X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

রোকেয়া হলের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ফুল বানুর সাক্ষাৎকার

.
২৫ মার্চ ২০১৯, ১৫:১৩আপডেট : ২৫ মার্চ ২০১৯, ১৫:৪০

১৯৭১ সালে ফুল বানুর বয়স ছিল ১৭ বছর। স্বামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের তৎকালীন মালী শহিদ আব্দুল খালেক। স্বামীর চাকরিসূত্রে থাকতেন হলের স্টাফ কোয়ার্টারে। ২৫ মার্চ ১৯৭১, স্বামী-সন্তান ও ছোট বোনের সঙ্গে ফুল বানু ছিলেন কোয়ার্টারের টিনশেড বাসায়। সে রাতে অপারেশন সার্চলাইটে পাকিস্তান আর্মি রোকেয়া হলের স্টাফ কোয়ার্টারে গণহত্যা চালায়। হানাদার বাহিনীর অতর্কিত ও বর্বর আক্রমণে শহিদ হন ৪৫ জন। অগ্নিঝরা মার্চের সেই কালো রাতে হানাদারদের গুলিতে ফুল বানুর স্বামী আব্দুল খালেক ও ছোটবোন নুরী নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হয়েও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান ফুল বানু। বেঁচে যায় তাঁর কোলে থাকা এক বছর বয়সি শিশুপুত্রও। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ফুল বানুর দিনগুলা যেন যুদ্ধাক্রান্তই। একাত্তরে সব হারিয়ে বর্তমানে পঙ্গুত্বের বোঝা নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি।

ফুল বানুর সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে সেই ভয়াল রাতের গা শিউরে ওঠা স্মৃতির বয়ান। কালো রাতের বর্বর ঘটনা এতই নির্মম ছিল যে এ নিয়ে আনুষাঙ্গিক কথার চেয়ে পাঠকরা বেশি আগ্রহী হবেন সরাসরি ফুল বানুর বক্তব্যে। তাই সরাসরি যাওয়া যাক ফুল বানুর ভয়াল স্মৃতিবয়ানে। বাশার খান

রোকেয়া হলের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ফুল বানুর সাক্ষাৎকার

তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যোন)এর খুব কাছেই রোকেয়া হলের অবস্থান। রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের সময় আপনি কোথায় ছিলেন?

৭ মার্চ ভাষণের দিন আমি রোকেয়া হলের স্টাফ কোয়ার্টারেই ছিলাম। আমার স্বামী আব্দুল খালেক সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুনতে গেছিলেন। হলের স্টাফ সবাই গেছিল সেদিনকার মিটিংয়ে। বিকেলবেলা কোয়ার্টার থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে পাইছি। রোকেয়া হলের অল্প দূরেই তো মিটিং। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো’, মাইকে সব কথাই কোয়ার্টার থেকে শোনা গেছে। রোকেয়া হলের অনেক মেয়েই মিটিংয়ে গেছিল। আমি তো তখন নতুন বউ। তাই যাইতে পারি নাই।

 

৭ মার্চের পরে এবং ২৫ মার্চের আগের দিনগুলোতে হলের এবং আশপাশের পরিবেশ কেমন দেখেছেন?

ছাত্ররা খালি মিছিল বাইর করত। মিছিল দেখলেই পাকিস্তানি সৈন্যরা তাড়া দিত। ছাত্ররা দেয়াল টপকাইয়া আমগো বাসায় যাইত গা। আমরা ছাত্রগো আশ্রয় দিছি, লুকাইয়া রাখতাম। আর্মি তাড়া কইরা গিয়া আর ছাত্র গো পাইত না। রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও মিটিং-এ যাইত। হলের অনেক ছাত্রীই মিটিংয়ে গিয়া হেনস্তা অইতে দেখছি। ছাত্রীরাও পুলিশের তাড়া খাইয়া হলে ঢুকত।

 

২৫ মার্চের ২/১দিন আগের উত্তাল সময়ে হলে কোনো ছাত্রী থাকতে দেখেছে?

অবস্থা খারাপ হওয়ায় হল তো বন্ধ হইয়া গেছিল। তারপরও কিছু কিছু ছাত্রী হলেই ছিল।

 

রাতে আক্রমণ করা হতে পারে ২৫ মার্চ দিনেরবেলা এমন কোনো আভাস কি কারো কাছ থেকে পেয়েছিলেন?

তখন তো রোকেয়া হল আর অন্য হলের স্টাফরা মিলে যুদ্ধে যাইব বইলা জগন্নাথ হলের মাঠে ট্রেনিং নিত। ছাত্ররা কইত, যুদ্ধ একটা লাইগা যাইব। তো তৈরি অইতে অইব। বাঁশের লাঠি দিয়া ট্রেনিং নিত সবাই। ২৫ মার্চ বিকেলেও আমার স্বামী আব্দুল খালেক জগন্নাথ হলের মাঠে ট্রেনিং করতেছিল। আমরা তো গরীব ছিলাম। আমার আব্বা কামিজউদ্দিন ঢাকা শহরে রিকশা চালাইত। পুরা শহর ঘুরত। বিকেলে আইসা কয়, শহরের ভাবসাব ভালা না। যুদ্ধ একটা লাইগা যাইব। তাড়াতাড়ি তৈরি হ। তোগো এইখানে থাকাডা নিরাপদ না। তোদের বাড়িতে (ডেমরার মাতুয়াইলে) দিয়া আসি।

বিকেল ৫টার সময় আমার বোন নুরীকে পাঠাইয়া কইলাম, তর দুলা ভাইরে কবি তাড়াতাড়ি আইতে। এরমধ্যে আমি সব কাপড় চোপড় গুছাইয়া রাখছি, হল ছেড়ে আমাদের বাড়িতে চইলা যাইব বইলা। ঝুড়ির মধ্যে বাচ্চার দুধসহ সবই লইছি।

খবর শুইনা আমার স্বামী আসল। আইসা কয়, কি জন্য ভয় করো। কিচ্ছু হবে না। আমি কানতে কানতে কইলাম, আব্বায় কয়, ঢাকার শহরে যুদ্ধ বলে লাইগা যাইব। উনি পাত্তা দিল না। হলের একজন বেয়ারার, তার নামও খালেক ছিল। উনিও কইল, ভাবি আপনরা চইলা যান। ছোট বাচ্চা আছে। আপনাদের বাড়ি তো কাছেই। খালেক ভাইয়ের পরিবার এইখানে নাই। গ্রামে থাকে। তাই উনি আবার কইল, আজ কিন্তু একটা কিছু অইতে পারে। তখন কিন্তু বিপদ হবে। তখন আমি আমার স্বামীকে বললাম, আমাদের দিয়া আসেন। আমার চিন্তা ছিল আমাদের দিয়া আসতে গেলে স্বামীরেও আটকামো। কমু, যাইয়েন না। স্বামী কয় কী, না যামু না। মরলে হয় মরব। বাঁচতে হইলে যুদ্ধ কইরাই বাঁচব। আমি তো জানি তাদের অস্ত্র নাই। কি দিয়া যুদ্ধ করব।

 

বিকেল গেল। রাতে কি অন্যান্য দিনের মতোই  আপনারা খাবারদাবার করেছিলেন? অন্যান্য কাজকর্ম কি স্বাভাবিকই ছিল তখনও?

না, রাতে আমি রাগ কইরা ভাত খাই নাই। আমি খালি কানতেছি। স্বামী আমারে কয়, খাও খাও। কিচ্ছু অইব না। লগে রেডিও লইয়া রাখছে। খবরে কী কয়, শুনতাছে। হলের স্টাফরা কেরাম বোর্ড খেলতাছে। ১১টার সময় রেডিওতে খবর দিছে, ইয়াহিয়া খান ১১দফা মাইনা গেছে। এই ডিকলার শুইনাই সবাই লাফান শুরু করে। কোয়ার্টারের ভিতরেই সবাই জয়ং বাংলা শ্লোগান দিতে লাগল। আমার মনে হয় পাকিস্তানি আর্মি এই শ্লোগান শুনছিল। নইলে মেয়েদের হলে এমনে আক্রমণ করল কেন? বাইরে তো কত রমক মানুষই ছিল। অরা হয়তো এই শ্লোগান শুনছে।

 

হানাদার বাহিনী রাত ঠিক কয়টায় কোয়ার্টারে আক্রমণ করে?

রাত ১২টা বাজতাছিল। আমি তখনও কানতাছি। স্বামীরে খালি কই এহনও তো যাওয়া যাইব। চলেন যাইগা। দরকার হইলে হাইটা যামু। বাসায় তখন আমি, কোলের বাচ্চা, আমার স্বামী এবং আমার ছোট বোন নুরী। এমনি শুনি বোম্বিং শুরু অইয়া গেছে। ট্যাংক দিয়া হলের গেট ভাঙতাছে। কিছুক্ষণ পরই বাসার বারান্দায় বুটের শব্দ শুনলাম। স্বামী রে কইলাম, মনে হয় আর্মি আইয়া পড়ছে। দরজা কিন্তু খুইলেন না। স্বামী কয়, মনে হয় ছাত্রদের মারতাছে। আমি কই এত শব্দ হইতাছে। যুদ্ধ লাইগা গেছে। বারান্দায় লোকজন হাঁটার শব্দ শুনতাছি। স্বামী কয়, মনে হয় ছাত্ররা আশ্রয় নিতে আইছে। দরজাটা খুইলা দেই। আমি কই, দেইখা লন বাইরে কারা, দরজার ফাঁক দিয়ে দেখি কী, খালি খাকি পোশাক। আমি কই ওমা, খালি মিলিটারি দেখতাছি। দরজা খুইলেন না। এরপর আমার স্বামীও উঁকি মাইরা দেখছে। তারপর আমার স্বামী রুমের পিছন দিয়া লোহার শিক ভাঙতে চাইল। মোটা শিক তো কিছুতেই ভাঙতে পারল না। পিছনে তো পুকুর। ভাঙতে পারলে আমরা লাফ দিয়া পইরা যাইতে পারতাম। এমনি দরজায় সমানে লাথি মারল। সাথে সাথে দরজা ভাইঙা গেল। দরজা থেইকাই গুলি আর গুলি। কি যে গুলি মারতেছে আর মারতাছে। আমার স্বামী নুরীরে লইয়া কাথা মুরু দিয়া মাটিত শুইয়া পড়ল। কিন্তু এত গুল্লি করছে, স্বামী ও নুরীর শরীর জাজরা বানাইয়া লাইছে। আমি বাচ্চাডারে লইয়া কাত অইয়া পইড়া গেছি। আমার রানে গুলি লাগছে। আমার তো গলা শুকাইয়া গেছে। মুখ দিয়া কান্না আর আহে না। সকালবেলা আইসা আবার বেয়ানেট দিয়া ঘাই মারছে গো (কান্না)। শনিবার আইসা লাশ নিয়া গিয়া গর্তে ফালাইছে।

 

আপনাদের বাসায় কি আগুন দিয়েছিল?

না।

 

চোখের সামনে স্বামী এবং ছোটবোন শহিদ হলো। আপনি বেঁচে গেলেন কি করে?

আমার মাথা আর শরীর ছিল ভিতরের সাইটে। পা ছিল বাইরের দিকে। বাচ্চাটা বুকের লগে চাপ দিয়া ধইরা রাখছি। ছেলেটার সাথে ঘরের কোরআন শরিফটাও বুকে জড়াইয়া রাখছিলাম। পায়ে গুলি লাগল। মনে হলো পায়ে ২২ মণ পাথর দিয়া রাখছে। খালি রক্ত পড়তাছে। নাড়তেও পারি না। পা অবশ অইয়া গেছে। নুরী, আমার স্বামীর রক্তে পুরা ফ্লুর ভাইসা গেছে। বাচ্চাডা নাইমা খালি কানতাছে। অর শরীরও রক্তে ভইরা গেছে। বয়স তার এক বছর ৩ মাস। হাঁটে। কান্দে আর আমারে ফিডারটা আইনা দেয়। অর ক্ষুধা লাগছে। আমার বুক ফাইটা যাইতাছে। নড়তেই পারতাছি না। পাশের বাসার কাজের ছেলেটারও গুলি লাগছে। ও বাঁইচা আছে। বাচ্চাটার কান্না শুইনা ও আসল। আইসা কান্দে আর কয়, ভাবি আপনে বাঁইচা আছেন। আমি কই, ভাইরে আমারে একটু পানি খাওয়া।

 

সারা রাত এভাবেই ছিলেন?

হ। সকালবেলা আর্মি আইছে। আমি কই, মইরাই তো যামু। আর্মিদেরই কই, আমারে পানি দেন। আমারে কয়, গলার চেইন বা টাকাপয়সা আছে? আমি কই, না। আমি শুইয়াই রইছি। পায়ের লাইগা উঠতে পারতাছি না। একটা মিলিটারি কয়, তোর ঘরে পানি কই? আমি বারান্দা দেখায় দিলাম। হেই মিলিটারিডা আমারে পানি খাওয়াইছে। আমারে কয়, কুচ ভয় নেহি। কুচ ভয় নেহি। অয় মনে করছে এই মহিলা তো এমনই মারা যাইব।

আর্মি শুক্রবার সারাদিন ও সারা রাত ছিল কোয়ার্টারে। শনিবার সকালে কারফিউ সিথিল করল। শনিবার সকালে দরজা দিয়া বাইরে তাকাইয়া দেখি লোক দিয়া গর্ত করতাছে। গর্তটা ঠিক আমার দরজা বরাবর করতেছে। লাশগুলা টিন ও কাথার মইধ্যে শুয়াইয়া কয়েকজন ধইরা নিয়া ফালাইতাছে। আমার স্বামী আর নুরীর লাশ যখন নিতাছে, ছেলেটা একটু একটু হাঁটে। ও পিছন পিছন হাঁটতে লাগছে। ও খালি আব্বু আব্বু কইতাছিল। দুইডা আর্মি বাচ্চাডার দিকে বন্দুক তাক করছে। খালি গুলি করব এমন সময় একটা আর্মি দেয়াল থেইকা লাফ দিয়া পইরা বন্দুকটা হাত দিয়া সরাই দিছে। আল্লায় বোধহয় আর্মিডারে পাঠাইছে। সে ছেলেডারে ঘরে দিয়া গেছে। আমারে কয়, বাচ্চা ধইরা রাখো।

 

আপনার প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। রক্ত বন্ধ করতে কাপড় দিয়ে ক্ষতস্থান বাধার চেষ্টা করেননি?

নড়তেই তো পারি না। বানমু কিয়া দিয়া। ছেলেটার পরনে হলুদ গেঞ্জি ছিল। অর গেঞ্জি, মাথার চুল সব রক্তে ভেজা। কোরআন শরিফটাও রক্তে ভইরা গেছে।

 

হত্যাকাণ্ডঠেকাতে হলের প্রভোস্ট আখতার ইমাম কোনো পদক্ষেপ কি নেননি?

বৃহস্পতিবার দিনেরবেলা (২৫ মার্চ) আমার মামাশ্বশুর বাড়িতে চইলা যাইতে আখতার ইমামের কাছে ছুটি চাইতে গেছিল। উনি কইছে, তরা কি জন্য যাবি? আমি আছি না। আমার বাসার এইখান দিয়া ওয়াল ভাঙা আছে। গণ্ডগোল লাগলে এই খান দিয়া ফেমেলি নিয়া আমার বাসায় আইসা পড়বি। মামাশ্বশুর হলো মহসিনের বাবা মুনিরউদ্দিন। উনি আইসা কইছিল, যুদ্ধ লাগলে আমি তোদের সবারে প্রভোস্টের বাসায় নিয়া যামু। কিন্তু উনি সেই রাতে ডিউটিতে হলের গেটে ছিলেন। এদিকে তো আসতেই পারলেন না। আইসা আমগোরে লইয়া যাওয়ার সুযোগই পাইলেন না। তো আখতার ইমাম হলের ডিউটিতে থাকা স্টাফদের বাঁচাইছে। কোয়ার্টারের কারো জন্য কিছু করে নাই।

  ফুল বানুর স্বামী শহিদ আব্দুল খালেকের পরিচয়পত্র

স্টাফ কোয়ার্টারে গণহত্যার খবর আখতার ইমাম নিশ্চয়ই রাতেই পেয়ে যান?

