X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

গল্পের জনপদ অথবা জনপদের গল্প ।। সুবন্ত যায়েদ

.
২৫ নভেম্বর ২০১৮, ১০:০০আপডেট : ২৫ নভেম্বর ২০১৮, ১০:০০

গল্পের জনপদ অথবা জনপদের গল্প ।। সুবন্ত যায়েদ চৌকাঠ পেরোনো সকাল সূর্যের সাথে বেশ দূর এগিয়ে, তারা কখনো স্থির হয়ে নাই। এবং যৌথ প্রচেষ্টায় তারা অনবরত সময়কে এগিয়ে নেবে বলে পা বেয়ে মাথার উপরে উঠে এলো রোদ। আর মানুষের শরীরের ভেতরে সেঁধিয়ে গেলো আপন আপন ছায়া। বাতাস ছিলো প্রবল তবু মেয়েটার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে দেখে মুখোমুখি বসা যুবকটির হঠাৎ জলতেষ্টা পেলো। তারা তখন গল্প নিয়ে খেলায় মেতে ছিলো, যারা বেড়ে উঠতে উঠতে তখন সদ্য তরুণ, আর রক্তে তাদের তেজ আছে বলে সহজে ক্লান্ত হলো না। তারা ছিলো জলপথের যাত্রী, রোদঝলমল দিনে যে যাত্রা স্থায়ী হবার কথা কয়েকশ মিনিট। তাদের ছোটো বোটটায় যারা বয়সি আর মনরোগা, তারা প্রথম প্রথম তরুণদের এসব কাণ্ড-কারবারে আগ্রহ দেখিয়ে একসময় ছোটো ছোটো ঢেউয়ের দোলে ঘুমের ঘোরে ঝিমুতে লাগলো।

একটু আড়ালে, বোটের কিনার ঘেঁষে ধূসর রঙের এক বৃদ্ধ যিনি বয়সের ভারে নুয়ে ছিলেন এবং স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছিলেন না। গোবেচারা চোখে সেদিকে তাকালে অবশ্য এর চে ভালো কিছু বোঝা যাবে না, কিন্তু সত্য হলো তার চোখদুটো জ্বলছিলো। তার চোখ ছিলো এই গাল্পিক যুবকদের দিকেই এবং সমস্ত শরীর নুয়ে পড়লেও চোখ কান তার অচল হয়ে যায় নাই। তার মনটাও ছিলো কচি লেবুপাতার মতো মোলায়েম সতেজ, তাই তরুণদের একজন হতে তার ভেতরে কোথাও ঘাটতি থাকলো না। তখন পাঁচ তরুণের ভেতরে একমাত্র কন্যা গল্প গাঁথতে শুরু করলো, আর এমনি তার ভঙ্গি যেনো সে আদিম কথাকার। সে আসমানের দিকে তাকিয়ে জমিনের গল্প বানাতে লাগলো যেটা মূলত একটা সিনেমা দেখার কাহিনি। যে লোকটা সিনেমাটা দেখতে বসেছিলো সে ছিলো অন্ধ এবং সেটা সম্ভবত সে জন্ম থেকেই বয়ে আসছিলো। তবু তার বোধ ছিলো পরিষ্কার এবং দৃশ্যকল্পনা ছিলো মোটামুটি নির্ভুল। বহুদিন থেকে তার বিচিত্র সব ইচ্ছে ছিলো আর সে সিনেমাটাও মূলত তার ইচ্ছে পুরনের অংশ। যদিও মনে হয় এতে কোনো সার্থকতা নাই, কারণ অন্ধ আর কী করে সিনেমা দেখে। কিন্তু তার সিদ্ধান্ত অবিচল ছিলো এই কারণে যে, শব্দের অনুসরণে সে মনের ভেতরে দৃশ্য বানাতে পারে, আর এভাবেই সে জগত সংসার অনুমাণ করে থাকে।

বিশাল হলরুমে সে ছিলো একমাত্র দর্শক। পরিচালক হাতের আন্দাজে একটা সিনেমা প্লে করে তিন ঘণ্টার জন্য প্রস্থান করলো। সেটা ছিলো আসলে একটা বিদেশি মুকাভিনয় সিনেমা, যেখানে ব্যাগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়া আর কোনো শব্দ ছিলো না। অন্ধ দর্শক, যে কিনা শব্দের অনুসরণে দৃশ্য বানাবে, সে দীর্ঘক্ষণ করুণ এক মিউজিকের সাথে ঠক্ ঠক্ শব্দ শুনতে পেলো। তাতে তার মনে দৃশ্য জেগে উঠলো চারটা চোখা ঠোঁট একটি চক্ষু ঠুক্রে ঠুক্রে খাচ্ছে। তারপর হঠাৎ উথলে ওঠা কান্নার মতো মিউজিক বেজে চললো আর অন্ধ লোকটা কেঁপে কেঁপে অন্ধকারে আলো হাতড়ালো, যেভাবে সে শব্দ থেকে দৃশ্য হাতড়ায়। কিন্তু তখন একটি রক্তাক্ত চোখ আর চারটি হিংস্র চোখা ঠোঁট ছাড়া সে কোনো দৃশ্য খুঁজে পেলো না। এটুকু বলে মেয়েটি নিজেই যেনো বিভ্রান্তিতে পড়লো, যখন অন্তর্গত চোখে তার চারটি চোখা ঠোটের বিপরীতে নিজের একটি চক্ষু ভেসে উঠলো, তখন তার গল্প আর লম্বা হলো না বরং তার মুখ-চোখ জুড়ে অচিন ছায়া দেখা দিলে বাকি চারজন তরুণও বিভ্রান্ত বোধ করলো। আর পাশের নুয়ে পড়া বৃদ্ধ লোকটি, সেও বিভ্রান্তি কাটানোর জন্য মনে মনে স্মৃতি হাতড়ে চললো। শুরু থেকেই তার মনে হতে থাকলো ঠিক এমন একটা সময় তার কাছে ফিরে আসছে শুরু করেছে যে সময়টা অতীত হতে হতে ছাইরাঙা ধূসর হয়ে গেছে। এখন বুঝি সে ধূসরতা একটু একটু কাটতে শুরু করেছে কিন্তু ভালো করে উজ্জ্বলতা এখনো এসে পারে নাই। তবে তিনি এমন অনুমান করলেন, যে অনুমানে বিশ্বাসের ভাগ বেশি থাকলো। এমন মুহূর্ত হয়তো সত্যিই আসতে চলেছে যেমন মুহূর্ত সে কখনো কল্পনাও করে উঠতে পারে নাই। কিংবা এতোটা বললে কোথাও হয়তো ভুল হতে পারে বরং সে হয়তো কল্পনা করেছে কিন্তু বাস্তবের রূপ ছিলো সেখান থেকে বহু পথ দূরে। তারপর হঠাৎ করেই তার স্মৃতি থেকে ধূসর সর কেটে গিয়ে সকালের রোদের মতো তরল হয়ে উঠলো। তখন তার ভেতরে আর কোনো জড়তা থাকলো না এবং তার নুয়ে পড়া দেহখানাও একটুখানি সতেজ হলো।

সে তো আসলে কবেকার কথা যখন জীবনের সব সারল্য কেটে গেলো আর তার যুবক বয়স উপস্থিত হলো, তখন হঠাৎ করে জীবন সম্পর্কিত একটি প্রশ্ন তাকে বিভ্রান্ত করে তুললো। সে যে জন্ম নিয়ে দুনিয়ার জমিনে পড়লো এবং মানুষ নামে তার পরিচয় ঘটলো, আসলে তার যাত্রা কোথায়, মানুষের যাত্রা কোথায়? কিংবা মানুষের এই ভঙ্গুর ও ঠুন্কো জীবনে আসলেই কি কোনো যাত্রা আছে অথবা তার প্রয়োজনই বা আছে নাকি! আড়ালে আসলে সবকিছুই নিরর্থক এবং এইসব জীবনের ঘুপচি গলি থেকে কোনো সদর রাস্তার সন্ধান পাওয়া যায় না। মানুষের যাত্রার স্বরূপটাও জানা যায় না বলে জীবনটা এক বিভ্রান্তি কিংবা সবটুকু আকণ্ঠ ঘোর ছাড়া কিছু মনে হয় না। কিন্তু এখানে একক বাস্তবতা বলে আসলেই কি কিছু হয়! সকালের রোদে তো মনের ভেতর কেমন মায়া জাগায়, তখন মনে হয় জীবনটা আসলে বয়ে বেড়ানো যায়। ওদিকে আবার মায়া জিনিসটাই হলো খানিক সময়ের জন্য সত্য, রোদ কেটে গেলে কেমন নগ্নতা প্রকাশ হয়ে পড়ে। সব কিছুই মূলত গোলমেলে এবং এসব কিছু মগজের ভেতরে জট পাকিয়ে তুললে তার সাধারণ জীবন ব্যহত হয়ে পড়লো। সমাজ সংসার তুচ্ছ মনে হলে ঘর ছাড়লো এবং পথে পথে প্রশ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকলো।

মেয়েটির পর গল্প শুরু করলো নতুন এক তরুণ যে বসেছিলো বৃদ্ধের মুখোমুখি। ছোটো বোটটা চলছিলো উত্তর দিকে না দক্ষিণ পানে থৈ-থৈ জলে তা টের পাওয়া যাচ্ছিলো না। তবে বোটটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে সে বিষয়ে নূয়ে পড়া বৃদ্ধ অনুমান করে চলছিলো, হয়তো সেখানেই যেখান থেকে সে নগরের পথ বাহির করা যায়। তখন যুবকের মুখে গল্প চলছিলো এক শিশুকে নিয়ে যে গল্পের নাম দেয়া গেলো- যাত্রা। একটি শিশু নয়মাস শেষে পৃথিবীর আলোয় এসে নামহীন থাকলো দেড় সপ্তাহ। তারপর একটি নাম পেলো আর সে নাম তার কানে পৌঁছানোর আগেই ফুসফুস থেকে শেষ হাওয়াটুকু বাহির হয়ে গেলো। এ গল্পে বৃদ্ধ লোকটা কেঁপে উঠলো যদিও এসব অজানা কোনো কথা না। এমন গল্প শোনার মুহূর্ত তার আগেও এসেছে। এবং যুবকের এ গল্প শোনার পর মনের ভেতরে তার আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকলো না যে, সে গল্পের ভেতরেই তাদের এখন বসবাস চলছে। গল্পের চরিত্র তবে এভাবেই প্রাণ পেয়ে জনপদে ঘোরে ফেরে, এমন দিনের জন্ম না হলে বিশ্বাস করা যেতো না। হায় জীবন, সত্য তাহলে এটাই যে, যাত্রাপথ অনুমানটুকু করা যায় না। অনর্থক এইসব ছোটাছুটি, তবু কেনো সে ছুটে চলে কিংবা চলেছিলো, চলতে চলতে পৌঁছেছিলো নূরনগরে। সে বড়ো অদ্ভুত নগরী যেখানে শুধু মগজ বিগড়ানো মানুষজন বাস করে, সবাই যে কোন তালে ঘোরে সেটা সে ঠাহর করে উঠতে পারলো না। এর ভেতরে রইস পাগলা সামনে এলো একদিন যেদিন সন্ধে বেলা পার হলে দ্বিগুণ অন্ধকার নেমে এলো যখন কোনো হাওয়া ছিলো না। তার মনে হলো পৃথিবী ফুরিয়ে গেছে কিংবা সকল খেলা শেষ হয়ে গেছে আর একটু একটু করে সেও অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে। তখন হঠাৎ তার কণ্ঠ চিরে এক দলা চিৎকার ছড়িয়ে পড়লে সামনে এসে কে দাঁড়ালো কিন্তু অন্ধকারে কিছু দেখা গেলো না। সে অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে একটি দেহ ছুঁয়ে দেখলো তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে পরিচয় জানতে চায়লো। অন্ধকার থেকে আগন্তুক উত্তরে বললো, নিজের সম্পর্কে এখনো কিছু জানা যায় নাই তবে লোকে কয় রইস পাগলা। কিন্তু এসব কিছু মানুষের বিভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই না। আমিও কতোদিন হয় বিভ্রান্তির চক্রে পড়ে ঘুরছি অথচ বিভ্রান্তির বিপরীতে সত্যাসত্য কিছু টের পওয়া যায় না। অথবা এ বিষয়ে বিশ্বাস রাখা ভালো যে, এই বিভ্রান্তিই সার, হয়তো সেটাই আবার সত্য।

