X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ফর্মের দিক থেকে আল মাহমুদ বেশ পরিপাটি

উৎপলকুমার বসু
১১ জুলাই ২০১৯, ১২:৩০আপডেট : ১১ জুলাই ২০১৯, ১৩:৪৮

আলোকচিত্র : এস এম সাইফুল ইসলাম, ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত

আল মাহমুদের কবিতায় নানারকমের পর্ব আছে। প্রথম থেকেই যেটা লক্ষ করার মতো সেটা হলো এই যে, কবিতায় ফর্মের দিক থেকে তিনি বেশ পরিপাটি। সাজানো গোছানো। ছন্দে বাঁধা সমিল পয়ার বা সনেটের রীতিতে তিনি যতটা সাবলীল, আমার মনে হয় গদ্যকবিতা বলতে ঠিক যা বোঝায়, তাতে তিনি ততটা বিশ্বাসী নন। তেমন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। যদিও কারাবাসের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে যখন ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’র কবিতাগুলি লিখেছেন, তাতে গদ্য কবিতার নানাধরন ও বিন্যাস আছে। আল মাহমুদের কবিতাকে এই দিক থেকে পাঠক কিছুটা আজকের দেশকালের চিন্তা ধারায় প্রাচীনপন্থী বা রক্ষণশীল মনে করতে পারেন। কিন্তু এর একটি সদর্থক গুণও আছে। আজকাল কবিতায় কবিরা গ্যাপ বা ফাঁকফোকর রাখতে ভালোবাসেন, কিন্তু আল মাহমুদের সমকালে এই ধারাটি সুপ্রশস্ত ছিল না, তা সত্ত্বেও কবির ভাবনা এক-একটি ছত্রে বা পঙক্তিতে যেভাবে পর-পর সজ্জিত হয়ে ওঠে, তার ভেতরে একটা চিন্তাসূত্রের উল্লম্ফন থেকে যায়। এটা আল মাহমুদের কবিতার এক নতুনত্বের দিক বলে আমার মনে হয়েছে।

প্রথম ভাবনা থেকে দ্বিতীয় ভাবনার ক্রমিক বিন্যাস এক্ষেত্রে পাঠকের চিন্তা ও কল্পনার ওপরেও খানিকটা নির্ভর করে। কবি এইভাবে পাঠকদের কাছে স্বপ্ন দেখার উৎসটুকু রাখেন আর পাঠককে এমন এক স্বাধীনতা দেন, ফলে লেখক-পাঠক মিলেমিশে একটি অনুভব চক্র তৈরি হয়। আল মাহমুদের যে-কোনো কবিতার মধ্যেই এইরকম একটি ব্যাপার আছে। কবি লিখলেন একভাবে আর পাঠক তার নিজের মতো করে একটা মানে করছে, সে নিয়ে তর্কাতর্কি করছে এবং কিছুটা ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণও এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে; এতে কবির কবিতাটি একটি বহুমাত্রিক রচনা হয়ে ওঠে যেখানে একাধিক কণ্ঠস্বরের তারতম্য একটি বৃত্তাকার আবহ তৈরি করে নেবে। প্রাচীন গ্রিস বা রোমে যেমন একটি ধারণা আছে যে—'Every book has its own destiny'—লেখক ভাবলেন যে তিনিই বইটির ভাগ্যবিধাতা, কিন্তু আদতে তা তো নয়। পাঠক ও লেখকের মধ্যে একটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের জোরেই বইটির নিয়তি চিহ্নিত হয়। শুধুমাত্র কবি বা লেখক তার জন্য দায়ী হতে পারেন না। কবিতা পঠন-পাঠনের অভিনব এই বিক্রিয়ার মধ্যে থেকে আল মাহমুদ আজও আমাদের কাছে জীবন্ত ও জনপ্রিয় নিশ্চয়ই, যার ফলে তাঁকে নতুন করে মূল্যায়নের প্রয়োজন বোধ করেছি আমরা।

আল মাহমুদের কবিতা অনেক সময় আখ্যানকেন্দ্রিক বা ন্যারেটিভ নির্ভর। আজকের পাঠক যেভাবে নিজেদের মতানুগ একটি কাহিনি বুনে তুলতে সক্ষম, সরু একটিমাত্র সরলরেখায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়া linear গল্পের চল আজ আর নেই। আজ আমরা কেউই আর ‘দেবতার গ্রাস’-এর মতো কবিতা লিখতে চাই না। আখ্যান-এর কালানুক্রমিক পট কখনও ভাঙা হলেও, আল মাহমুদ রয়ে-বসে গল্প বলার একটি প্রবণতা বারবার প্রয়োগ করেছেন কবিতায়।

আল মাহমুদের কবিতা মূলত মধ্যপন্থী। অর্থাৎ তা প্রাচীন ঐতিহ্যকেও স্বীকার করে এবং নতুনকেও যুগিয়ে দেয় কলমের ডগায়। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা কবিতায় নারী-পুরুষের প্রেমসম্পর্ক বিশেষভাবে বর্ণনা নির্ভর। সেই বর্ণনা বা বিবৃতি নারী অবয়বকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে। সৌন্দর্য মুগ্ধতাই হোক বা অনুভবের গভীরতাই হোক একধরনের অঙ্গ-সংস্থান-সাযুজ্যকে বারবার মূর্তিতে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। শরীরের অ্যানাটমিটাই এখানে বড়ো। আবার এই শরীর-সৌষ্ঠবের মধ্যে দিয়েই অধিবাস্তবতা বা metaphysical বিশ্বাসের জগতে ব্যক্তি তার উৎক্রমণকে ঘনিয়ে তুলেছে। আমাদের সংস্কৃতিতে আউল-বাউল-সুফি-দরবেশ রচিত গান বা ছড়ার মধ্যে এই বোধ কাজ করেছে। বৈষ্ণব পদাবলিতে শেষপর্যন্ত দেহ অতিক্রান্ত ভাবসম্মিলনটাই তো বড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষ্ণের মথুরা গমনের পরে তাই রাধার এই সুররিয়ালিস্ট, জগৎটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু জীবনানন্দ তাঁর বনলতা সেনের মধ্যে দিয়ে নতুন ধারার প্রচলন ঘটালেন। নারীর অবস্থান পালটে গেল। নারী-পুরুষ সম্পর্কের ভিত্তি এখানে 'techno-political' । ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’—এই প্রশ্নটির মধ্যে এটা স্পষ্ট যে মেয়েটির বিস্ময় তৈরি হয়েছে যুবকের নিরুদ্দেশের কারণে। এই চলে যাওয়াকে সে ব্যাখ্যা করবে বলে বসে আছে—এভাবে যদি মেয়েটির দিক থেকে কবিতাটাকে পাঠ করি, যাকে বলে 'reading in reverse', তবে বনলতা সেনের অবস্থানগত বিশেষত্ব আমাদের চমৎকৃত করবে। তাই দু’দণ্ডের মুখোমুখি বসার মধ্যে দিয়ে নারী ও পুরুষের সম্পর্কের একটা নতুন দিক এখানে উঠে এল যা শারীরিক নয়, মানসিক আদান-প্রদানের অন্য এক বৃত্তকে বুঝিয়ে দেয়। এইভাবে বাংলা কবিতার ধারায় আমরা পূর্বসূত্রে লব্ধ 'anatomico-metaphysical'  সম্পর্ক সম্ভাবনাকে অন্যভাবে দেখতে চাইছি, যদিও কেউ-ই সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারছি না। আল মাহমুদ এই দিক  থেকে এই দ্বিমুখী চিন্তাচেতনার কথা বলতে চেয়েছেন।

আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’ দীর্ঘ কবিতাটি শুরু হয়েছে এই 'techno-political' দিগন্ত থেকে। অপরিচিতা অনাত্মীয়া মেয়েটিকে প্রলুব্ধ করবার জন্য পুরুষটি নিজের প্রেমিকসত্তার যে প্রকার তরঙ্গ তুলে ধরেছে, নিজের কৌমার্যকে যেভাবে প্রাধান্য দিয়েছে, তা কিন্তু শেষপর্যন্ত বিবাহপ্রথার সেই পুরোনো রীতিকেই অবলম্বন করেছে তার সঙ্গে মিলিত হবার জন্য। ‘কবুল কবুল’ বলার মধ্যেই তার আসল স্বীকৃতি ও ঘোষণা এটা সে মেনে নিয়েছে। একই অবস্থান প্রক্রিয়ার সমতলে থাকলেও পুরুষটি মেয়েটির সম্মতির জন্য প্রার্থী হয়ে আছে, তাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে তার সম্মতির এবং যৌথজীবনের আগে সে প্রথাকেই গ্রহণ করে তাকে অনুষ্ঠানাদির সাহায্যে বিবাহ করছে। এখানে অধিবাস্তবের প্রয়োজনটুকু বুঝিয়ে দিয়েছে ঐতিহ্যকে রক্তের মধ্যে মনে রেখেই অগ্রসর হয়েছেন কবি।

বাংলা ছোটগল্পে এই 'techno-political'  যে মানব, তার প্রথম পদক্ষেপ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে। এছাড়া সতীনাথ ভাদুড়ির ‘জাগরী’ উপন্যাসেও এর রূপায়ণ দেখতে পাই। আল মাহমুদের কিছু কিছু গল্পে এই সমাজতাত্ত্বিক ত্রিকোণের বহুমাত্রিক অবস্থান দেখতে পাই। পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের মধ্যে পরবর্তী ধাপে এসেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ননী ভৌমিক, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকেরা। আল মাহমুদ মূলত 'metaphysical' এবং ব্যক্তি-সমাজ সম্পর্কের বিন্যাসকে দু-দিকে দু-নৌকায় পা দিয়ে চলার আগ্রহ দেখিয়েছেন বলে মনে হয়। কিন্তু প্রাচীনপন্থীর ঐতিহ্য-বিশ্বাস নিয়ে যেমন গৌতম বসুর ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’-এ বা বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়ের লেখায় ফুটে ওঠে আজও। আমরা চাইছি এই পর্ব থেকে নতুন স্তরে উত্তীর্ণ হতে। তাই দু’দিক থেকেই এই দ্বিমাত্রিক টানাপোড়েনের পথে আমাদের অগ্রসর হতেই হয়। আল মাহমুদ সেই নতুন যাত্রার দিশারি।পুনর্মুদ্রণ

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী