X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

চেনা সুরের রাগ-রঙ

বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়
২১ নভেম্বর ২০১৮, ১০:০০আপডেট : ২১ নভেম্বর ২০১৮, ১০:০০

চেনা সুরের রাগ-রঙ পর্ব-১৯

চিত্রপরিচালক তপন সিংহের সমস্ত ছায়াছবিতেই সঙ্গীতের প্রয়োগ বিস্ময়কর। তিনি নিজে একজন উঁচু দরের গীতিকার এবং সুরকারও ছিলেন; কিন্তু ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ছায়াছবিতে সঙ্গীত নির্দেশক ছিলেন ওস্তাদ আলি আকবর খাঁ। তার সরোদ সমস্ত ছবিটির আবহকে যেন ব্যাপ্ত করেছিল, কিন্তু তবু যেন খুব স্পষ্টভাবে তার উপস্থিতি পরিস্ফুট হয়নি; বরং, সেভাবে যিনি প্রকাশিত হয়েছিলেন, তিনি ওস্তাদ আমীর খাঁ। তার তিনখানি গান আছে এই ছায়াছবিতে—একটি খাম্বাজ ঠুংরি, রাগেশ্রী রাগে একটি গান এবং মেঘ রাগে তারাণা, যার কথা বলছিলাম। তবে খাম্বাজ ঠুংরিটি, একদিক থেকে বিচার করলে, একটি মহামূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল; কারণ, যতদূর মনে হয়, আমীর খাঁ সাহেবের আর কোনো ঠুংরির রেকর্ড নেই। খুব নিশ্চিত এই, তবে প্রায় নিশ্চিতভাবেই এ কথা বলা যায়। কোনো জলসা বা কোনো অনুষ্ঠানেই তাঁকে কখনো ঠুংরি গাইতে দেখিনি, বা শুনিনি। যা শুনেছি, তা হলো, ঠুংরি তিনি গাইতেন না। কেন গাইতেন না, সে সম্পর্কেও নানা মতবাদ। কেউ বলেন, খেয়ালের ভাব তরল হবে, এই কারণেই তিনি ঠুংরি গাইতেন না। এ কথা তিনিই নাকি বলতেন। আবার কেউ কেউ বলেন, আসলে ঠুংরির হৃদয় বিদারক যন্ত্রণা, তিনি সহ্য করতে পারতেন না।...

এই দু’ই তত্ত্বের মধ্যে কোনটা আসলে সত্য, তা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। বহুকাল আগে, কোনো একটি লেখায় পড়েছিলাম আমীর খাঁ সাহেব একবার নাকি ঠুংরি সম্পর্কে তার অনীহার কারণ হিসেবে খেয়ালের ভাব লঘু হওয়ার আশঙ্কার কথা কোথাও বলেছিলেন এবং সে কথা শুনে ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেব ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। আর দ্বিতীয় কারণটিও শোনা কথা, তবে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ছায়াছবিতে তার গাওয়া ঠুংরিটি শুনরে মনে হয়, এ হৃদয় বিদারক বেদনা সহ্য করা শ্রোতার পক্ষেই কঠিন, গায়কের পক্ষে তো হতেই পারে। প্রসঙ্গত এও বলে নিই, বাগেশ্রী রাগে গানটিকেও ঠুংরি বলব কিনা ভেবে পাই না।

ঠুংরির কথা থাক। মেঘ রাগে তারাণার কথাই বলি।

ওস্তাদ আমীর খাঁর কথা বললেই, বিশেষ করে দুটি রাগের কথা মনে পড়ে। একটি হলো মারোয়া এবং অন্যটি মেঘ। ছায়াছবির যে রেকর্ডটির কথা বলছি, সেটি সেভেন্টি এইট আরপিএম রেকর্ড বলাইবাহুল্য এবং মাত্র তিন সাড়ে তিন মিনিট তার স্থিতি, কিন্তু বিশেষত সেই বিশাল ভগ্নপ্রায় প্রাসাদের কতকালের পরিবেশে সেই তিন মিনিটকাল যেন মুহূর্তেই এক অনন্ত বিরহবেদনার লীন হয়ে যায়। গানের শুরুতেই ক্ষিপ্র ধুলোর ঘূর্ণির মতো একটি তান আমাদের চেতনাকে যেন এই বর্তমানের বাঁধন ছিঁড়ে উড়িয়ে নিয়ে যায় শুস্তা নদীর তীরবর্তী সেই প্রাসাদের আনাচে কানাচে গুমরে ওঠা এক ইরানী ক্রীতদাসীর অতীত ইতিহাসের কান্নার গভীরে। মনে হয় এই ভাবটি পরিস্ফুট করার জন্য ওস্তাদ আমীর খাঁর কণ্ঠই ছিল সবচাইতে উপযুক্ত। সুর স্পষ্ট কিন্তু কণ্ঠ একটু ধরা ধরা, যেন ইতিহাসের মতোই অস্পষ্ট, অধরা। বিরহভারাতুর।

‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ছবিটি দেখুন এবং মেঘ রাগের এই রসকে উপভোগ করুন। ... কিন্তু আরো পরিপূর্ণ রূপে যদি এ রস পেতে চান তবে, আমীর খাঁ সাহেবেরই গাওয়া বড় রেকর্ডটি শুনুন। মেঘ রাগে প্রথমে বিলম্বিত খেয়াল এবং এর পরে পাবেন ওই একই তারাণা গানটি, আরো বিস্তারিতভাবে।

মেঘ রাগে অনেকগুলি রেকর্ডের কথা বললাম, কিন্তু একটি বহু পুরোনো রেকর্ডের কথা ভুলতে পারি না কিছুতেই। সে আজ থেকে প্রায় বছর পনের আগের কথা। আমি তখন আকাশবাণী কলকাতায় একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে থাকি, যাতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে বহু দুর্লভ রেকর্ড সংগ্রহ করে শ্রোতাদের শোনাতাম। তার মধ্যে সাম্প্রতিক শিল্পীদের রেকর্ড তো থাকতই, সেই সঙ্গেই থাকত বহু পুরোনো দিনের ওস্তাদ আর বাঈজীদেরও অবিস্মরণীয় সব গান। ওস্তাদ কালে খাঁ, ওস্তাদ মৌছুদ্দীন, ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁ, ওস্তাদ ইমদাদ খাঁ (সেতার), ওস্তাদ আমীর খাঁ (সরোদ), গহর জান, মালকা জান, আচ্ছান বাঈ, জোহরা বাঈ ... এমনি আরো কত যে নাম। এসবই ১৯০২ থেকে ১৯১০ সালের, অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে নিদর্শন। কিন্তু যে গানটির কথা বলছিলাম, সেটি হঠাৎই আবিষ্কার করি একটি ক্যাসেটের মধ্যে, যার গায়ে কারো হাতের লেখা ... ' Indian vocal classical records–1930 to 1940, (From London)..’ ভারতীয় সঙ্গীতের এই সব দুর্লভ রেকর্ড কিভাবে লন্ডন থেকে আমার হাতে এসে পৌঁছালো, সেটা আমার কাছেও রহস্য, কিন্তু এই ক্যাসেটটি দেখে আমাকে একজন বিখ্যাত রেকর্ড সংগ্রাহক রন্তীদেব মৈত্র বলেছিলেন, ওটা শর্বরী বাবুর, অর্থাৎ শর্বরী রায়চৌধুরীর সংগ্রহ থেকে রেকর্ড করা—বিশেষত ফেরত হয়ে আমার কাছে এসেছে। যাই হোক, মেঘ রাগের যে গানটির কথা বলছিলাম, সেটি এতেই ছিল—শিল্পী ওস্তাদ আল্লা দিনো। সে গানের অভাবনীয়তায় এতই অভিভূত হয়েছিলাম যে ধরেই নিয়েছিলাম, নামটা ভুল লেখা হয়েছে। আল্লা দিনো নয়, ওটা নিশ্চয়ই আত্রৌলি ঘরাণার প্রাণপুরুষ ওস্তাদ আল্লা দিয়া খাঁ-রই রেকর্ড। পরক্ষণেই মনে হলো, কিন্তু ... তবে যে শুনেছি তিনি কোনো রেকর্ড করেননি! ... কাজেই খটকা একটা থেকেই গেল এবং খটকাটা যে অমূলক ছিল না, তাও জানলাম রন্তীদেব বাবুর কাছেই। জানলাম, উনি আসলে আল্লা দিনো খাঁ এবং গুজরাটের জামনগর রাজদরবারের সভাগায়ক ছিলেন। ব্যস্। এর বেশি আর কিছুই জানতে পারিনি। তার ঘরাণা, তার সাংগীতিক ঐতিহ্য, শিক্ষা সম্বন্ধে কিচ্ছু না! তবু, শুনে মনে হয়, আত্রৌলি বা আগ্রা ঘরাণার শিল্পীই হয়তো বা। ... সে যাই হোক, মেঘ রাগের সে রূপ ভোলার নয়। দীর্ঘ তানের প্রবাহ যেন ডানা মেলে উড়তে উড়তে কোন মেঘলোকে হারিয়ে যাচ্ছে, আবার চকিতে দেখা দিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে। ...

বাংলায় মেঘ রাগে গানের খুব প্রাচুর্য যে আছে, এমন নয়। তবে কয়েকটি নজরুল গীতির কথা মনে পড়ে যেগুল ‘মেঘ’ রাগাশ্রিত। যেমন, ‘গগনে সঘনে চমকিছে দামিনী’ গানটির কথা মনে পড়ে। আরেকটি গান—‘শ্যামা তন্বী আমি মেঘ-বরণা’। এই দুটি গান মেঘ রাগে বাঁধা। আরো একটি গান, ‘বরষা ঐ এল বরষা’, মেঘমল্লার রাগাশ্রিত, কারণ এই গানটিতে কোমল গান্ধারের প্রয়োগ রয়েছে। গানগুলি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে শুনেছি, তবে কোনো রেকর্ড আছে কিনা, জানি না।

রবীন্দ্রনাথের একাধিক গান মেঘ রাগাশ্রিত বলা হয়েছে। যেমন, সবচাইতে প্রথমেই বলব, ‘হৃদয়ে মন্দ্রিল ডমরু গুরুগুরু’—গানটির কথা। বর্তমানে মেঘ রাগে নিখাদ কোমল। কিন্তু এই গানটিতে বারবার শুদ্ধ নিখাদের ব্যবহার করা হয়েছে, যার ফলে বৃন্দাবনী সারংয়ের কথা মনে পড়ে; তবে মুল্লার অঙ্গ (রে মা রে পা) আছে আর তাই ভাতখণ্ডের মতানুসারে একে মেঘমল্লার বলাই ভালো। আরো অনেকগুলি রবীন্দ্রসঙ্গীতের সম্পর্কেও প্রায় একই কথা বলা যায়, যেমন— ‘যেতে যেতে একলা পথে’, ‘গহন ঘন ছাইল’, ‘আজি শ্রাবণ ঘন গহন মোহে’, ‘আমি এলেম তারি দ্বারে’ ... প্রভৃতি। তবে মতান্তরও থাকতে পারে। যেমন, ‘গহন ঘন ছাইল’ গানটি রবীন্দ্রনাথের ‘ভাঙাগান’ পর্যায়ের এবং যে মূল গানটি অবলম্বনে রচিত (ইন্দ্র হুঁ কী...) সেটি ছিল মিয়ামল্লারে। রবীন্দ্রনাথ, বলাইবাহুল্য, তার স্বভাবসিদ্ধ পথেই বাণীর সঙ্গে সঙ্গে গানটির সুরেও নিজের রঙ মিশিয়েছেন। ‘আমি এলেম তারি দ্বারে’ গানটির সুরেও মেঘের চাইতে বৃন্দাবনী সারংয়েরই প্রাধান্য। ‘যেতে যেতে একলা পথে’ গানটিও বিশুদ্ধ মেঘ রাগের নয়। মেঘ আছে, তবে মিশ্রণ ঘটেছে। এই দুটি গানেই যে রাগটি মিশ্রিত হয়েছে সেটি মল্লারেরই একটি প্রকার এবং আরো সঠিকভাবে বলতে হলে, রাগটি হলো গৌড়মল্লারের একটি প্রকার, যাকে বলা হয় কাফী ঠাটের গৌড় মল্লার।

ব্যাপারটা বেশ জটিল মনে হচ্ছে? ... সেটা খুবই স্বাভাবিক, কারণ সুরের অনন্ত মুক্তিকে খুব সহজ, সরল, মোটা দাগের কতকগুলি নিয়মের খাঁচায় বাঁধতে চাইলে সমস্যা তো হবেই! পৃথিবীর সমস্ত ছবিকে কি আপনি কতকগুলি সীমিতসংখ্যক জ্যামিতিক রেখার সাহায্যে বর্ণনা করতে পারেন? কিংবা শুধুমাত্র সাতটি বর্ণের সমন্বয় হিসেবে? যদিও প্রতিটি ছবিই শেষ পর্যন্ত সাতটি রঙের (অথবা আসলে অনন্ত সংখ্যক রঙের) সমন্বয়েই সৃষ্টি, কিন্তু তাকে শুধুমাত্র সাতটি রঙের কয়েকটি সীমিত সংখ্যক রঙিন নকশা হিসেবে ভাবতে গেলে, চিত্রশিল্পের ওপর খুব একটা সুবিচার করা হবে বলে মনে হয় না। সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও কথাটা সমানভাবে খাটে। সব গানই সাত সুরেই (অথবা অনন্ত সুরেই) প্রকাশিত হয়, কিন্তু সব গানকেই রাগ সঙ্গীতের খাচায় বন্দী করতে গেলে সেটা সঙ্গীত বা রাগ—কারোর পক্ষেই স্বাস্থ্যকর নয়। রবীন্দ্রনাথ এই জন্যই সম্ভবত, তার গানে রাগের উল্লেখ করতেন না। তবু, তার গানে রাগের অনুসন্ধান করার মধ্যে ভুল কিছু নেই! বরং অনেক সময়ই, তার গানেও রাগের হুবহু প্রতিরূপটি খুঁজে পাওয়া যায়। কোন কোন গানে তা পাওয়া যাবে সেটা জেনে রাখলে আমাদেরই সুবিধে। তাতে রাগ চেনার কাজটা সহজ হয়ে যাবে—এই আর কি? (চলবে)

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে বিমানবন্দরে বাস, প্রকৌশলী নিহত
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে বিমানবন্দরে বাস, প্রকৌশলী নিহত
ভারত-পাকিস্তান টেস্ট হবে দারুণ: রোহিত
ভারত-পাকিস্তান টেস্ট হবে দারুণ: রোহিত
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