সে বিস্মিত হলো অন্ধকারে দাঁড়ানো আগন্তুকের কথা শুনে, যে কিনা তার ভাবনার বিষয়েই কথা বলতে শুরু করেছে হঠাৎ এসে, সে কি তবে অন্তরদর্শি কেউ নয়! হয়তো আরো অনেক সত্য সে জানে যা সাধরণের ভাবারও সাধ্যে কুলায় না সুতরাং একে হাত ছাড়া করার কোনো সুযোগ নাই। তখন সে অন্তরদর্শি লোকটাকে আরো গভীরভাবে কামনা করলো লোকে যাকে রইস পাগলা বলে ডাকে। কিন্তু তখন আর সামনের অন্ধকার থেকে কারো কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না।

সকাল হতে হতে সমস্ত অন্ধকার কেটে উঠে দ্বিগুণ রোদ ছড়িয়ে পড়লো। মনে হলো এই চরাচর জুড়ে কোনো দিন কোনো অন্ধকার দাপট দেখাতে পারে নাই। অথচ এই অন্ধকারই নাকি মৌলিক, আলোর মতো, যার হয়ে উঠতে হয় না। তবু তার মনে কোনো নেতি চিন্তা ভর করলো না। বরং তার মনে হলো, এমন রোদের রাজ্যে আড়াল থাকবে তেমন কোনো গোপন বস্তুর জন্ম নশ্বর পৃথিবীতে হয় নাই। সেই ভরসায় সে নূরনগরের এখানে ওখানে রইস পাগলার খোঁজ করলো কিন্তু সারা দিনে তার দর্শন মিললো না। তখন অন্ধকারের মৌলিকত্বের শক্তি সম্পর্কে সে সিরিয়াস ভাবনায় পড়লো। এভাবে রোদ ঝলমল দিনটা সন্ধ্যায় গড়ালো, তখন ক্লান্ত চোখ তার পশ্চিমে আকাশের উপরে স্থির হলে, ক্ষুদ্র চোখের ভেতরে বিশাল এক আকাশজুড়ে লাল নীল হলদে আলোর শেষ দৃশ্য মঞ্চস্থ হলো। তখন তার মনে অন্ধকারের ভাগ একটু ম্লান হয়ে এলে, উড়ো হাওয়ায় রাজহাঁসের পালকের মতো কয়েক টুকরো সাদা ভেতরকার অন্ধকারে জায়গা করে নিলো। তাতে তার পতনউন্মুখ দেহ খানিক সতেজ হয়ে উঠলে সামনে সে রইস পাগলার অস্তিত্ব টের পেলো। সে উঠে দাঁড়িয়ে রইস পাগলার সামনে নত হয়ে বললো, অন্তত আমাকে কিছু বলুন, বিভ্রান্তির চক্রে পড়ে জনম জনম তো আর ঘোরা যায় না!

রইস পাগলা হেসে কইলো, জীবনটা হইলো বিভ্রান্তিমূলক চলমান এক গপ্প, তাকে আর কেমনে পাশ কাটানো যায়! সেটা টের পায় তোমার আমার জীবন। আর সেই জনপদের তরুণেরা, যে জনপদে আকস্মিক তারা উপস্থিত হয়। যে কাহিনির শুরুটা হলো ছোটো এক বোটে, যাতে চড়ে কয়েকজন মানুষ একটি বৃদ্ধ আর সদ্য হয়ে ওঠা পাঁচজন তরুণ যাত্রা করে। দীর্ঘ যাত্রাপথ কীভাবে প্রাণের মতো উচ্ছল করা যায় সে বিষয়ে তারা ভাবতে ভাবতে গল্পের খেলা শুরু করে। তরুণদের ভেতরে একমাত্র কন্যাটি তখন গল্প বলে চলে এক অন্ধের যে কিনা শব্দ শুনে মনের ভেতরে দৃশ্যের অবতারণা করে। তারপর আরেকজন তরুণ এবং আরেকজন তারপর, গল্প করে। তাদের পাশে বসে থাকা নুয়ে পড়া বৃদ্ধ উৎসুক হয়ে হঠাৎ তাদের যাত্রার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তারা বিভ্রান্ত হয় না। তারা উত্তর করে যে, তারা জীবন দেখতে বাহির হয়েছে, আসলে জীবনটা কী কিংবা কি তার রঙ আর কেমন তার চলন-বলন! তখন বৃদ্ধ তাদেরকে এক নগরীর কথা বলেন সেখানে নাকি জীবনের গল্পগুলো নগ্ন হয়ে ঘোরে। জীবনের রঙ আর কেমন তার চলন-বলন চোখের ওপর সেসব ঢেউয়ের মতোন আছড়ে পড়ে। এসব শুনে তরুণরা দারুণ উৎসুক হয় এবং এমন নগরীর কথা কোথাও কোনো দিন শোনা গেছে কিনা স্মরণ করে। তারপর বৃদ্ধকে বলে, আমাদের সে নগরীর পথ বলে দিন যদি সত্যিই তার অস্তিত্ব থেকে থাকে। তখন বৃদ্ধ তাদেরকে ইশারায় অপেক্ষা করতে বলে এবং দীর্ঘ সময় পর বোটখানা কূলে ভীড়লে তারা নেমে পড়ে। বৃদ্ধ তাকে অনুসরণ করতে বলে আগে আগে দুর্বল পায়ে হাঁটে সে এমন এক পথে, যে পথে তাদের ছয়জোড়া পা ছাড়া আর কোনো পা সেদিকে এগোয় না। তারা হাঁটতে থাকে এবং সে যাত্রা একটু একটু করে দীর্ঘ হতে হতে তরুণরা যখন ভাবতে শুরু করে যে, এ যাত্রা আরো দীর্ঘ হবে তখন হঠাৎ বৃদ্ধ পথের পাশে বসে দীর্ঘ দম নিতে থাকে। তরুণদের হৃদপিণ্ড ধুকপুক করে ওঠে বৃদ্ধের দম ফুরিয়ে যাচ্ছে কিনা সে ভয়ে। কিন্তু বৃদ্ধ টেনে টেনে কথা বলে এবং তরুণদের পথ দেখিয়ে সেদিকে হাঁটার নির্দেশ করে। তারা আবার যাত্রা করে আর বৃদ্ধ কমে আসা দম নিতে নিতে অসমাপ্ত পথের কথা ভাবে যে, আসলেই পথের কোনো সমাপ্ত হয় না যেখানে জীবনের কোনো যাত্রা জানা যায় না।

তরুণরা অল্প সময়ের যাত্রাপথেই একটি নগরীর দেখা পায়। কিন্তু সেখানে চমকপ্রদ কিছুর দেখা মেলে না বরং সবকিছুই চেনা-চেনা, যেনো এ তাদের নগরী। অথচ বৃদ্ধ কীসব কথা কয়ে তাদের এমুখো পাঠালো তবে কি সেসব তার মনের ভোজবাজি ছাড়া আর কিছুই ছিলো না!

তারা আরো এগিয়ে যেতে থাকে এবং এবার তাদের চোখে অন্যরকম দৃশ্য ধরা পড়ে যদিও সেটা আহমরি কিছু না, আনন্দ মিছিল শহরে নেমেছে। সেখানে কোনো বৃদ্ধ নাই কিংবা মধ্যবয়সীও না, সার সার শুধু তরুণ যুবকের উচ্ছাসমাখা মুখ। তারা যে কিসের আনন্দ মিছিল করে প্রথমে ঠিক বোঝা যায় না। তারপর তারা খোঁজ নিতে থাকলে সংবাদ পায় যে, এ আনন্দ গভমেন্টের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ। গভমেন্ট নাকি নিম্নশ্রেণির তরুণীদের ওপর উচ্চশ্রেণির তরুণদের ইচ্ছেমত উপগত হবার অনুমতি দিয়েছে।

শহরে হঠাৎ উপস্থিত হওয়া তরুণরা এতে করে দারুণ বিস্মিত হয় আর বলাবলি করে যে, পৃথিবী তাহলে এতোদূর এগোলো। তবে তারা খুশি হয় এ কারণে যে, বৃদ্ধের কথা একেবারে মিথ্যে অন্তত নয়।

তারপর তারা আরো সামনে এগোয়, আর দেখে এ শহরে যত্র তত্র উঁচু দেয়াল পোক্ত বুকে খাড়া হয়ে আছে। আর প্রতিটা দেয়ালের আড়ালেই যেনো গোপন কোনো অভিসন্ধি অন্ধকারে আঁধারে কানাকানি শুরু করেছে। তারা সামনে এগোয় ধীর পায়ে, তারা হাঁটে আহতের মতো পা ঘসে। তাদের উৎসুক কান আর তৃষ্ণার্ত মন জেনে যায় অন্ধকার আঁধারের যতো গোপন কানাকানি। এ নগর খুব বড়ো নয় কিন্তু এ নগরে এতো পোক্ত দেয়াল কারণ, প্রচীন কালের মহামারির মতো এখানে দশ রকমের বিভাজ্যতা ছড়িয়ে গেছে। এখানকার তরুণ-তরুণীরা নিজেদের মতো রাজ্য গড়ে নিয়েছে যেখানে বয়সীদের অবাধ যাতায়াতের সুযোগ নাই। শিশু আর বয়সীরা একত্রে বাস করে এবং এদের সবার ভেতরে আবার বিভেদ আছে উচ্চ আর নিম্নশ্রেণির। এই দুই শ্রেণির আর একত্রে বাস করার সুযোগ নাই। এর ভেতর আবার মাথা গজিয়েছে ধর্ম, এরা কেউ কারো মুখ দেখবে না কিংবা দেখাবে না বলে বিশাল দেয়াল তুলে আড়াল হয়েছে।

তারা শহরের পথে ঘাটে ঘুরে ঘুরে মানুষের আজব সেসব বিভক্তি দেখে নিজেদের চোখ অবিশ্বাস করতে শুরু করে। এমন কিছু যে সত্যিই শোনা যায় নাই এবং তারা ভেবে পায় না যে এরা অগ্রবর্তী পৃথিবীর মানুষ না পশ্চাৎপদ, যেখানে আবার আধুনিক পৃথিবীর সকল উপকরণ বিদ্যমান আছে। এসব জিজ্ঞাসার ভেতরেই তারা আরো সামনে এগোয় আর সেই সাথে একটা গোপন কৌতুহলের সমাধান ঘটে। তারা আসলে একটা মহল্লার সন্ধান পায় যেখানে কোনো উজ্জ্বল রঙ্গের মানুষ নাই যেটা ঠিক পেছনে ফেলে আসা মহল্লার বিপরীত। এখানে শুধু ম্লান রঙ্গের মানুষ, জনপদের মানুষজন যাদের কালো বলে আখ্যা দেয়। তখন তরুণেরা ভাবে, পুরনো বিভেদ তবে দিনে দিনে এমন নগ্ন হয়।

শেষ পর্যন্ত তারা মানুষ বিষয়ে তুমুল বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে আর নিজেদের দিকে তাকানোর চেষ্টা করে। আসলেই কি মানুষের কোনো যাত্রা আছে নাকি সবটুকুই বিভ্রান্তি, আর তারা এ নগরীতে এসে দ্বিগুণ বিভ্রান্তিতে আটকে গেছে। তারা কি আসলেই বাস্তব কোনো চরিত্রে আছে কিংবা সত্যিকারের মানুষের কোনো নগরীতে! নাকি এ স্বপ্ন, দুর্বোধ্য ঘোর, যেখানে তারা বোকার মতো আটকে গেছে। এভাবে তারা ক্রমেই নিজেদেরকে অবিশ্বাস করতে শুরু করে এবং পরস্পরের দিকে সন্দেহের চোখে তাকাতে থাকে। তাদের ভেতরে একজন বলে যে এটা সত্যিই স্বপ্ন, জটিল সম্মিলিত স্বপ্ন, চিমটি কেটে কেটে এর থেকে উদ্ধারের কথা ভাবা যেতে পারে। তারপর তারা সত্যাসত্যই নিজেদের গায়ে চিমটি কেটে কেটে ঘোর ও দুঃস্বপ্ন থেকে বাহির হবার চেষ্টা করে, কিন্তু তাতে কোনো সফলতা মেলে না। এভাবে তারা চিমটি কাটতে কাটতে আর বিতর্ক করতে করতে নতুন এক মহল্লায় চলে আসে। এখানে এসে তারা অবাক হয় বটে কারণ ঠিক মতো বোঝা যায় না যে এটা মূলত কাদের মহল্লা। কারণ এখানে কালো ধলা বৃদ্ধ তরুণ সব একাকার হয়ে আছে এবং উঁচু নিচু কিংবা ধর্ম বিষয়েও কোনো প্রভেদ বোঝা যায় না। তবে মানুষগুলোকে একটু অস্বাভাবিক লাগে বৈকি কারণ চলন বলনে কারো কোনো তাল বোঝা যায় না। তারপর তারা ঠিকি বোঝে বটে, কিংবা এই সংবাদটুকু তারা পেয়ে যায় যে, এটা হলো মাথা বিগড়ানোদের মহল্লা আর তাই এখানে কোনো বিভাজ্যতা খাটানো যায় না। তখন তরুণদের মনে হয় যে, স্বপ্নের এ অধ্যায়ে এসে তারা একটু স্বস্তি টের পাচ্ছে এবং মনের ভেতরে আর আগের মতো ভার ভার ঠেকে না।

কিন্তু সে আর কতোক্ষণ, সময়ের একটা ভাগ পার হতে হতে সে ভাবটা তাদের কেটে গেলে তারা আবার সন্দেহ করতে শুরু করে নিজেদেরকে যে, তবে কি তাদের মাথাও বিগড়ে যেতে শুরু করেছে!

হায় হায়, তারা নগরী থেকে বাহির হবার চেষ্টা করে বটে, কিন্তু হাজার বার পা ফেলে ফেলে পুনরায় একই জায়গায়, মাথা বিগড়ানোদের মহল্লায় এসে দাঁড়ায়, যেনো পুরো পৃথিবীতে একটাই মাত্র নগরী আছে!

এবার তারা চূড়ান্তভাবে চোখে শুধু জোনাকির মিছিল দেখে আর মাতালের মতো শরীরে চিমটি কাটে, তবু বিভ্রান্তি-ঘোর-স্বপ্ন থেকে বুঝি আর বাহির হওয়া যায় না।

বৃদ্ধের কথা শুনে তরুণরা দারুণ উৎসুক হয়ে উঠলো এবং এমন নগরীর কথা কোনো দিন কোথাও শোনা গেছে কিনা স্মরণ করার চেষ্টা করলো। তারপর বৃদ্ধকে বললো, আমাদের সে নগরীর পথ বলে দিন যদি সত্যিই তার অস্তিত্ব থেকে থাকে। তখন বৃদ্ধ তাদেরকে ইশারায় অপেক্ষা করতে বললো এবং দীর্ঘ সময় পর বোটখানা কূলে ভীড়লে তারা নেমে পড়লো। বৃদ্ধ তাকে অনুসরণ করতে বলে আগে আগে দুর্বল পায়ে হাঁটতে থাকলো সে এমন এক পথে, যে পথে তাদের ছয়জোড়া পা ছাড়া আর কোনো পা সেদিকে পদক্ষেপ নিলো না।

পাঠ-প্রতিক্রিয়া

‘গল্পের জনপদ অথবা জনপদের গল্প’ এই শিরোনামের গল্পটির প্রবেশ মুখটি বেশ শক্ত-পোক্ত। কিছুতেই ঢোকা যাচ্ছিল না। এরপর কড়া এক মগ কফি নিয়ে বসতে হলো। সেজন্য গল্পকারকে ধন্যবাদ জানাই। কয়েক চুমুক পান করতেই ফুরফুরে মেজাজে গল্পটি পড়তে শুরু করি এবং প্রথম কয়েক লাইনের পরই কফির মগ একলা পড়ে থাকে। কেননা ততক্ষণে গল্পের জলপথের যাত্রীদের সাথে বোটটিতে আমিও উঠে পড়েছি।

গল্পটি লেখা হয়েছে একদল যাত্রীদের নিয়ে, যারা একটি বোটে করে জলপথে যাথা শুরু করেছে। এবং তাদের ভেতর তরুণরা গল্প-গল্প খেলায় মেতে উঠেছে। আর কিছু বয়সি যাত্রীরা তাদের এই খেলায় আগ্রহ দেখালেও শেষ অবধি ঢেউয়ের তালে ঝিমুতে লাগলো। কিন্তু একজন বৃদ্ধকে দেখা যায় তরুণদের গল্পে চোখ-কান খোলা রেখে মন নিবদ্ধ করে রাখতে। গল্পকার এই বৃদ্ধের দুর্দান্ত উপমা টেনেছেন— " কচি লেবু পাতার মত মোলায়েম সতেজ", যাতে বোঝা যায় তার উজ্জ্বল উপস্থিতি কতটা মূল্যবান। গল্পটি এগিয়ে চলে এদেরকে নিয়ে এবং একসময় শেষ হয়ে যায়। আমি অনেকগুলো ভাবনার মাঝে পড়ে যাই।

গল্পের ভাষায় খুব না হলেও কিছুটা নতুনত্ব পেয়েছি, যার কিছু কিছু দিক থেকে শহীদুল জহির কিংবা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রভাবিত, তবুও অচেনা এই লেখকের উপস্থানা অন্যরকম স্বাদ দিয়েছে। কিন্তু কিছু শব্দ বেমানান ঠেকেছে। যেমন- বোট, সিরিয়াস, গভমেন্ট ও সিনেমা।

গল্পটিতে বেশিরভাগ সময় ধরে লেখক বলে গেছেন মানুষ প্রবাহমান জীবনের আলোর কথা।যে কারণে গল্পটি পড়ে ফেলার পর আমার ওলন্দাজ চিত্রশীল্পি ভিন্সেন্ট উইলিয়াম ভ্যানগগের আঁকা "বোটস সেইন্টেস ম্যারাইস" শিরোনামের চিত্রকর্মের কথা মনে পড়ে যায়।ওই ছবিটিতে দেখা যায় একটা সমুদ্রপাড়ে কতগুলো বোট স্থির ।আর বাকিরা জল পথে নেমে গেছে। স্থির স্পেসটি হলুদ বর্ণের। কিন্তু চলমান বোটগুলো উজ্জ্বল আলোর অভিমুখে গতিশীল। যা হোক, সবশেষে বলবো ভালো লেগেছে। কাহিনী, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, সবখানেই নতুন কিছু স্বাদ দেওয়ার জন্য গল্পকারকে ধন্যবাদ জানাই।

[আমরা গল্প ও কবিতার সঙ্গে পাঠ-প্রতিক্রিয়া জুড়ে দেবার সীদ্ধান্ত নিয়েছি। যিনি পাঠ-প্রতিক্রিয়া লিখবেন তাকে শুরুতে জানতে দেয়া হয় না লেখকের নাম। আবার লেখক কখনোই জানতে পারবেন না পাঠ-প্রতিক্রিয়া কে লিখেছেন।বি.স.]

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ইসরায়েলি হামলায় হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতার মৃত্যু: যুক্তরাষ্ট্র
ইসরায়েলি হামলায় হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতার মৃত্যু: যুক্তরাষ্ট্র
ম্যারেজ কাউন্সেলিং সম্পর্কে যা কিছু জানা জরুরি
ম্যারেজ কাউন্সেলিং সম্পর্কে যা কিছু জানা জরুরি
নিজ বাড়ির সামনে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
নিজ বাড়ির সামনে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
কয়রায় সুইডেনের প্রিন্সেস ক্রাউন ভিক্টোরিয়া
কয়রায় সুইডেনের প্রিন্সেস ক্রাউন ভিক্টোরিয়া
সর্বাধিক পঠিত
লিটনের বাদ পড়া নিয়ে যা বললেন হাথুরুসিংহে
লিটনের বাদ পড়া নিয়ে যা বললেন হাথুরুসিংহে
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
পদ্মার গ্রাহকরা এক্সিম ব্যাংক থেকে আমানত তুলতে পারবেন
একীভূত হলো দুই ব্যাংকপদ্মার গ্রাহকরা এক্সিম ব্যাংক থেকে আমানত তুলতে পারবেন
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার
‘সরলতার প্রতিমা’ খ্যাত গায়ক খালিদ আর নেই
‘সরলতার প্রতিমা’ খ্যাত গায়ক খালিদ আর নেই