কোয়ার্টারে যে সবারে গুল্লি কইরা মারতাছে, এইডা আখতার ইমাম জানছে। কোয়ার্টার থেইকা তনু মিয়া কীভাবে জানি জানালার লোহা ভাইঙা পলাইছিল। অয় গিয়া সব কইছে। তনুর বউ—বাচ্চা নিয়াই পলাইয়া বাঁইচা গেছে। উনি আখতার ইমামরে সব জানাইছিল।

 

শহিদদের লাশের কী হলো, কী দেখলেন?

লাশের কোনো দাফন—কাফন হয় নাই। বর্তমান শামসুন্নাহার হলের গেটে মাটিচাপা দিছিল। শনিবার কারফিউ উঠাইলে হলের স্টাফ হাবুল ও কুদ্দুস আইসা কয়, আপনি এখান থেকে জান গা। আমি কই, আমি তো মইরা যামু। বাচ্চাটারে আব্বার কাছে পৌঁছাইয়া দিয়েন।

 

হলে আর্মি তখনও ছিল?

হ। হলের মধ্যেই ছিল। একটা লাশও কাউকে নিতে দেয় নাই। শনিবার সকালে আবার আর্মি আইসা সব তল্লাশি করে। কোথাও কিছু আছে কিনা। লাইথথাইয়া অনেক কিছু ভাঙছেও। কাউফিউ সিথিল করার পর ছাত্ররা আসে। হলে দাড়োয়ান নমীর মেয়ে রে যে মারছে। অরা তো হিন্দু। সবসময় গলায় গহনা থাকত। হেই ফেমিলির ৭ জন মারছে। মেয়েটার গলায় স্বর্ণের হার ছিল। এই হারসহ মেয়েটারে গর্তে মাটিচাপা দিছে। স্বাধীনতার পর এই হারা পাওয়া যায়। (কান্না)।

 

স্টাফ কোয়ার্টারের কোনো নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছিল কি?

না। আইসাই খালি গুলি করছে। অরা মানুষ মারার তালে আছিল।

 

হলের কোনো ছাত্রীকে ধর্ষণের খবর কি পরে জানতে পেরেছিলেন?

না, আমি জানতে পারি নাই। হলের ভিতরে যে স্টাফরা ছিল, তারা বলতে পারব। হল তো ছুটি অইয়া গেছিল। তবে কয়েকজন ছাত্রী ছিল সেই রাতে। যারা দেশের ভক্ত ছিল। লড়াই কইরা দেশ স্বাধীন করব এমন মন—মানসিকতার ছাত্রীরা হলে ছিল।

 

হলে সে রাতে কত জন ছাত্রী ছিল? এ নিয়ে কোনো তথ্য কি স্বাধীনতার পরে আপনি জানতে পেরেছিলেন?

আমি কইতে পারুম না।

 

২৭ মার্চ সকালের কথা বলছিলেন। তারপর কী হলো?

সকাল ৯টার পরে কয়েকজন ছাত্র আসল। আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে তারা রাস্তায় গাড়ি থামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু একটা গাড়িও থামল না। আমি তো দাঁড়াইতেই পারি না। নিব কেমনে। হলের আক্কাস মামা আমারে কোলে নেয়। তার পুরা ফেমিলি মাইরা ফালাইছে। তার স্ত্রী, ৩ মেয়ে রাশিদা, নাহার ও পারুল এবং ২ ছেলে জাহাঙ্গীর ও আলমগীর—এই ৫ জনরে মারছে।

 

উনি বেঁচে গেলেন কীভাবে?

উনি হলে নাইট ডিউটিতে ছিলেন। ফেমিলিতে খালি উনি বাঁচতে পারছে। আমার কোলের বাচ্চা তহন কানতাছে। হাবুল তারে কোলে লইল। আক্কাস মামা ছেলেটারে কোথা থেকে আইনা ফিডারে দুধ খাওয়াইল। বর্তমান শামসুন্নাহার হলের ওখানে একটা বাথরুম ছিল। আহত লোকদের প্রথমে উখানে নিয়া রাখল। চারদিকে খালি কান্না আল কান্না। বড় নিঃশ্বাস আর আল্লাহ! আল্লাহ! শব্দ। নেওয়াজ আলীর ২ মেয়ে হাসিনা ও রওশন আরাও গুলি খাইছে। অদেরও এখানে আনে। আমার ছেলেটা আবার দুধু দুধু বইলা কানতাছিল। একজন আইসা কয়, বাচ্চার মুখ বন্ধ করেন। আওয়াজ শুনলে আবার গুল্লি করব। আমার তখন খালি পানির পিপাসা লাগতে থাকে। গলা শুকাইয়া মনে হয় দম বাইর হইয়া যাইব। কে যেন আইনা বালতি দিয়া পানি খাওয়ায়। কিন্তু পানির পিপাসা যায় না। গুল্লি খাইলে কেমন পানির পিপাসা হয়—তাতো অন্য কেউ কইতে পারব না। শনিবার রাইতটাও শামসুন্নাহার হলের ওই জায়গায়ই রইলাম। রোববার সকালে আর্মি হলের দেয়াল পার হইয়া অন্য দিকে গেছে। এই ফাঁকে কয়েকজন ছাত্র আইসা আমাদের ঢাকা মেডিকেলে নিয়া যায়। গুলিতে তো আমার শরীরের কাপড় ছিন্নভিন্ন। আমি খালি কাপড় টানি। ছাত্ররা কয়, আপনি আমাদের মায়ের মতো। এগুলো নিয়ে এখন ভাইবেন না। তারা আমারে ঢাকা মেডিকেলে নিল। রক্ত যাইতে যাইতে আমার অবস্থা তখন খুব খারাপ। চোখে ঝাপসা দেখতাছি। কইলাম, বাবারা, আমি আর বাঁচুম না। হাবুল আমার ছেলেটারে নিয়া গেল বাপের বাড়ি।

 

আপনার বাবা তখনও খবর পাননি?

আমার মা—বাবা শুনছে যে, আমি, নুরী ও আমার স্বামীসহ সবাই শহিদ হইয়া গেছে। তারা কান্নাকাটি কইরা ঢাকা আইতে চাইছিল। কিন্তু গ্রামবাসী আসতে দেয় নাই। বলে, গেলে তোমাদেরও মারব। গ্রামবাসী একপর্যায়ে তাদের বাইন্ধা রাখে। আমি ভালো হওয়ার পর মা পরে এই কথা আমারে কইছে।

 

তারপর হাসপাতালে চিকিৎসার অবস্থা কেমন ছিল?

ছাত্ররা তো ভর্তি করাইয়া দিয়া গেল। আমারে অমনেই ফালাই রাখছে। ছাত্ররা তো দেশের চিন্তায় আছে—কেমনে দেশ স্বাধীন করবে। তাই তারা ভর্তি কইরাই চইলা গেছে। আমি হাসপাতালের কিছু চিনি না। কোথায় খাবার দেয়। কোনখানে কী দেয়? কাছের লোক তো কেউই নাই। খালি ব্যান্ডেজ করছে। চিকিৎসা কিছুই হয় নাই। বিকেলবেলা আমার বাবা ও মামাতো ভাই আসে। তারা তো জানে, আমি মরা। লাশ নিতেই আসে। পরথম হলে যায়। গিয়া দেখে সব লাশ গর্তের ভিতরে। গর্ত খুইরা অনেক লাশের নিচে আমার স্বামী আর বোন নুরীর লাশ পাইছে। আর্মি তখন হলে ছিল না। আব্বা রিকশা চালায় তো। একটা ভ্যানগাড়ির ব্যবস্থা করে। লাশ দুইটা ভ্যানগাড়িতে উঠাইছে। তারপরেই আর্মি আইসা পড়ে। আব্বার মাথায় বন্দুক ধইরা কয়, লাশ গর্তে রাইখা আয়। নইলে গুলি করব। আব্বা আবার লাশ গর্তে ফালাইয়া আসে। লোকদের জিগায়, আমার মেয়ে কই? লোকজন কয়, হাসপাতালে গিয়া পাইতে পারেন। আব্বা তখন হাসপাতালে আসে। সেখানে আহত অনেক লোক ছিল। আব্বা তো খুইঁজা পায় না। আমার সামনে দিয়াই কয়েকবার হাঁইটা গেছে। কিন্তু চিনতে পারে নাই। আমার তো রক্ত সইরা চেহারা সাদা হইয়া গেছে।

আমি আব্বারে দেইখাই ডাকি। কিন্তু গলা দিয়া আওয়াজ বেরুয় না। পরে আমার দিকে তাকালে আমি ইশারা দেই। তখন আব্বা আসে। আমি তো কানতাছি। উনি সান্ত্বনা দিয়া কয়, তর জামাই আর নুরী নিচের তলায় ভর্তি আছে। অরা ভালো আছে। কান্দিস না। আমি তো কই, সবই তো দেখছি বাবা। কইয়া কানতাছি।

রানের ভিতরে গুলি ছিলই। হাসপাতালে আর্মিও আসে। আমারে কয় কি হইছে? আমি ভয়ে কই—পইরা গিয়ে ব্যথা পাইছি পায়ে। গুল্লি লাগছে বললে যদি মনে করে আমি মুক্তি। এই ভয়ে সত্য কথা কই নাই। নার্স ও ডাক্তার মাঝেমধ্যে আসত। আবার যাইত গা। যদি মাইরা ফালায়।

১৫ দিন পর একদিন আব্বা আমার পাশে বইসা কয়, তোর শরীর থেকে এমন পচা গন্ধ বার হইতাছে। আমি কই, আব্বা ব্যান্ডিজ তো একদিনও খুলে নাই। পা তো ফুইল্লা রইছে। খালি একটা একটা ইনজেকশন দিয়া যায়। আব্বা নিচতলায় গিয়া ডাক্তার আনছে। ডাক্তার আইসা দেখে অবস্থা খারাপ। ডাক্তার হাত দিয়ে দেখবার চায়। আমি খালি সরাইয়া দেই। কারণ গুল্লি তো আমার রানে লাগছে। পরে ডাক্তার ধমক দিছে। আব্বা আমার হাতে জোর কইরা ধরে। তারপর ওটিতে নিয়া যায়। রাইতে গুল্লি বাইর করে। আমি তো অজ্ঞান। আব্বা সারা রাইত বারান্দায় ছিল।

 

হাসপাতালে কত দিন ছিলেন?

৯ মাসই হাসপাতালে ছিলাম। ছেলেকে দেখার জন্য এরমধ্যে ৩ বার পলাইয়া মাতুয়াইল চইলা গেছিলাম। আব্বা বারবার আইনা ভর্তি করছে। কারণ গুল্লির ঘা শুকায় নাই। প্রথমবার টানা ৩ মাস ছিলাম। আবার পরে ২বার ভর্তি হই। দেশ স্বাধীন হওয়ার ২ দিন আগে আবার মাতুয়াইলা চইলা যাই।

 

দেশ স্বাধীন হওয়ার খবর কি বাড়িতে থেকেই পেলেন?

না। তখন তো পুরা যুদ্ধ। আমাদের বাড়িতেও আর্মি আসে। আব্বা আমারে ডেমরার আমুলিয়া নিয়া যায়। ইন্ডিয়ার আর্মি খালি শেল মারতাছে। তারপর আব্বা আমারে রূপসী নিয়ে যায়। ওখানেও শেল মারছে। শেল পইড়া তাল গাছ পুইরা গেছে। আমার বাচ্চা খুব কানতাছিল। একলোক আইসা দুধ দিল। একটা বুড়া লোকের বাড়িতে গিয়া আশ্রয় নিলাম। বুড়ার সব লোক ইন্ডিয়া গেছে। ১৬ ডিসেম্বর আইল। আমার ঐদিন খুব ঘুম পাইছে। ৪টা সময় শুনি সবাই খালি জয় বাংলা করতাছে। চারদিকে খালি জয় বাংলা শ্লোগান। আব্বা কয়, দেশ স্বাধীন হইয়া গেছে, আর চিন্তা নাই। আমি কানতে কানতে কই, আমার তো সব গেছে। সব হারাইয়া স্বাধীন অইল। এই কইয়া অজ্ঞান হইয়া গেলাম।

 

দেশ স্বাধীন হলে কোনো সাহায্যসহযোগিতা পেয়েছিলেন?

বঙ্গবন্ধু আমার স্বামীকে ২০০০ টাকা লেইখা চিঠি দেয়। এই টাকা পাইছি। পাইয়া স্বামীর নামে ৫০০শ টাকা দান করি। আমি আহত বইলা ১০০০ টাকা দেয়। কিন্তু সেইটা আর উঠাইতে পারি নাই। আমার আব্বা এইটা ভাঙাইতে গেলে কয়, যার নামে ইস্যু করা সে আসতে হবে। তারপর আমি মন্ত্রণালয়ে যাই। কিন্তু পা তখনও ভালো হয় নাই। বিল্ডিংয়ে তো উঠতে পারি না। আব্বা আমারে নিচে রাইখা উপরে যায়। কয় কি, স্বামী তো পাইছেই। পরে আইসো। তারপর এই টাকাটা আর পাই নাই।

 

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো সহযোগিতা পেয়েছিলেন?

হ্যাঁ, পাইছিলাম। স্বাধীনতার পর টানা ১৭ বছর মাসে ২শ টাকা করে ভাতা পাই। এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর কয়েকমাস ৪শ টাকা করে পাইতাম। এরপর ভাতা দেওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়।

 

এখন কোনো ভাতা পান?

না।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শহিদ কর্মকর্তাকর্মচারি পরিবারদের তো বিনাভাড়ায় কোয়ার্টার দেয়া হয়। সেটা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে। আপনার কবে থেকে কোয়ার্টার পান?

হ্যাঁ, ১৯৭৩ সাল থেকে আমিও কোয়ার্টারে আছি। তবে আমার নিজের একটা চাকরির চেষ্টা করছি, কিন্তু পাই নাই। পরে ছেলে বড় হওয়ার পর চেষ্টা করি। কিন্তু তাও হয় নাই। তারপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করি। তখন কার্জন হলের একটা বিভাগে আমার ছেলের ইন্টারভিউ আছিল। কার্ডটা প্রধানমন্ত্রীর হাতে দেই। উনি বলেন, ‘কী! শহিদের ছেলের চাকরি হয় না! আমি বিভাগের চেয়ারম্যানকে ফোন করব’। এই বলে তার পিএসকে কার্ডটা রাখতে বলেন। পরে কিন্তু আমার ছেলের চাকরি আর হয় নাই। উনি ফোন করছিলেন কিনা তাও জানি না। তার কাছে আরেকবার যাওয়া আর সম্ভব হয় নাই। কিন্তু তারপরও চাকরি হয় নাই। এখন ছেলেটা ছোটখাটো চাকরি করে, কোনোরকম সংসার চালায়।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
স্লিপিং ট্যাবলেট খেলেও ভূতের ভয়ে সরকারের ঘুম আসে না: গয়েশ্বর
স্লিপিং ট্যাবলেট খেলেও ভূতের ভয়ে সরকারের ঘুম আসে না: গয়েশ্বর
অবন্তিকার আত্মহত্যা: প্রশাসনকে লালকার্ড দেখালেন শিক্ষার্থীরা
অবন্তিকার আত্মহত্যা: প্রশাসনকে লালকার্ড দেখালেন শিক্ষার্থীরা
‘গুলশান লেক থেকে কোটি কোটি মশা বেরিয়ে গেছে’
‘গুলশান লেক থেকে কোটি কোটি মশা বেরিয়ে গেছে’
৩ তরমুজ ব্যবসায়ীকে জরিমানা
৩ তরমুজ ব্যবসায়ীকে জরিমানা
সর্বাধিক পঠিত
দিন দিন নাবিকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছে দস্যুরা
দিন দিন নাবিকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছে দস্যুরা
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা সাকিবকে আমার বাসায় নিয়ে আসেন: মেজর হাফিজ
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা সাকিবকে আমার বাসায় নিয়ে আসেন: মেজর হাফিজ
‘বিএনএমের সদস্য’ সাকিব আ.লীগের এমপি: যা বললেন ওবায়দুল কাদের
‘বিএনএমের সদস্য’ সাকিব আ.লীগের এমপি: যা বললেন ওবায়দুল কাদের
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার