এ বছর জেমকন সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন কথাসাহিত্যিক শাহীন আখতার। গতকাল রাজধানীর একটি পাঁচতারকা হোটেলে অনাড়ম্বর এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। পুরস্কার প্রাপ্তির পর কথাসাহিত্যিক শাহীন আখতার যে অনুভূতি প্রকাশ করেছেন তা বাংলা ট্রিবিউনের পাঠকদের জন্য হুবহু প্রকাশ করা হলো।
ধন্যবাদ জেমকনকে।
যে বইয়ের জন্য এ পুরস্কার, তার নাম ‘অসুখী দিন’। গত শতকের চল্লিশের দশক নিয়ে লেখা উপন্যাস। বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা আর দেশভাগের দশক ছিল সেটা। তখন ঔপনিবেশিক শাসকেরা বিদায় নিচ্ছেন। দেশের মানচিত্র আঁকা হচ্ছে, আমাদের ভবিষ্যত নির্ধারিত হচ্ছে।
আমাদের এখানে দেশভাগ নানা কারণে জটিল। তাই হয়ত আমাদের ইতিহাসে, সাহিত্যে তা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এর একটা বড় কারণ, পাকিস্তানের জন্মের অল্প সময়ের মধ্যে পূর্ব বাংলা নামের প্রদেশটিকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল। ৫২-এর ভাষা-আন্দোলন থেকে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা অর্জন। আমাদের ইতিহাস আর সাহিত্যকে এ টালমাটাল সময়টা ধারণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়েছে।
আরেকটা বিষয় হয়ত লেখকদের মনে হয়েছে—এ অঞ্চলে যেহেতু দেশভাগজনিত উদ্বাস্তু সমস্যা পশ্চিম বাংলার মতো প্রকট নয়—আমরা এ বিষয়ে কী লিখব।
আসলে দেশভাগ নিয়ে আমাদের কোনো সরল গল্প নেই। তা উদ্বাস্তু হওয়ার বেদনা বা নতুন দেশ অর্জন, যে অর্থেই বলি না কেন। মাঝখানে তালভঙ্গ করে দেওয়ার মতো ৭১-এর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অবধারিতভাবে ঢুকে পড়বে। আমি মনে হয় ‘অসুখী দিন’-এ এসবই বলতে চেয়েছি অতীত-বর্তমান মিশিয়ে, এপার-ওপারের দুই সময়ের দুজন মানুষের মুখ থেকে। একটা নেই-জগতকে নির্মাণ করতে চেয়েছি পাজলের টুকরার মতো জুড়ে জুড়ে। ধ্রুপদী সাহিত্যের মতো একটা গল্পের শুরু থেকে শেষ অব্দি নিরবিচ্ছিন্নভাবে বলে যাওয়ার সুযোগ নেই মনে হয় এখানে। চল্লিশের দশক অসম্ভব ছিঁড়ে-খুঁড়ে আমাদের কাছে পৌঁছেছে।
আমাদের দেশভাগের ইতিহাস আর বর্তমান বাস্তবতা পাকিস্তান এবং ভারতের চেয়ে আলাদা। আমি আমাদের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থান থেকে বইটা লিখতে চেয়েছি। এই ক্ষেত্রটা নতুন। কিন্তু সম্ভাবনাময় এবং এ নিয়ে কাজ করা জরুরি। নিদেনপক্ষে ৭১, ৫২-এর আরো পেছনে আমাদের ইতিহাস-চর্চার পরিসরটা বাড়ানো দরকার।
‘অসুখী দিন’-এর কজন পাঠক আমাকে বলছিলেন—এ বইয়ের অতীতের অনেক ঘটনা তারা জানেন না। সিঙ্গাপুরে ইংরেজদের আত্মসমর্পণে তারা চমকে গেছেন। ইম্ফল কোথায়—গুগল ম্যাপ দেখে তাদের জেনে নিতে হয়েছে। এমন কষ্ট করে যারা বইটা পড়েছেন, আমি অবশ্যই তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
দেশভাগের অভিঘাত শেষ হয়ে যায়নি। এ উপমহাদেশের সংখ্যালঘু মানুষের দিকে তাকালে সেই সময়কার হৃৎকম্পন টের পাওয়া যায়।
জেমকনকে আবারো ধন্যবাদ, আমার এ চেষ্টাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য।
সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা।
শাহীন আখতার
৭ নভেম্বর, ২০১৯