনিকতাকে চপেটাঘাত করা অন্যতম প্রধান ছবি। আসাদ-সুবর্ণার অসাধারণ পারফরম্যান্সের এই ছবিটি বেশ আলোচিত হয়েছিল। 'চলো না ঘুরে আসি অজানাতে' হ্যাপী আখন্দের জনপ্রিয় এ গানটি ব্যবহৃত হয়েছিল ছবিটিতে, শিল্পী নিজেও অভিনয় করেছিলেন।

কিশোর অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে নির্মিত বাদল রহমানের 'এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী' ছিল খুবই নামকরা ছবি। নব্বই দশকের 'দীপু নাম্বার টু' ছবিটি এই অ্যাডভেঞ্চারের পরবর্তীকালের অনুপ্রেরণা বলা যায়। সি বি জামানের 'পুরস্কার' ছবিটিও কিশোর সাইকোলজি নিয়ে নির্মিত। 'রাম রহিম জন' ছিল ব্যতিক্রমী ছবি। মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান তিন ধরনের মানুষের উপস্থাপনায় মানবিকতাকে তুলে থরা হয়। 'অভিযান' নামে আরেকটি ব্যতিক্রমী ছবি ছিল। ছবিতে রাজ্জাক, জসিম, ইলিয়াস কাঞ্চন তিনজন মিলে নদীপথে জাহাজ নিয়ে যায় ব্যবসার কাজে। ছবিটি বেশ উপভোগ্য। ইতিহাসের প্রেক্ষিতে 'রঙিন নবাব সিরাজউদ্দৌলা' ছিল আগের সাদাকালোর পরে আরেকটি মাইলফলক। পরিচালনা করেন প্রদীপ দে। প্রবীরমিত্র ছিলেন নবাবের ভূমিকায়। বিদেশি ছবির ছায়া অবলম্বনে আলোচিত ছবি ছিল মালেক আফসারীর 'ক্ষতি পূরণ।' ভৌতিক ছবি ছিল কাজী হায়াৎ-এর সোহেল রানা-অঞ্জনা অভিনীত 'রাজবাড়ি।'

বাংলা সিনেমার ফ্যামিলি ড্রামার ভিতটা ছিল এ দশকে, আর নব্বই দশকে পেয়েছিলো জোয়ার। এই ধরনের সিনেমার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো ‘সত্য মিথ্যা’, ‘যোগাযোগ’, ‘প্রতিরোধ’, ‘মাটির কোলে’, ‘পেনশন’, ‘দূরদেশ’, ‘সৎভাই’ ইত্যাদি। এ জে মিন্টুর হাত ধরে এ ধরনের ছবির জোয়ার আসে। তাকে বলা হত বাণিজ্যিক ছবির মাস্টারমেকার।

অ্যাকশন ছবির ক্ষেত্রে আশির দশকেই নাটকীয় পরিবর্তন আসে ঢালিউডে। ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলমের হাত ধরে নায়ক রুবেল আসেন মার্শাল আর্টের দুর্দান্ত ব্যবহার নিয়ে। দর্শকের পছন্দের শীর্ষে ছিল এই মার্শাল আর্টের ছবিগুলো। রুবেল অভিনীত 'লড়াকু, বজ্রমুষ্ঠি' ছবি দুটি আশির শেষের দিকের আলোচিত অ্যাকশন ছবি।

আশির দশকে ঢাকাই চলচ্চিত্রের দাপট চোখে দেখার মতো। টলিউডি ইন্ডাস্ট্রি তখন ঢালিউডেরর আদলে ছবি নির্মাণ শুরু করে। কারণ তারা তখন এঘর-ওঘর মিলিয়ে 'ছোট বৌ, বড় বৌ, আমাদের সংসার' এ ধরনের টিপিক্যাল ফ্যামিলি ড্রামায় সেকেলে সেটে ছবি নির্মাণ করত। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে তখন 'দূরদেশ'-এর মতো যৌথ প্রযোজনার ছবিও নির্মিত হয়েছিল। বাংলাদেশ-পাকিস্তান-নেপাল তিন দেশের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হয়েছিল 'ব্যবধান' ছবি।

সবচেয়ে বড় ব্যবসাসফল ছবির ইতিহাসটি আশির দশকের শেষের বছর অর্থাৎ ১৯৮৯ সালে ঘটে, তোজাম্মেল হক বকুল পরিচালিত 'বেদের মেয়ে জোসনা' ছবির মাধ্যমে। দেশীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ব্যবসাসফল ছবির রেকর্ড গড়ে ছবিটি। ইলিয়াস কাঞ্চন-অঞ্জু ঘোষ জুটির এ ছবিটি ফোকের সাথে মিউজিক্যাল বৈশিষ্ট্যও ধারণ করে। ছবির সবগুলো গানই খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। ছবির গল্পে বেদে সংস্কৃতির চিরন্তন আবেদনের সাথে রাজতন্ত্রের বাস্তব অবস্থা দেখানো হয়েছে। ছবিটি পরে টলিউডে পুনঃনির্মাণ করা হয়। ঢালিউডি বাণিজ্যিক ছবির রিমেক করে টলিউডে মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির চাকা ঘোরে এর মাধ্যমেই। যে কারণে নব্বই দশকে আমাদের বেশ অনেক ছবি তারা রিমেক করেছিল। এমনকি আমাদের নির্মাতাদের নিয়ে গিয়ে তারা ছবি নির্মাণ করেছে তাদের ইন্ডাস্ট্রির পরিবর্তনের জন্য। আমাদের রাজ্জাক, জসিম, আলমগীর, শাবানা, সুচরিতা, ববিতা, কবরী, সোহেল রানা, উজ্জ্বল, রুবেল, ইলিয়াস কাঞ্চন, জাফর ইকবাল, অঞ্জু ঘোষ, দিতি, চম্পা এবং আরো তারকারা তখন বহাল তবিয়তে কাজ করছে। তাদের ইন্ডাস্ট্রি থেকে জয়শ্রী কবির, সুনেত্রা তারা এসে ঢালিউডে পোক্ত আসন গড়েছিল। আমাদের সুবর্ণ সময়ে আশিক দশক ছিল মোক্ষম প্ল্যাটফর্ম। (চলবে)

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’