X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

দোজখের ওম কিংবা ইলিয়াসের দীর্ঘশ্বাস

রফিকুজ্জামান রণি
০৪ জানুয়ারি ২০১৯, ১৫:৫৮আপডেট : ০৪ জানুয়ারি ২০১৯, ১৬:০০

দোজখের ওম কিংবা ইলিয়াসের দীর্ঘশ্বাস কখনো কখনো সুদীর্ঘ মৃত্যুর চেয়ে বেঁচে থাকাটাই যন্ত্রণাময়। এই ধ্রুবসত্য অতি সহজেই উপলব্ধি করতে পেরেছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। তাঁর ‘দোজখের ওম’ গল্পের কামালউদ্দিনের জীবনচক্রের ভেতর নজর দিলেই বিষয়টি আরো বেশি স্পষ্ট হয়। গভীর রাত্রিতে ঘুমঘোরে যখন প্রয়াত স্ত্রী এসে পক্ষাঘাতগ্রস্ত কামালউদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে মুখ বাঁকিয়ে বলে- ‘যাইবা না? খালি দুইটা খাওন আর নিন্দেও লাইগা তোমার এমুন লালচ ক্যালায়? বুইড়া জইফ মরদ একখান, হাগামোতা ভি ঠিকমতোন করবার পারো না, তয় কিয়ের টানে পইড়া থাকো, এ্যাঁ?’ তখন মনে হয় এই বেঁচে থাকা শুধুমাত্র দিন আর রাত্রির কাছে নিজেকে সঁপে দেয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। এখানে সাধ-আহ্লাদ কিংবা সুখ-দুঃখের হিসেব বড় জটিল, রহস্যময় অঙ্কে ঠাসা। স্ত্রীহারা, যৌবনহারা, কর্মতৎপরতাহারা এবং পারিবারিক কোন্দলের ভেতরে স্রোতের শ্যাওলার মতো অযত্নে অবহেলায় বেঁচে থাকা একজন মানুষ যে কেবল ফ্রানজ কাফকার মেটামোরফসিস  উপন্যাসিকার গ্রেগর সামসা নামের সেই মানব পোকাটির মতোই একটি অথর্ব বস্তু ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।

বিশ্বসাহিত্যের ক্ষণকালীন প্রজাপতি, কবি আর্তুর র‌্যাঁবো কবিতার রথে চড়ে দোজখের ভেতরে কাটিয়ে এসেছেন সুদীর্ঘ একটি মৌসুম এবং কাব্যের তরী বেয়ে টমাস ট্রান্সট্রোমার জাহান্নামে ঘুরে বেরিয়েছেন সাড়ে তিনরাত্রি! কিন্তু ইলিয়াস তাঁর গল্পে সময়কে নির্দিষ্ট ফ্রেমে বাঁধেননি বটে, তবে দুঃখী মানুষের তাবৎ জীবনটাকেই তিনি দোজখের ভেতরে পড়ে থাকতে দেখেছেন। ইহলোক এবং পরলোকের মধ্যেও যে কখনো কখনো সূক্ষ্ম মিল-অমিলের অস্তিত্ব লুকিয়ে থাকে সেটাই তিনি শৈল্পিকভাবে তুলে ধরেছেন ‘দোজখের ওম’ গল্পে। অবশ্য গল্পটি পড়ে কারো কারো মনে এই প্রশ্ন উঁকি দেয়া প্রসঙ্গরহিত নয় যে, ‘দোজখের ওম’ গল্পের নায়ক আবার স্বয়ং লেখক তথা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস নিজেই নয় তো! এই গল্পের নায়ক কামালউদ্দিনের মতো শেষজীবনে ইলিয়াস নিজেও তো কর্কটব্যাধি ক্যান্সারের আক্রমণে কর্মক্ষমতা এবং চলৎশক্তি হারিয়েছেন, নিক্ষিপ্ত হয়েছেন দুর্বিষহ অসহায়ত্বের কারাগারে। একসময় পরম বিক্রমে রাষ্ট্র চষে বেড়ানো গল্পের নায়ক কামালউদ্দিন জীবনের শেষমুহূর্তে এসে পঙ্গুত্ববরণ করে নিষ্কর্মা হয়ে পড়লে সংসার এবং আপনজনদের কাছে সে একটা দয়ার পুতুলে পরিণত হয় এবং সুখ ও সম্প্রীতির সংসারে ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ে বিভেদের সাপ। সবলদের কাছে তার বেঁচে থাকার গুরুত্ব নষ্ট হয়ে যায়, সে হয়ে পড়ে সংসারের অপাঙক্তেয় এবং দুর্বলদের কাছে হয়ে ওঠে গুরুত্ববহ, আর্শিবাদের বস্তু। কিন্তু সবলদের দাপটে সেটাও যেন লীন হয়ে যেতে থাকে। মানুষের সহজাতপ্রবৃত্তি এবং জীবনপ্রবাহের রূঢ়বাস্তবতাকে নিজের জীবনের সাথে না মেলালে এতোটা নিখুঁতভাবে বর্ণনা করা কী আদৌ সম্ভব? তাই ইলিয়াসের জীবনের অন্তিম মুহূর্তের দিকে তাকিয়ে আমরা ধারণা পাই যে- ‘দোজখের ওম’ হচ্ছে তাঁরই গল্প, তাঁরই দীর্ঘশ্বাস! এই গল্পের মতো ক্ষোভ, বিদ্রুপ, শ্লেষ-উষ্মা কিংবা রাগের গরল ঢেলে ‘ফোঁড়া’ ‘খোঁয়ারি’, ‘মিলির হাতে স্টেনগান’, ‘কিটনাশকের কীর্তি’, ‘অপঘাত’, ‘যুগলবন্দী,’ ‘রেইনকোট’ ইত্যাদি গল্পে বীভৎর্স সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজের ব্যক্তিত্ব, সমাজমনস্কতা ও লেখনীর শক্তিমত্ত্বার কথাই তিনি জানান দিয়েছেন এবং সাংসারিক খুঁনসুটি, সামাজিক দ্বন্দ্ব, পারিবারিক কলহ, মানবিক বৈষম্য, নারী পুরুষের জৈবিক চাওয়া পাওয়ার হিসেব-নিকেশ আর পরচর্চার চিত্র ব্যাখ্যা করেছেন ‘তারা বিবির মরদ পোলা’ গল্পসহ বেশ কিছু লেখায়।

