X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০
হামীম কামরুল হকের প্রিয় মুক্তিযুদ্ধের গল্প

আবুবকর সিদ্দিকের ‘জাল যোদ্ধা’

.
১৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৯:০০আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৯:০০

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রচুর কাজ হলেও আড্ডা-আলোচনায় একটি কথা বারবার ওঠে, ‘মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য কই?’ বা ‘ওয়ার এন্ড পিস’-এর মতো উপন্যাস চাই।’ এটা হয়ত পাঠকের উচ্চাশারও দিক। মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য নিয়ে ভাবেন এমন ৫ জন লেখকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা প্রিয় গল্পটির নাম। বিজয়ের দিনে এমন ৫ টি গল্প পুনর্মুদ্রণ করা হলো।

আবুবকর সিদ্দিকের ‘জাল যোদ্ধা’ সারাদিন দমসাঁটা খাটুনি। ঘাম। ক্লান্তি। সেই কোথায় সাভার, কোথায় মহম্মদপুর— সকাল-বিকেল নিজের রকি জিপ নিয়ে ইঁদুরদৌড়। কারখানার গোড়াপত্তনের বেলায় এই প্রাথমিক স্টেজের পরিশ্রম ও টেনশন, যাকে বলে একেবারে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। এ ছাড়াও স্রেফ টিকে থাকার জন্যেই রয়েছে কত না ভদ্রগোছের ধান্ধাবাজি।

ইঁদুর নয়। দিবালোকের হাসান মওলাকে দেখে মনে হয় একটা শ্যামলা খরগোশ। দৌড় নয়। লাফে লাফে পার হয়ে যাচ্ছে বাধাসংকুল আরণ্যক ধাপগুলো।

আর সন্ধে হতেই শুরু হয়ে যায় এক অন্যরকম জীবন। বলতে গেলে সম্পূর্ণ নিজস্ব এক ব্যক্তিগত জীবন। এত নিঃসঙ্গ এত সংরক্ষিত (বরং সুরক্ষিত বললে আরো সত্যের কাছাকাছি হয়) যে, স্ত্রী-পুত্র-বান্ধব, কারুর সাধারণভাবে অধিকার নেই এই সন্ধে থেকে রাতের খাওয়া শুরুর আগের প্রহরটুকু। বিশেষ করে গরমের এই পোড়ানো দিনগুলোতে। বাথরুমে ঢুকে তারিয়ে তারিয়ে চান করে। সাবানের ফেনা মেখে দাঁড়িয়ে থাকে আয়নার সামনে। কোনোদিন বা আপন অজান্তে মুঠোর মধ্যে আলতো বন্দি থাকে প্যাতপেতে শিশ্ন। নিজের ভুঁড়ির দিকে নজর পড়তে খেয়াল হয়, সম্প্রতি কর্তাগিন্নি দুজনেরই নাদাপেট। যার দরুন দাম্পত্য মিলনে একটা মন্দা এসে যাচ্ছে দিনকে দিন। কোনো সন্ধ্যায় বা আয়নায় তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের প্রথম যৌবনের কচি মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে। বাতাসে ভাসন্ত বকুলগোড়ের মতো কোনো সতীর্থা রাজনৈতিক সঙ্গিনীর মুখও বা অস্পষ্ট উদ্ভাসিত হয় বেলজিয়াম গ্লাসে। অবচেতনের মওলা সেদিন ফেলে আসা গানের দু-এক কলি গুনগুন করে ভাজে : ‘মিলতে হিঁ আঁখে দিল হুয়া দিওয়ানা কিসিকা/আফসানা মে বন গ্যায়া আফসানা কিসিকা।’

ঘাড়েগর্দানে পাউডার...আদ্দির সাদা পাঞ্জাবি...তার উপর জেসমিন পারফিউমের স্প্রে এবং পেগখানেক হইস্কি—ঢুকু ঢুকু...ব্যাস, তারপর নিচে নেমে এসে ড্রয়িংরুমের পাশেই যে পকেটকামরাটুকু, সেখানে খুলে পড়া দরজায় ছিটকিনি। রাত সাড়ে নটা-দশটার আগে আর খোলাখুলির নাম নেই।

মওলা স্মৃতিকথা লিখেছে। তার নাটকীয় রাজনৈতিক জীবনের বিচিত্র সব ঘটনাপু; পঞ্জিও বলা যায়। বিশেষ করে, ফ্রিডমফাইটার মওলার গৌরবোজ্জ্বল অভিজ্ঞতার সেই দিনগুলোর কথা।

উপরে সাজানো গোছানো পার্সোনাল স্টাডিরুম। সব ফেলে দিয়ে নিচের এই পিঁজরাপোলে এসে আস্তানা নিতে হয়েছে। ওখানে স্বস্তি নেই। টিভি চলে গাঁ গাঁ করে। মনিরার পাসটাইম। সেইসঙ্গে কাজের মেয়ে ভুনুর আদেখলেপনা।

ফুরফুর করে চুল ওড়ে টেবিলফ্যানের মোলায়েম হাওয়ায়। কলমের তলায় কাগজের কোনাও উড়াল দেয়। মওলার পাইলট পেন ডানা মেলে উড়ে চলে সাদা কাগজের উপর দিয়ে। কলম তো ভেসে বা উড়ে চলতে পারে না। তার একটা দায়-দায়িত্ববোধ আছে। তাকে বাস্তবতার ঘাঁতঘোঁত মেনে চলতে হয়। প্রায় দু দশক আগে যে ভয়ংকর যুদ্ধকাণ্ডটা ঘটে গেছে, তার সব পার্টস্টার্টসগুলো ঠিক ঠিক রিকন্ডিশন করে নিয়ে এতদিন পর আবার এখন এই সাদা কাগজের উপর দিয়ে স্টার্ট করানো কম রিসকের ব্যাপার নয়। কখনো কল্পনা কখনো ইগো কখনো বা অপরিমিতি এসে হানা দিয়ে যায়। কত হিসেব করে পা মেপে চলতে হয়। কোনো প্রসঙ্গ খুলে-মেলে, কোনো প্রসঙ্গ ঠারেঠোরে...এ ভাবেই লিখে যেতে হয।

“কলমি দীদার একজন কুখ্যাত জোতদার। ভূমিদাস ও ভূমিহীন কৃষকদের শোষণ করে করে সে শুয়োরের মতো ফুলে উঠেছে। এই শ্রেণীশত্রুটির রক্তে হাত রাঙিয়ে আমরা আজ সর্বহারাদের বিজয়ের পথ আরো এক ধাপ এগিয়ে নিতে পারলাম। আশা করা যাচ্ছে, অত্র এলাকায় অচিরেই পার্টির লাল ঝাণ্ডা ... ... ...”

‘লাল ঝাণ্ডা’ কথাটা কেটে ‘জয় বাংলার নিশান’ বসিয়ে দেয় মওলা। লিখতে লিখতে কলম থামিয়ে কিছুটা সময় হাত গুটিয়ে বসে থাকে। এ রকমটাই ধাত হয়ে দাঁড়াচ্ছে এই ধরনের কাটাকুটির প্রান্তে এসে। যদিও এসব কাটাকুটি শ্রেণীশত্রুর গলাকাটার তুল্য মেহনতের কাজ নয়। তবু কাটতে তো হয়। ক্লান্তি ধরে যায় শেষটায়। আর এই করেই লেখাটা আর এগোতে পারে না সে রাতে। এমন একটা গ্যাঁড়াকলে আটকে যেতে হয়-না হাসান মওলাকে!

বাইরের আকাশে মোষের মতো হোঁক্কা দিচ্ছে কালবোশেখির মেঘ। যে কোনো মুহূর্তে ঘাড়ঝাড়া দিয়ে উঠবে। টেবিলফ্যানও গোঁ গোঁ গোঁজাচ্ছে। মওলা একটু উঠবে। বাথরুম পেয়ে গেছে বেশ আগে থেকেই। ঝিঁঝি ধরা পায়ে কিছুতে চপ্পল ঢুকছে না। বাঁ পাখানা উরু থেকে পাতা অব্দি কাঠের খুঁটির মতো। নাড়ানো যাচ্ছে না। ধুত্তোরি! মওলা জোরে চিমটি কাটে হাঁটুতে।

আর তখন, এই রকম অচলাবস্থায়, কলিংবেল বেজে চলেছে বাইরে। ঝড়ের মধ্যে ছুটন্ত ট্রেনের সিটির মতো টানা তীক্ষ্ণ ভৌতিক।

নেপথ্যে ড্রইংরুমের দরজা খুলে দেবার শব্দ হয়। কে এল এই ঝড়ো রাতে এমন অসময়ে? শাহীন যে এই দুর্যোগে আসবে না, সে তো জানা কথা। ছেলেটা সারাদিন বনের মোষ তাড়িয়ে ঘরে ফেরে রাত এগারটা-বারটার কাছাকাছি। তবে যে বান্দাই এসে থাকুক না কেন, সে যে একটা আস্ত উৎপাত, তাতে তো সন্দেহ নেই।

হ্যাঁ, এবারে এই পকেটকামরার দরজায় খুটখুট শব্দ। আঃ! কে ডাকে? আচ্ছা বেকুব বটে! শেষকালে এ ঘরেও হামলা! এমন করলে কী করে এগোবে লেখা। এ বাড়ির যদি কারো কোনো অ্যাকাডেমিক সেন্স্ থাকে তবে,—তুমি শালা হোর ডে খেটে মরছ শালার ব্যাটাদের ঠাটবাট বজায় রাখার জন্যে আর তোমার এই রাতের দামি সময়টুকুকে সামাল দেবার জন্যে কোনো শালী যে ওই টিভি সেট রেখে এদিকে একটুখানি...

মওলা দরজা খুলে দিতেই চাকর নসু মুখ বাড়িয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে তেড়ে যায় মওলা, ‘কী হল কী আঁ? জ্বালাচ্ছিস কেন আঁ? আর সব কোথায় মরেছে?’

‘জি, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।’

দ্যাখা করতে চান্—দ্যাখা করতে চান—কে চান—কে চায়? কোত্থেকে এসেছে?

নাম বলেন নি। কেবল বলছেন এখুনি ডেকে দিতে হবে। জরুরি দরকার।

‘এঃ—ভারি লাটসায়েব এসেছেন! আচ্ছা তুই যা। জলদি চা-বিস্কুট নিয়ে আয়। ঝটপট বিদেয় কর।’

‘জি, ব্রিফকেস আছে হাতে। সহজে নড়বে মনে হয় না।’

‘আরে থোঃ! শালার ল্যাখার সময় যত ডিস্টার্বেন্স!’

‘কেএ—এ—কী দরকার আমার সঙ্গে অ্যাঁ আ—’ বলতে বলতে ড্রইংরুমের পরদা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়ে মওলা। সোফাসেটজুড়ে জাবড়ি মেরে বসে অথবা আধাশুয়ে ছিল লোকটা। তাড়াতাড়ি করে উঠে পড়ে। আদাব দেয় হাত তুলে।

ছিরি ছুরত দেখে স্বভাবতই চাখ কুঁচকে যায় মওলার। ‘উম্ম্, নট সো সিগনিফিক্যান্ট-নট সো ইম্পর্ট্যান্ট!’

‘ওঃ বসুন। কোথাত্থেকে আসছেন?’

অদ্ভুত অনাবিল একটা হাসি উপহার ছাড়ে লোকটা। ‘আমার নাম আবু নওশাদ। অগ্রিম গ্রুপ অব পাবলিকেশনস থেকে এসেছি। আসলে ফোন করে আসাই উচিত ছিল।’

‘কী ব্যাপার, মানে আমি তো ঠিক ইয়ে—’

‘না না—ব্যস্ত হবেন না আপনি। মাত্র মিনিটদশেক সময় স্পেয়ার করেন যদি, আপনার একটা ইন্টারভিউ নিতে, এই মানে সামনে স্বাধীনতা দিবস তো, আমাদের সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘অগ্রিম’ স্পেশ্যাল নাম্বার বের করতে যাচ্ছে, তো আপনি তো সেভেন্টি ওয়ানে ভেটার‌্যান ফ্রিডমফাইটার ছিলেন, আপনার মূল্যবান অভিজ্ঞতার একটা ন্যারেশন আমরা এ সংখ্যাটিতে ছাপতে চাই।’

আহা! ছবি পালটে যায় একলহমায়। হায়! পাশের ঘরে পাইলট পেন প্রতীক্ষামুখর। সাদা কাগজ বিরহব্যাকুল। সব ভুলে যায় মওলা। ভেতরের দরজার দিকে তাকিয়ে বাঘের মতো হাঁক পাড়ে, ‘অ্যা-য় নোসু, শিগ্গির নাশতা নিয়া আয়।’

কিন্তু ‘অগ্রিমে’র প্রতিনিধি প্রত্যাখ্যান করে নাশতার প্রস্তাব। অবশ্যই সহবতের সঙ্গে। ‘জি, পেট খারাপ যাচ্ছে তো! আরেকদিন এসে সুদে-আসলে নিশ্চয়ই—আলসারের রোগী তো—তাহলে শুরু করা যাক কী বলেন? আকাশের যা অবস্থা!’ বলতে বলতে ব্রিফকেস খুলে একটা মিনি ক্যামেরা ও একটা মিনি টেপরেকর্ডার বের করে ফেলে আবু নওশাদ নামের লোকটা।

হাসান মওলা মাথার চুল কায়দা করে নেয় আন্দাজে হাতে থাবড়ে। তারপর গলার নিচের বোতাম লাগিয়ে বেশ গরুচোরের মতো গ্যাঁট হয়ে বসে থাকে।

আবু নওশাদ একটা নরম ঠোনা মেরে মওলার চিবুক পজিশনে নিয়ে আসে।

ফ্লিক!...ফ্ল্যাশভাল্বের ঝিলিক।

‘থ্যাংক্স!’

গরুচোরাই গাম্ভীর্য অটুট রেখে মওলা শুরু করে : ‘মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জীবনে জাতীয় যুদ্ধ। এতে পার্টিসিপেট করাটাও ছিল আমাদের জাতীয় কর্তব্য।’

‘জাতীয়’ শব্দটাকে চাতুর্যের সঙ্গে পালটা ব্যবহার করে আবু নওশাদ, ‘সিওর,—সে দিক দিয়ে এই ইন্টারভিউতে পার্টিসিপেট করাও একটা জাতীয় দায়িত্ব পালন করা, কী বলেন?’

মওলা তার ইস্পাতগাম্ভীর্য ধরে রেখেই চালাতে থাকে : ‘আমি অবশ্য আরো একটা লাস্টিং মেথডে এই জাতীয় দায়িত্বটা পালনের চেষ্টা করে যাচ্ছি। এখন সেইটে নিয়েই—’

‘ইজ ইট? মোস্ট ইন্টারেস্টি!’

‘হ্যাঁ নওশাদ সাহেব। আমি আমার মেমর্য়াস্ লেখায় হাত দিয়েছি। অ্যান্ড ইউ উড বি কমপ্লিটলি বেজড অন মাই সেভেন্টি ওয়ান-এক্সপিরিয়েন্সেজ। ফুল অব ভ্যালুয়েব্ল্ ফ্যাক্টস্ অ্যান্ড ডকুমেন্টস্।’

‘তাহলে তো বেশ মেজর কাজে ইনভলভড এখন আপনি।’

‘মেজর না মাইনর সে তো আপনারাই বলবেন। তবে আমি পার্সোন্যালি এ ব্যাপারে অনেকদিন থেকে একটা মর‌্যাল কমিটমেন্ট ফিল করে আসছি।’

‘এটা আপনার দেশপ্রেমের নিদর্শন বলে ধরে নেবে জাতি।’

গলায় শৌখিন উদাসীনতা এনে জবাব দেয় মওলা, ‘হতে পারে...তবে তার আগে লেখাটা কমপ্লিট হবার দরর্কা’

প্রায় তালে তালে পাদপূরণ করে আবু নওশাদ, ‘লেখা কমপ্লিট হবার পর বই আকারে পাব্লিশ হবার দরকার।’

‘দেখা যাক।’

‘দেখা যাক না। আপনি কনসেন্ট দিন। আমরা লেখাটা প্রথমে ধারাবাহিকভাবে সাপ্তাহিক ‘অগ্রিমে’ ছাপব। তারপর আমরাই বই আকারে বের করার দায়িত্ব নেব। রীতিমতো স্ট্যাম্পে সই করে চুক্তিপত্র হবে।’

‘আচ্ছা আচ্ছা—সে হবে’খন। শেষ করতে দিন তো আগে।’

‘বেশ তাহলে কাজের কথায় চলে আসি। প্রথমে আপনাদের পার্টির কথা কিছু বলুন। আপনাদের তো লেফ্ট্ওরিয়েন্টেড পার্টি ছিল?’

‘হ্যাঁ। আমরা কমিউনিস্ট পার্টি থেকে যুদ্ধ করি।’

‘কোন কমিউনিস্ট পার্টি? মানে পার্টি তো তখন সংখ্যায় বহু এবং বহুধাবিভক্ত।’

‘আমরা হক-তোয়াহার পার্টি-ব্যানারে কাজ করি।’

‘অর্থাৎ ১৯৬৭তে সিলেটের চা বাগানে অনুষ্ঠিত গোপন কংগ্রেসে যে পার্টির জন্ম হয়?’

‘হ্যাঁ, ইসিসিপি। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এম. এল.)।’

‘তা, এই পার্টি তো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের একটু ভিন্নতর মূল্যায়ন করে, তাই না?’

‘পার্টলি।’

‘পার্টলি নয়। পুরোপুরিই। আপনারা মুক্তিযুদ্ধকে বলেছিলেন ‘দুই কুকুরের কামড়াকামড়ি’। ঠিক তো?’

‘ওটা একটা প্রাইমারি অ্যাসেসমেন্ট ছিল। ছেড়ে দিন।’

‘ছাড়ছি। তবে তার আগে কুকুর দুটোর পরিচয় যদি একটুখানি দিতেন দয়া করেÑ’

‘কুকুর দুটো হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের ধনী শোষক ও পশ্চিম পাকিস্তানের ধনী শোষক। আরে সায়েব, রাখুন তো এসব। কবেকার কী ছাই! সব মনে আছে নাকি? আরে, এসেছেন তো আমার সাক্ষাৎকার নিতে।’

‘তাই তো নিচ্ছি। এই সামান্য দু-চারটে প্রশ্ন আপনার টোট্যাল পার্সোন্যালিটির মুখবন্ধ করতে পারেন। এরও গুরুত্ব আছে। আব্দুল হক মুক্তিযুদ্ধকে সা¤্রাজ্যবাদী চক্রান্তের শিকার বলেছিলেন মনে আছে?’

এবারে একটু তাপ প্রকাশ পায় মওলার গলায়, ‘ সে তো মতিন-আলাউদ্দিনরাও বলেছে, বাংলাদেশ রুশ-ভারতের ষড়যন্ত্রের ফসল।’

আবু নওশাদের ঠোঁটে পাতলা সরের মতো এক পরদা হাসি খেলে আবার মিলিয়ে যায়। তার গলার স্বরটা খোনা খনখনে কিন্তু উচ্চারণের প্রক্রিয়া বড় মর্মভেদী। কী তার শেষ মতলব কে জানে? তবে এটুকু বোঝা যায়, সইয়ে সইয়ে ঘাতসহ করে আনতে চাইছে তার সাক্ষাৎদাতাটিকে। হুইল-বড়শির মাছ নিয়ে যে খেলা চলে।

‘হক- তোয়াহা আর মতিন-আলাউদ্দিন টাকার এপিঠ-ওপিঠ। আবার, তাদের সীমান্তপারের নকশালী গুরুদের অ্যাসেসমেন্টও প্রায় কাছাকাছি; কাছাকাছি কেন একইরকম ছিল। ওই সময়ে সিপিআই (এম.এল.) হাওড়া জেলা কমিটি দ্বারা প্রকাশিত দেশব্রতীতে লেখা হয়, দালাল মুজিব চক্রকে শিখণ্ডী খাড়া করে মার্কিন-সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদী জোট ভারত সরকারকে দিয়ে এই যুদ্ধ চালাচ্ছে। লেখাটা সম্ভবত সরোজ দত্তের, তাই না?’

কিছুটা ধৈর্যচ্যুতি ঘটার উপক্রম দেখা দেয় মওলার চোখেমুখে। খানিকটা ঝাঁঝ নিয়ে বলে, ‘আরে কিসের মধ্যে কী, পান্তা ভাতে ঘি! মহাফ্যাসাদ! এতকাল পর এইসব রিমোট কুতক্কো খুঁচিয়ে তুলে লাভ! আপনি এসেছেন তো আমার স্মৃতিকথা রেকর্ড করতে। তাই তো?’

এখন সরাসরি নাম ধরে সম্বোধন করে সাংবাদিকটি। বয়েসে অবশ্য এরা দুজনে প্রায় সমান সমান হবে।

‘দেখুন হাসান মওলা সাহেব, ইন্টারভিউ মানে কিন্তু শুধুই ভমিটিং ইভেন্টস নয়। আপনার ভিউজ অ্যান্ড ভিশন্স্ও সমান গুরুত্বপূর্ণ। অমোঘ সত্যটি কোথায়? যে কোনো সৎ সাক্ষাৎকারের সেইটেই তো আখেরি নিশানা। আমি বলতে চাই, আপনাদের ব্ল্যাংকিবাদী ভূমিকার জন্যে বাংলাদেশকে আজ কঠিন মূল্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। কট্টর মৌলবাদী মওলানা সিদ্দিক আহমেদও যখন সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বলেন, বাংলাদেশ বিদেশি ষড়যন্ত্রের ফল, তখন কি প্রতিধ্বনি ও মূলধ্বনি বড় গায়ে গায়ে শোনায় না? তোয়াহা সাহেবের পার্টিপেপার সাপ্তাহিক ‘গণশক্তি’ ১৯৭১-এ লেখে : রাজাকাররা দেশপ্রেমিক। শেখ সাহেব স্বাধীনতার পর পর রাজাকার-আলবদর-আলশামস-জামাতি-মৌলবাদী থেকে শুরু করে তাবৎ বাংলাদেশবিরোধীদের গণক্ষমার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে জায়েজ করে দিলেন। তারই পরিণামসুবাদে দেখা যায়, একই ক্যাবিনেটের আসন অলংকৃত করেছেন বাঁয়ে মার্কস্বাদী কমিউনিস্ট, ডাইনে রাজাকার মওলানা মান্নান। পাসপোর্টবিহীন গোলাম আযমকে বহিষ্কারের সাধ্য হয় না সার্বভৌম সরকারের। এমন কি, একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারেরও। আর অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, নব্বইয়ের উপজেলা নির্বাচনে জামাতে ইসলাম বেশ কিছুসংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ সিট দখল করে নেয়। চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে প্রথম স্বাধীনতার ঘোণা দিয়েছিলেন যে মেজর জিয়া, তারই বিএনপি পার্টি সরকার গঠন করে জামাতের সমর্থন নিয়ে। আর ইলেকশনের সময় বঙ্গবন্ধুর পার্টি আওয়ামী লীগ থেকে নেতা যান গোলাম আযমের দোয়া চাইতে। আর এখন দেখুন মাদারী-কা-খেল। সরকারকে হটানোর ন্দোলনে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ মাঠে নেমেছে ডাইনে মৌলবাদী জামাতী ইসলাম ও বাঁয়ে স্বৈরাচারী জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে। বাংলাদেশ কি আবার ফিরে যাচ্ছ কালো গুহায়?’

এই দীর্ঘ যুক্তিজাল মওলাকে বেশ কিছুক্ষণের জন্যে হতবাক করে রাখে। ফোঁস করে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলে, ‘হকরা কিন্তু বাংলাদেশকে মেনে নিয়েছেন শেষটায়।’

‘হায়! তার আগে অর্থাৎ স্বাধীনতার পরেও ছ’ ছয়টি বছর পর্যন্ত তারা বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নিতে পারেন নি।’

আবু নওশাদকে আর এগিয়ে যেতে দিতে চায় না মওলা। কিছুটা সমন্বয়ী সুরে বলল, ‘জানেনই তো, একটা দুর্বলতা আমাদের গোড়া থেকেই কাবু করে রেখেছিল। এদেশের চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিগুলো একাত্তরের যুদ্ধে একজোট হয়ে কাজ করতে পারে নি। ১৯৭১-এর পয়লা জুন মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে কলকাতার বুকে ১১-দলের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম কমিটি’ গঠিত হয়। কিন্তু এই কমিটি নামে টিকলেও কামে তেমন এগোতে পারে নি। বিশেষ করে, মওলানা ভাসানীর প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত থাকাটা আমাদের জন্যে বিরাট ক্ষতির কারণ হয়। গোটা মুক্তিযুদ্ধ আমলে তাকে কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের কোহিনূর প্যালেস থেকে আরম্ভ করে আসামের গৌরীপুর স্টেট, হিমালয়ের পাদদেশ ইত্যাদি নানা জায়গায় বিচ্ছিন্ন এক অবরুদ্ধ অতিথির মতো বাস করতে হয় ভারতে।’

মওলার কথা শেষ হবার জন্যে অপেক্ষা করছিল আবু নওশাদ। এবার পাল্টা আঘাত করে, ‘যদি বলি, আপনারা নিজেরাই নিজেদের সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতি করেছেন চারু মজুমদারের খতম লাইনের আমদানি করে?’

মওলা মাথা ঝুঁকিয়ে সায় দেয়। তারপর টেনে টেনে বলতে থাকে, ‘ওটা তো এতদিনে একটা ওল্ড ফ্যাক্ট। খুলনার কমরেড নজরুল ইসলাম পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে চারু মজুমদারের সঙ্গে দেখা করেন ও ফিরে এসে পার্টিতে খতম লাইন আমদানি করেন।’

‘হু, ঠিক কোন সময়ে পার্টিতে এই লাইনটি রণনীতি হিসেবে গৃহীত হয়, মনে পড়ে?’

‘১৯৭১-এর জানুয়ারির দিকে হবে। এই নকশালী লাইনেরই প্রভাবে পার্টি সেভেন্টি ওয়ানের যুদ্ধে শ্রেণীসংগ্রামকে প্রাধান্য দেয়।’

‘উহুঁ! বরং ঠিকভাবে বললে কথাটা দাঁড়ায়, শ্রেণীসংগ্রামকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে পার্টি জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের গুরুত্ব প্রকটভাবে উপেক্ষা করে।’

কিন্তু আত্মসান্ত্বনা নিয়ে মওলা বলে, ‘বলতে পারেন। তবে ১৯৭৫-এর অবশ্য পার্টি চারু মজুমদারের খতম লাইন বর্জন করে।’

চাপা শ্লেষ নিয়ে যোগ করে আবু নওশাদ, ‘হ্যাঁ, কয়েক হাজার টাটকা যুবকের বিভ্রান্তি-হতাশা ঘটিয়ে, শত শত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে, কিছু শিক্ষিত তরুণকে নরঘাতকের ভূমিকায় প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের দাঁড়াটি ভেঙে দিয়ে তবে তারা হুঁশ ফিরে পান।’

মওলা কিছুটা যেন আত্মবিহ্বল হয়ে পড়েছিল। একজন উটকো আগন্তুক বাড়ি বয়ে এসে সাক্ষাৎকার নেবার ছলে তার নিজের এবং তারই মতাদর্শপুষ্ট পার্টিগুলোর ব্যর্থতার খতিয়ান কব্লিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এটা কী অদ্ভুত অবিশ্বাস্য কাণ্ড! চলমান টেপের দিকে তাকিয়ে মনকে চোখ ঠারে সে। সতর্ক হও। মুখ সামাল দাও। তোমারই তো বাড়ি এটা। তেমন বেজুত ঠেকলে অফ করে দেবে টেপ। ডাণ্ডা মেরে। চুরমার করে ফেলবে ক্যামেরা। ঘাড়ধাককআ দিয়ে বের করে দেবে ব্যাটাকে। কে ওটা? কী চায়? কাদের এজেন্ট ওর এই অগ্রিম গ্রুপ? সিআইএ? কেজিবি? র’? এখন কেন এরা এসে ঘেরে তাকে জীবনের ঠিক ভরাভোগের মুখে? এই বেলাটিতে, যখন একজন সুহৃদ মিনিস্টারের কাছ থেকে একটি গ্রিন সিগন্যাল আসার প্রতীক্ষায় লবেজান প্রতিটি দিনের প্রতিটি প্রহর।

আবু নওশাদের  শেষ নালিশটা বাস্তবিক খেপিয়ে দেয় মওলাকে। কড়া গলায় প্রতিবাদ তোলে। ‘আপনি সব পার্টির দায় আমাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন কেন? মস্কোপন্থীরা তো সেই শুরু থেকেই সম্পূর্ণ সেপারেট স্ট্রাটেজি নিয়ে চলতে থাকে। আর আমরা যারা তখন পিকিংপন্থী ছিলাম, তাদের সবাইকে এই ডে ঢালাওভাবে নকশালাইট বলা হয়, এটা কিন্তু আদতেই সত্যের অপলাপ। বিশেষ করে, একদিকে দেবেন-বাশার, অন্যদিকে জাফর-মেনন-রনো, এঁরা কখনো খতম লাইন সমর্থন করেন নি। আপনার মনে থাকতে পারে, ১৯৬৯-এর অক্টোবর মাসে জাফর-মেনন-রনো ফ্রাকশন আনুষ্ঠানিকভাবে ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা সমন্বয় কমিটি’ গঠন করেন। পরে ওই একই বছরে ১৬ই ডিসেম্বরের পর তারা নাম পাল্টিয়ে ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের বাংলাদেশ সমন্বয় কমিটি’ রাখেন। এই সংগঠন ১৯৭০-এর পয়লা জানুয়ারি থেকে চেষ্টা অব্যাহত রেখে ওই বছরের ২৫ শে জানুয়ারি দ্বিতীয় বৈঠকে মিলিত হয় ও একটা মনোলিথিক কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার উদ্যোগ নেয়। এদের সঙ্গে সে সময় একমতে আসে দেবেন-বাশার গ্রুপদের পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, কমিউনিস্ট সংহতি কেন্দ্র ও হাতিয়ার গ্রুপের বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি। এদের প্রাইমারি রণনীতি ছিল তথাকথিত নকশালবাদী রাজনীতিকে নেগেট করা ও ঔপনিবেশিক পূর্ববাংলায় শ্রেণীসংগ্রামের ভিত্তিতে বিপ্লব সংগঠিত করে জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করা।’

হঠাৎ এই সময় নসু এসে পরদার ফাঁক দিয়ে গলা বাড়িয়ে দেয়। তাকে দেখে গর্জে ওঠে মওলা, ‘ভাগ্ এখান থেকে। সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে কথা বলছি আমরা আর—’

‘জি, খাবার দেয়া হয়েছে।’

‘বলে দে দেরি হবে। হে এঃ! ফ্যাচাঙের আর সময় পায় না!’

আবার শুরু করতে যাচ্ছে মওলা। আবু নওশাদ তাকে থামিয়ে দেয়। রেকর্ডপ্লেয়ারে ফুরানো টেপ পালটিয়ে নতুন টেপ ইন করে। তারপর মওলাকে আবার কথা বলতে ইঙ্গিত করে।

‘তো যা বলছিলাম, ফর ইয়োর ইনফরমেশন মাই ডিয়ার ইয়ংম্যান, আমি কিন্তু ভুল বুঝতে পারি এবং সময় থাকতেই পার্টি চেঞ্জ করি।’

‘হ্যাঁ, পয়েন্টে আসুন এবার। আপনার পার্টি চেঞ্জের অ্যাফেয়ার্সটা আমাদের নলেজে রেকর্ডেড আছে।’ আবু নওশাদের গলার স্বর উঁচু পরদায় চলে যায় এইখানটায়।

হঠাৎ যেন খরগোশের মতো কানে চাড় লাগে মওলার। ‘কী—কী বললেন?’

আপনার পার্টি চেঞ্জের ব্যাপারটা আমাদের নলেজে আছে। আকর্ণ হেসে দেয় মওলা। তারপর ঠিক প্রেমালাপের মতো করে বলে, ‘ তো ওই ঘটনা। আমি আমার দলবল নিয়ে জাফর-মেননদের গ্রুপে চলে এলাম।’

‘না।’ বোমার মতো ফেটে পড়ে আবু নওশাদের কণ্ঠ।

‘আঁ—আঁ—কী বলতে চান আপনি আন্দাজে?’

‘আপনি আর আপনার তিন ফলোয়ার সালাম-বালু-আকবর ও সেইসঙ্গে দুটো এসএলআর, একটা স্টেনগান, দুকেস অ্যামুনিশন্স্ নিয়ে গোপনে হাত মেলান মুজিব বাহিনীর সঙ্গে।

‘মিথ্যে! মিথ্যে! ডাঁহা মিথ্যে কথা!’ আর্তনাদের হাই টোনে গলা চিরে যায় মওলার।

বাইরে ঝড় শুরু হয়ে গেছে। আকাশ থেকে ভূত-প্রেতরা নেমে আসছে পৃথিবীর আলো গ্রাস করতে। সেই প্রলয়রোলের তলায় একতলার ঘরের যাবতীয় হাঁকারহাহাকার তলিয়ে যেতে চায়।

তর্জনী উঁচু করে কথা বলে আবু নওশাদ নামের মধ্যবয়েসী দুবলাপাতলা লোকটা।

‘ইউ আর এ ফার্স্টক্লাস লায়ার মিঃ মওলা! তখন নভেম্বর মাস। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে এ দেশের সীমানায় ছেড়ে দেয়া হচ্ছে মুজিববাহিনীকে। ওরা শিকারী কুত্তার মতো হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরছে নকশালবাদীদের। আপনি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে গিয়ে কথা বললেন, মুজিববাহিনীর একজন কমান্ডারের সঙ্গে। সেই বেজিটার মুখটা মনে পড়ছে? গোলাপিলাল ঠোঁট। আর তার পুঁতিদানার মতো ঝকঝকে চোখ। একটা শিরীষ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আপনারা কথা বলছিলেন। বেজিটা গর্তের বাইরে এসে আপনাদের দেখে হকচকিয়ে যায়। ঘাড় বেঁকিয়ে সরল চোখে তাকিয়ে আপনাদের ষড়যন্ত্র শুনতে থাকে। আপনি তার গোলাপি ঠোঁট তাক করে গুলি করলেন। কী মনে পড়ছে মিঃ মওলা? বেজিটা—

তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে মওলা। নিমাই সন্ন্যাসীর মতো একসঙ্গে দুই বাহু তুলে হামলে ওঠে, ‘র্আরেরেরে—আপনি তো দেখছি একজন ব্লাকমেইলার জার্নালিস্ট!’

‘আর আপনি? আপনি একজন উচ্চাভিলাষী লোভী লুম্পেন। নেতৃত্ব আর রুটির লালসায় কী জঘণ্য কাজটা করেছিলেন সেদিন!’

ধপাস করে বসে পড়ে মওলা। ফ্যানের হাওয়া তার চুলে খেলা করে, খেয়াল নেই। রেকর্ডার স্পুল ঘুরে চলে নিঃশব্দ নিয়তির মতো।

মওলা মরিয়া হয়ে টোপ ফেলতে চায়, ‘বলুন, কত টাকা হলে চলবে?’

‘কী যে বলেন!’ লজ্জিত হাসি আবু নওশাদের ঠোঁটে।

‘আমি আপনাকে পুলিশে হ্যান্ডওভার করব জানেন? থামান—থামান আপনার টেপ।’

 হেসে ওঠে আনু নওশাদ। হাসির রেশ জিইয়ে রেখে বলে, ‘ও তো থামে না। আপনি আর আমি একদিন থেমে যাব, ও চলতেই থাকবে।’

‘ও—ও—ওফ্! কে? কে? আপনি?’ কী মতলব? বাতাসে ঘুসি ছোড়ে মওলা।

‘ সেদিন নেতৃত্ব আর সোনাদানার লোভে তুমি—তুমি! আমার পার্টির জুনিয়র কানাডার মাওলা বকশো কী ট্রেচারিটা করলে সেদিন! ছিঃ—ছিঃ—!’

মাথার চুল হঠাৎ কাঁটা দিয়ে ওঠে মওলার। শরীরের এ বিচিত্র রহস্য; কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। সব যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

‘আমাকে চিনতে পার টুটুল?’

ওই মেটালিক কণ্ঠ আফ্রিকান ড্রামের মতো এসে আঘাত করে মওলার কানের পরদায়। সঙ্গে সঙ্গে মাথার ভেতর স্মৃতির ঘন্টা নড়ে উঠে সাড়া দেয়। উন্মাদের মতো ডুকরে ওঠে সে : ‘জি—লা—আ—নী—ঈ—ঈ—!’

 বেশ শোনায়, —ঈ ঈ ঈ ঈ ঈ ... ... ...এই ঈ-কারান্ত ধন্যাত্মক ঝিঁঝিকীট ঘরের দেয়ালে দেয়ালে মাথা ঠুকে মরে।

খনখনে গলায় উত্তর দেয় আগন্তুক, ‘হুঁ আমিই। চিনলে তাহলে? তোমার জীবন বাঁচিয়েছিল যে যে একবার সেই সুধাগঞ্জের হেমায়েত জোদ্দারের রামদার কোপ থেকে। হ্যাঁ, তোমার সেই কমরেড জিলানী। যাকে তুমি ধরিয়ে দিয়েছিলে বেইমানি করে।’

বিশাল ড্রইংরুমের অন্ধিসন্ধি মুহূর্তে ভরে যার পুরু পচা বোঁটকা দুর্গন্ধে। কার্পেটের তলা সোফার নিচে থেকে সিলিঙের প্লাস্টিক পেইন্ট—সর্বত্র থক থক গাদ গাদ করছে ওই অসহ্য অসুস্থ গন্ধ। পন্ডস্ টালকাম পাউডার বা জেসমিন এসেন্স, সমস্ত কৃত্রিম সুগন্ধ ছ্যাঁচাথ্যাঁতা হয়ে যায় শ্বাসরোধী চাপে। দম ফেঁপে আটকে আসে হাসান মওলার। এ ড্রইংরুম এখন ভ‚পাল বা চেরনেবিল।

স্বগতস্বরে বিড়বিড় করে মওলা, ‘কিন্তু তাকে যে মুজিববাহিনী গুলি করল! তার লাশটা বেতবন হ্যাগড়াবনের উপর দিয়ে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে গেল! অ্যাঁ? সত্যি তো? তুমি জিলানী?’

‘অবিশ্বাসী! এখনো আমার আদরের বোন মনিরা তোমার ঘরে। মনে নেই? আমার শোকে চোখের পানি ঝরাতে ঝরাতে তুমি দরদী সেজে মনিরার ওপর দখল নিলে। একচালে নেতৃত্ব-ধনরত্ন-রাজকন্যে সব মুঠোর মধ্যে। বলিহারি বটে!’

সাহস করে মাথা তোলে মওলা। একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখতে চায় ও মুখের প্রকৃত আদল। মিলিয়ে নিতে চায় সেই মূল আদ্রা।

তাই তো। কোথায় গেল সেই সাংবাদিক আবু নওশাদ? সেই স্মার্ট মুখচোখ? তার জায়গায় এ কী বীভৎস কী অচেনা এক শবের গলিত মুখচ্ছদ! শুটকো পাঁশুটে চামড়া—ফাটা ফাটা—ফাটলের ফাঁকে রক্তহীন ফ্যাকাসে মাংসের ভেংচি। এ তো মৃত্যু মূর্তিমান!

নাড়ি ঠাণ্ডা হয়ে যায় মওলার। গলা কপাল শিরদাঁড়া বেয়ে কল কল ঘামের স্রোত। অশরীরী আতংক জ্যান্ত শরীরের প্রতিটি প্রত্যঙ্গে শিহরণ পাঠিয়ে দিচ্ছে। দু হাতের পাতা দিয়ে চোখ ঢেকে রাখে অনেকক্ষণ। তারপর মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে, ‘না না, এ অসম্ভব! তুমি মরে গেছ। সেই একাত্তরেই তুমি গুলি খেয়ে স্পটডেড।’

 মেটালিক ভয়েস রিটর্ট করে, ‘হাঁ হাঁ— কোনো একাত্তরেই মুক্তিযোদ্ধারা মরে না। তারা মৃত্যুর পরই অমরত্ব পায়।’

এ সব বাত্তেলা কোনো সাড়া তোলে না মওলার স্বায়ুতে। যেন এক সমূহ ব্যর্থতার ফাঁদে জিম্মি হয়ে পড়ছে তার উদীয়মান ভবিষ্যৎ। যেন ফার্স্টক্লাস ওয়েটিং রুম থেকে তার সমাসন্ন সাফল্যকে কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে বাইরের প্লাবনে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে চলেছে বাইরে।

‘কী ভাবছ বসে? তোমার কি ভাববার জো আছে আজো? তাহলে একবার পেছন পানে ফিরে তাকাও। কী, দেখতে পাচ্ছ তোমার পায়ের অতীত ছাপগুলো? কোন কোন ধাপে দাগ রেখে রেখে আজ তুমি এই চূড়ার কাছাকাছি এসে ঠেকেছ? দেখ, ওই ধাপটায় লেখা রয়েছে মাওলা বকশো। যে এখন রাজধানীতে এসে আধুনিক ভোলধারী হাসান মওলা।’

‘উহুঁহুঁ! মাথা তোল। তুলে দেখ। তোমায় দেখতে হবে। ওই যে সুটকেসটা মুখখোলা পড়ে আছে নদীর ধারে। দেখ ভালো করে, চিনতে পারার কথা। ও সুটকেস তুমিই ফুঁকে দিয়েছ। প্রায় আধমনটাক সোনার গহনা ছিল ওতে। যত গলাকাটা শ্রেণীশত্রুর নারীর ভুষণ। কথা ছিল সব আমাদের পার্টির গণকোষাগারে জমা হবে। কিন্তু আখেরে তুমি তোমার নিজের কমরেডকে খতম করে নিজেরই আখেরাত গুছিয়ে নিলে। মহম্মদপুরে এক বিহারির এই ফাঁকা বাড়ির জবরদখলি মালিক হয়ে গেলে তুমি এক প্রাক্তন গ্রেট মুক্তিযোদ্ধা। খানিকটা সোনা গলিয়ে এই হালফ্যাশনের দোতলা হেঁকেছ। বাকিটা ঢালছ এখন সাভারে ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সে। তোমার এই উপরের ধাপগুলো বড় বেশি মাপাজোখা হে! ফলে এখন যে সরকার আসে তুমি তার নেকনজরে থেকে যাচ্ছ। তোমার প্রতিভার শেষ নেই। এমন কি জামাতিদের সঙ্গেও তুমি একটা ইমম্যাচিয়োর পরকীয়া অ্যাফেয়ার্স ডেভেলপ করে নিতে পেরেছ। তোমাকে একটা জাতীয় পুরস্কার-পুরস্কার দিচ্ছে না কেন অ্যাঁ? আচ্ছা, তুমি কি মন্ত্রীটন্ত্রী হয়ে বসবে নাকি? সে রকম কানাঘুষোও চলছে বাজারে।’

নিজের কীর্তিকথা শুনতে শুনতে অবশ হয়ে এসেছে মওলার মাথামগজ। ঠিক যেন রোলার গড়িয়ে যাচ্ছে খুলির ভেতর। খোয়া পাথর নুড়ি সব টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে ছিটিয়ে পড়ছে পাঁজরের দুইদিকে। এক অদৃশ্য অরোধ্য ক্ষয়কাজ।

সময় গড়িয়ে যায় আঙুলের ফাঁক গলে। কিছুই ধরে রাখা যায় না। সামনের সোফায় বসে আছে ও কি সময়ের র্টসো? কিছুটা সময় নিজের জন্যে ওর কাছ থেকে মেঙে রাখা যায় না? ভিতরের দিকে একটা ব্লাডার চুপসে মিইয়ে আসছে। মুখ দিয়ে টকজল উঠে আসে মওলার। বাইরে বিশ্বভাসানো মহাঢল। ভিতরে সময়হীন শূন্য পারাবার। নসু ভুনু মনিরা... সবাই পারঘাটায় দঙ্গল বেঁধে বসে আছে। কেউ পার হয়ে আসবে না, কেউ পার হয়ে যেতে পারবে না আজ এমন মহামারী বাদুলে রাতে। পাউডারের ভুরভুর বাস, এসেন্সের মদির ঘ্রাণ, শবের আঁশটে বদবু; সবকিছু ঘোঁট পাকিয়ে একটা কেলাসিত বিষম বেদশা ধারণ করেছে ঘরের চৌকো স্পেস। আলাদা করে আর শনাক্ত করার উপায় নেই। মনে হচ্ছে ওই কম্পোজিট পুতিগন্ধ, ওর উৎস আসলে মওলারই ভেতরবাগে পচধরা দেহ। মওলা পচছে। পচনের কাজ কত দিন ধরে চলছে সে জানে না। জানতে পারে নি।

খনখনে গলা আওয়াজ করে, ‘তোমাকে একটা কথা বলব।’

‘জি জিলানী ভাই!’ সহজ হতে চেষ্টা করে মওলা।

‘যে কথাটা বলতে এসে আড্ডা জমিয়ে তুললাম। বলে চলে যাই।’

‘বলুন আমি শুনছি।’

‘দেখ, কেউই শেষ পর্যন্ত টেকে না। রেজা শাহ্, মার্কোস, ভুট্টো, আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া, এরশাদ; সবাইকে একসময় না একসময় ধরা খেতে হয়। বুঝলে আমার সাধের ভগ্নীপতি? ওই ভুয়ো আত্মস্মৃতিটা আর লিখো না। ছেড়ে দাও।’

‘আমি যে অনেকখানি এগিয়েছি জিলানী ভাই।’

‘আর পারবে না এগোতে। ধরা খেয়ে যাবে। এমন এমন ঘটনা সামনে...না, তোমার সাধ্যে কুলোবে না। তুমি এখন তেলেজলে দিব্যি বাড়বাড়ন্ত। এই দেহ নিয়ে এ বেলা আর পারবে না সত্যের দোধারী ব্লেডের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে। ছেড়ে দাও এটা।’

‘আ—আমি একবার গোড়া থেকে ফের চেষ্টা করে দেখি।’

‘আ আঃ...! বলছি পারবে না। তুমি তো মুক্তিযোদ্ধা নেই আর। বহু আগে মরে গেছ। তোমার রক্ত দূষিত হয়ে গেছে। তোমার কোনো অধিকার নেই ফিউচার জেনারেশনকে মিসগাইড করার। শাহীন, —হ্যাঁ, তোমার ছেলে গো, ওরা  যে ফেক মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করতে নেমে পড়েছে। ওদের এগিয়ে যেতে দাও। আর একটা কথা, আমাদের সম্বন্ধে তোমরা বলে বেড়াও, আমরা রোমান্টিক টেররিস্ট। চারু মজুমদারের লাইন ফলো করে আমরা ভুল করেছি। হয়তো সত্যি কথাই। তবে তার চেয়ে বড় সত্যি হচ্ছে, আমরা দেশটাকে ভালবেসেই এই ভুল করেছিলাম। আমাদের ভালবাসায় তোমার মতো ভেজাল ছিল না।’

বাজপড়া মানুষের মতো বসে থাকে মওলা। সে অ-নে-ক—অনেকক্ষণ। খেয়াল করতে পারে না কখন ফাঁকা হয়ে গেছে ড্রইংরুম। বিদেয় নিয়েছে ঘেয়ো মুর্দার বোঁটকা দুর্গন্ধ। খোলা হাট দরজা। স্বচ্ছ স্বাভাবিক বাতাস।

এক থাবায় শক্তিহীন শোলা হয়ে গেছে মওলা। ধুঁকতে ধুঁকতে উঠে দাঁড়ায়। খুব সন্তর্পণে হেঁটে যায় বাইরের দরজার দিকে। ছিটকিনি তুলে দেয় আলগোছে। টালুমালু চোখে তাকায় এদিক ওদিক। টলতে টলতে চলে আসে পাশের কামরায়।

পাণ্ডুলিপির উলঙ্গ কাগজপত্তর। খোলা কলম। যাবতীয় সরঞ্জাম ছইচিত্তির হয়ে পড়ে আছে তার অপেক্ষায়। টেবিলের দিকে তাকিয়ে জ্বালা করে ওঠে দুটো চোখ। গলা রগড়িয়ে নির্মম শব্দ ঠিকরে বেরিয়ে আসে : ভুয়া—ভুয়া—স ব ভুয়া!

পাণ্ডুলিপির পাতাগুলো একটি একটি করে ছিঁড়তে বসে। কুটিকুটি করে ছিঁড়তে থাকে। ছিন্ন পাতা রাশ করে সাজায় টেবিলের ওপর, যেন তার গত জন্মের আঁতুড়মণ্ডপ। জন্মের আগেই বৈধব্যের সাদা থান চেপেছে পল্কা গতরে।

তারপর বিসর্জনের পালা। ঢাকীরা ঢাক বাজায় মেঘে মেঘে। আকাশের চোখ ফেটে জল ঝরে নিশাল ধারায়।

ছেঁড়া পাতার ধ্বংসাবশেষ ভেতর বারান্দায় বয়ে নিয়ে আসে মওলা। সারা সৃষ্টিজুড়ে অঝোর বর্ষণ। জনমানবহীন অন্ধকার নিসর্গ। পালি দিয়ে কেটে যাওয়া ইলেকট্রিকের আলো। আকাশের দিকে একবার উতলা চোখে তাকিয়ে নেয়। যদি কোনো বান্ধব-ইশারা নজরে আসে। কালি—কালি—শুধু কালি—মেঘগোলা কালি—তমসাগোলা কালি—ভ্রষ্ট মানুষের দূষিত রক্তগোলা কালি—।

কাগজের টুকরোগুলো ড্রেনে ঢেলে দেয় নিঃশব্দে।

ড্রেনের ঘোলা জল তুমুল কোলাহল তুলে ছুটে চলে। বাংলাদেশের আঁতিপাঁতি সমস্ত বর্জ্য বয়ে নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলে আত্মনাশা টানে।পুনর্মুদ্রণ

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ভাইস চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নারী উন্নয়ন ফোরামের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
ভাইস চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নারী উন্নয়ন ফোরামের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
কাপ্তাই হ্রদে পানি স্বল্পতায় কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন
কাপ্তাই হ্রদে পানি স্বল্পতায় কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
মৌলভীবাজারে ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা মর্মান্তিক: মানবাধিকার কমিশন
মৌলভীবাজারে ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা মর্মান্তিক: মানবাধিকার কমিশন
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি