X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

জোসেফ কনরাডের হাত ধরে নরক দর্শন

অমল চক্রবর্তী
২৭ আগস্ট ২০১৯, ০৮:০০আপডেট : ২৭ আগস্ট ২০১৯, ০৮:০০

জোসেফ কনরাডের হাত ধরে নরক দর্শন

জাতিতে পোলিশ, জন্মেছেন ইউক্রেনে, জীবন কাটালেন ইংল্যান্ডে, হয়ে উঠলেন ইংরেজি ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক—যে ভাষা তিনি একুশ বয়স পর্যন্ত জানতেন না। জোসেফ কনরাডের এই বৈচিত্রপূর্ণ ব্যক্তিগত পটভূমি তার উপন্যাসকে অনেকটা প্রভাবিত করেছে। সেই কবে জোসেফ কনরাডের ‘হার্ট অফ ডার্কনেস’ পড়ে অন্ধকারের আরাধনা দেখে শিউরে উঠেছিলাম। খুব কষ্ট লেগেছিল দর্পনে নিজেকে দেখে—এই পিশাচ যোনির বৃত্তান্ত! জাহান্নাম দেখার অভিজ্ঞতা পেতে চাইলে এই নভেলার প্রথম ১০-১২ পৃষ্ঠা পড়লেই চলবে। কনরাড বিশটির বেশি উপন্যাস লিখলেও, ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত এই ছোট আয়তনের উপন্যাস আধুনিতকতাবাদী সাহিত্য আন্দোলনকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। প্রকাশিত হওয়ার শত বছর পরেও বিষয়বস্তু ও রচনাশৈলীর অভিনবত্বের কারণে সমভাবে আলোচিত ও সমালোচিত এই নভেলা আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম প্রধান সম্পদ। এই উপন্যাসকে ঘিরে উত্তর ঔপনিবেশিক লেখকদের তীব্র প্রতিক্রিয়া এখনো এর প্রাসঙ্গিকতাকেই তুলে ধরে।

এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র দুজন—কুর্টজ নামের এক নির্মম ও পৈশাচিক বেলজীয় প্রশাসক এবং মার্লো নামের কাহিনীর সূত্রধর—অনেক বছর পরে সাম্রাজ্যের কেন্দ্র লন্ডনের টেমস নদীতে নেলি নামের এক স্টিমারে যে বসে কঙ্গো ভ্রমণের স্মৃতিচারণ করছে। ১৮৯০ সালের মধ্যে আফ্রিকার অধিকাংশ অঞ্চল ইউরোপের কলোনিতে পরিণত হয়। এই উপন্যাসে ‘ডার্কনেস বা অন্ধকারের কেন্দ্র বলতে ভৌগোলিক অর্থে কঙ্গো বোঝালেও, গূঢ়ার্থে মানব মনের অমীমাংসিত অন্ধকারকে নির্দেশ করে। এই ইঙ্গিত মার্লো অনেকবার ভাবে ও ভাষায় জানিয়েছে। আফ্রিকার একেবারে হৃদপিণ্ডের মাঝে মার্লো স্টিমার চালক হিসেবে গিয়েছিল। এই যাত্রাকে এমনভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, বোঝা যায় ভৌগোলিক কঙ্গো নদীর চেয়ে এতে মূলত মানুষের ভেতরের অবচেতন যাত্রাকে দেখানো হয়েছে। ইউরোপ থেকে জাহাজে করে আফ্রিকার কূলে পৌঁছানোর পর পনেরো দিন হেঁটে প্রায় দুইশ কিলোমিটার ভেতরে সেন্ট্রাল স্টেশনে মার্লো ও আরো ষাটজনের দল যখন পৌঁছালো, তখন আরো গভীরভাবে তার কাছে ঔপনিবেশিক নৈরাজ্যের ভয়াবহতা প্রকট হলো। কুর্টজ নামের আগ্রাসী ও সফল এজেন্টকে উদ্ধার করার জন্য মার্লো যখন সেই বড় কঙ্গো নদী বেয়ে আফ্রিকার জঙ্গলের ভেতরে প্রবেশ করে সেখানে অসুস্থ, শীর্ণ, অভুক্ত আফ্রিকাবাসীদের দেখে তার মনে হয় এটাতো ‘জাহান্নামের একেবারে মধ্যে সেঁধিয়ে যাওয়া’। কুর্টজ আফ্রিকা গিয়েছিলো এক মহান ঔপনিবেশিক মিশন হাতে নিয়ে; কিন্তু তার পরিণতি বড় করুণ। গহীন বন  আর বিশাল স্বাধীনতা তার ভেতরের পশুত্বকে উন্মুক্ত করে দিলো। মার্লো স্বীকার করে—বনের আর একটু গভীরে গেলে হয়তো তারও এই একই অবস্থা হতে পারতো।

১৮৯৭ সালে প্রকাশিত ‘নিগার অফ দা নার্সিসাস’ উপন্যাসে কনরাড তার লক্ষ্য হিসেবে বলেছিলেন, ‘এমন সাহিত্যিক হব, যার শব্দ দেখার আগে তোমাকে শ্রবণ করাবে’। ঠিক যেন  ইম্প্রেশনিজম চিত্র আন্দোলনের মতো কনরাড পাঠককে অনুভূতির গভীরে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। আর ‘হার্ট অব ডার্কনেস’ উপন্যাসের নাতিদীর্ঘ কাহিনী সেটাই আমাদেরকে দেখায়। মার্লো যখন জঙ্গলের গভীরে ঢোকে আমরাও তার সাথে কঙ্গো নদীর ভেতরে ঢুকি, জঙ্গলের স্পর্শ পাই, নরমাংসভোজীদের ঢোলের শব্দ শুনি আর গহীনতায় আঁতকে উঠি। কঙ্গোর গভীর জঙ্গল থেকে আধমরা অবস্থায় কুর্টজকে উদ্ধার করে জাহাজে আনার পরে, ওই রাতে সে পাগলের মতো হামাগুড়ি দিয়ে আবার সেই অন্ধকারেই যেতে চেয়েছিলো। মার্লো আক্ষরিক অর্থেই জোর করে লড়াই করে তাকে আবার স্টিমারে ফিরিয়ে এনেছে। এই অন্ধকার প্রীতি কুর্টজ চরিত্রকে জীবনানন্দ দাশের ‘অন্ধকার’কবিতার মতো আরো প্রতীকী করে দেয়, যেন কুর্টজ চিৎকার করে বলতে চায় :

‘আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি;

অন্ধকারের  স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে 

 থাকতে চেয়েছি’

কুর্টজ আসলে কে? নিছক সাম্রাজ্যবাদী শাসক যে নয়, তা তো শুরু থেকে বুঝেছি। কুর্টজ সেই আর্কিটাইপাল (অশুভ প্রতিভা)—উচ্চ প্রতিভাশালী কিন্তু শেষ পর্যন্ত অবক্ষয়িত ব্যক্তি যার পতনে রয়েছে কিংবদন্তির উপাদান। কুর্টজ : ফাউস্টাস, মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট-এর শয়তান, মবি-ডিকের ক্যাপ্টেন আহাব। মরার আগমুহূর্তে সে উচ্চরণ করছিলো—‘আমার হাতির দাঁত, আমার বন, আমার টাকা’। তীব্র আমিত্ত্ববোধ মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়, এই নভেলা তারই প্যারাবল। এক অর্থে মানুষ তার আদি পাপে এতটাই আকণ্ঠ নিমজ্জিত যে, কারো কাছেই পরিত্রানের পথ জানা নেই। আফ্রিকাকে সভ্য করে তোলার মহান ব্রত নিয়ে যে কুর্টজ সুদূর ব্রাসেলস থেকে কঙ্গোর জঙ্গলে গিয়েছিলো, সে আরো অসভ্য ও জংলী আত্মগর্বী দানবে পরিণত হলো। এই নভেলার শেষ বাক্যে আমরা শুনি কৃষ্ণ দাস বালকের উক্তি ‘মিসতাহ কুর্টজ ডেড’। এলিয়ট তার ‘Hollow Men’ কবিতায় একটি স্থানে এই উক্তিকে ব্যবহার করেছেন। কনরাডের অন্ধকার যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়—এই অন্ধকার আমাদের মনের অবচেতনের অন্ধকার। কুর্টজের যাবতীয় অপকর্ম সত্ত্বেও, কেন মার্লো তার প্রতিই গভীর আকর্ষণ বোধ করে? হয়তো এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে এই নভেলার মূল রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। 

কনরাডের নায়কেরা নিঃসঙ্গ; তারা খুঁজে নেয় সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন স্থান। বিচ্ছিন্নতাবোধ এই উপন্যাসকে আধুনিকতাবাদী আন্দোলনের সামনে এনেছে। সমগ্র জীবন কনরাড বহিরাগত ছিলেন। কনরাডের ব্যক্তি-জীবনের বিচ্ছিন্নতাবোধ ‘হার্ট অফ ডার্কনেস’-এ প্রবাহিত। মানুষগুলো কেউ কারো সাথে একাত্ম নয়; চরম যান্ত্রিকতা ঔপনিবেশিক জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বহমান। কুর্টজের আফ্রিকা-দর্শন তাকে পাগলামির চরমে পৌঁছে দেয়; উত্তর ঔপনিবেশিক সাহিত্যের পথিকৃৎ আরবি লেখক তায়িব সালেহ এর উল্টোটা দেখাচ্ছেন—‘সিজন অফ মাইগ্রেশন টু দ্য নর্থ’ উপন্যাসের নায়ক মুস্তফার পশ্চিম-দর্শন তাকে উন্মাদ  করে দিয়েছিলো। উভয় ক্ষেত্ৰেই বিচ্ছিন্নতাবোধ মানসিক উন্মুলতার প্রধান কারণ। তীব্র বিচ্ছিন্নতার ফল কী হতে পারে, আমরা তা কুর্টজের মধ্যে দেখি, মৃত্যুর আগে সে ‘ভয়’,‘ভয়’ উচ্চারণ করতে করতে মারা গেলো—এই ভয় অন্ধকারের সর্বোচ্চ  সীমায় গিয়ে নিজেকে দেখার ভয়।

এখন কথা হলো জোসেফ কনরাডের এই নভেলাকে উত্তর-ঔপনিবেশিক সমালোচকেরা কেন আক্রমণ করছেন। এই নভেলায় সাম্রাজ্যবাদ ও বর্ণবাদী শ্রেষ্ঠত্ববাদকে আক্রমণ করা হলেও উত্তর ঔপনিবেশিক সমালোচকের অনেকে কনরাডের এই আফ্রিকা পর্যবেক্ষণের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পান। বিশেষ করে, নাইজেরীয় কথাসাহিত্যিক চিনুয়া আচেবে এক বিখ্যাত প্রবন্ধে আফ্রিকাকে অসভ্য ও আলোবিহীন হিসেবে তুলে ধরায় কনরাডকে আক্রমণ করেছেন। কনরাডের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ : তার বর্ণনায় আফ্রিকা আছে কিন্তু কালো আফ্রিকানরা অনুপস্থিত। কনরাডের নেতিবাচক দর্শন আরেকজন লেখক ভি.এস নাইপলকে মনে করিয়ে দেয়। ‘কনরাডের অন্ধকার’ প্রবন্ধে তিনি স্বীকার করেছেন, তিনি যে জায়গায় পৌঁছেছেন তার অনেক আগেই কনরাড সেখানে পৌঁছে গেছেন। এক অর্থে দু’জনের লেখাতেই আফ্রিকা যেন সাংস্কৃতিকভাবে এক অন্ধকারের জগৎ। সেন্ট্রাল স্টেশনে মার্লো যখন যাচ্ছিলো, জঙ্গলের গভীর থেকে ড্রামের শব্দ শুনে তার মনে হলো ‘তারা (কালোরা) চিৎকার করছিলো এবং লাফাচ্ছিলো এবং ঘুরছিলো এবং ভয়াবহ মুখভঙ্গি করছে —আপনার সাথে এই বুনোদের দূরবর্তী আত্মীয়তার চিন্তাভাবনা আপনাকে আতংকিত করে তুলবে’। এই ধরনের উক্তি প্রমাণ করে মার্লো বা কনরাড আফ্রিকাকে বা আফ্রিকানদের বুঝতে চাননি। কনরাড এক রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই এই বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত ঔপনিবেশিক সমাজকে অঙ্কন করেছেন। এখানে ঔপনিবেশিক প্রভু আর তার কৃষ্ণাঙ্গ দাস, কাউকেই তিনি শ্রেষ্ঠতর প্রমাণের জন্য কলমের কালি খরচ করেননি—‘হার্ট অফ ডার্কনেস’ সাম্রাজ্যবাদের সস্তা স্তুতি বা নিন্দা করার জন্য নয়।

উপন্যাসের ক্ষেত্রে আধুনিকতাবাদী পরীক্ষা-নিরীক্ষার একটি প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ জোসেফ কনরাডের ‘হার্ট অব ডার্কনেস’। কনরাড বলেছেন: একটি শিল্পকর্ম একচেটিয়া মানে কদাচিৎ সীমাবদ্ধ। নিজের উপন্যাসের ক্ষেত্রে কনরাডের এই উপলব্ধি আরো সত্য। ‘হার্ট অফ ডার্কনেস’ নভেলার অর্থ নানারকম। না নেই, এই সুগভীর তাৎপর্যপূর্ণ উপন্যাসের কোনো একক ব্যাখ্যা নেই। আমাদের ভেতরের পাপ বোধকে, আমাদের নৈতিক অবস্থানের দ্বিধান্বিত রূপ ও সার্বিক বিভ্রান্তি, আধুনিকতার উন্মত্ততা সবকিছুই এর বিষয়ের মধ্যে রয়েছে। অন্ধকারের গল্প আমাদের সামনে এনে দিয়ে কনরাড আমাদেরকে ভড়কে দিতে চাননি। বরং একটি মিথ্যা রোমান্টিক আশাবাদ, যা আমাদের সভ্যতা ও অগ্রগতি নিয়ে মেকি তৃপ্তি দেয়, তার ফানুস উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন।

কনরাডকে অপছন্দ করা যায়, কিন্তু তার ‘অন্ধকারকে’ অস্বীকার করা যায় না। কুর্টজের অন্ধকার যে, মানবজাতির অবচেতনের গাঢ় অন্ধকার, শেষে সেটাই দেখি। নভেলার অন্তিমে মূল সূত্রধর মার্লোর মনে পড়ে, টেমস নদীর কুচকুচে কালো জল আর কঙ্গোর কালো অন্ধকার পৃথিবীর সব নদীর আর সব সভ্যতার একই পরিণতির মতো। বুদ্ধের মতো পদ্মাসনেবসে মার্লো সেই নরকযাত্রার স্মৃতি স্মরণ করে। 

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বদলাতে চান ম্রুনাল
সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বদলাতে চান ম্রুনাল
পিএসজির অপেক্ষা বাড়িয়ে দিলো মোনাকো
পিএসজির অপেক্ষা বাড়িয়ে দিলো মোনাকো
অস্ট্রেলিয়ার সৈকতে আটকা পড়েছে শতাধিক পাইলট তিমি
অস্ট্রেলিয়ার সৈকতে আটকা পড়েছে শতাধিক পাইলট তিমি
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি