X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

বীরাঙ্গনা খঞ্জনীর কথা

বাশার খান
১৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ১০:০০আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ১০:০০

বীরাঙ্গনা খঞ্জনীর কথা বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্জন ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন। নয় মাসব্যাপী মুক্তির সংগ্রামে বাঙালি নারীরা ছিলেন অদম্য সাহসে পুরুষের সঙ্গে। কেউ কেউ যেমন রণাঙ্গনে সম্মুখযুদ্ধে লড়েছেন, আবার আবার কেউ আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা, বাসায় বাসায় গিয়ে চাঁদা তুলে মুক্তিবাহিনীকে আর্থিক যোগান, গোপনে তথ্য সরবরাহসহ নানাভাবেই সম্পৃক্ত হয়েছেন। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীর সম্পৃক্ততার সবচেয়ে করুণ ও নির্মম অধ্যায় হল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার ঘটনা।

যুদ্ধ চলাকালীন নয় মাসে হানাদার বাহিনীর স্থাপিত ক্যাম্পগুলোতে বাঙালি কিশোরী, যুবতি ও গৃহবধূদের মাসের পর মাস আটক রাখা হয়। আন্তর্জাতিক গবেষক সুজান ব্রাউনমিলার তাঁর Against Our Will: Men, Women and Rape বইয়ে এ ব্যাপারে লিখেছেন, ‘একাত্তরের ধর্ষণ নিছক কোনো ঘটনা ছিল না। সেখানে আট বছরের বালিকা থেকে শুরু করে পঁচাত্তর বছরের নানি—দাদির বয়সী বৃদ্ধাও শিকার হয়েছিল এই যৌন পাশবিকতার। রাতে চলত আরেক দফা নারকীয়তা। কেউ কেউ হয়তো আশিবারেরও বেশি ধর্ষিত হয়েছে। ...ঘটনাস্থলে ধর্ষণের পর প্রতি একশ জনের মধ্যে অন্তত দশ জনকে অন্য সেনাদের জন্য তাদের ক্যাম্প বা ব্যারাকে নিয়ে যাওয়া হতো। এই পাশবিকতায় কত জন নারীর মৃত্যু হয়েছে, আর কত জনকে মেরে ফেলা হয়েছে—তার সঠিক সংখ্যা হয়তো কল্পনাও করা যাবে না।’

যুদ্ধকালীন নারীদের ওপর চালানো এই পাশবিকতাকে ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত Convention on the Prevention and Punishment of the Crimes of Genocide- (CPPCG)-এর আর্টিকেল ২-এ বলা হয়েছে Forcibly transferring children of the group to another group যুদ্ধকালীন নারীদের ওপর চালানো এই বর্বরতাকে একশব্দে বলা হয়, Genocidal Rape। একাত্তরে পাকিস্তানি সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ও বাংলাদেশে যুদ্ধ পরিচালনারত জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী বাঙালিদের ওপর বর্বর গণহত্যা চালানোর পাশাপাশি জেনোসাইডাল রেপের মাধ্যমে নারীদের জরায়ুতে পাকিস্তানি সেনাদের ভ্রুণ ঢুকিয়ে দিয়ে এই অঞ্চলকে বাঙালিশূন্য করার অপচেষ্টায় মেতে উঠেছিল।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে জেনোসাইডাল রেপ—এর শিকার হওয়া এমনই এক হতভাগ্য নারী আফিয়া খাতুন খঞ্জনী। বাড়ি কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী জগন্নাথ দিঘী ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে। 

আফিয়া খাতুন খঞ্জনী ১৯৩৯ সালে ফেনী জেলার বরইয়া চৌধুরী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হাসমত আলী চৌধুরী ও মা মাসুদা খাতুন। 

১৯৬৩ সালে কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার জগন্নাথ দিঘী ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামের রুহুল আমিন মানিকের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। ১৯৬৪ সালে রোকসানা ও ১৯৬৫ সালে আবদুল মতিন নামে এক মেয়ে ও এক ছেলের মা হন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্য খঞ্জনীর, হঠাৎ একদিন স্বামী হেকমত আলী মারা যান। দুই শিশু সন্তান নিয়ে বিধবা আফিয়া খাতুন খঞ্জনী পড়েন অথই সাগরে। ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে কোনো রকম দিন কাটছিল তাঁর। এমন সময় আসে ১৯৭১।

২৫ মার্চ ঢাকায় আক্রমণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। চালায় নির্বিচারে গণহত্যা। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের জগন্নাথ দিঘী এলাকা ছিল যুদ্ধে কৌশলতগ কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর কারণ হল- ১. চৌদ্দগ্রামের ওপর দিয়ে জগন্নাথ দিঘী হয়ে গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। ২. জগন্নাথ দিঘীতে ছিল তৎকালীন ইপিআর-এর ক্যাম্প। যেখানে বর্তমানে বিজিবি’র ক্যাম্প। ৩. ইপিআরের কয়েকশ গজ পূর্বেই ভারত সীমান্ত ৪. চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম জগন্নাথ দিঘীর ওপর দিয়ে বয়ে চলা মহাসড়ক। তাই জগন্নাথ দিঘীকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ৩০/৩১ মার্চ অথবা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে জগন্নাথ দিঘীতে ঘাঁটি স্থাপন করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। পাশেই সোনাপুর গ্রাম। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী জগন্নাথ দিঘীর আশপাশে বর্বর হত্যাকাণ্ড চালানোর পাশাপাশি চোখ পড়ে সেখানকার নারীদের ওপর। জগন্নাথ দিঘী ক্যাম্পের আর্মি পার্শ্ববর্তী গ্রামে হানা দিয়ে তরুণী এবং গৃহবধূদেরকে পাশবিক নির্যাতন চালাতে শুরু করে।

এরইমধ্যে হানাদার বাহিনীর এদেশীয় জগন্নাথ দিঘী এলাকার দোসর-রাজাকারদের কয়েকজন একটি খবর পৌঁছে দেয় জগন্নাথ দিঘী ক্যাম্পে যে, সোনাপুর গ্রামের আফিয়া খাতুন খঞ্জনী নামে এক অপরূপ সুন্দরী বিধবা নারী বাস করে। তাতেই কপাল পোড়ে খঞ্জনীর। জুন মাসের কোনো একসময় পাকিস্তানি সেনাদলের এক হাবিলদারের নেতৃত্বে সোনাপুর থেকে আফিয়া খাতুনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় জগন্নাথ দিঘী ক্যাম্পে। তারপর তাঁর ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন।

বর্তমানে মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়ায় আফিয়া খাতুন খঞ্জনীর একাত্তরের কোনো স্মৃতি মনে না থাকলেও তাঁর ওপর চালানো নির্মম ঘটনার তথ্য পাওয়া যায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, আত্মীয়স্বজন এবং মেয়ে রোকসানার কাছ থেকে। তাঁদের তথ্যমতে, অপরূপ সুন্দরী হওয়ায় জগন্নাথ দিঘী ক্যাম্পে থাকা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এক হাবিলদার খঞ্জনীকে জোরপূর্বক বিয়ে করে। এ ঘটনার মাধ্যমে স্থায়ীভাবে ক্যাম্পে থাকতে বাধ্য হন খঞ্জনী। তাঁর স্বামী হেকমত আলীর খালাতো ভাই আব্দুল বারেক জানান, নিজের জীবনের সব হারিয়ে খঞ্জনী ঐ হাবিলদারকে শর্ত দেন, তিনি ক্যাম্পেই থেকে যাবেন—তার বিনিময়ে সোনাপুর এলাকার আর কোনো নারীকে ধর্ষণ করা বা ক্যাম্পে তুলে আনা যাবে না। খঞ্জনীর শর্তে রাজি হয় হাবিলদার।

তবে সরেজমিনে সোনাপুর গিয়ে গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নভেম্বরে সোনাপুর গ্রামের আরও দুজন গৃহবধূ জগন্নাথ দিঘী ক্যাম্পে থাকা হানাদান বাহিনীর হাতে ধর্ষণের শিকার হন। তাঁদের একজন খোদেজা বেগম। খোদেজার স্বামী বাচ্চু মিয়াকেও হত্যা করে হানাদার বাহিনী। দেশ স্বাধীন হলে মানসিক ভারসাম্য হারান খোজেদা। বর্তমানে সোনাপুরের আশপাশে পথে পথে ঘুরে বেড়ান তিনি। কিন্তু খাকি পোশাকের কাউকে দেখলে আর রক্ষা নেই। বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) বা পুলিশ দেখলে ক্ষেপে যান। সামনে যা পান তাই ছুঁড়ে মারেন। গত ৪৬ বছর ধরে খোদেজা প্রতিদিন সকালে ঘর থেকে বের হয়ে যান। ফিরেন সন্ধ্যায়। স্বামীর লাশ খোঁজেন পথেঘাটে, স্থানীয় বাজারে।

খোদেজা  নির্যাতনের শিকার হওয়ার দিন একই বাড়ির আরেকজন গৃহবধূ ধর্ষণের শিকার হন। এই গৃহবধূর ছেলে-মেয়েরা বর্তমানে সমাজে প্রতিষ্ঠিত। একাত্তরে তাঁর ওপর চালানো বর্বরতার কথা স্মরণ করে এই লেখকের সঙ্গে ডুকরে কেঁদে উঠেন এই বীরমাতা। কিন্তু ছেলে মেয়েদের সামাজিক লজ্জার ভয়ে তাঁর পরিচয় প্রচার পাক তা চান না তিনি। খোদেজা এবং নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে না চাওয়া গৃহবধূর ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে সোনাপুরে আর কোনো নারীকে ধর্ষণ করা হবে না- খঞ্জনীকে দেয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাবিলদারের এমন প্রতিশ্রুতি ছিল আসলে প্রতারণা।

তবে চতুর এই হাবিলদারের শেষ রক্ষা হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের অ্যাম্বুশে নিহত হয় সে। এই অ্যাম্বুশে অংশ নেয়া এবং চৌদ্দগ্রামেরই বাসিন্দা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা  আবুল কাশেম জানান, ‘আগস্ট কিংবা তার পর আমাদের ইনফরমাররা খবর দেয় যে, ঐ হাবিলদারসহ পাকিস্তানি সেনার প্রায় দিন সকালেই চৌদ্দগ্রামের চিওড়া রাস্তার মাথায় একটি চায়ের দোকানে চা খেয়ে আশপাশের গ্রামে হানা দেয়। এই খবর পেয়ে আমরা চিওড়া রাস্তার মাথায় অ্যাম্বুশ করার পরিকল্পনা করি। ইপিআরের বাঙালি সদস্য নায়েক শহীদুল্লাহসহ আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল একদিন ভোরে চিওড়া রাস্তার মাথায় অ্যাম্বুশ সেট করি। সকাল ৮টার দিকে ওই হাবিলদার চিওড়ারও ওই চায়ের দোকানের দিকে আসতে দেখা মাত্র আমাদের অস্ত্রগুলো গর্জে ওঠে। হাবিলদারের গলায় গুলি লাগে এবং ঘটনাস্থলেই সে নিহত হয়। যদিও আমরা হাবিলদারের লাশের কাছাকাছি যাইনি। দেশ স্বাধীন হলে ওখানকার চায়ের দোকানদার হাবিলদার গলায় গুলি লেগে মারা যাওয়ার কথা জানায় আমাদের।’

আফিয়া খাতুনের কথিত স্বামী মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যাম্বুশে নিহত হলেও বন্দিদশা থেকে মুক্তি মেলেনি তাঁর। ২৮ নভেম্বর মতান্তরে ৪ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী জগন্নাথ দিঘী ক্যাম্পে হামলা চালায়। জগন্নাথ দিঘী ক্যাম্প মুক্তিবাহিনী দখলে নেয়ার পর মুক্ত হন আফিয়া খাতুন খঞ্জনী।

সম্ভ্রম হারিয়ে বন্দি জীবনে থেকে বেরিয়ে বেদানার্ত খঞ্জনী ফিরে যান তাঁর মেয়ে রোকসানা ও ছেলে মতিনের কাছে। কিন্ত ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, খঞ্জনী পাকিস্তানি হানাদারদের ক্যাম্প থেকে মুক্ত হলেও এবার সামাজিক ও পারিবারিক নির্যাতনের মুখোমুখি হন। এরইমধ্যে ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।

যুদ্ধ শেষ হলেও খঞ্জনীর জীবনে শুরু হয় যুদ্ধ পরবর্তী জীবন যুদ্ধ। তাঁর এই যুদ্ধ এতই করুণ যে, কল্পনাকেও হার মানায়। সোনাপুর গ্রামে শ্বশুর বাড়িতে নষ্টা, ভ্রষ্টা, অসতী হিসেবে আখ্যায়িত হন আফিয়া খাতুন।

আফিয়া খাতুন খঞ্জনীকে বর্তমানে দেখাশোনা করেন তাঁর মেয়ে রোকসানা। রোকসানা জানান,  ‘দেশ স্বাধীন হলে আমার দাদি বোচন বিবি মাকে তাড়িয়ে দেন পাকিস্তানি আর্মির হাতে ধর্ষিতা বলে। এমনকি আমাকে এবং ছোট ভাই মতিনকেও জোরপূর্বক রেখে দেন দাদির কাছে। এরপর মা আমার নানা বাড়ি ফেনী চলে যান। কিন্তু সেখানেও আশ্রয় মেলেনি মা খঞ্জনী বেগমের। মা পাকিস্তানি আর্মির ক্যাম্পে বন্দি ছিল বলে নানা বাড়ির লোকজনও মাকে গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করে।। পরবর্তীতে মা ক্ষুধার জ্বালায় ভিক্ষা করতে শুরু করেন। রাত কাটাতেন ফেনীর কোনো বাজারে অথবা রেলস্টেশনে।’

রোকসানা আরও বলেন, ‘মাকে ছাড়া দাদির কাছে সীমাহীন কষ্টেই চলছিল আমাদের ভাইবোনের জীবন। অভাব-অনটন আর অনাদরে থাকতে থাকতে কিছু দিন পর আমার ভাই আবদুল মতিন মারা যায়। একমাত্র ভাইটির মৃত্যুর খবর শুনে আমার মা শেষ বারের মতো ভাইয়ের লাশ দেখতে আসেন। কিন্তু কষ্টের কথা হলো মা নাকি অপবিত্র নারী- তাই  সমাজের লোকজন ভাইয়ের লাশটিও মাকে দেখতে দেয়নি।’

একের পর মানসিক ধাক্কা সইতে পারেননি আফিয়া খাতুন। একসময় মানসিক ভারসাম্য হারান। আবারও ঠাঁই হয় ফেনী রেলস্টেশনে। স্বাধীনতার পর অভাব-অনাদার আর পথে পথে ঘুরে যুদ্ধ পরবর্তী জীবনযুদ্ধে ২৮টি বছর কেটে যায় তাঁর।

১৯৯৯ সালে খঞ্জনী আশ্রয় পান ফেনীতে তার ভাই সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা আবদুর রহমান চৌধুরীর বাড়িতে। কিন্তু সেখানেও স্বজনদের অবহেলা ছিল নিত্যসঙ্গী। ভাই, ভাবী ও তাদের ছেলেমেয়েরা মাথা গোজার ঠাঁই ও চারটে ডালভাত খেতে দিলেও কেউ তাঁর কাছে আসতো না। ভাই আবদুর রহমান চৌধুরী তাঁকে আলাদা একটি মাটির ঘরে রাখতেন। আবদুর রহমান চৌধুরীর গৃহকর্মী আনোয়ারা বেগম খঞ্জনীকে রান্না করে খাওয়াতেন ও  দেখভাল করতেন।

এদিকে খঞ্জনীর মেয়ে রোকসানার বিয়ে হয় ফুল মিয়া নামে এক দিনমজুরের সঙ্গে। রোকসানা ও ফুল মিয়া দুজনই কুমিল্লা শহরে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প’র একটি কারখানায় চাকরি শুরু করেন। বাসা নেন শহরের বাগিচাগাঁও বড় মসজিদ সংলগ্ন বস্তিতে। সেখানে রোকসানা ও ফুল মিয়া দম্পতির সুরাইয়া, মুন্না ও তারিন দুই মেয়ে ও এক ছেলে হয়। এরপর রোকসানা হতভাগী মায়ের খোঁজে বের হন। ফেনীর মামা বাড়ি থেকে মা খঞ্জনীকে নিয়ে আসেন কুমিল্লায় বস্তির নিজের বাসায়। সেই থেকে আফিয়া খাতুন খঞ্জনী এখনো মেয়ে রোকসানার কাছেই আছেন।

 কুমিল্লা শহরে মেয়ের বাসায় থাকাকালীন খঞ্জনীর ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ ও বিজয়ের মাস ডিসেম্বর আসলে কুমিল্লা শহরের দু’একজন সাংবাদিক খঞ্জনীর খোঁজ-খবর নিতে আসতে শুরু করেন। ২০১২ সালে দৈনিক যুগান্তরের কুমিল্লা প্রতিনিধি মো. কামাল উদ্দিন আফিয়া খাতুন খঞ্জনীর একাত্তরের নির্মম ঘটনা ও তাঁর যুদ্ধ পরবর্তী জীবনযুদ্ধ নিয়ে একটি প্রতিবেদন লিখেন। প্রতিবেদনটি দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশ হওয়ার পর স্থানীয় আরও কয়েকজন সাংবাদিক খঞ্জনীকে নিয়ে লিখতে শুরু করেন। বিষয়টি নজরে আসে তখনকার কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. হাসানুজ্জামান কল্লোলের। ২০১৪ সালে তিনি জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রতিটি থেকে একজন করে বীরাঙ্গনাকে সরকারি খাস জমি প্রদান করার উদ্যোগ নেন। এ জন্য সে বছরের ১৯ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করা হয় কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের সন্তান ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীকে। সেখানে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের শিকার জেলার ১৫ নারীকে ‘বীর নারী মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তাঁদের সরকারি খাস জমির দলিল হস্তান্তর করা হয়। সেদিনকার অনুষ্ঠানে কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন,‘কুমিল্লার বীর নারী মুক্তিযোদ্ধা বীরাঙ্গনাদের খাস জমি প্রদানের মতো ঐতিহাসিক কাজ  করে জেলা প্রশাসন প্রশংনীয় ভূমিকা পালন করেছে। এ কাজের মধ্যে দিয়ে কুমিল্লা আবারও জেলা হিসেবে অগ্রপথিক হয়ে ইতিহাসে স্থান করে নিল। কুমিল্লার সন্তান হিসেবে এ কাজে সম্পৃক্ত হতে পেরে আমি নিজেকে গৌবান্বিত মনে করছি।’ অনুষ্ঠানে জেলার ১৫ জন বীরাঙ্গনাকে মোট এক একর ৭ শতক সরকারি খাস জমি প্রদান করা হয়। (সূত্র : দৈনিক কালের কণ্ঠ, ২০ ডিসেম্বর ২০১৪)। 

এরপর রাজধানী ঢাকা থেকে খঞ্জনীর মেয়ে রোকসানার সঙ্গে যোগাযোগ করেন কয়েকজন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক। তাদের সহযোগিতায় ২০১৫ সালের ২৭ অক্টোবর সামাজিক সহায়তা উদ্যোগ এবং সমাজকল্যাণ ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণাভিত্তিক সংগঠন মাটি’র যৌথ আয়োজনে খঞ্জনীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সামাজিক সম্মাননা এবং আর্থিক অনুদান প্রদান করা হয়। পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারি গেজেটে তালিকভূক্ত হতে খঞ্জনীকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করে এ দুটি সংগঠন।

আফিয়া খাতুন খঞ্জনীকে সরকারি যে খাস জমি দেয়া হয় সেটি জেলার চৌদ্দ্রগ্রাম উপজেলার কনকাপৈত ইউনিয়ন অবস্থিত। সে জমি তখন স্থানীয় এক প্রভাবশালীর দখলে। জেলা প্রশাসন প্রদত্ত জমি উদ্ধার করতে আরেক যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয় খঞ্জনীর মেয়ের রোকসানাকে। জমি দখল নিতে গেলে আগের দখলদার প্রভাবশালী তাকে তাড়িয়ে দিয়ে হুমকি দেয়। বাধ্য হয়ে রোকসানা সাংবাদিকদের শরাণাপন্ন হন। এ নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। জেলা প্রশাসনও জমিটি উদ্ধারে সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

জমি উদ্ধারের যুদ্ধের মধ্যেই সুখবর আসে আফিয়া খাতুন খঞ্জনীর। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল—এর ৩৭তম সভায় খঞ্জনীসহ একাত্তরে নির্যাতনের শিকার ২৪ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরপর নভেম্বর ২০১৬, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার খঞ্জনীসহ ২৪ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে। পরে বছর ২০১৭ সালের মার্চে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধা সনদ বুঝে পান আফিয়া খাতুন খঞ্জনী। বর্তমানে প্রতি মাসে সরকার প্রদত্ত ১০ হাজার টাকা করে ভাত পাচ্ছেন তিনি। ঈদ ও পহেলা বৈশাখে পাচ্ছেন উৎসব বোনাস ভাতা। 

২৭ মার্চ ২০১৭, মুক্তিযোদ্ধা সনদ গ্রহণ করতে এই নিবন্ধের লেখকসহ আফিয়া খাতুন খঞ্জনী ও তাঁর মেয়ে রোকসানা হাজির হন ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। দুপুর ১২টার দিকে মন্ত্রণালয়ের গেজেট শাখার দায়িত্বরত সচিব খঞ্জনীর হাতে সনদ তুলে দেন। এ সময় মায়ের সরকারি স্বীকৃতির সনদ হাতে পেয়ে লেখককে জড়িয়ে ধরে খঞ্জনীর মেয়ে রোকসানা  কেঁদে ওঠেন। কিন্তু নির্বিকার ছিলেন আফিয়া খাতুন খঞ্জনী। মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়ায় বুঝেননি এই সনদের গুরুত্ব। বুঝারও চেষ্টা করেননি। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। চোখেন পানি মুছতে মুছতে রোকসানা বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে আমার হতভাগী মা সব হারিয়েছেন। সমাজ ও আত্মীয়স্বজনরা মাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। পাগল হয়ে রাস্তায়—রেলস্টেশনের ঘুরেছেন। অভাবে-অনাদরে একমাত্রও ভাই মরে গেল। সর্বস্ব হারিয়ে মা যে আজ মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট পেলেন- কিন্তু এর কোনো মর্মই বুঝলেন না। মেয়ে হিসেবে এই আনন্দের দিন এর চেয়ে কষ্টের আর কী থাকতে পারে।’

আফিয়া খাতুন খঞ্জনীকে বর্তমানে মেয়ে রোকসানা এবং রোকসানার স্বামী ও ছেলেমেয়েরা দেখভাল করেন। কিছু দিন আগে স্ট্রোক করেছিলেন খঞ্জনী। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে ফ্রি চিকিৎসা সেবা দিয়ে খানিকটা সুস্থ করে তোলে। তবে একে তো মানসিক ভারসাম্যহীন, এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে বার্ধক্যজনীত নানা রোগ। তাই বলা যায়, খঞ্জনীর জীবনের যুদ্ধ শেষ হয়নি। এখন লড়ছেন শরীরের সঙ্গে। যুদ্ধ তার নিত্যসঙ্গী।

স্বাধীনতার চার দশক পরও একাত্তরে ধর্ষণের শিকার নারীরা ছিলেন সমাজে অবাঞ্চিত। লাঞ্ছনা, ধিক্কার ও তিরস্কারের শিকার হয়ে আসছিলেন তারা। কিন্তু গত কয়েকবছরে বদলে গেছে বীরাঙ্গনাদের নিয়ে বাঙালিদের মনোভাব। বেসরকারিভাবে অনেক সংস্থা-সংগঠন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মার্চ ও ডিসেম্বরে নানাভাবে সম্মাননা দিয়ে আসছেন। সবশেষ বীরাঙ্গনাদের সরকারিভাবে মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে অনেকটা ভেঙ্গে গেছে সমাজে বীরমাতাদের তিরস্কৃত হওয়ার ধারণা। এখন আফিয়া খাতুন খঞ্জনীর মত বীরাঙ্গনা নারীরা সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে লজ্জার নয়, বরং গর্বের।

লেখক : মুক্তিযুদ্ধ গবেষক এবং সাংবাদিক

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
হাসপাতালের বদলে শিশুরা ঘুমাচ্ছে স্বজনের কোলে
হাসপাতালের বদলে শিশুরা ঘুমাচ্ছে স্বজনের কোলে
পারটেক্সের বিপক্ষে হেরে রূপগঞ্জ টাইগার্সের অবনমন
পারটেক্সের বিপক্ষে হেরে রূপগঞ্জ টাইগার্সের অবনমন
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
বিএনপির বিরুদ্ধে কোনও রাজনৈতিক মামলা নেই: প্রধানমন্ত্রী
বিএনপির বিরুদ্ধে কোনও রাজনৈতিক মামলা নেই: প্রধানমন্ত্রী
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!