ঝাউসন্ধ্যা
তুমি একটি টাওয়েলের ছায়া
মুখাবৃত্ত করে ঝাউগাছের নির্ভরতায়
উড়তে দিতে তোমার মুখ
তাতে রোদ উঠত, পাখি বসত আর
সরলানন্দে খুঁটে খুঁটে খেত ঠোঁটের কুয়াশা
তখন সকাল দুপুর কিংবা সায়াহ্নের মতো
সীমাবদ্ধতা কোথায় মিলিয়ে যেত!
তুমি চাইলেই এক জীবনের প্রয়োজনীয় রোদ্দুর
কোচরভর্তি তুলে নিতে পারতে নিমেষে
তুমি ভাবলেই পাখিদের ডানার আদলে লিখে নিতে পারতে
এক জীবনের সমগ্র স্বাধীনতা
কিন্তু ঝাউগাছের অবিশ্বাস্য বিরাটত্ব খুলে
তুলে নিলে একজীবনের ছোটবড় বিপুল নস্টালজিয়া
তাতে ঝরে পড়া আছে, ভেঙে পড়া আছে
আছে উঠে দাঁড়ানোর অঢেল তর্জমা
ঝাউগাছের নিচে একমাত্র ফলবান পুকুর
তাতে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে ধরতে
কোনোদিন সন্ধ্যা নেমেছিল?
ঝাউসাঁতার
ঝাউগাছের দিকে তাকালে
গ্রন্থবদ্ধ প্রাচীন অধ্যায় থেকে শুরু হয়
সমবেত কোরাসের বিস্তর উদ্ভাবন
এবার নক্ষত্রের সঙ্গে নক্ষত্রের টোকা দিয়ে দেখি
এইভাবে কতদিন তারা সুরে ও সাড়ায়
আকাশের পেটে রণভাষ্য ধরে রাখতে পারে
আর তখন বিষুব ঝড়ে কেঁপে ওঠে ঝাউগাছের প্রাণ
পার্শ্ববর্তী পুকুরের তলপেট থেকে হামলে ওঠে নদী
ধানক্ষেত হামলে পড়ে মাধ্যমিকের ডগায়
ব্যাপক সবুজের ভেতর মাথা গুঁজে দেয় গোলাবারুদের ঝাঁক
ঝাউগাছের প্রকটত্ব ও বিশালতা নিয়ে
যতটা যা দেখেছি—কোথাও তাতে হামলে পড়া, গর্জে ওঠা নেই
আমাদের ঝাউকৈশোরে
তোমার মুখের ওপর দিয়ে দু’চারগাছি অবাকসিঁথি চুল
উড়ে বেড়ানো ছাড়া আর কোনো স্মৃতি মনে নেই
ঝাউগুজব
ঝাউগাছের অপেক্ষা সারাদিনের স্তন থেকে
টুপটুপ ঝরে পড়ত আমাদের বাড়ি
কনকনে সকালের মাঠে স্নেহার্দ্র হলুদ ফুলেরা
সমবেত ভুলে যেত আমাদের নাম
এই নাম ঠোঁটে করে ঝাউপাতা মর্মরিত তুমুল বাজাত
আর কেউ সোনারূপা বিক্রির হাটে ঝাউগাছ কাঁধে করে
অহেতু প্রশংসাসমেত বলে যেত ঝাউগাছ বিকোবার কথা, নিলামে—
আমাদের কান নিত চিলে
ঠোঁট-মুখ-অজুহাত—সকলই কুঁকড়ে যেত গুণ্ঠিত পৌষের শীতে
যথাউঁচু প্রধান সড়কের পাশে
গুজবের ডালপালা ক্রমবর্ধ ব্যাপক উগড়াত
আর ঘুম ভেঙে প্রহর গড়িয়ে এলে
বিরান প্রান্তর ভরে সাঁই সাঁই বেজে যেত প্রবল ঝাউগাছ
ঝাউভস্ম
একটি মহার্ঘ জীবনের মতো
খরচ হতে গিয়ে একদিন হারিয়েই গেল
মহীরূহ গভীর ঝাউগাছ
মহাবিশ্বের সামুদ্রিক গভীরতা দুহাতে মাড়িয়ে
ঝাউগাছের গভীরতা ক্রমশ উর্ধমুখী হয়
তাতে ফুলে ফুলে ওঠে স্পর্ধা, ঝুলে পড়ে যায় দীর্ঘশ্বাস
বিপন্ন ঝঞ্ঝাক্রুদ্ধ রাতে তুখোড় পালক মেলে ঢেকে দেয়
জনপদ প্রতিবেশ গৃহবদ্ধ অঢেল সংসার
একদিন শোকাক্রান্ত রাতে
হাই তুলে ডানা মেলে হঠাৎ বিমূর্ত হলো প্রকৃত গুজব
আমি এক বৈঠা হাতে হঠাৎ আগুনের নদী পাড়ি দিতে গেলে
নাক মুখ শ্রীহীন কবন্ধ গুজব বলে—এইভাবে ভস্ম লেখা আছে
আজ আবার ঘুম ভেঙে গেলে
নাড়িকাটা নতুন পাতার ভিড়ে মুঠি মুঠি পড়ে থাকে ঝাউপাতার ছাই
ঝাউভাষা
পুকুরে হাঁসের পালকের ভাষায় ঢিল ছুড়ে দিলে
ঝাউগাছ তুমুল শাসাত
মলয় বাতাসে তার অভিব্যক্তি জোড়া দিতে বলে
খুঁজে নিত সারা দিনের রোদ
শীতকাতুরে দিনে জিওলের ঘা খেয়ে
ঝাউগাছের বাকলে খুঁজেছি আপাত মাতৃত্বের কায়া
ঝাউতাপে শুকিয়ে নিয়েছি রক্তাক্ত আঙুল
এখন ঝাউগাছের সীমানা প্রাচীরে জলপাই বনের প্রগাঢ় আঁধার
হরিতকির শেখানো তেতোয় অসহ্য ছেনালি পরশ
কিংবা নিবৃক্ষ ধাতব শৃঙ্খলে পরিত্যক্ত মেয়াদোত্তীর্ণ রোদ
তবু চেনা পথ পাড়ি দিয়ে ঝাউগাছ ঝাউগাছ বলে ডাক দিলে
হিমালয় থেকে ছুটে আসে সাঁই সাঁই ক্ষুধার্ত বাতাস
ঝাউগাছের বিস্মৃত পাতায় একবার নাম লিখে দিলে
জেগে ওঠে মর্মরিত পাতার কোরাস
আর তাতে তুমি-আমি দিশাহীন—আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই
****