X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১
বছরের দীর্ঘতম রাত

এক মোহময় অভিজ্ঞতা

উম্মে ফারহানা
০৫ মে ২০১৯, ০৬:০০আপডেট : ০৫ মে ২০১৯, ০৬:০০

এক মোহময় অভিজ্ঞতা ইদানীং গল্প আর কবিতায় ইংরেজি শিরোনাম বিরল নয়। বেশ ক’বছর ধরেই দেখছি বাক্যের ভেতরে যেভাবে ইংরেজি ঢুকে পড়ে, সাবলীলভাবে, লেখাতেও সেটিকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছেন না লেখকরা। কথ্য ভাষায় লেখার এই ধারাটিকে সকলে গ্রহণ না করলেও ধারাটি জনপ্রিয় হয়েছে বেশ। আবদুল্লাহ আল মুক্তাদিরের প্রথম গল্পগ্রন্থ বছরের দীর্ঘতম রাত (২০১৯) যে ভাষারীতিতে লেখা তা কথ্য না হলেও আলাদা। অনেকগুলো গল্পের শিরোনাম ইংরেজি ভাষায়, শুধু শব্দ নয়, গোটা বাক্যই গল্পের শিরোনাম, যেমন: দ্য মোস্ট পোয়েটিক লেটার্স কিংবা আ লেটার ফ্রম দ্য নিউ নার্সিসাস কিংবা কাদম্বিনীঃ হার সুইসাইড ইজ আ পলিটিকাল ডেথ। ঠিক পোশাকি প্রমিত ভাষারীতিকে অবধারিত ধরবার প্রবণতাও অনুপস্থিত। বলা যায় গদ্যভাষা নিয়ে একেবারে নতুন ধরণের কিছু পরীক্ষাই করেছেন লেখক।

এই গ্রন্থের গল্পগুলো অনন্য বহুভাবে। প্রথমত, এর চরিত্রায়ন আক্ষরিক অর্থেই অসাধারণ। মৃত ব্যক্তির আত্মা, একটি কর্পুর গাছ, একজন নর্তক—এমন বিচিত্র চরিত্রেরা মুক্তাদিরের প্রটাগনিস্ট। রোজকার দেখাশোনা জীবনকে না দেখে সমান্তরালে চলা আরেকটি জীবনের ধারার খানিক আভাস যেন পাওয়া যায় এই গল্পগুলোতে। তাই বলে একে ফ্যান্টাসি ধরণের লেখা বলেও আলাদা করা যাবে না। ফ্যান্টাসিতে যেমন প্রয়োজন হয় ‘willing suspension of disbelieve’-এর, এই গল্পগুলোতে তেমন জবরদস্তি নেই। গডেস অফ দ্য উইকেন্ডস’র দেবীকে কোনো জাদুবাস্তবতার আলোয় দেখা যায় না, প্রচলিত অর্থে ফ্যান্টাসি বলতে আমরা যা বুঝি তেমন অতিপ্রাকৃতের আভাসও নেই এই চরিত্রগুলোতে। বরং মনে হয় লোকায়ত ধারণা, পৌরাণিক সত্য যাকে বলা যায় সাবজেক্টিভ ট্রুথ, তার দিকেই লেখক ঝুঁকেছেন বেশি।

নামগল্প ‘বছরের দীর্ঘতম রাত’ও এক দেবীর কথা বলে। দেবীদের শক্তিমান করে আঁকেন লেখক, সম্ভবত এ তাঁর মহাকাব্য পাঠের প্রভাব। পুরাণে আমরা দেখেছি নারীরা শক্তিময়ী, নারীরা স্বাধীন ও স্বচ্ছন্দ। মুক্তাদিরের দেবীরাও তেমনি। বছরের দীর্ঘতম রাত-এ দেখি দেবীর প্রেমে পড়বার ভয়ে সুন্দর পুরুষেরা কালিঝুলি মেখে রূপ লুকাতে ব্যস্ত, যেন দেবীর নজরে পড়ে না যান। অথচ দেবী কোনো অপশক্তি নন, নন কোনো বিধ্বংসী হিংস্র মায়াবিনী। আসলে দেবীর দিক থেকে প্রেমের এই দৃষ্টি মানবিক সামর্থে ধারণ করা সম্ভব হয় না, তাই পুরুষেরা চায় না অমন প্রেম।

চরিত্রায়ণের সঙ্গে সঙ্গে লেখার ফর্মেও লেখক বহু পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন বলে বোধ হয়। আবদুল্লাহ আল মুক্তাদির মূলত কবি, তার প্রকাশিত অন্য গাঙের গান, সমুদ্রসমান যারা পড়েছেন তাঁরা ধরতে পারবেন যে এই ভাষাটি মুক্তাদিরের নিজস্ব। গদ্য লিখবার সময়ও তিনি তাঁর নিজ ভাষায় সাবলীলভাবে প্রকাশ করে গেছেন বিভিন্ন বয়ান। ছোট ছোট গল্পগুলির চিত্রকল্পও এমন যে মনে হয় এটি হলেও হতে পারতো দীর্ঘ একটি কবিতা। কবিতায় যেমন গল্প থাকে, কোনো না কোনো কাহিনীর আভাস পাওয়া যায়, এই গল্পগুলোতেও সেভাবেই উপস্থিত কাব্যভাব। গদ্য পদ্যের মাঝখানের যে বেড়া, সেটিকে মাড়িয়ে উভয়পাশে স্বচ্ছন্দ চলাফেরার প্রয়াস বলেই অনুমান করি এই লেখাগুলোকে।

কিন্তু কৌতুহলোদ্দীপক ব্যাপার হলো, গল্পগুলো আকারে যেমন ছোট, পাঠে ততটা সহজ নয়। সহজ নয় এই অর্থে যে, যেসকল রেফারেন্স ব্যবহার করেছেন লেখক, দেশি বিদেশি মিথ আর প্রাচ্যপাশ্চাত্যের জনপ্রিয় সংগীতের উল্লেখ করেছেন তা বেশ খানিকটা সচেতনতা দাবী করে। গল্পের বর্ণনাভঙ্গিও এমন যে পাঠক মনোযোগী না হলে তা পুরোপুরি উপভোগ করতে ব্যর্থ হবেন।

মিথ আর গান শুধু নয়, এদেশীয় সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ সহজ সরলভাবে চলে এসেছে এই সংকলনের গল্পগুলোতে। হোমিওপ্যাথের দোকান, গ্রামের ঈদগাহ মাঠ, মফস্বলের সিনেমাহল—এ সকল কিছুই এদেশের মানুষের জীবনের মূলধারার চিত্রায়ণে ঠিকঠাক সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে গেছে গল্পের সেটিংয়ে। এই দেশের মানুষের জীবনকে, তার বাস্তবতাকে ধরবার জন্য লেখক গদ্যসুলভ নিরপেক্ষতার বদলে বেছে নিয়েছেন কাব্যসুলভ আবেগকে। ‘দেশ আমাদের বিষাদ জনক, এই দেশ আমাদের বিষণ্ণ মাতা’ গল্পের উল্লেখ এক্ষেত্রে বিধেয়। দেড় পৃষ্ঠার এই গল্পে কবিতার মতন মেটাফোর ব্যবহার করেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি আর কবিতা হয়নি, ইচ্ছাকৃতভাবেই একে গদ্য হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন লেখক।

পুরো সংকলন থেকে যদি একটি গল্পের কথা বলতে হয়, আমি বেছে নেবো ‘ভেজা বাতাসে গ্রামটাকে ভুল মনে হয়’ শিরোনামের গল্পটিকে। শুধু আকারে দীর্ঘ বলেই নয়, বিষয়বস্তু এবং বর্ণনার রীতি, দুই দিক থেকেই চমকপ্রদ এই গল্প। বিষাদের সঙ্গে মিশে আছে খানিক প্রশান্তি, জীবনের অপর পাড়কে যেন দেখতে চাইছেন তিনি, দিগন্তবিস্তৃত নদীর এক পাড় থেকে যেমন দেখার চেষ্টা করা যায় ওপাড়ে কি আছে, পুরোপুরি দেখা যায় না, অনুমান করা যায় শুধু।

গল্পগুলো হয়তো হতে পারতো আরেকটু বড়, হয়তো বর্ণনাগুলো কিছুক্ষেত্রে আরো প্রাঞ্জল হতে পারতো, তাতে গল্পের ভেতরে ঢুকতে সুবিধা হতো পাঠকের। ন্যারেটিভে আরেকটু বিস্তৃতি বরং বেশি সুখপাঠ্য করতো গল্পগুলোকে। ‘চাঁদ বহুকাল চাঁদ থাকার পর’ শিরোনামের গল্পটি যেমন বয়সন্ধির বালকের কথা জানিয়েছে, ফুরিয়ে গেলে পরে মনে অতৃপ্তি জাগে, মনে হয় আরেকটু জানতে চাই ছেলেটাকে, কিছুইতো বললেন না লেখক। ‘অন্য বেহুলা’র বাবার চরিত্রটিকে মানবিক করে তোলার জন্যও আরেকটু বিস্তৃতি জরুরি ছিল, পিতাপুত্রের সম্পর্কের মিথষ্ক্রিয়া কীভাবে পাল্টে যায়, কীভাবে সময়ের সঙ্গে বদলায় সব ধরণের আবেগ, আরো বিশদে বললে গভীর হতো।

লেখায় পরীক্ষানীরিক্ষার মূল চ্যালেঞ্জই হলো যে পাঠক পড়বার সময় এই পরীক্ষানিরীক্ষার কোনো চিহ্ন পাবেন না, লেখাকে লেখার মতন উপভোগ করতে পারবেন। এই মানদণ্ডে মুক্তাদিরের লেখা উত্তীর্ণ বিবেচিত হবে। গল্পের মধ্যে তিনি দিয়েছেন কবিতার স্বাদ, গদ্যের মধ্যে এনেছেন কাব্যের ঘোর। বছরের দীর্ঘতম রাত পাঠের অভিজ্ঞতা মোহময়।

সবশেষে বলা যায়, বছরের দীর্ঘতম রাত নামের সংকলন আজকের বাংলাসাহিত্যের জগতে এক নতুন সংযোজন। গল্প কিন্তু কবিতার মতন, পরীক্ষামূলক হয়েও সাবলীল, আবেগী হয়েও তীক্ষ্ণ এমন গদ্য খুব বেশি লেখা হয় না।

গল্পগ্রন্থ:বছরের দীর্ঘতম রাত/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির/প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত/প্রকাশক: ঐতিহ্য, ঢাকা/প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৯/ পৃষ্ঠা: ৭৮/ মূল্য: ১৫০ টাকা

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
চতুর্থ ধাপে যে ৫৫ উপজেলায় ভোট
চতুর্থ ধাপে যে ৫৫ উপজেলায় ভোট
ঝিনাইদহ-১ আসনের উপনির্বাচন ৫ জুন
ঝিনাইদহ-১ আসনের উপনির্বাচন ৫ জুন
সোনার দাম ভ‌রিতে কমলো ৩ হাজার টাকা
সোনার দাম ভ‌রিতে কমলো ৩ হাজার টাকা
সর্বাধিক পঠিত
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
উৎপাদন খরচ হিসাব করেই ধানের দাম নির্ধারণ হয়েছে: কৃষিমন্ত্রী 
উৎপাদন খরচ হিসাব করেই ধানের দাম নির্ধারণ হয়েছে: কৃষিমন্ত্রী 
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