বিষয়বৈচিত্র্যের অভিনবত্ব, বহুমাত্রিক বর্ণনাশৈলি, সুক্ষ্মকৌতুকবোধ, নাটকীয় উপস্থাপন আর সমকালের সিঁড়ি বেয়ে চিরকালে ওঠার দীপ্ত প্রয়াস ইলিয়াসের লেখাকে দিয়েছে ভিন্নস্বাদ, যুগান্তর সৃষ্টিকারী নির্যাস। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি এবং ইতিহাস ও সমাজ-সচেতন মন, নিজস্ব উপস্থাপনকলার মাধ্যমে তিনি যে গল্পের ভুবন সৃষ্টি করেছেন তা একেবারেই তুলনারহিত। কেবলমাত্র ইউরোপীয় সাহিত্যের ল্যামপুন কিংবা স্যাটায়ারধারার রম্যই নয়, তার লেখায় যে সুক্ষ্ম কৌতুকবোধের অস্তিত্ব বিরাজমান, সে কৌতুকের আড়ালে ঘাসের সাপের মতো লুকিয়ে থাকে বাস্তবতার চিরন্তন প্রচ্ছায়া। ইলিয়াস যে সব বিষয়ের উপর লিখেন সেটা এতোটাই নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ ও বর্ণনা করেন তা দেখলেই অনুমান করা যায় সাহিত্যে সাধনার দীর্ঘ ৩০ বছরের আয়ুষ্কালে সর্বসাকুল্যে হাতেগোনা কয়েকটি রচনার উপকরণ আহরণ করতে কতটা নিবিষ্ট পাঠক আর পরিশ্রমী লেখক হয়ে ওঠেছিলেন। তিনি সাধারণ মানুষের বক্তব্য হুবহু গল্পের সংলাপে রূপদানের পাশাপাশি ধর্মভ্রষ্টদের নকল কণ্ঠস্বরও রপ্ত করে নিয়েছেন দক্ষতার সাথে। তাঁর প্রায় প্রত্যেকটি লেখাকেই বলা যায় ‘দ্বান্দ্বিক সময়ের ম্যাসেজ।’

ইলিয়াস বরাবরই অল্পপ্রজ, নিরিক্ষাপ্রবণ, শুদ্ধধারার বাস্তববাদী কথাকার। পাঁচটি সংকলনে সর্বসাকুল্যে ২৩টি গল্প। তবে অগ্রন্থিত রচনাসমূহ মিলিয়ে ৩০টিরও অনধিক ছোটগল্পের স্রষ্টা তিনি। গল্পের তরীতে ভাসিয়ে এমন সব রহস্যময় জগতের দিকে টেনে নেন তিনি যে জগত পাঠকের সম্পূর্ণ অচেনা। গল্পচ্ছলে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পাশাপাশি একগল্পের ভেতরে একাধিক উপগল্প ঢুকিয়ে দিয়ে জীবনের বিচিত্র সব বন্দরে ঘুরিয়ে আনেন তিনি। ঢাকা শহরের হাজার রকম এলাকা, অলিগলি, উপগলি কিংবা পাড়া-মহল্লার কথা যেমন তাঁর লেখায় নান্দনিকভাবে উঠে এসেছে, তেমনিভাবে গ্রামীণ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষঙ্গও সাবলীলভাবে ঠাঁই পেয়েছে। দেখা যায় চমৎকার কিছু মিশ্রভাষার ব্যবহারও। শহীদুল জহির এবং সাইয়িদ আতীকুল্লাহর অনেক রচনায়ও এ জাতীয় চিত্র চোখে পড়ে কিন্তু কারো সাথে কারোরই মিল খুঁজে পাওয়া শক্ত।

যদিও তিনশ বছর বেঁচে থাকার প্রার্থনায় ব্রত ছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কিন্তু মাত্র ৫৪ বছর বয়সেই তাঁর পৃথিবীর আয়ুকাল ফুরিয়ে যায়। আমরা দেখেছি, লালনভক্ত কবি সৈয়দ শামসুল হক মরমিসাধক লালন শাহর মতো ১১৬ বছর বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছিলেন; নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদও চেয়েছিলেন দীর্ঘজীবন পেতে। তাছাড়া ‘আরো কিছুদিন বেঁচে থাকলে আমি অমর হতাম’ ইংরেজি সাহিত্যের নৈরাশ্যবাদী ও ক্ষণজন্মা কবি জন কীটসের এই খেদোক্তি থেকে আমরা এটাও ধারণা করতে পারি যে, ঘাতকব্যাধি যক্ষ্মা গলায় ঝুলে থাকার পরও আরো কিছুদিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন তিনি, কুড়িয়ে আনতে চেয়েছিলেন হাজারো নৈরাশ্যময় অধ্যায়ের মধ্য থেকে একরত্তি আলোর নুড়ি। কিন্তু প্রকৃতি বড় নির্দয়, নির্মম ও একরোখা! কারো ইচ্ছের বিন্দুমাত্র মূল্যও তার কাছে নেই। প্রকৃতি তাই সৈয়দ হক-ইলিয়াস-হুমায়ূন এবং জন কীটস্ কারো কথাই পাত্তা দেয়নি। আশ্চর্য-পরিতাপ এবং অলঙ্ঘনীয় সত্য এই যে, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হুমায়ূন আহমেদ এবং সৈয়দ শামসুল হকের মতো দীর্ঘায়ুপ্রত্যাশী প্রবাদপ্রতিম লেখকত্রয়ী প্রায় একই রোগে চলে গেলেন পরোপারে- ক্যান্সার!

জীবদ্দশায় একবার ‘ছোটগল্প মরছে নাকি ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে’- এমন যুক্তিতর্কে জড়িয়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছোটগল্পের মৃত্যুর পক্ষেই রায় দিয়েছিলেন। তারপরও বলতে হয়, দুই শতাব্দির বাংলাগল্পের বহুবর্ণিল পথপরিভ্রমণের অন্যতম সারথি হিসেবে তাঁর নামটাও স্বর্ণখচিত, উজ্জ্বল। ওয়ালীউল্লাহ্-উত্তর বাংলা কথাসাহিত্যে সবচেয়ে শক্তিমান লেখকদের নাম নিতে গেলে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের নামটাও অনায়াসে চলে আসে। সেকারণেই হয়তো ইলিয়াস সম্পর্কে ওপার বাংলার প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেছেন- ‘কি পশ্চিম বাংলা কি বাংলাদেশ সবটা মেলালে তিনি শ্রেষ্ঠ লেখক।’পুনর্মুদ্রণ 

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কলেজ চত্বর থেকে অসুস্থ ভুবন চিল উদ্ধার
কলেজ চত্বর থেকে অসুস্থ ভুবন চিল উদ্ধার
নাহিদ সুলতানা যুথীসহ ৩ জনের জামিন আবেদন শুনতে হাইকোর্টের নতুন বেঞ্চ
নাহিদ সুলতানা যুথীসহ ৩ জনের জামিন আবেদন শুনতে হাইকোর্টের নতুন বেঞ্চ
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা সাকিবকে আমার বাসায় নিয়ে আসেন: হাফিজ উদ্দীন
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা সাকিবকে আমার বাসায় নিয়ে আসেন: হাফিজ উদ্দীন
রাজধানীতে মাদকবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার ২৩
রাজধানীতে মাদকবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার ২৩
সর্বাধিক পঠিত
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
পদ্মার গ্রাহকরা এক্সিম ব্যাংক থেকে আমানত তুলতে পারবেন
একীভূত হলো দুই ব্যাংকপদ্মার গ্রাহকরা এক্সিম ব্যাংক থেকে আমানত তুলতে পারবেন
দিন দিন নাবিকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছে দস্যুরা
দিন দিন নাবিকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছে দস্যুরা
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার
‘সরলতার প্রতিমা’ খ্যাত গায়ক খালিদ আর নেই
‘সরলতার প্রতিমা’ খ্যাত গায়ক খালিদ আর নেই