X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১
শিমুল মাহমুদের প্রিয় মুক্তিযুদ্ধের গল্প

পারভেজ হোসেনের ‘স্তব্ধতার অনুবাদ’

.
১৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৮:০০আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৮:০০

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রচুর কাজ হলেও আড্ডা-আলোচনায় একটি কথা বারবার ওঠে, ‘মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য কই?’ বা ‘ওয়ার এন্ড পিস’-এর মতো উপন্যাস চাই।’ এটা হয়ত পাঠকের উচ্চাশারও দিক। মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য নিয়ে ভাবেন এমন ৫ জন লেখকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা প্রিয় গল্পটির নাম। বিজয়ের দিনে এমন ৫ টি গল্প পুনর্মুদ্রণ করা হলো।

পারভেজ হোসেনের ‘স্তব্ধতার অনুবাদ’ চিতলমারীর মরা বুকে ভাটার টান থাকে না। হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে চ্যাতলা কাদায় খামি আঁটতে আঁটতে অনায়াসে একশোহাতি গাঙ পার হয়ে শিমুলতলীর হাটের দিকে সদাই কিনতে ছোটে মালেক।

এপারে তরমুজখেতে বুড়ো লতার শুকনো পাতার সাথে পীতরঙা পাকা তরমুজের বিচ্ছেদব্যথা কোলে নিয়ে ক্রমাগত শূন্যতায় ফেঁপে ওঠে বাতাস। ধোঁয়ার মতো ধূলিকণা জলহীন খেতের কচি সবুজ ইরি চারার ডগায় স্পর্শ রেখে যায়। গাঙ পার হয়ে আসা মালেকের পায়ে লেপটানো কাদা না শুকালেও ইরি খেতে জলহীনতায় জেগে ওঠা ফাটলের ক্রমবিস্তার দেখে ওর কলজে শুকিয়ে আসে। এ মাসে বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনাই নেই। এদিকে একটিমাত্র শ্যালোমেশিন জোয়ারের পানি টেনে টেনে নেতিয়ে পড়ে। আরও মেশিন বাড়াতে গেলে ধানবেচা পুরো টাকাটাই তেলের দামে চলে যাবে যে!

একমাথা রোদ নিয়ে তরমুজের ভিটায় ঠায় দাঁড়িয়ে মালেকের ক্লান্তি ধরে এল। দু-দুটো মাস মোষের মতো খেটেখুটে ইরি খেতে কেমন তরতাজা গোছাগুলাই না ফলিয়ে তুলল, আর শেষে কিনা পানির আকালে পুড়ে যাবে...!

আলের পথ ছেড়ে রাস্তায় উঠে আকাশছোঁয়া, ছালখসা বুড়ো শিমুলগাছের চ্যাপটা শেকড়ে পায়ের কাদা ছাড়াতে ছাড়াতে হাটে যাবার আমেজটা আবার চাগিয়ে তোলে সে। কিন্তু দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ ধরে নবগ্রামের মাথা ফুঁড়ে একখণ্ড ক্ষুদ্র কালো মেঘের মতো শকুনের পাল উড়ে আসতে দেখে মালেক। উড়তে উড়তে বিস্তৃত চরাঞ্চল পার হয়ে এসে বিরাটাকারে সারা শিমুল ছেয়ে পাখা গুটায়। আর মালেকের তখন মনে হয়, এই ভরদুপুরেও গভীর গোঙানি তুলে চিতলমারীতে যেন সন্ধ্যা আছড়ে পড়ল।

শকুনগুলোর ভয়ার্ত গ্রীবা, ধারালো ঠোঁটের কদর্যতাসমেত থকথকে আকৃতির ইতিউতি ওই সুউচ্চ শিমুলের মিনার থেকে যেভাবে সমগ্র অঞ্চলটাকে প্রদক্ষিণ করছিল, মালেকের গা গুলিয়ে উঠল তাতে। মৃত্যুর মতো হিম হয়ে এল ওর অনুভবের টান টান স্নায়ু—‘কোন আজাব যে নেইমে এল এই ভরদুপুরে, ইয়া আল্লা, মাবুদ! গোটা জীবনে এমন দেহি নাই, এত শকুন, একসাথে!’

মালেকের বুঝি আর হাটে যাওয়া হলো না। এক অকথ্য অনড় রাহু যেন ওকে গ্রাস করছিল। ওপারে দূর গ্রামের বদ্ধ বাতাসে ঘন রোদের মিশ্রণ গলিত তামার মতো চুইয়ে নামছে। আরও গুটিকয় শকুন, যারা পাখা গুটিয়ে টাল সামলে গাছের ডাল আঁকড়াতে পারেনি, তারাও পাক খেতে খেতে এসে দলে ভেড়ে। মৃত্যুমুখী হলুদ পাতা আর দীর্ঘ শকুনপালক মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম মেনে ঘুরতে ঘুরতে একসময় সবুজ ঘাসে লুটায়। আর মালেকের একদম পায়ের কাছে আছড়ে পড়ে ছড়িয়ে যায় পালিয়ে যাওয়া কোনো পাখির বুকের তলার ওমে লালিত নীলচে ডিম। কদিন পরই ফুটে বেরোত এমন বাচ্চার বিজলমাখা শরীর।

মালেকের চোখের ঘোর তখনো কাটেনি। তবু সে ভেজা মনে হাটের দিকে পা রাখল। আর যখন ধেয়ে আসা সন্ধ্যায় আরও কজনার দলে মিশে ধুলোওড়া মেঠোপথ ঠেঙিয়ে সে ঘরমুখী, তখনো তার চেতনাজুড়ে শকুনগ্রীবা, তীক্ষ্ম ঠোঁটের আগায় মড়কের তীব্র বোটকা ঘ্রাণ।

হাটফেরা এতগুলো মানুষের খাপছাড়া যত্তসব প্যাঁচালের হালকা ছলকে তার মন দুলছিল না। সে বরং চালের দাম সেরে বারো আনা বৃদ্ধির গৌরব বুক থেকে নামিয়ে ঘন ঘন ভাবছিল—বড় দুর্দিনে ডাকছে বলে মনে হচ্ছে সবারে। ধানের গোছা মোটা হয়ে উঠলে হবেটা কী, গাঙে পানি নাই, তেলের যা দাম, মেশিনও বাড়ান যাবে না; ওদিকে শকুন পড়িছে।

হাটুরেদের লম্বা দল থেকে লোক ছুটতে ছুটতে যখন তারা তিনজন, ঝাঁকা মাথায় লম্বু রউফ হড়হড়ে গলায় চ্যাঁচাতে থাকে। ওকে থামিয়ে দিয়ে কদম আলী পাঞ্জাবির পকেট হাতড়ে বিড়ি তোলে ঠোঁটে—গঞ্জে যাত্রা বসলি ভাপাপিঠার দোকান দিমুনে। গ্যালোবারে দুশো লাভ আছিল, গান শুনতিও পয়সা লাগেনি।

তুই তো ট্যাহা ছাড়া কিচ্ছু ভাবতে পারিসনি, খালি ট্যাহার গন্ধে নাক উঁচিয়ে থাহিস- একথা বলে রউফ ঢিলে হয়ে আসা লুঙ্গিতে শক্ত করে গিঁট দেয়। পায়ের গোড়ালিতে কাঁটার খোঁচা খাওয়ায় চিনচিনে ব্যথা ক্রমে বেড়েই চলছিল তার। এক পায়ের ওপর গুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আরেক পা থেকে টিপে টিপে খানিকটা রক্ত বের করে নিল সে। ততক্ষণে কদম আর মালেক অনেকটা এগিয়ে কলাঝোপের আড়ালে চলে গেছে, তাই ও বিষয়ে চলন্ত বিতর্কটা ধরার জন্য জোরে জোরে পা চালায় রউফ। তখন চারদিকে ঘোর অন্ধকার মাটি খামচে ধরেছে। দিগন্তজোড়া খোলা মাঠ থেকে পাক খেয়ে উঠে আসা ভারী বাতাস শাঁই শাঁই ঢুকে যাচ্ছে ঘনবসতিগুলোয় আর মেয়েরা আজকের মতো গুছিয়ে নিচ্ছে ঘরগেরস্থালি। শুধু না ফেরা হাটুরেদের বউঝিরা তখনো অপেক্ষা করে; সদাইপাতি এলে তবে চুলোয় আঁচ ধরাবে।

ঘুটঘুটে অন্ধকার নামছে। কাচপোকা আর ব্যাঙের গোঙানি উথলে উঠলে মালেক আর কদম অনেকটা পিছিয়ে পড়া রউফের জন্য দাঁড়ায়। খানিকটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে ও এসে গেলে মালেক বিস্ময়ের সাথে তার দুই সহযাত্রীকে চকিত, নীরক্ত করে তোলে- দেহিছিস, বাড়ি ফিরতে ফিরতে কেমন রাত হলো? মোদের পথ ফুরাচ্ছে না যেন, মনডার মইধ্যে কেমন ভয় ভয় করতিছে, রউফ!

এ সময় কদম আবারও ভাপাপিঠা আর যাত্রার নাচনেওয়ালিদের গল্প তুলতে যাচ্ছিল, কিন্তু মালেকের এহেন আবিষ্কারে সে-ও কেমন বিচলিত কণ্ঠে রউফকে উদ্দেশ করে বিস্ময়ে হতবাক- তাই তো, হেই বেলা থাকতি হাট ছেড়েছি, আর সবে মাত্তোর সোনাকান্দির ঘোপ পেরোলাম!

মুহূর্তে চরাচর তোলপাড় করা ঘন বাতাসের প্রবল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে। যেন একটা শোঁ শোঁ শব্দের সাথে দূরগামী ট্রেনের হুইসেল যেভাবে দিগন্তে মিশে যায়, ঠিক তেমনি আক্রান্ত করে তোলে তিন হাটুরের শ্রবণযন্ত্র। তারা বিহ্বলচিত্তে পরস্পর পরস্পরকে স্পর্শের আয়ত্তে আনে। কিন্তু এতক্ষণে হারিয়ে গেছে সেই শব্দের তরঙ্গরোল, শুধু ঘুটঘুটে অন্ধকার যেন পাশ ফিরে শোয়।

কদম আলি, আবদুর রউফ আর আবু মালেকের পায়ে কুড়োলের কোপ পড়লেও থমকে থাকে না তারা। কুমোরের খুঁড়ে খুঁড়ে মাটি তুলে নেয়া গর্তের দলা-দলা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে কবরের কথা মনে পড়ে মালেকের। মায়ের কবর খুঁড়তে হয়েছিল তাকে, আর কবরের তলায় জল জমেছিল বলে মাটিচাপা লাশ কলার খোলের মতো হেলেদুলে ভাসছিল। মালেকের মনে পড়ে, সে স্বপ্নে দেখেছিল, কবরজুড়ে ঢেউ উঠেছে, লাশ দুলছে এবং এখন সে দেখতে পাচ্ছে, কুমোরের খুঁড়ে তোলা কবরে তার লাশ ভিজে ভিজে ঢোল! যেন ফাটার সময় হয়েছে, দুর্গন্ধে শেয়াল-শকুন ডাকার পাঁয়তারা চলছে। আর মাঝবয়সী রউফ মাথার সাজি রাস্তার ওপর বসিয়ে রেখে পাছার কাপড় তুলে সেই কুমোরখোঁড়া কুয়োয় হাগতে বসেছে। হাটের বাসি-কাঁচা গিলে গিলে পেটের পরিপাকযন্ত্র আপাতত বিকল করে ফেলেছে সে।

কদম একটা মস্ত ঢিল তুলে সেই কুয়োর গভীরে ছুড়ে দিলে এক প্রকট পতনের শব্দে রউফের বেগবান প্রাকৃতিক কর্মটি অকস্মাৎ বাধা পেয়ে খিঁচে থাকে। এই খিঁচুনিতে তার মগজ বিগড়ে যায় মুহূর্তে—তর বউরে চুদি, হালারপো, ঢিলাস ক্যান!

রউফের কণ্ঠস্বরে গুয়ের গন্ধ ছড়িয়ে যায়, কিন্তু কদমের কোনো বিকার নেই তাতে। সে দুষ্টু বালকের মতো শুধু ঢিলায়, হাসে আর ঢিলায়। ওর বউ তুলে গালি দিতে দিতেই রউফের স্মৃতিতে লুটিয়ে পড়ে দুবছর আগের কদমের স্ত্রীর কালো কোমল শরীর। থরথর কম্পন, উছলে ওঠা ঘন নিশ্বাস এবং কষ্টে ও ক্লান্তিতে রক্তের মাখামাখি। অবুঝ গোঁয়ারের মতো বেতবনের ওপারে দু-তিনটে খড়ের গাদার মাঝখানে ফেলে কুমারী মেয়েটাকে ছিঁড়ে ফেলেছিল সে। সেই স্মৃতি বড় সুখের, বড় আনন্দের। কদম যতোই ঢিলাক হাগতে বসে রউফ পুরনো সেই আনন্দে ডুবে ডুবে গাদায় জমা জল নিয়ে উঠে আসে।

কদম এখন একটা বিকারহীন পশুর মতো বিড়ির ধোঁয়ায় ডুবতে চায়, কিন্তু রউফ তাকে বিড়ি না দিয়ে একা একা টানতে থাকে। তার পায়ুর খিঁচুনি এবং শিশ্নের উত্থানজনিত স্নায়বিক চাপ কিছুটা শিথিল হয়েছে বলে এখন কদমকে সে ক্ষমা করতে পারত, কিন্তু সে হাগতে বসেছে আর শালায় কিনা ঢিলাচ্ছে, এই নিয়ে একটা অভিমানমিশ্রিত ক্রোধে রউফ সঙ্গচ্যুত হয়ে পড়ে। মালেকের ব্যাপারটা ভালো ঠেকে না, সে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে—তোরা কী শুরু করিছিস, জোরে পা চালা, কুমোরকান্দার পথঘাট ভালা না, রাতবিরেতে...শ্মশানটাও তো বেশি দূরে নয় রে!

কলজে লাফিয়ে ওঠে কদমের। তার পায়ে বুনো লতা প্যাঁচিয়ে গেছে বলে মনে হয়। আর রউফ তখন নিঃশব্দে হেটে যায়। শ্মশানের কথা উঠতেই তার পোড়খাওয়া ঘা অকস্মাৎ কি খোঁচা খেল?

কুমোরকান্দার ওই শ্মশানেই তো ঘটেছিল ঘটনাটা—এই তো মাস খানেক আগে ধনঞ্জয় শিকদারের পরীর মতো মেয়ে দুটোকে পাক সেনারা টেনে হিচঁড়ে শ্মশানের নির্জনে নিয়ে ফেলে। তারপর দশ-বারোজন মিলে শুধু ভোগই করেনি, বেয়নেটের গুঁতোয় এফোঁড়-ওফোঁড় করে রেখেছিল ওদের! স্তন কেটে ছুড়ে মেরেছিল ওদেরই কুকুর মায়ার মুখে। কিন্তু পেছনে পেছনে ছুটে আসা মায়া দূরে দাঁড়িয়ে শুধু লেজ নাড়ছিল, কুঁইকুঁই করে শ্মশানের মাটি আঁচড়াচ্ছিল তখন। রউফরা এসব দেখেনি, লোকমুখে শুনেছে। শমসের মাঝির নায়ে করে সৈন্যরা ঢুকেছিল এ এলাকায়। একমাত্র শমসেরই এ ঘটনার চাক্ষুস সাক্ষী। তারই বর্ণনায়, মায়ার মাটি আঁচড়ানো আহাজারির সামনে রক্তাক্ত স্তনটুকরো ধুলো মেখে কাদাপিণ্ডের মতো হয়ে এলেও ও যখন ছুঁলো না রাইফেল উঁচিয়ে মায়াকেও খতম করে ওরা; আর ধর্ষণের মহাতৃপ্তি গোঁফে ঝুলিয়ে গঞ্জের দিকে চলে যায়। এরপর এদিকে আর কখনও তারা আসেনি।

ঠান্ডা বাতাসের গায়ে শিশিরের স্পর্শ লাগতেই ঘাস-লতা-পাতায় ভেজাভাব ফুটতে থাকে। শ্মশান থেকে বেরিয়ে গোটাকয় শেয়াল পুবদিকের কুমোরবাড়ির পুকুরঘাটে উঠেছে হয়তো, সেখানে কুকুরের একটানা হল্লা। কিন্তু ওদের মনে হয়, হল্লাটা যেন যোজন যোজন দূরের কোনো ঘটনা। 

ওপথে চোখ তুলে তাকাবারও সাহস হারিয়ে ওরা কেবল ভাবছে, ধলপাড় খালের কোলঘেঁষে পোড়ো শ্মশানটার বুক চিতিয়ে পড়ে থাকার কথা। আর ঠিক তার মধ্যিখানে আকাশ ফুঁড়ে দাঁড়ানো জীর্ণ-শীর্ণ ক্ষয়প্রাপ্ত ঠুঁটো মঠটির কথা, যার চুড়োয় শতসহস্র শেকড় সেঁধিয়ে একটি অশ্বত্থ ডালপালা বিস্তার করে আছে, যেন পাখনা মেলা একটি বিশাল বাজের থাবায় একটি মৃত মোরগের করুণ শরীর।

একসময় ওরা ধলপাড় খালের পুলের ওপর এসে দাঁড়ায়। তলায় প্রবহমান কালো জলের উজ্জ্বলতায় নিজেদের কোনো ছায়া ভাসছে না দেখে যখন, ঠিক তখনই বিশখালীর বুকের ওপর সার্চলাইটের আলো ফেলে জল কেটে কেটে স্টিমার চলে যায়। সেই আলো ঘুরপাক খেতে খেতে  গ্রামের পর গ্রাম ফুঁড়ে এসে ওদেরকে বিশখালীর কথা জানায়। সেখানে প্রচুর ইলিশ, নাও নিয়ে কতবার সেই ইলিশ মেরে এসেছে ওরা। বাড়িতে ইলিশভাজার গন্ধে খিদায় পেট মুচড়িয়ে উঠেছে আর ঠিক ওমনি ইলিশভাজার একদিন তালাক খেয়ে বাপের বাড়ি চলে আসে মালেকের ছোট বোন সালেহা। এসেই এনড্রিন খেয়ে চিরতরে সটকে পড়ে মেয়েটা।

তার কোলে শিশু নেই, সে মাসে মাসে বাপের বাড়ি ঘুরে যাওয়া রোজগেরে বউ নয়, তাই তার শরীওে ছিল অজস্র নীল দাগ। ইলিশভাজা পুড়ে গিয়েছিল সেদিন। মালেকের চোখ ভিজে ওঠে। গলার স্বর আটকে গিয়ে গলগণ্ডের কাছে হামা দিতে থাকে। ঢোঁক গিলে পুলের রেলিংয়ে কোমর ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। বিস্তৃত ধানি জমির ওপর দিয়ে পাখনা মেলে তেড়ে আসা দক্ষিণা বাতাস হিম ছড়িয়ে দিয়ে যেতেই কেমন জ্বরজ্বর লাগে মালেকের—খারাপ বাতাসের আছর লাগলনি গায়ে, এমন একটা গোপন ভাবনায় জড়িয়ে সে তার ভগ্নির আত্মমরণকেন্দ্রিক বেদনার ভার খুইয়ে ফেলে। ভাবে, শরীরডা য্যান পাক খাচ্ছে, গুলাচ্ছে। এরপর সে তার স্মৃতি থেকে একটি সুরা জপে, বুকে ফুঁ দেয় এবং পুল থেকে নেমে সদাইভরা ব্যাগ, গলায় দড়িবাঁধা জিয়ল মাছের লোটাটা নামিয়ে রেখে তুলসী আর ধুতরা ঝোপের গোড়া দীর্ঘ মূত্রপাতে ফেনিয়ে তোলে। আর এই জলত্যাগের সময়টাতে মালেক নিজেকে বারকয়েক উল্টেপাল্টে দেখে।

তার বাবা তখন বেঁচে ছিল। দুর্ধর্ষ জোয়ান সেই চাষির চর দখলের বহুকীর্তি এ অঞ্চলে রূপকথা হয়ে আছে। মালেকের বারবার মনে হতে থাকে, কদমদের কুঁড়ে আগুন দিয়ে ছাইভস্মে পরিণত করেছিল তার বাপ; আর সেই আগুনে ওদের গোয়ালঘরের বলদগুলো বাঁধন ছিঁড়ে পালাতে পারলেও গাভিন গাই দুটো পুড়ে মরেছিল। বাইশ বছরের শত্রুতা বুকে বেঁধে লোকটা যখন মৃত্যুবরণ করল, মালেক তখন সবে জোয়ান। কিন্তু সে বাপের কিছুই পায়নি। মৃত্যুকালে মালেকের হাত চেপে ধরে বাপ বলেছিল, মামুদের স্বভাব পেইয়েছিস, বলবার কিছু নাই, শক্ত হয়ে না দাঁড়ালি ওরা তোকে গ্রামছাড়া করবি।

গ্রাম ছাড়তে হয়নি। সে শত্রুতাও সেরকম আর নেই। কিন্তু কেন যেন বুকের মধ্যে খলবলিয়ে ওঠে। দুবলারচরে আদমের লাশটা যে পড়েছিল, তার তো কোনো সুরাহা হয়নি। কে ফেলেছিল সে লাশ? রক্তে হাপর ওঠে মালেকের। ওসবের সাথে তার তো কোনো যোগসূত্র নেই। না থাক, তবু কদম আর রউফ তো দূরত্বের সূত্রে হলেও খালাতো-মামাতো ভাই; পুরনো শত্রুতার সূত্র ধরে ওরা দুটো মিলে যদি তার গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে ওই খালের কাদায় পুঁতে রাখে চিরকালের জন্য, কাকপক্ষীও টের পাবে না। দৈত্যের মতো কদমের টলটলে রুক্ষ চোখসমেত ভয়ংকর একটা মুখাবয়ব মালেকের সামনে খলখলিয়ে ওঠে। রউফের লিকলিকে হাত দুটো সাঁড়াশির মতো এঁটে বসে তার গলায়। দম আটকে আসে মালেকের, জিব বেরিয়ে পড়ে দুই পাটি দাঁতের ফাঁক গলিয়ে। আর তখনই মুত্রপাতের পর ও উঠতে গেলে অসাবধানতায় পায়ের ঠোকা লেগে শুকনো কলাপাতা দিয়ে মোড়ানো জিয়ল মাছের লোটাটি উল্টে যায়। আর লোটা ওল্টানো জলের ধারায় ধুলো মাখতে মাখতে জ্বরগ্রস্ত বউয়ের জন্য কেনা শিং মাছের বাচ্চারা তুলসীতলার মুতের ফেনায় গিয়ে গড়াগড়ি খায়।

কদম আর রউফ এদিকে ফিরেও তাকায় না। তাদের শিরায় প্রবহমান রক্ত বুঝি দই হয়ে গেছে। কেননা রাত তখন কত, তারা বুঝে উঠতে পারে না। এবং পূর্ব দিকে খাঁ খাঁ জমিন পেরিয়ে গাছপালায় মুদ্রিত যে গ্রাম, তার অন্ধকার অবয়ব ফুঁড়ে এক অদ্ভুত আলোর বিন্যাস ক্রমশই পুরো প্রকৃতির ওপর রং চড়াতে থাকে। একসময় শিকদারবাড়ির বুড়ো তালগাছ আর বাঁশঝাড়ের সর্বোচ্চ মাথা ছাড়িয়ে আগুন থেকে তুলে আনা লোহার বলের মতো দ্বিতীয় পক্ষের একখানা চাঁদ যখন উঁকি দেয়, তখন তারা কিছুটা আশ্বস্ত হয়। বুঝতে পারে রাত কদ্দুর গড়িয়েছে। কিন্তু বুঝতে পারার নতুন যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না কারও।

—পা চালিয়ে চল রে মালেক, আমার বাপের তামাক ফুরিয়েছে, বুড়োটার চেঁচানিতে বাড়িত আগুন ধইরে যাবে।

—তোর ভাবিরও যে আবার জ্বর বাড়তি দেখি এলাম, আমার তো মনে হয় কোনো সর্বনাশে ধরিছে রে, আসবার পথে যা দেখলাম, তা তো কলাম না।

—কী দেখিছিস?

রউফের চোখ-মুখের চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে ভয়ার্ত বিস্ময় গলগলিয়ে নামে। কদমও ব্যাপারটা জানতে চায়, কিন্তু কী শুনতে কী শুনবে সেই দ্বিধায় আক্রান্ত হয়ে কিছুটা যেন থিতু হয়ে থাকে সে, তবু আগ্রহ দমন সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই মালেক ইশারায় রউফ আর কদমকে ডাকে, ওই তেমাথার টিলাটায় বসি চল, আমার আর হাঁটতি জোর হচ্ছে না; একটু জিরিয়ে লই।

তারা তিনজন এই পথযাত্রায় প্রথমবারের মতন পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা নিয়ে মুখোমুখি বসল এবং দেশলাইয়ের একটি কাঠি ঠুকে তিনটি বিড়ি ধরিয়ে নিয়ে নিজেদের মধ্যে গভীর সৌহার্দ্যরে সৌজন্যটুকু উপস্থাপন করে চুপ মেরে রইল।

চিতলমারীতে এখন তিরতিরিয়ে জোয়ারের কুরোমাখা জল এসেছে। সারা দিনের রোদক্লান্ত ঘাসেদের গায়ে জমে উঠেছে শিশিরের জল। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই—কাচপোকা, ব্যাঙ, ডালপালা কাঁপানো হু হু দক্ষিণা বাতাসের টানা হুল্লোড়টুকু ছাড়া। আর এদিকে তিনজনের বিশৃঙ্খল বিড়ি টানার ফলে দূর থেকে দেখলে অনড় স্থিরতায় তিনটি জোনাকি পোকার নৈঃশব্দ্যিক আলাপচারিতার কথাই মনে হয়। গাঢ় চাঁদ ফ্যাকাশে আলো ফেলে এই ভূতভূতে পরিবেশটায় যে পরিবর্তন রচনা করেছে, তাতে এই বিড়ির ধোঁয়ায় বুঁদ তিনটি মানুষের মধ্যে একমাত্র মালেকই ঈশ্বরের অপার রহস্যের কথা স্মরণ করে কেঁদে উঠল।

—জীবনডা পাপে পাপে ছেয়ে গেছে রে...কত পাপ করিছি, নইলে পোয়াতি বউডা জ্বরে মরতি বসিছে যখন, তখন কিনা শকুনের পাল দেখলাম! সোনার ধানে পানির আকাল লাগল। দেশ জুইড়া মিলিটারি হামলাইয়া পড়ল। আর দ্যাখ, এই যে বাড়িত ফিরমু, ক্যামনে ফিরমু, আমরা কি জানি কিছু, ক? মোদেরে পাপের ছোঁয়ায় ধরিছে নিশ্চিত!

মালেকের চোখের কোনায় নোনতা জলের ফোঁটা ভেসে উঠে গড়াতে চায় আর কদম বিলাপের সুরে তার দাদার কীর্তিবর্ণনে তৎপর হয়ে ওঠে।

—জানিস নে? জানিস তো তোরা, মোর দাদাজান, বিলের দেশ থেইকে ধান কাটি আর বাড়িত ফিরতি পারলি না। তারা পাঁচজন সাত দিন সাত রাত শুধু বাড়ির পথে নাও বাইতে বাইতে বিশখালী আইসে তবে পথ পেল। তত দিনে ওলাবিবির কামড় খেইয়ে তুষ-পোড়া জ্বরে তারা অচেতন। বিষ্ণুদার বাপ নদুগোপাল নদীর মইদ্দে ওলাবিবির পুজো দিলে, দাদায় শিন্নি রেঁইধে থালা ভরি গাঙে ভাসালে, কিন্তু কাজ কী হলো? পাঁচজনই বাড়িত আইসে তিন দিনের মাথায় কবর নিল। আর গ্রামকে গ্রাম গুটিবসন্তের ডরে ফাঁকা হইয়ে গেল। শুনিছি তিন-চারশো মানুষ মরিছে তাতে।

‘তিন-চারশো মানুষের মৃত্যু’ কথাটার মধ্যে যে ব্যাপকতা এবং গভীর বেদনা লুকিয়ে ছিল, তা যেন ঢেকে দিল ওদের মুখ। কদমের এমনিতেই গল্প বলার একটা খ্যাতি আছে- পুরো পরিবেশটাকে নিজ আয়ত্তে রেখে সে ওলাবিবির ঐতিহাসিক নিষ্ঠুরতার কথা বলে চলে এবং মালেকের শকুনদর্শনের ভয়ার্ততার কাহিনি বিস্মৃত হয়ে তারা তাদের পূর্বপুরুষের সর্বনাশের ইতিহাসের মুখোমুখি বোবা দৃষ্টি নিয়ে ন্যুব্জ হয়ে পড়ে। পূর্ণমুদ্রণ

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া